বয়স ২৭-২৮ বছর। হালকা ছিপছিপে গড়ন। শ্যামবর্ণের এ ছেলেটির নাম মোঃ হানিফ মিয়া। হানিফ মিয়া একজন স্যানিটারি মিস্ত্রি। বাথরুমের কমোড, টাইলস্, বাথটাব ফিটিংস করা তার প্রতিদিনের কাজ। এ কাজ করেই চলে সংসার। ঘোরে জীবন ভাগ্যের চাকা। হানিফ মিয়ার শৈশবটা এমন ছিল না। এমন হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু ভাগ্যের দৈবচক্রে হানিফ মিয়া আজ একজন স্যানিটারি মিস্ত্রি। এর চেয়ে বড় আর কোনো পরিচয় নেই হানিফ মিয়ার। আর দশটা ছেলের মতো সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন হানিফ মিয়া। হানিফ মিয়ার জন্ম পাবনার বেড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। বাবা আব্দুর রশিদ মিয়া ও মা হনুফা খাতুনের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড়। পরিবারের সবার বড় হওয়ায় সব স্বপ্ন ছিল হানিফকে নিয়ে। হানিফও সেই স্বপ্নের পথেই হাঁটছিলেন শৈশব থেকে। হানিফের বাবা আব্দুর রশিদ মিয়া আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছলই ছিলেন। নিজেদের জমির ধান আর পুকুরের মাছে মোটামুটি সুখেই কেটেছে হানিফের শৈশবের দিনগুলি। এলাকার অন্যসব ছেলের সাথে বই বগলদাবা করে যেতেন স্কুলে। হাসতেন, খেলতেন সবই করতেন। চার ভাইবোনের সাথে ভালোই কাটছিল শৈশব। হাসি-গান আর প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল দিন, মাস, বছর। দেখতে দেখতে হানিফ এসে পৌঁছলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ স্তর পঞ্চম শ্রেণীতে। এ সময়টায় বাবা রশিদ মিয়ার শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি পড়ে গেলেন বিছানায়। বাবার অনুপস্থিতিতেই হানিফ ধরল সংসারের চাকা। বাজারের ছোট্ট দোকানটা দেখার মাধ্যমে শুরু হয় হানিফ মিয়ার কর্মজীবন। যে বয়সে হানিফ মিয়ার হেসে-খেলে বই নিয়ে আনন্দে স্কুলে যাওয়ার কথা, সে সময়ে হানিফ মিয়া কাঁধে তুলে নিলেন সংসারের হাল। আর এখানেই অপমৃত্যু ঘটে হানিফ মিয়ার আজন্ম লালিত স্বপ্নের। যেখানে হানিফ মিয়া নিজেকে কল্পনায় রঙিন করতেন একজন চাকরিজীবী হিসেবে। কিন্তু বাবার অসুস্থতায় আস্তে আস্তে সেই স্বপ্নিল দিনগুলো ক্রমেই ধূসর হতে থাকে। বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে। চিকিৎসার জন্য বিক্রি হতে থাকে সব সম্পত্তি। বিক্রি করতে করতে শেষ পর্যন্ত বাকি থাকে শুধু দোকান আর ভিটাটুকু। কিন্তু ভাগ্য বোধহয় হানিফ মিয়ার সাথে নেই। শত চেষ্টাতেও বাঁচানো গেল না বাবা বশির মিয়াকে। পৃথিবীর রূপ-রস আনন্দ উপভোগ করতে না করতেই হানিফ মিয়া হারান তার অভিভাবক পিতাকে। এখানেই শেষ নয় হানিফ মিয়ার জীবনের গল্পের। বরং এখান থেকেই শুরু। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। বেঁচে থাকার আর টিকে থাকার লড়াই। যেখানে শুধু নিজেকে বাঁচানোর বা টিকানোর তাগিদ নয়। বরং সাথে মা ও তিন ভাইবোনকেও টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা। পাবনার বেড়া উপজেলার এক সময়ের সচ্ছল পরিবারের সন্তান হানিফ মিয়া তখন ভীষণ একা। সাথে আছে শুধু টিকে থাকার একান্ত ইচ্ছা আর জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার আকাক্সক্ষা। সবকিছু মিলিয়ে খুব দ্বিধার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন। শুরুটা ধানের ক্ষেতে কামলার কাজ দিয়ে। ধান কাটা আর কাটার পর মাড়ানো ধান বাড়ি পৌঁছে দেওয়াই ছিল হানিফ মিয়ার মূল কাজ। এভাবেই চলতে থাকে অভিভাবকহীন হানিফ মিয়ার সংসার। না খেয়েই সকালবেলা যান মাঠে। চিন্তা শুধু একটাই মা, ভাইবোনদের নিয়ে একটি স্বপ্ননীড় রচনার।
