ফুটওভার ব্রিজ সড়ক পরিবহনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে পথচারী পারাপারের সেতু (Pedestrian Foot Over Bridge) বলেও অনেকে অভিহিত করে। এ ধরনের সেতু পথচারী পারাপারের জন্যই ব্যস্ততম সড়কের ওপর স্থাপন করা হয়, যাতে পথচারীরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তা পার হতে পারে। পথচারীদের রাস্তা পারাপারের জন্য এর চেয়ে উত্তম ও সহজলভ্য ব্যবস্থা দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু অনেক পথচারী ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের পরিবর্তে নিচ দিয়ে রাস্তা পার হওয়াকেই সহজ মনে করে। ব্যস্ত নগরের পথচারীদের মধ্যে সাধারণত এ ধরনের প্রবণতা অনেক বেশি। এর পেছনে সময়, নিরাপত্তাসহ আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আলোচ্য রচনায় পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের অনীহাকে বিশ্লেষণ করে, এতে চলন্ত সিঁড়ির (Escalator) সুবিধা যুক্ত হলে তা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে কী পরিবর্তন আনতে পারে তা আলোকপাত করা হয়েছে।
ঢাকার ফুটওভার ব্রিজ ও একটি পরিসংখ্যান
রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে ৬৮টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় ৩৪টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় ৩১টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। তিনটি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (RHD)-এর আওতায়। ঢাকায় সাধারণত তিন ধরনের ফুটওভার ব্রিজ লক্ষ করা যায়। এগুলো হলো- স্টিল ফুটওভার ব্রিজ, প্রি-ফেব্রিকেটেড গার্ডার (Pre-fabricated guarder) ফুটওভার ব্রিজ ও কংক্রিট (RCC) ফুটওভার ব্রিজ।

যে কারণে ফুটওভার ব্রিজ অব্যবহৃত
যদিও ঢাকার অনেক স্থানে পথচারীদের পারাপারের সুবিধার জন্য ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে, কিন্তু এগুলোর অধিকাংশই বেশির ভাগ সময়ই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। এর প্রধান কারণ, বেশির ভাগ ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়িগুলো শেষ হয় ফুটপাতে, যার অধিকাংশই থাকে হকারদের দখলে। শুধু তা-ই নয়, ফুটওভার ব্রিজগুলোর ওপরে মালামাল রেখে জায়গা দখল করে থাকে, যা পথচারীদের হাঁটার জায়গা দখল করে নেয়। যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে ফুটওভার ব্রিজগুলোর ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এর ফলে ময়লা জমে ব্রিজগুলো নোংরা হয়ে যায় ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। নিরাপত্তার অভাবও ফুটওভার ব্রিজগুলো অব্যবহৃত থাকার একটি বড় কারণ। বিশেষ করে রাতের বেলা অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজে কোনো আলোর ব্যবস্থা না থাকার কারণে পথচারীরা ছিনতাইকারী ও দুর্বৃত্তদের ভয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে। এ জন্যই রাতের বেলা ঢাকার অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজ প্রায় খালি পড়ে থাকে। কিন্তু এত সব কারণের মধ্যেও ঢাকার পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় তাঁদের সিঁড়ি পেরিয়ে ফুটওভার ব্রিজে উঠতে না চাওয়ার প্রবণতাকে। এ জন্য অনেকে সময়কে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করান, বয়স্ক লোকেরা দেন তাঁদের বয়সের অজুহাত। এ জন্যই অনেক দেশে এখন ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি (Escalator) যোগ করা হচ্ছে, যাতে পথচারীরা সহজে এ ধরনের ব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশেও এ ব্যবস্থা চালু করার চিন্তা করা হচ্ছে খুব জোরালোভাবে।
অন্য দেশের দৃষ্টান্ত
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বেশ কয়েকটি জায়গায় ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি সংযোজন করা হয়েছে এবং এর ফলে বেশ ভালো ফল পাওয়া গেছে। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বেশ কিছু নতুন ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে চলন্ত সিঁড়িসহ এবং পুরোনো ব্রিজগুলোতেও চলন্ত সিঁড়ি সংযোজন করা হচ্ছে। দিল্লির গণপূর্ত অধিদপ্তরের পরিকল্পনায় এ ফুটওভার ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, যা বয়স্ক, শারীরিকভাবে অক্ষম ও শিশুদের জন্য ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারকে বেশ সহজ ও আনন্দদায়ক করে তুলছে। প্রধান সড়কে চলাচলকারী ড্রাইভার ও অন্যান্য গাড়ি ব্যবহারকারীরাও রাস্তার ওপর থেকে পথচারীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বেশ উপকৃত হচ্ছে। এতে তারা যেমন অযথা যানজট থেকে রক্ষা পাচ্ছে, তেমনি পথচারীদের নিরাপত্তাও বাড়ছে অনেক।

