ড. মোহাম্মদ সাব্বির মোস্তফা খান

ভূগর্ভস্থ পানির ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর থেকে চাপ কমিয়ে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষন করা

ড. মোহাম্মদ সাব্বির মোস্তফা খানের জন্ম ঢাকায় ১৯৭৩ সালে। বাবা ড. এস আই খান আর মা সুলতানা খান। জন্ম ঢাকায় হলেও শিক্ষাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মাধ্যমিক দিয়েছেন বুয়েট স্কুল থেকে ১৯৮৭ সালে। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৮৯ সালে। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হন। ১৯৯৭ সালে বুয়েটের প্রভাষক হিসেবে পানি সম্পদ কৌশল বিভাগে যোগ দেন।

উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় পুরকৌশল বিষয়ে মাস্টার্স করেন। একই প্রতিষ্ঠানে ২০০৪ সালে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর দেশে ফিরে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান নিজ কর্মক্ষেত্র বুয়েটে। ২০১৩ সালে নিজ কর্মদক্ষতায় বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন।

শিক্ষার পাশাপাশি মেধাবী এ মানুষটি খেলাধুলায়ও সমান পারদর্শী। তিনি একাধারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স ও টেবিল টেনিস (টিটি) দলের হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। গুণী এ শিক্ষাবিদ মুখোমুখি হয়েছিলেন বন্ধন-এর। বলেছেন নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের নদীর পানিবিষয়ক নানামুখী সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। আলাপচারিতার সূত্রধর ম. শাফিউল আল ইমরান।

বাংলাদেশের পানিসম্পদ কতটা সমৃদ্ধ?

বাংলাদেশ পানি সম্পদে দারুণ সমৃদ্ধ। এ দেশের পানি সম্পদের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। বাংলাদেশের পানি সম্পদ বলতে মূলত বড় যে তিনটা নদী আছে, সেটার পানি আর ছোট-বড় মিলে যে ৪০০ নদী আছে, সে সম্পদকে বোঝায়। আমরা গ্রাউন্ড ওয়াটার, মানে ভূগর্ভস্থ পানি সেচ ও খাওয়ার কাজে প্রচুর ব্যবহার করছি। এ কারণে ওয়াটার লেবেল ধীরে ধীরে নিচে নামছে। এখন পর্যন্ত সমৃদ্ধ থাকলেও ভবিষ্যতে পানির পরিমাণ কমতে পারে। আর তাই আমাদের সামগ্রিকভাবে একটা ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট টিম হাতে নিতে হবে।

পানিকে কেন আমরা সম্পদ হিসেবে নিতে পারিনি?

মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন খাবার কাজে ও সেচের জন্য পানিটা ব্যবহার করি, তখন পানির কোনো মূল্য ধরি না! ধরি পানিটা তুলতে যে খরচ হয় সেই মূল্য। কোনো কারখানা যদি তাদের কাজে পানি ব্যবহার করে, তবে সে কারখানা কিন্তু পানির জন্য কোনো খরচ ধরে না। ধরে এই পানিটা তুলতে কত খরচ হবে সেটা। ভবিষ্যতে যদি এই পানিকে সম্পদ হিসেবে ধরি, তবে যে কেউ এই পানি তুলবে, তাকে এই পানির জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। আর এটা এখন সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে এই ধারনাটা আসতে পারে।

বাংলাদেশের নদীগুলো অতি দ্রুত ভরাট ও শুকিয়ে যাওয়ার কারণ কী?

বাংলাদেশের নদীগুলো দ্রুত ভরাট ও শুকিয়ে যাওয়ার কারণ নদীতে যদি পানিপ্রবাহ কম থাকে বা ভেলসিটি কমে যায়, তাহলে আস্তে আস্তে পলিমাটি নদীর তলদেশে জমতে থাকে। বাংলাদেশের নদীগুলো ডাইনামিক। আর শুকিয়ে যাওয়ার কারণ অবশ্যই ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ুর পরিবর্তন। বাংলাদেশের নদীগুলো বর্ষাকালে ভরে যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাতের কারণে আবার শীতকালে একেবারেই বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর এ পরিবর্তনের কারণে যে নদীগুলো শীতকালে শুধু শুকিয়ে যেত, সেটা একেবারেই ধু ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে। আবার হঠাৎ বৃষ্টির পানির কারণে এবং নদীগুলো নাব্যতা হারানোয় আচমকা বন্যার প্রার্দুভাব বাড়ছে। এ ছাড়া আমাদের ট্রান্সবাউন্ডারি রিভারগুলোর পানিপ্রবাহ অন্য দিকে নেওয়ার ফলে নদীগুলো শুকনো মৌসুমে আরও শুকিয়ে যাচ্ছে।

মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নামছে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কী ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছে?

