সিরাজগঞ্জ জেলার সলঙ্গা থানা থেকে ৫ কিলোমিটার পুর্বে হাটিকুমরুল ইউনিয়নে নবরতœ মন্দিরটির অবস্থান। হাটিকুমরুল বাস স্টপেজ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ পেরুলেই ডান পাশে গাছপালার ফোকর দিয়ে চোখে পড়বে দোচালা একটা ছোট মন্দির। আর একটু এগুলেই আরেকটা মন্দির। দেখতে গোলাকার হলেও আসলে এটা আটকোণা, অষ্টকোণাকৃতি। গম্বুজটাও আটকোণা। গম্ভুজের শীর্ষভাগ ধীরে ধীরে সরু হয়ে উঠে গেছে। মন্দিরের ভেতর আর বাইরের দেয়ালের প্লাস্টাওে মোগল আমলের ছোঁয়া। মন্দিরটির নাম শিবমন্দির। কার্নিশ বাঁকানো মন্দিরটির ভেতরে রয়েছে ছোট একটা শিবলিঙ্গ।
শিব মন্দিরের শতেক ফিট পরেই দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় মূল মন্দিও, এটাই হাটিকুমরুল নবরতœ মন্দির। যেটা দেখতেই অতদুর ছুটে যান দশনার্থীরা। জনৈক রামনাথ ভাদুড়ী মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর আমলে (সময়টা ১৭০৪ থেকে ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। হিন্দু স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন কারুকার্যমন্ডিত নবরতœ মন্দিরটি তিনতলাবিশিষ্ট। এ মন্দিরে ছিল পোড়ামাটির ফলক সমৃদ্ধ ৯টি চূড়া। এ জন্য এটিকে নবরতœ মন্দির বলা হতো। গ্রামের একেবারে ভেতরে, ধরতে গেলে অজপাড়াগাঁয়ের ভেতর এত সুন্দর পরিচ্ছন্ন মন্দির সুিত্যই মুগ্ধ জাগানিয়া।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে ধারণাটা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত সেটা হচ্ছে- মথুরার রাজা প্রাণনাথের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন জমিদার রামনাথ ভাদুরী। মথুরার রাজা প্রাণনাথ দিনাজপুর জেলার কান্তনগরে ঐতিহাসিক কান্তজির মন্দির নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সংকটে পড়ে যান, এতে করে তিনি বাৎসরিক রাজস্ব পরিশোধ করতে অপারগ হয়ে উঠছিলেন। এদিকে রামনাথ ভাদুরী মথুরা থেকে অর্থশূন্য হাতে ফিরে এসে, বন্ধুত্বের খাতিরে নিজ কোষাগার থেকে টাকা দিয়ে রাজা প্রাণনাথের বকেয়া দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের আদলে হাটিকুমরুলে একটি মন্দির নির্মাণের শর্তে পরিশোধ করে দেন। শর্ত মোতাবেক রাজা প্রাণনাথ কান্তজির মন্দিরের অবিকল নকশায় হাটিকুমরুলের এ নবরতœ মন্দির নির্মাণ করে দেন।
আরেকটি মতামতও আছে। সেটি হচ্ছে, রাখাল জমিদার নামে পরিচিত রামনাথ ভাদুরী তার জমিদারি আয়ের সঞ্চিত কোষাগারের অর্থ দিয়েই এ মন্দির নির্মাণ করেন। সে সময়ে বহুকাল ধরেই মহা ধুমধামে এ চারটি মন্দিরেই পূজা অর্চনা করা হতো। কালের বিবর্তনে ভারত উপমহাদেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি, দেশ বিভাগ ও নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে হারিয়ে যায় জমিদারের পূর্বপুরুষরা। অরক্ষিত এ নবরতেœর অনেক মূল্যবান প্রাচীন সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায় দেশি-বিদেশি দুর্বৃত্তরা।