কিন্তু পৃথিবীতে বোধহয় সব মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। তেমনি হয়নি হানিফ মিয়ারও। ধান কাটার কাজ করে যেন আর চলছিল না হানিফ মিয়ার সংসার। আর তাই অনাহারে-অর্ধাহারে পাড়া-প্রতিবেশীদের সামান্য সহযোগিতায় চলল কিছুদিন। কিন্তু এভাবে তো আর চলবে না সারাজীবন। তাই ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে হানিফ মিয়া চলে এলেন রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু ইট-কাঠের নগরীর কোলাহলময় এ ঢাকাতে যেন কেউ কারো নয়।
এখানকার জীবন পাবনার চাইতেও কঠিন। মানুষগুলোকে অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক মনে হয় হানিফ মিয়ার। পাবনার সহজ সরল হানিফ মিয়া ঢাকা শহরে এসে হয়ে পড়েন আরো অসহায়। মসজিদ, ফুটপাতে অনাহারে কাটে ক’দিন। এরপর হানিফ মিয়ার দিকে চোখ তুলে চাইলেন বিধাতা। তেজগাঁও এলাকায় এক দোকানের সামনে বসে থাকা এক ভদ্রলোককে অনেকক্ষণ ধরে দেখতে লাগলেন মনোযোগ দিয়ে। লোকটি কথা বলছিল পাবনার আঞ্চলিক ভাষায়। নিজের এলাকার মানুষ পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো। আস্তে আস্তে ঐ লোককে বলতে লাগলেন জীবনের সব ধূসর গল্পগুলো। পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা ঐ লোকটি পেশায় ছিলেন একজন স্যানিটারি ব্যবসায়ী। তিনি সবকিছু শুনে হানিফ মিয়াকে নিজের ব্যবসায় কাজে লাগিয়ে দেন সেদিন থেকেই। আর দিনে দিনে হানিফ মিয়া পরিণত হন একজন দক্ষ স্যানিটারি মিস্ত্রিতে। এক সময়ের অসহায় অভিভাবকহীন হানিফ মিয়ার মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো। দুই বোনকে ম্যাট্্িরক পাসের পর বিয়ে দিয়েছেন ভালো জায়গায়। ছোট ভাইটি পাবনার বেড়াতে একটি স্থানীয় কলেজে পড়ালেখা করছে। সব মিলিয়ে এখন ভালোই আছেন হানিফ মিয়া। জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কথা বলতে গিয়ে হানিফ মিয়া জানান, জীবনটা একটা পুষ্পক্ষেত্রের মতো। আপনি যত শুদ্ধভাবে টিকে থাকতে পারবেন বিজয়টা আপনার জন্য ততটা সহজ। আর পিছপা হলেই হারিয়ে যাবেন। স্যানিটারি মিস্ত্রির কাজ করে দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয় হানিফ মিয়ার। পাশাপাশি পাবনাতে চালাচ্ছেন ছোট্ট ব্যবসাও। সব মিলিয়ে কখনোই দুঃখ-কষ্টের কাছে হার মানেননি এ যুবক। আর তাই তো এখন সুখেই আছেন। জীবনের সব ভাগ্যবঞ্চিত তরুণ-যুবা জীবনটাকে হানিফ মিয়ার মতো যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবেই ভাবুক। তাহলে হয়তো আর থাকবে না বেকারদের অতৃপ্তি আর না পাওয়ার বেদনা।
জিয়াউর রহমান চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ২২ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১২