ভূগর্ভস্থ পানি বেশি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নামছে। ফলে আমাদের হ্যান্ডটিউবওয়েল এবং সেচের পাম্পগুলোর স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। সাধারণত ১০ মিটার পানি নিচে নেমে গেলে পাম্পে পানি ওঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে ভূগর্ভস্থ পানি যেন বেশি নিচে নেমে না যায়। এ জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। সে জন্য সারফেজ ওয়াটার বা নদীর পানি সেচের জন্য ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।

কীভাবে পানির স্তর নামা রোধ করা যায়?

পানির ব্যবহার কমলে, বিশেষ করে যত্রতত্র পানির ব্যবহার কমালে আমরা পানির স্তর নামা রোধ করতে পারি। নদীর পানি আর ভূগর্ভস্থ পানি একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। নদীর পানির স্তর যদি ওপরে ওঠে যায়, তবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ওপরে উঠে যাবে। আবার নদীর পানির স্তর যদি নিচে নেমে যায়, তবে ভূগর্ভস্থ পানির লেভেলও নিচে নেমে যাবে। তার মানে একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। আমরা যদি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর পানি শুকনো মৌসুমে নিয়ে আসতে পারি, সেটা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকেও আস্তে আস্তে ওপরে ওঠাতে সাহায্য করবে। সুতরাং আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর থেকে চাপ কমিয়ে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষন করা।

ভূগর্ভস্থ পানির বিষয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের চিত্র খুব ভয়াবহ। সেখানকার পানি এবার সাধারণ লেভেল থেকে অনেক নিচে নেমে যাওয়ার কারণ কী?

আমরা দুই জায়গা থেকে পানি পেতে পারি। একটা কনফাইন্ড এক্রিফার, অন্যটি আন-কনফাইড এক্রিফার। প্রথমত, আপনি যেমনটা বলছিলেন যে শ্যালো মেশিনগুলো দিয়ে যদি পানির লেয়ার নিচে নামার কারণে পানি ওঠানো সম্ভব না হয়, তবে অন্য জায়গা থেকে আমাদের পানি ব্যবহার করতে হবে। আবার অন্য জায়গায় পাম্পটি অ্যাডজাস্ট করতে হয়। এটা হচ্ছে মূলত যে জায়গায় পাম্পটি আছে সে জায়গায় গর্ত করে নিচে বসাতে হবে। আর যেমনটা বলছিলাম, থিউরিক্যালি ১০ মিটার হলেও ৮ মিটারের নিচে গেলে পানি ওঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, পাম্পটিকে পানির মধ্যে বসানো। পানির মধ্যে বসালে পাম্পটির প্রপেলার লেয়ারের মধ্যেই ডুবে থাকে। ফলে পানি সহজেই ওপরে ওঠে। এই টেকনোলজিগুলো আছে। তবে আমরা পানির যত ব্যবহার করছি, তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে আবার ভূমির জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। এখন ভূমির ক্ষতির ফলে ভূমিক¤প হতে পারে। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানি ওঠানোর ফলে মাটির যে স্থানে পানি থাকে, সেগুলো ফাঁকা হয়। ফলে ভূমিক¤প হলে বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। আর যদি পানি থাকে, তবে ভূমিকম্পের সময় ড্যাম্পিং হিসেবে কাজ করায় ভূমিকম্প রোধ করা সম্ভব।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে বা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করছে। কিন্তু আমরা কেন তা করতে ব্যর্থ হয়েছি?

