জিয়োপলিমার সিমেন্ট: পরিবেশবান্ধব নির্মাণ উপকরণ

সিমেন্টশিল্পে জিয়োপলিমার সিমেন্ট এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ফ্রান্সের বিজ্ঞানী প্রফেসর জোসেফ ডেভিডোভিট জিয়োপলিমার সিমেন্টের আবিষ্কারক। জিয়োপলিমার সিমেন্টের কেমিস্ট্রি, প্রয়োগিক ব্যবহার, কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কমানোর মতন প্রক্রিয়া প্রথম আবিষ্কৃত হয় তাঁরই হাত ধরে। জিয়োপলিমার সিমেন্ট মূলত পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের বিকল্প উপকরণ হিসেবে অবকাঠামো নির্মাণ, যোগাযোগব্যবস্থা ও সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে বাঁধ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। জিয়োপলিমার সিমেন্ট তৈরিতে প্রয়োজন অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট, সোডিয়াম বা পটাশিয়াম সিলিকেট আর পানির। কাঁচামাল হিসেবে প্রকৃতির কাদামাটি থেকে প্রাপ্ত অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট, শিল্পকারখানা থেকে উৎপন্ন উপজাত উপাদান ব্লাস্ট ফার্নেস সংযোগ ও কয়লা পোড়ানোর পর উৎপন্ন ফ্লাই অ্যাশের মিশ্রণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

জিয়োপলিমার সিমেন্টের কিউরিং টাইম অনেক কম পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের তুলনায়। জিয়োপলিমার সিমেন্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে শক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে। এই সিমেন্ট পারে সব ধরনের শিলা থেকে উৎপন্ন এগ্রিগেইটের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ড তৈরি করতে। এ কারণেই দ্রুত সিমেন্ট জমে যাওয়ার পাশাপাশি শক্তিশালী বন্ড তৈরিতে এর জুড়ি মেলা ভার। শুধুমাত্র কংক্রিট তৈরিতেই ব্যবহৃত হয় পরিবেশবান্ধব জিয়োপলিমার সিমেন্ট।

জিয়োপলিমার কংক্রিট ব্লক

জিয়োপলিমার সিমেন্ট পাইরামেন্ট

১৯৯১ সালে সিমেন্টকে আরও উন্নতকরণে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা। ইরাকযুদ্ধের সময় সৌদি আরবে দ্রুত প্লেন অবতরণ করার জন্য রানওয়েটি খুব শক্ত ও উন্নতমানের হওয়া প্রয়োজন ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্স জিয়োপলিমার সিমেন্টে তৈরি করে পাইরামেন্ট (Pyrament), এরই মাধ্যমে সিমেন্টের ইতিহাসে সৃষ্টি হয় যুগান্তকারী অনন্য এক দৃষ্টান্ত।

পাইরামেন্ট ব্লেন্ডেড সিমেন্ট সবচেয়ে আদর্শ সিমেন্ট, বিশেষত কংক্রিটের রানওয়ে নির্মাণে। এই সিমেন্ট চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে রানওয়েকে শক্ত করতে সক্ষম, যাতে সহজেই কোনো এয়ার বাস বা বোয়িং অবতরণ করতে পারে। জিয়োপলিমার সিমেন্ট চার ঘণ্টার মধ্যে কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ ২০ এমপিএ পৌঁছাতে পারে, যেখানে সাধারণ সিমেন্টের এই শক্তিতে পৌঁছাতে সময় লাগে কয়েক দিন। পাইরামেন্ট ব্লেন্ডেড সিমেন্টের স্বীকৃতি মেলে অবকাঠামো তৈরির কারখানায়। কেননা এটা দ্রুত শক্তি অর্জনে সক্ষম। ১৯৯৩ সালে পাইরামেন্ট কংক্রিট ব্যবহার করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০টি শিল্পকারখানায়, ৫৭টি সামরিক স্থাপনায় এবং অন্য সাতটি দেশের বেসামরিক এয়ারপোর্ট নির্মাণে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রকৌশলীরা পাইরামেন্ট ব্লেন্ডেড সিমেন্টনির্ভর কংক্রিটের গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখতে পান, এটার গুণগতমান অন্যান্য সিমেন্টের তুলনায় অনেক উন্নত।

অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পাইরামেন্ট ব্লেন্ডেড সিমেন্ট এবং সাধারণ সিমেন্টের নমুনা নিয়ে দেখা যায়, সাধারণ সিমেন্টের গ্রেইন সাইজ খুব বেশি খসখসে (Coorse), যা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু জিয়োপলিমার সিমেন্টের গ্রেইন সাইজ হোমোজিনিয়াস ও স্বচ্ছ। এতেই বোঝা যায়, জিয়োপলিমার সিমেন্ট উন্নতমানের।

জিয়োপলিমার সিমেন্টের প্রকরণ

স্ল্যাগনির্ভর জিয়োপলিমার সিমেন্ট

নির্মাণ উপকরণ: মেটাকেত্তলিন (MK-৭৫০) + ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ + ক্ষারীয় সিলিকেট।

জিয়োপলিমার সিমেন্টের প্রথম উন্নত রূপ পাওয়া যায় ১৯৮০ সালে। তখন সেটা (পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম) পলি (সিয়ালেট) অথবা স্ল্যাগনির্ভর জিয়োপলিমার সিমেন্ট ছিল। এ সম্পর্কিত গবেষণার গবেষক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ ডেভিডোভিট ও জে এল সেওয়ের। ১৯৮৫ সালে এটা ‘দ্রুত উচ্চ শক্তিনির্ভর মিনারেল পলিমার’ নামে পরিচিতি পায়।

জিয়োপলিমার কংক্রিটে ঢালাই

রক (Rock) নির্ভর জিয়োপলিমার সিমেন্ট

নির্মাণ উপকরণ: মেটাকেওলিন (MK-৭৫০)+ ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ+ ভোলকানিক টাফ (Tuff)+ ক্ষারীয় সিলিকেট। 

ফ্লাই অ্যাশনির্ভর জিয়োপলিমার সিমেন্ট

১৯৯৭ সালে সিলভারস্ট্রিম, ভেন জেরসভেল্ট এবং ভ্যান ডেভেনটার জিয়োপলিমার সিমেন্টকে আরও উন্নত রূপ দিতে ফ্লাই অ্যাশনির্ভর জিয়োপলিমার সিমেন্ট তৈরি করেন। বর্তমানে দুই ধরনের ফ্লাই অ্যাশনির্ভর জিয়োপলিমার সিমেন্ট তৈরি হচ্ছে। প্রথমটি ক্ষার সক্রিয়করণ জিয়োপলিমার সিমেন্ট আর দ্বিতীয়টি সংযেযাগ বা ফ্লাই অ্যাশনির্ভর জিয়োপলিমার সিমেন্ট। 

জিয়োপলিমার সিমেন্ট কংক্রিট

সিমেন্ট মূলত বাইন্ডার অর্থাৎ জোড়া লাগাতে সাহায্য করে। কিন্তু কংক্রিট একটি কম্পোজিট উপাদান, যা তৈরি হয় সিমেন্টের সঙ্গে পাথর বা স্টোন এগ্রিগেইটের মিশ্রণে। কংক্রিট তৈরিতে সিমেন্ট (সাধারণত পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট অথবা জিয়োপলিমার সিমেন্ট) অবশ্যই লাগে।

কংক্রিটে বিভিন্ন সাইজের এগ্রিগেইটের (যেমন বালু এবং ছোট ছোট শিলা) মিশ্রণ সিমেন্টের সহায়তায় বাইন্ডার হিসেবে কাজ করে। কংক্রিট মিশ্র অবস্থায় ভেজা এবং শুকিয়ে গেলে তা দারুণ শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। জিয়োপলিমার কংক্রিট মিশ্রণে বাইন্ডারকেই জিয়োপলিমার সিমেন্ট বলা হয়।

