মানব সভ্যতাকে যদি একটি বিশাল শক্তিধর যানবাহনের সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেখানে আমরা সবাই আরোহী, ইঞ্জিন হচ্ছে প্রযুক্তি, স্টিয়ারিং হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ, আর আমাদের এই অজানা পথ চলতে যে হেডলাইট দরকার, সেটি বিজ্ঞান। সৃষ্টির আদি থেকে এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো হচ্ছে মানব সভ্যতার উন্নয়নে। আর এ সব উন্নয়ন কাজের মান উন্নত, সুন্দর ও দ্রুত করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে যারা অপরিসীম ভ‚মিকা পালন করে চলেছে, তারাই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার।
পরিচিতি
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং ট্রেডসম্যানদের সম্মিলিত উদ্যোগে গঠিত হয় কারিগরি টিম এবং এই টিমের সদস্যদের অনুপাত হলো ১ : ৫ : ২৫। মানসম্পন্ন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে রাজধানীসহ জেলায় জেলায় সরকারি ৪৯টি এবং বেসরকারিভাবে প্রায় ২০০ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, অটোমোবাইল, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, ইলেকট্রনিক, কম্পিউটার, আর্কিটেকচার, কেমিক্যাল, ফুড, সিরামিকস, গ্লাস, লেদার, গ্রাফিক্স, মেরিন ইত্যাদি বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা হয় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। আর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিবি) হচ্ছে প্রকৌশল পেশাজীবীদের একটি বড় সংগঠন। এখানকার সদস্য প্রকৌশলীদের উচ্চ শিক্ষার অধিকার, কর্মক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আলোকবর্তিকাস্বরূপ কাজ করে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠার ইতিকথা
জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ সংরক্ষণ, প্রযুক্তি ভাবনাযুক্ত রাজনীতি, প্রযুক্তিতে গণমানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণমুখী তথ্য প্রযুক্তি, সর্বপোরি প্রযুক্তিমনস্ক জাতি গঠনের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় আইডিইবি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল দি ইস্ট পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারস। স্বাধীনতার পর নাম পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ। এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন প্রকৌশলী তাজাম্মুল হোসেন। এ ছাড়া প্রকৌশলী এ কে এম হামিদ, আব্দুল কাদের সরকার, আব্দুল কাদের গাজী, জাফরুল হাসান, তাসাদ্দুক হোসেন, ইজাবুল খালিদ প্রমুখের অবদানের জন্য প্রতিষ্ঠানটি আজ এই অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রকৌশলী এ কে এম হামিদ পালন করে যাচ্ছেন তাঁর দায়িত্ব। দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
- প্রকৌশল শিক্ষার মান উন্নয়নের চেষ্টা
- প্রতিষ্ঠানটির সদস্যদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করা
- দেশীয় কাঁচামালের যথাযথ ব্যবহার
- প্রকৌশলীদের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি
- নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাস্তব ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ
- প্রচলিত নির্মাণ প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ
- দেশের সার্বিক উন্নয়নে নিজেদের অধিকতর সম্পৃক্ত রাখা
আইডিইবির সেবাসমূহ
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছেন। গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিটিসিএল, আণবিক শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, বিআইডবিøউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি টিভি চ্যানেল, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন, বাংলাদেশ স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই, ডেসকো, ডিপিডিসি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, মোবাইল ফোন কোম্পানি, সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, এসএসসি ভোকেশনাল স্কুল ও মাদ্রাসা, টেক্সটাইল মিল, জুট মিল, ইস্পাত শিল্প, চামড়া শিল্প, মৃৎ শিল্প, গার্মেন্টস শিল্পসহ অসংখ্য কারিগরি-অকারিগরি প্রতিষ্ঠানে সাফ্যল্যের সাথে কারিগরি ব্যবস্থাপনায় অতুলনীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ।
শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ
বর্তমানে আইডিইবিতে তিন লক্ষ শিক্ষার্থী সদস্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সদস্যদের যোগাযোগ ও কর্মক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষাদান করে। এখানে যে সকল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় :
অটোক্যাড, কম্পিউটার বেজড অফিস ম্যানেজমেন্ট, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার মেইটেন্যান্স অ্যান্ড ট্রাবল শুটিং, মডার্ন গ্রাফিক্স অ্যান্ড ওয়েব পেজ ডিজাইন, ট্যালি (অ্যাক্রোডিং সফটওয়্যার), টেকনিক লার্নিং ম্যানেজমেন্ট ফর পলিটেকনিক অ্যান্ড টিএসসি টিচার্স, ইলেকট্রিক-মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস, কনস্ট্রাকশন সাইট ম্যানেজমেন্ট, মডার্ন অফিস ম্যানেজমেন্ট ইনক্লুডিং ইন্টারনেট অ্যান্ড ই-মেইল, ট্রেনিং কোর্স অন প্লাম্বিং, আর্থকোয়াক অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, টোটাল কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (টিকিউএম), লিডারশিপ স্টাইল : ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, বার-মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফায়ার সেফটি অ্যান্ড ফার্স্ট এইড ম্যানেজমেন্ট ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড এক্সজিকিউটিভ, টেলিকমিউনিকেশন, ইনস্ট্রুুমেশন ইঞ্জিনিয়ারিং।