বাংলাদেশে এটি আছে, খুব বেশি আকারে না থাকলেও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে আছে। উপকূলীয় এলাকায় যে এনজিওগুলো কাজ করে বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের খাবার পানির জন্য বৃষ্টির পানিকে তারা কাজে লাগায়। মূলত এটা করে বাসার ছাদে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর এক-দুই মিনিট পানিটা ফেলে দিয়ে পরে ওই পানিকে আটকায়, যেটা পরবর্তী সময়ে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রথম যে পানিটা আসে, তাতে ময়লা থাকে। সেই পানিটা ফেলে দিয়ে পরে একটা স্লাপের মাধ্যমে বিভিন্ন জারে আটকিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। এটা মূলত খাবার পানি হিসেবেই বেশি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার অনেক জায়গায় এই রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং আছে। কিন্তু ঢাকা শহরে যেখানে বৃষ্টির পানি যথেষ্ট, সেখানে আমরা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ইউজ করছি না। তবে রাজউকের নতুন নীতিমালা আসছে, যেখানে সাজেস্ট করা হচ্ছে আমরা বিভিন্ন বাসার ছাদে যদি রেইন ওয়াটার হারভেস্ট করতে পারি, তবে আমাদের দৈনিক ব্যবহারের পানির কিছু অংশের চাহিদা ওখান থেকে পূরণ করতে পারব। সুতরাং এই কনসেপ্টটা শুধু বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য দারুন উপযোগী।

বৃষ্টির পানিকে কীভাবে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়?

আসলে বৃষ্টির পানি উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কেননা ধোয়া-মোছা বা অন্যান্য কাজের জন্য আমরা লবণাক্ত পানি ব্যবহার করতে পারি। খাবার পানি ব্যবহারের জন্য এই পানিটা যে জারে রাখতে হবে, সে জার সাধারণত ঢেকে রাখতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। সংগ্রহ করার পর এটাকে নিয়মিত ঢেকে রাখতে হবে। কারণ, বাইরে থেকে কোনো জীবাণু যদি পানিতে চলে যায়, সেটা অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে। 

অন ফার্ম ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে কীভাবে চাষাবাদের সেচকাজে পানির কার্যকর ব্যবহার সম্ভব?  

অন ফার্ম ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বলতে বাংলাদেশে সেচব্যবস্থাকে বোঝায়। বাংলাদেশের সেচব্যবস্থা মূলত দুভাবে হয়। একটা নদীর পানি দিয়ে, অন্যটা ভূগর্ভস্থ পানি সেচের মাধ্যমে। নদীর পানি থেকে যেটা বড় বড় প্রজেক্ট হয়, ওটা ব্যক্তি পর্যায়ে করা সম্ভব নয়। আমাদের জন্য যেটা, সেটা হচ্ছে আমাদের কৃষক একা অথবা চার-পাঁচজন মিলে একটা সেচপাম্প কেনেন। তাঁরা তখন ওই পানিকে বিভিন্ন জনের মধ্য বণ্টন করেন। এখানে আমি যেটা মনে করি, অনেকেই মধ্যস্বত্বভোগী, যাঁরা শ্যালো মেশিন কিনে ভাড়া দেন। এই পানি তাঁরা বিক্রি করেন বিভিন্ন ইউজারের কাছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের কিছু ভূমিকা রাখা উচিত, সেচকে আমি মনে করি অধিকার। আমাদের ফসল উৎপাদনের সঙ্গে যে উপাদানগুলো জড়িত, সেটার সঙ্গে সরকারের একটা ইনভলমেন্ট থাকলে অন ফার্ম ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিত করা যায়। এর উপকারি দিক, কেউ মধ্যস্বত্বভোগী এসে অতিরিক্ত ইনকাম করতে পারবে না, তাই এটা থাকা দরকার।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। এতে সাগরের লোনা পানি ভূগর্ভে মেশার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, এর প্রভাব কী হতে পারে?

বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব আমাদের দেশে প্রচুর। একটা ইমপ্যাক্ট, যেটা সি লেভেল রাইজ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায় বিভিন্ন এলাকার বরফ গলা পানি এসে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। আরেকটা কারণ, তাপমাত্রা বাড়লে উচ্চ তাপে পানি এক্সপেন্ট করে ফুলে যায়। এ কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এখন এই লোনা পানি দুভাবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ঢোকে। এক নদী দিয়ে, দুই ভূগর্ভ দিয়ে। শীতকালেও এমনকি সিলেট পর্যন্ত এ লোনা পানির ইমপ্যাক্টটা চলে যায়। দেখা যায়, জোয়ারের পানি আসে এবং চলে যায় কিন্তু তা গেলেও নদীর পানির সঙ্গে লবণাক্ততা থেকেই যায়। ভূগর্ভস্থ পানিটা হচ্ছে আরও স্লো প্রসেস, এটা আস্তে আস্তে যদি ভূগর্ভস্থ পানির মধ্য ঢোকে। তাহলে ভূগর্ভস্থ পানি সবই লোনা পানি হয়ে যায়, তখন ওই পানিকে আমরা সহজেই খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। সেটাকে সেচ কাজে ব্যবহার করারও সমস্যা আছে। কারণ, আমরা বিভিন্ন স্টাডিতে দেখেছি, লোনা পানি যদি সেচে ব্যবহার করা হয়, তখন ওই শস্যের উৎপাদন কমে যেতে পারে। সুতরাং এ কারণে আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। সি লেভেল রাইজ করার কারণে আজ থেকে ৫০ বা ১০০ বছর পর আমাদের সারফেজ ওয়াটার বিশেষ করে লবনাক্ততায় যে পরিবর্তন আসছে, সেটার ওপর বেজ করে আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটারকে কীভাবে ম্যানেজ করব সে ব্যাপারে এখনই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

পানিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান বিদ্যমান, যা ভবনের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো প্রতিরোধে করণীয় কী?

কোনো জায়গার পানি ব্যবহারের আগে, সেটা ভবনের জন্য বা যেকোনো কাজে হোক, তা পরীক্ষা করতে হবে। এখন আমাদের কিছু মাত্রা আছে। যেমন- খাবার পানির ক্ষেত্রে বলতে পারি যে আর্সেনিক এই পরিমাণ বা কম থাকতে হবে। আবার আয়রনটা এত থেকে এত থাকতে হবে। এ রকম কিছু মাত্রা আছে। এ রকম যেকোনো কাজে সেটা খাবার পানি হোক বা সেচকাজ হোক অথবা ভবন নির্মাণ হোক, আমাদের ওই পানিটা ব্যবহারের আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোন উপাদানটা মাত্রার বাইরে আছে। তখন সেই উপাদানকে দূর করতে হবে। এগুলোর কিছু প্রক্রিয়া আছে। অথবা এমন জায়গার পানি ব্যবহার করতে হবে, যে জায়গায় কোনো ক্ষতিকর উপাদান নেই। পরীক্ষা করতে হবে পানিকে। 

উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা একটি বিরাট সমস্যা। এই পানিকে কীভাবে খাওয়ার উপযোগী করা যায়?

উপকূলীয় এলাকার পানি খাওয়ার উপযোগী করার একটা প্রক্রিয়া আছে, যেটাকে বলে ডি সেলাইনেশন বা ডি সেলিনেশন। এর মানে হচ্ছে, লবণাক্ত পানিকে সুপেয় পানিতে পরিণত করা। বড় বড় জাহাজে ডি সেলিনেশন প্লান্ট আছে। এই প্লান্ট সমুদ্রের লবণাক্ত পানি নেয়, লবণকে বের করে দেয় এবং পানিকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর দেশে ডি সেলিনেশন প্লান্ট আছে। এসব দেশ জাহাজে করে সমুদ্রের পানি নিয়ে সুপেয় করে বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দিচ্ছে। আমাদের দেশের জন্য সমস্যা হচ্ছে, এই লবণাক্ত পানিকে সুপেয় করতে প্রচুর এনার্জির দরকার। আর আমাদের এখানে এমনিতেই প্রচুর এনার্জির ক্রাইসেস আছে, বিদ্যুতের ক্রাইসিস আছে। সুতরাং এখন পর্যন্ত এ কারণে শুরু করা যায়নি এ প্রজেক্ট। তবে আমি স্পেশালি মনে করি, এই লবণাক্ত পানিকে সুপেয় করার যে ডি সেলিনেশন প্লান্টগুলো ছোট পরিসরে হলেও বাংলাদেশে আসতে পারে। তারপর তার খরচ কী রকম হচ্ছে তা নিরূপণ করে ভবিষ্যতে বড় পরিসরে আনা সম্ভব।

পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০০১ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন কত দূর? এ আইন পানি সম্পদ রক্ষায় কী ধরনের ভূমিকা রাখছে?

আসলে বাংলাদেশে যে ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান রয়েছে, তারই সামগ্রিক একটি প্ল্যান এটি। আসলে সমস্যা এখানে যে এই প্ল্যানে খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ নেই। নদীর পানি, ভূগর্ভস্থ পানি সামগ্রিকভাবে কীভাবে ব্যবহার করব, এটার কিছু নীতিমালা আছে। তবে আমি বলব, অতীতে আমাদের কোনো সামগ্রিক নীতিমালা ছিল না। এখন আমরা একটা নির্দেশনা পাচ্ছি  কীভাবে পানি সম্পদকে ব্যবহার করব। মূল সমস্যা হলো, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার একেক জায়গার পানি সম্পদ একেক রকম। সিলেটের হাওরাঞ্চল বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজশাহী অঞ্চল বলেন আবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কিংবা হিল এরিয়া বলেন আর সুন্দরবনের নিকটবর্তী এলাকা বলেন। এ রকম ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্ল্যানকে অ্যাড্রেস করা সম্ভব না। কিন্তু তারা যেটা দিয়েছে, একটা সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই ভালো।

সম্প্রতি বাংলাদেশের সমুদ্রে নতুন সীমানা যুক্ত হয়েছে। এই জলসীমার সম্পদগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়?