এভাবে ভারতের মুম্বাই, দিলি, কলকাতা, মহারাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি শহরে ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি সংযোজন করা হচ্ছে এবং এর ফলে ভারতের পথচারীরা রাস্তার বদলে ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পারাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ভারত ছাড়াও মালয়েশিয়া, চীন ও সিঙ্গাপুরে চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশে ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি
ঢাকায় ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি (Escalator) সংযোজন করার চিন্তা একেবারেই সা¤প্রতিককালের। ঢাকার সৈনিক ক্লাবসংলগ্ন বনানী ১১ নম্বর সড়কে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম চলন্ত সিঁড়ির (এস্কেলেটর) ফুট ওভারব্রিজ। পথচারীদের সুবিধায় এ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে এ চলন্ত সিঁড়ি পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করা হচ্ছে। ভালো ফল ও সাড়া পাওয়া গেলে নগরের অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজকে এ সেবার আওতায় আনা হবে। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সাধারণ সিঁড়ির মতোই ওঠানামার সিঁড়ি থাকবে এ ফুটওভার ব্রিজে। এ চলন্ত সিঁড়ি ভোর ছয়টা থেকে রাত ১২টা অবধি একটানা চালু থাকবে। যদি বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে জেনারেটরের ব্যবস্থাও থাকবে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য থাকবে সিকিউরিটি। এই ফুটওভার ব্রিজটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল এ বছরের মে মাসে, লক্ষ্য ছিল আগস্ট মাসে তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। কিন্তু সময়সীমা পার হয়ে গেলেও এখনো এ ফুটওভার ব্রিজটির নির্মাণকাজ স¤পন্ন হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে মোট ২৩টি ফুটওভার ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১০টি এবং উত্তরে ১৩টি। উত্তরের ১৩টি ফুটওভার ব্রিজের মধ্যে একটি হচ্ছে চলন্ত সিঁড়ির ফুটওভার ব্রিজ। যদি বনানীর এই পাইলট ফুটওভার ব্রিজ প্রকল্প সফল হয় তবে এ উদ্যোগের মাধ্যমে ঢাকার অব্যবহৃত ফুটওভার ব্রিজগুলোকে এ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

নির্মাণব্যয়
এ ধরনের ফুটওভার ব্রিজের নির্মাণ খরচ কিন্তু খুব বেশি নয়। সাধারণ ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণখরচের সঙ্গে বাড়তি ৫০ লাখ টাকা যোগ করলেই এ চলন্ত সিঁড়ির (এস্কেলেটর) ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা সম্ভব। অর্থাৎ একটি সাধারণ সিঁড়ি নির্মিত ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করতে লাগে দুই কোটি টাকা। আর চলন্ত সিঁড়িসহ ব্রিজ তৈরিতে সব মিলিয়ে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হবে।
ভারতসহ পৃথিবীর নানা দেশে ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি সংযোজন পথচারীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশেও এখন এ ধরনের ফুটওভার ব্রিজের নির্মাণ শুরু হয়েছে। আশা করা যায় এ সুবিধা চালু হওয়ার পর পথচারীকে আর হেঁটে ফুটওভার ব্রিজে ওঠানামা করতে হবে না। যেসব পথচারী ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে অনীহা দেখায়, তারাও স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করবে এ ফুটওভার ব্রিজ। কোনোমতে সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতে পারলেই স্বাচ্ছন্দ্যে পার হওয়া যাবে রাস্তার এপার-ওপার। চলন্ত সিঁড়ির ফলে বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীরাও অনায়াসে এ ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে ওঠানামা করতে পারবে। যদি এ সুবিধা চালু হওয়ার ফলে অধিকসংখ্যক পথচারী ব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠে স্বাচ্ছন্দ্যে এবং নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারে, তবেই এ প্রযুক্তির সুফল ভোগ করা যাবে।

আবু আহমেদ সুফিয়ান
প্রভাষক, পুরকৌশল বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৩ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৩