কর্মক্ষেত্র
এসএসসি পাস বা সমমানের ভোকেশনাল ও দাখিল তথা বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, ভোকেশনাল উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা মেধানুসারে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসমূহে ভর্তির সুযোগ পায়। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ সরকারি ও বেসরকারি শিল্পকারখানায় মর্যাদাপূর্ণ চাকরির সুযোগ পায়। এ ছাড়া জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই সকল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারই চাকরি করে দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তারা নিজ নিজ উদ্যোগে কনসাল্টিং ফার্ম, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে অগণিত ট্রেডসম্যান ও অ-কারিগরি মানব সম্পদকে উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বৈদেশিক চাকরিতেও রয়েছে তাদের বিপুল চাহিদা। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও জাতীয় স্বার্থেই। কারিগরি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী আজ মধ্যম স্তরের এই কারিগরি শিক্ষা ব্যাপক প্রসারিত হচ্ছে ।
জাতীয় উন্নয়নে আইডিইবির সুপারিশসমূহ
গণমুখী তথ্য প্রযুক্তি বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতি। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি এ কে এম হামিদ বলেন, পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে গণমানুষের জীবনমান উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করা অপরিহার্য। এ ছাড়া তিনি আইডিইবির সুপরিশ সম্পর্কে বলেন, এ পর্যন্ত আইডিইবির গবেষণালব্ধ জাতীয়ভিত্তিক অনেক সুপারিশ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে :
- গ্যাস রফতানির চিন্তা বন্ধকরণ। গ্যাসভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলা ।
- বিদেশে দক্ষতা পাচার বন্ধকরণ। দরিদ্র জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের চাকরি নিয়ে বিদেশ যাওয়া বন্ধকরণ ।
- গভীর ও অগভীর নলক‚পের মাধ্যমে ভ‚গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে দেশকে মরুভ‚মিতে পরিণত করা বন্ধকরণ। বিকল্প হিসেবে সেচ কাজে সারফেস ওয়াটার ব্যবহারকরণ।
- প্রথমে খাল খনন না করে পুকুর, বিল, ডোবা ও হাওড় খননকরণ ।
- নদী-নালা, খাল, উপ-নদী ও শাখা নদীতে প্রথমে স্লুইস গেট ও রেগুলেটর নির্মাণকরণ।
- নদীর দুই পাড়ে বাঁধ নির্মাণের জন্য মাটি কাটার আগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রেগুলেটর নির্মাণকরণ।
- বৃহৎ জলাধার নির্মাণার্থে ফারাক্কা বাঁধের বিকল্প হিসেবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কয়েক মাইল ভাটিতে বাঁধ নির্মাণ।
- কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে যমুনা ব্রিজের সাথে ব্যারেজও নির্মাণ ।
- ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহের জন্য প্রযুক্তি ও পরনির্ভর বৃহদাকারের ডেমরা ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপন পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সহজ ও দেশজ প্রযুক্তিনির্ভর ও ছোট ছোট ওয়াটার ওয়াকর্স স্থাপন।
- ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্টার কানেক্টকে বহুমুখী প্রকল্পে রূপান্তর। ভবিষ্যৎ সকল প্রকল্পকে যথাসম্ভব বহুমুখী করে নির্মাণকরণ।
- বর্তমান স্থান থেকে তিস্তা বাঁধ ২৫-৩০ মাইল ভাটিতে স্থানান্তর। নতুন করে খাল খনন না করে রেললাইন ও হাইওয়ের বরোপিঠগুলো সংস্কার করে বাঁধের প্রধান খাদ হিসেবে ব্যবহার।
- চলন বিলসহ দেশের অন্যান্য বিল ও হাওড়গুলোর গভীরতা বৃদ্ধি করে এগুলোকে মৎস্য চাষ ও কৃষিকাজের জন্য জলাধারে পরিণতকরণ ।
- রাজধানীকে বাঁচাতে যানজট নিরসন, প্লটের বদলে ফ্ল্যাট বরাদ্দের নীতি গ্রহণ এবং বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষাকরণ ।
দাবিসমূহ
- ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ক্ষেত্রে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু।
- ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসকে ডেস্ক ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভাগকরণ।
- তিন বছরের অভিজ্ঞ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারকে চাকরি ক্ষেত্রে সদ্য পাস করা ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারের সমতুল্য গণ্য করা।
- বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভ্রান্ত চিন্তা পরিহার করে ইঞ্জিনিয়ারিং ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে অবিলম্বে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা।
- চাকরি ক্ষেত্রে অমানবিক গেজেট প্রথা অবিলম্বে তুলে দেওয়া।
- গণবিরোধী চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অধ্যাদেশ প্রণয়ন বন্ধ করে নির্মাণ আইন প্রচলন।
যোগাযোগ
ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ
১৬০/এ ভিআইপি রোড, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০
ফোন :৯৩৩৬৬৬৬, ৯৩৫৮৮৮৮
ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৮৩১৮৮৮৮
ই-মেইল : [email protected]
Web : www.ideb.org.bd
তানজিনা আফরিন ইভা
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১২