প্রতিটি বাড়ির অন্দরসাজে ক্রম বিবর্তনের একটি ইতিহাস থাকে। দেশ বেড়ানো প্রস্তুতি, নানা মানুষের উষ্ণ সংস্পর্শ এবং ফেলে আসা দিনগুলো সব মিলিয়ে অন্দরমহল হয়ে ওঠে বিশেষ এক গল্প।
অন্দরমহলের সাজসজ্জা নিয়ে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট তো আমরা হরহামেশাই করছি। কিন্তু কখনও কি ভেবেছেন। শুধু সাদার সাথে নানা রঙয়ের ব্যবহারেই পাল্টে যেতে পারে আপনার অন্দরমহলের পুরো চেহারাটা। মনোক্রোম্যাটিক কালার স্কিম অথবা কনষ্ট্রাষ্টিং নানা রকমের কলার স্কিম এখন প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। এখন তো যে কোন বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকলেই নজরে পড়ে নানা রকমের কালার কম্বিনেশন। তবে আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বাড়ির দেয়ালে এত রঙ ব্যবহার করা পছন্দ করেন না। তাঁদের চিরাচরিত ট্রাডিশনাল কালার স্কিমই পছন্দ। যাঁদের পছন্দটা এই দিকে তাঁরা কিন্তু অন্দরমহলে সাদার সাথে নানা রঙয়ের কনট্রাস্টিং ট্রাই করে দেখতে পারেন বলছিলেন কামরাঙ্গা ডিজাইন লিমিটেডের চীফ ইন্টোরিয়র ডিজাইনার মুমানা ইসলাম খান।
সঠিক রঙের ব্যবহার ঘরে কোমল আবহ তৈরি করে। ঘরকে আরও আরামদায়ক ও নান্দনিক করে তোলে। অন্দরসাজের পরিকল্পনায় দেয়ালে হালকা রঙ, নানা ধরনের আসবাব, ফ্র্যাবিক্সে রঙয়ের খেলা অন্দরমহলকে করে তুলতে পারে সুদিং এবং গজির্য়াস।
কোনও একটি বিশেষ থিম অথবা জিনিসকে হাইলাইট করে অনায়াসেই বানিয়ে ফেলা সম্ভব এক্সক্লুসিভ ইন্টেরিয়র। আমাদের প্রায় সবার মনের সযতেœ লালিত ইচ্ছে একটা সুন্দর ঝকঝকে ডেকোরেটেড স্পেশাল বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট। তবে সেই স্বপ্নের বাড়ির ইন্টেরিয়র প্ল্যান করার সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা ডিসাইড করে উঠতে পারি না ঠিক কোন থিম অথবা জিনিসকে পুরো ইন্টেরিয়রে প্রাধান্য দেব। যেমন, ধরুন আপনার পছন্দ অ্যান্টিক লুক। তাই বলে সারা বাড়ি অ্যান্টিক জিনিসে ভর্তি করে রাখবেন এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। কিংবা হয়তো আপনার পছন্দ কোনো একটি বিশেষ রঙ। তাই বলে সব ঘরের দেওয়ালেই সেই রঙ করতে হবে সেটাও কিন্তু নয়।
ইন্টেরিয়র ডেকরেশনের মূলমন্ত্রই হল মিনিম্যালিজম এবং কন্টিনিউয়েশন। এই সব কথা মাথায় রেখেই অন্দরের ইন্টেরিয়র প্ল্যান করেন ডিজাইনার মুমানা ইসলাম খান। বাড়ির অন্দরসাজে ছিমছাম, স্ট্রেট লাইনের সাথে এথনিক ফার্ণিচারের কম্বিনেশন ফেব্রিকে নানা রঙয়ের ব্যবহার। নিজের দেশের ট্রাডিশনের সাথে অন্য দেশের ট্রাডিশনের মিক্স এন্ড ম্যাচই তার পছন্দ। অপ্রয়োজনীয় আসবারের কারণে ফ্লোর স্পেস যাতে ঢেকে না যায় সেই দিকেও রয়েছে বিশেষ নজর।
বসার ঘরটিতে রয়েছে ট্রাডিশনের আফ্রিকান স্টাইলের সাথে মর্ডান এবং নিজের দেখা ট্রাডিশনের ছোঁয়া। মর্ডান সাদা সোফা সেটটিতে ব্যবহার করা হয়েছে উজ্জ্বল রঙয়ের কুশন কভার। আফ্রিকান এথনিক লুক দিতে কুশন কভারে এম্বব্রডারি করা হয়েছে দেয়ালের পেইন্টিং এর সাথে মিল রেখে। ফ্লোরে যে কাপের্টটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও তৈরি করা হয়েছে আফ্রিকান মোটিফ এবং ট্রাডিশনকে মাথায় রেখে। পর্দার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে দেশীয় সিল্ক এবং টাঙ্গাইলের শাড়ীকে। পর্দার রং নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সোফার কুশান এবং কভারকে প্রাধান্য দেখা হয়ে। লাল আর সবুজের সাথে কমলার রংয়ের ব্যবহার নিমিষেই পাল্টে দিয়েছে পুরো ঘরের চেহারা। রুমের একপাশে বুক শেলফটি ফাংশনাল তো বটে, তার সঙ্গে পুরো ঘরের ডেকোরেশনকে কমপ্লিমেন্ট করেছে। বুক শেলফের দিকে নজর ফেরালে চোখে পড়বে গামারি কাঠের ফ্রেমের সাথে বাজাঁ এবং গ্লাসের নান্দনিক ব্যবহার। ফ্লোরে ফেলে রাখা কুশান দুটির কভারে ব্যবহার করা হয়েছে আফ্রিকা থেকে আনা ট্রাডিশনারল ফ্রেবিক্স। যা কিনা ঘরের বাকি জিনিসের সাথে একদম মানানসই। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা নানা ধরনের শোপিস আবার কখনও সুন্দর সুন্দর পেইটিং এই ফ্ল্যাটের অন্দরসাজকে করে তোলে আরও বেশি নান্দনিক ও আকর্ষক।
অন্দরমহলে সবুজের প্রাণবন্ত উপস্থিতি ঘরের ভিতরের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াকে বদলে দিয়ে এনে দিতে পারে ভালো লাগার সতেজ আমেজ। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, একই গাছের পাতায় কখনও কচি কলাপাতায় রঙ, কখনও গাঢ় সবুজ আবার কখনও হালকা সবুজ। আর প্রকৃতিতে সবুজের এমন ভিন্নতা যদি আপনার অন্দরমহলের আঙ্গিনায় থাকে তাহলে তো কথাই নেই। সাথে কৃত্রিম ঝড়না অপরূপ সৌন্দর্যে ভরে উঠবে আপনার সবুজ অন্দর। (ছবি: ch. Dscou ১৮৯)
সদর আঙ্গিনা পেরিয়ে অন্দরে প্রবেশ করার সুখেই বসার ঘরের একটি দেয়ালে চোখে পড়ে রাষ্টিক টাইলসের ব্যবহার (ছবি: ch. Dscou ১৯৭)। একটু পাঞ্চ ঘরে তাতে ব্যবহার করা হয়েছে আকাশের নীল রং সাথে উজ্জ্বল রংয়ের পেইন্টিং যা কিনা উষ্ণ স্বভাবেরই প্রতিফলন। পেইন্টিং এর নিচে নজরে পড়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা শোপিস। ঘরের সিটিং এরেঞ্জমেন্টের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় পুরো গদির সোফার সাথে ট্রাডিশনাল কাতান কাপড়ের কুশান কভার এবং সোফা ব্যাক। (ছবি: ch. Dscou ১৯৯)। একপাশে ফ্লোরাল প্রিন্টের কাপড়ের সিটার বহন করছে মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ট্র্রাডিশনকে।
এক কর্নারে রয়েছে থাইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা ক্যাবিনেট। এমনকি লুকের সাথে ট্রাডিশনাল লুক তৈরি করতে পর্দায় ব্যবহার করা হয়েছে দেশী শাড়ী। রুমের আরেকটি কর্ণারে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের সিটার (ছবি: ch. Dscou ২০১)। শোফার কুশন থেকে দুটো সলিড কালার বেছে নেয়া হয়েছে সোফা কভার, গদি এবং কুশনের জন্য। সেন্টার টেবিলে রাখা শোপিসের সাথে মিল রেখে দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে লাল আর কালোর কম্বিনেশনের পেইন্টিং।
বেডরুমের বেশি অ্যাকসেসরিজ বা ডেকর আইটেম না রাখাই ভালো (ছবি: ch. Dscou ২১৩)। বরং দেওয়াল সাজিয়ে তুলুন সুন্দর ছবি, পেইটিং, টেপোষ্ট্রি বা পছন্দের ফ্যাবিক্স ফ্রেমবিন্দ করে। বেডরুমটির দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছে নানা রংয়ের খেলার দুটি উজ্জ্বল পেইটিং মূলত এই পেইটিং দুটোর থিমই বহন করছে পুরো ঘরের ইন্টেরিয়র। সামান্য প্ল্যানিং আর একটু ইনোভিটিভ থিংকিং তৈরি করেছে একটা এক্সক্লুসিভ বেডরুম। একটু বৈচিত্র্য আনতে ব্যবহার করা হয়েছে ভিন্ন স্ট্রাইলের খাট। পেইটিং থেকে নেয়া হলুদ রং এর ব্যবহার বিছানার চাদরে এনে দিয়েছে