যেভাবে তৈরি হয় জিয়োপলিমার সিমেন্ট কংক্রিট

জিয়োপলিমার সিমেন্ট, পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষত রাসায়নিক গঠনের দৃষ্টিকোণ থেকে। যদিও একই যন্ত্রপাতির সাহায্যে জিয়োপলিমার সিমেন্ট তৈরি করা হয়, যা ব্যবহৃত হয় পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট তৈরিতেও। তবুও প্রধান পার্থক্য জিয়োপলিমার সিমেন্ট কংক্রিট তৈরির ক্ষেত্রে তাপ প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। প্রায় ১৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা প্রয়োগ করা হয়, যাতে কিউরিং সঠিকভাবে হয়। তাপ প্রযুক্ত হয় দুইভাবে। একটি উত্তপ্ত আসন তৈরির মাধ্যমে আর অপরটি উত্তপ্ত বাতাসকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে। নগর অঞ্চলে সাধারণত কংক্রিটের মিশ্রণ ঢালার আগে সেখানকার প্যানেলে ইনসুলেটেট টিউব স্থাপন করা হয়। তারপর গরম পানি সেই টিউবের ভেতর প্রবেশ করিয়ে প্যানেল গরম রাখা হয়, যাতে কিউরিং প্রসেসটি সঠিক হয়। পরে এই টিউবগুলো ঘরের অভ্যন্তরে ঘরকে গরম রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়।

জিয়োপলিমার সিমেন্ট কংক্রিটের ব্যবহার যে কারণে

জিয়োপলিমার সিমেন্ট কংক্রিট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে কিন্তু শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী উপাদান হিসেবে স্থায়ী হয় অনেক দিন। পুরোনো ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, যা কি না শুধুমাত্র কংক্রিট সিমেন্টে তৈরি। সনাতন পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সমস্যা এর উচ্চমূল্যের কারণে বড় আকারের চুল্লির প্রয়োজন হয়, যাতে জীবাশ্ম শিলা পুড়িয়ে পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট তৈরি করা হয়। এতে একদিকে বায়ুদূষিত হয় অপর দিকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন করে দূষণ ঘটায় পরিবেশের। পরিসংখ্যান বলছে, শুধু পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য পৃথিবীতে প্রায় ৭ শতাংশ কার্বন নিগর্ত হচ্ছে, যা ঘটাচ্ছে মারাত্মক পরিবেশদূষণ।

জিয়োপলিমার কংক্রিট হলো ব্লক ও জিয়োপলিমার কংক্রিটে তৈরি দেয়াল

জিয়োপলিমার সিমেন্ট প্রস্তুতিতে কোনো জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি কিউরিংয়ের সময় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয় না। জিয়োপলিমার কংক্রিট তৈরিতে খুব কম শক্তির প্রয়োজন পড়ে পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট কংক্রিটের তুলনায়। যে কারণে ৯০ শতাংশ কম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। জিয়োপলিমার কংক্রিট সিমেন্ট পরিবেশবান্ধব হওয়ায় যেকোনো পরিস্থিতিতে কাজ করতে সুবিধা হয়। 

যদিও জিয়োপলিমার কংক্রিট নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে কয়েক শতাব্দী ধরেই। কিন্তু এর ব্যবহার ছিল মানুষের কাছে অজানা। আরবান ইডেন হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম প্রকল্প, যেখানে জিয়োপলিমার কংক্রিট সিমেন্ট ব্যবহার করে ভবন নির্মাণ করা হয়। জিয়োপলিমার কংক্রিট সিমেন্টের রয়েছে যথেষ্ট স্থৈতিক শক্তি। পৃথিবীব্যাপী প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে জিয়োপলিমার কংক্রিট সিমেন্টের ব্যবহার বাড়বে বৈ কমবে না!

প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ

সাবেক অতি. প্রধান প্রকৌশলী, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top