সমুদ্রসীমার বিষয়ে যদিও আমি এক্সপার্ট নই, তবুও আমি যেটা বলব, সম্পদ উত্তোলনে বাংলাদেশে নিকট অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি তেল ও গ্যাস এক্সপ্লোরেশন করেছে। আমি মনে করি, এটা করার কারণ, তারা তথ্য নিয়ে এক্সপ্লোরেশন করেছে। বড় বড় কোম্পানি কিন্তু বাংলাদেশে এসেছে। তারা যেটা করে, সেটা স্যাটেলাইট থেকে অথবা ভূমির বাইরে থেকে আন্ডারগ্রাউন্ডের সয়েলের ভেতরে কী আছে, তেল না গ্যাস আছে, তা সার্ভে করে। যখন তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয় যে এই জায়গায় থাকতে পারে তখন তারা ড্রিল করে দেখে সেখানে যে তেল না গ্যাসের মজুদ আছে, সেটা উত্তোলনযোগ্য কি না? এ কারণে আমি মনে করি, বাংলাদেশে যেটুকু সীমানা পেয়েছি, অতীতে যেহেতু পৃথিবীর নামকরা কোম্পানিগুলো এসে এক্সপ্লোরেশন করেছে। সুতরাং এখানে তেল-গ্যাস আমরা যেটাকে ফসিল ফুয়েল বলছি, সেটা পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা আছে। বাপেক্স এটা নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস উত্তোলনের জন্য। এখনো তাদের সমুদ্রে এক্সপ্লোরেশনের জন্য সেই টেকনোলজি নেই কিন্তু বাপেক্সকেই এই টেকনোলজিটা ডেভেলপ করতে হবে, যাতে সমুদ্রে সহজেই সম্পদ আহরণ করতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পানি সম্পদ কৌশল বিভাগ এ দেশের পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে কতটুকু ও কীভাবে ভূমিকা রাখছে?

পানি সম্পদ কৌশল বিভাগ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) প্রতিষ্ঠিত হয় সত্তরের দশকে। যখন সরকার মনে করেছে পানি সম্পদের জন্য আলাদা একটা বিভাগ প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বা পুরকৌশলের অধীনে একটা বিভাগ হিসেবে পানি সম্পদ কৌশল থাকে কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে, বুয়েটে বিশেষ করে আলাদা একটা ডিপার্টমেন্ট করা হয়েছে। এ ডিপার্টমেন্ট করার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা  এখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কারিকুলামটাকে এমনভাবে ডিজাইন করেছি, যাতে এখানে যারা গ্র্যাজুয়েট, তারা বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমরা যে কাজটা করেছি তা হলো আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অরগানাইজেশনের ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রিসার্চে কাজ করি। যেমন- এর আগে বুয়েটের ডার্ক প্রজেক্ট ছিল নেদারল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আমাদের একটা লিংকেজ প্রজেক্ট ছিল। বর্তমানে একটা প্রজেক্ট আছে নেদারল্যান্ডের ইউনেসকো, আইওসি এবং আরও দুটো অরগানাইজেশনের সঙ্গে। এগুলোর মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন নলেজ শেয়ার করি। যেহেতু তারা উন্নত দেশ, সেহেতু তাদের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে, সেগুলো বাংলাদেশে নিয়ে কীভাবে এখানকার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটানো যায় সে বিষয়ে গবেষণা করছি। আর তৃতীয়ত, আমরা কনসালটেন্সি সার্ভিস প্রোভাইড করি। বাংলাদেশ সরকার এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন- পানি উন্নয়ন বোর্ড, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, এলজিইডি তাদের যে ওয়াটার রিলেটেড প্রজেক্ট থাকে, সেখানে আমরা পানি সম্পদ বিষয়ে কনসালটেন্সি সার্ভিস প্রোভাইড করে থাকি।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫২ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top