বৈচিত্র্য। সাথে অন্যান্য রংয়ের সমাহার রয়েছে কুশান কভার এবং পর্দায়। রুমটিতে দুই লেয়ারের পর্দা ব্যবহার করা হয়েছে। জানালার প্লেমেটে ভিন্নতা আনতে কটন কাপড়ের উপর গোল্ডেন রঙয়ের ব্লকের ব্যবহার পুরো পরিবেশকে করে তুলেছে অসাধারণ। প্রথম লেয়ারে অফহোয়াইট রঙয়ের পর্দা ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় লেয়ারের পর্দাতে সাদা রঙের উপর ব্লক করা হয়েছে তিনটি রঙের কম্বিনেশনে। কালার থিম হিসেবে দেয়ারে রাখা পেইন্টিং এর সাথে মিল রেখে বিছানায় ব্যবহার করা হয়েছে নানা ধরনের বালিশ এবং কুশান কভার। ব্লকের জন্য যেই মোটিফটি ব্যবহার করা হয়েছে একটু ভিন্নতা আনতে সেটি আবার বিছানায় রাখা কুশান কভারটিতে এমব্রডারি করা হয়েছে। এক কথায় ঘরে ঢুকালেই পাবেন রঙের উষ্ণতার ছোঁয়া।
(ছবি: ch. Dscou ২১৩) যত বেশী ডার্ক শেডের রঙ বাছাই করবেন ঘর তত ছোট দেখাবে। আর হালকা রঙ ঘরকে বড় দেখাতে সাহায্য করে। ঘরের জন্যে এমন ফার্ণিশ বাছাই করবেন যা আপনার ঘরের কালার স্কিমের সঙ্গে মানানসই হয়। জানালা দরজার পর্দা নির্বাচনের সময়ে খেয়াল রাখবেন, তা যেন খুব বেশি ভারী ফ্যাব্রিক্নের না হয়। এতে ঘর দেখতে ছোট লাগে। তাই বসার ঘরটির ক্ষেত্রে সিল্ক এবং মসলিন কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ঘর দেখতে বড় এবং কোজি লাগে। ঘরের রঙ হালকা বিশেষ করে সাদা, সে ক্ষেত্রে ঘরে একটা কোজি ফিল আনতে কুশান কভারে ভাইব্রেন্ট ও উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলস সিলিং এ স্টপ লাইটের ব্যবহার তৈরি করছে আলোর আধাঁরির খেলা। ফার্ণিচারের ক্ষেত্রে বেছে নেয়া হয়েছে লেকার পলিশের ট্রাডিশনাল লুক। ফ্লোরে উডেন টাইলসের ব্যবহার এতটুকুুও বেমানান লাগছে না। আর পাঁচটা বাজার চলতি ফ্লোর টাইলস নয় বরং রয়েছে ইনোভেশনের ছোঁয়া। অতিরিক্ত কোন আসবাব চোখে পড়বে না ঘরটিতে ছিমছাম অথচ খুবই ফাংশনাল। ফ্লোরে বিছানা এ্যাক্রোলিক কার্পেট অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়া।
বসার ঘরের একটি দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছে সবুজ রঙ এর স্লেট যা কিনা নিঃসন্দেহে নজর কাড়ে বাড়িতে আসা অতিথিদের। টেবিলের উপর ল্যাম্পহোডটি কাস্টমাইজ করে তৈরি করা। কাঠের ফ্রেমের সাথে টেরাকোটার ব্যবহার ল্যাম্পটিকে দিয়েছে নান্দনিক রূপ। স্পটলাইটের ব্যবহারে পুরো পরিবেশটি হয়ে উঠেছে রহস্যময় ও মায়াবী। (ছবি: Mr. Mahbub ০০৪) ফয়ার থেকে ডাইনিং এবং ফরমাল লিজিং এর মধ্যবর্তী স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে ফিক্সড ফ্রাঞ্চ ডোর ও সুইং ডোর। পুরো ডোরটিতে সাদা পেইন্ট এবং গ্লাসের ব্যবহারে হয়ে উঠেছে অসাধারণ। মূলত এয়ার সারকুলেশনের কথা মাথায় রেখে ডোরটি করা হয়েছে। কারণ সারাক্ষন এয়ারকন্ডিশনড রুমে থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে এবং ত্বকের পক্ষে ভালো নয়।
আপনার অন্দরমহল ইন্টেরিয়র করার সময় নিজের রুচিবোধ সাথে একজন দক্ষ ডিজাইনারের সহযোগিতায় আপনার অন্দরমহল হতে পাওে স্বপ্নীল আবাস। তাহলে এবার একটু সাহস করে একটা বিশেষ ফোকাল পয়েন্ট বেছে নিয়ে তৈরি করে ফেলুন আপনার ড্রিম হোম।
ফারজানা গাজী
ছবি কৃতজ্ঞতা : কামরাঙ্গা ডিজাইন লিমিটেড
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৩ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১২