দিনাজপুর জেলার কান্তজির মন্দিরের অনুকরণে গঠিত তিনতলা এই মন্দিরের আয়তন ৬৫.২৪ বাই ৬৫.২৪ ফুট। বর্গাকার মন্দিরটি প্রায় ২ ফুট প্লাটফরমের উপর তৈরি। মন্দিরের মূল কক্ষটি বেশ বড়। চারদিকের দেয়ালের বাইরের চারপাশ পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সাজানো ছিল। পরে কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক আর মানুষের অবহেলায় সংস্কারের অভাবে সব নষ্ট হলে প্রতœতত্ত¡ বিভাগ মন্দিরটি অধিগ্রহণ এবং নতুন করে এর সংস্কার করে।
মন্দিরটি তিনতলাবিশিষ্ট। এলাকার লোকজনের কাছে এটি দোলমঞ্চ নামেও পরিচিত। মন্দিরের উপরের রতœ বা চূড়াগুলো অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। নিচতলায় দুটি বারান্দা বেষ্টিত একটি গর্ভগৃহ। এর বারান্দার বাইরের দিকে ৭টি এবং ভেতরের দিকে ৫টি খিলান বা প্রবেশ পথ। গর্ভগৃহের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দুটি প্রবেশপথ আর মন্দিরের ২য় তলায় কোনো বারান্দা নেই।
হাটিকুমরুল নবরতœ মন্দির বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবরতœ মন্দির। মূল অবস্থায় যে পোড়ামাটির চিত্রফলক দ্বারা সাজানো ছিল সেটা মন্দিরটি দেখলেই বোঝা যায়। এখনো মাটির গায়ে সামান্য কিছু চিত্রফলকের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। এই মন্দিরটির কোনো শিলালিপির পরিচয় পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়ভাবে এই মন্দিরটি ভাদুরী জমিদারের বাড়ির জমিদারীর মন্দির নামেই খ্যাত। অনেকে মনে করেন এই মন্দির খাজনা আদায়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। নবরতœ মন্দিরের বাইরে পূজার আয়োজন হলেও ভেতরে পূজা হতে দেখেনি কেউ। এমনিভাবেই নবরতœ মন্দিরকে দেখে এসেছে এলাকার মানুষজন। প্রথমদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নবরতœ মন্দিরে পূজা আয়োজনের কথা বলা হলেও দুটো কারণে স্থানীয় হিন্দু পরিবাররা এতে রাজি হয়নি। প্রথমত, এটি জমিদারি সম্পত্তি হওয়ায়। প্রজা হিসেবে জমিদারি সম্পত্তি ব্যবহার যথাযোগ্য মনে করেনি তারা। দ্বিতীয়ত, এখানকার হিন্দু পরিবারদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না বা এখনো নেই। নবরতœ মন্দিরে পূজা চালিয়ে যাওয়ার মতো সাধ্য এখানকার পরিবারগুলোর নেই। এ কারণে এ মন্দিরের ভেতরে পূজা না দিয়ে বাইরেই পূজা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে এলাকার লোকজন।
এই এলাকায় এখনো দুই তিন মাইল জুড়ে ২০-২৫ ফুট মাটি খুঁড়লে পুরনো লম্বা প্রাচীর এবং সারি সারি ইটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ধারণা করা যায়, জমিদারি আমলের এই জমিদার বাড়ি মাটির নিচে হারিয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজনও এটা বিশ্বাস করে। তাদের ধারণা মন্দিরগুলো জমিদার বাড়ির চেয়ে উঁচুতে ছিল অথবা দৈববলে মন্দিরগুলো মাটির নিচে হারিয়ে যায়নি। প্রথমেই দোচালা ছনের ঘরের আদলে যে মন্দিরটা রয়েছে সেটা নাট মন্দির যা স্থানীয় লোকজনের ভাষায় বাংলা মন্দির। আটকোণা মন্দিরটা শিব মন্দির, বড় মন্দিরটা নবরতœ মন্দির আর নবরতœ মন্দিরটার পেছন দিকে আরেকটু ভেতরে অলংকরণ করা গোলাকার শিব মঠ। এ নিয়েই হাটিকুমরুল নবরতœ মন্দির এলাকার পরিসর। স্বাধীনতার পর প্রতœতত্ত¡ বিভাগ পর্যায়ক্রমে বের করে নিয়ে আসে মন্দিরটির প্রাচীন সৌন্দর্য। যা আজ দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৬ তম সংখ্যা, জুন ২০১২