কাচের কথা

কাচ কী?

কাচ একটি স্বচ্ছ (অদানাদার) কঠিন পদার্থ। এটা সাধারণত শক্ত অথচ সহজে ভাঙা যায় এবং সহজেই আলো এর ভেতরে ভেদ করতে পারে। অনেক আগে থেকেই ঘরের জানালা এবং পানি পান করার পাত্র হিসেবে কাচ বেশি ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি সোডালাইম গ্লাস যাতে ৭৫% বালু (সিলিকন ডাই-অক্সাইড) এবং সোডিয়াম অক্সাইড ও ক্যালসিয়াম অক্সাইডের সাথে খুব অল্প পরিমাণ অন্যান্য উপাদান মিশ্রিত থাকে। গ্লাসের (Glass) মূল শব্দটি ল্যাটিন শব্দ গ্লিসাম (Glesum) থেকে উৎপত্তি। জার্মান ভাষায় এই শব্দটি দ্বারা কোনো বস্তুর স্বচ্ছ অথবা উজ্জ্বলতাকে বোঝানো হয়।

কাচ তৈরির ইতিহাস

কাচ তৈরির ইতিহাস অনেক পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালে মেসোপটেমিয়াতে প্রথম কাচ তৈরির আভাস পাওয়া যায়। জানালার জন্য যে কাচ ব্যবহার করা হয় সেটাকে ফ্ল্যাট গ্লাস বলে। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ফ্ল্যাট গ্লাস বড় আকারের সিলিন্ডারে উচ্চ চাপে বায়ু প্রবেশ করার মাধ্যমে যে সিলিড্রিক্যান কাচ তৈরি হয় সেটি পরবর্তীতে কেটে শিটের আকারে তৈরি করে জানালার কাচ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বেশির ভাগ জানালার কাচ তৈরি হতো সিলিন্ডার পদ্ধতিতে। সিলিন্ডারটি ৬ থেকে ৮ ফুট লম্বা এবং ১০ থেকে ১৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ ছিল এবং পুরুত্ব একটি নির্দিষ্ট মাপের সমতল কাচ হিসেবে তৈরি করা সম্ভব হয়।

১৮৪৮ সালে পেটেন্ট তৈরি করেন হেনরি বেসিমার নামক একজন ইংরেজ প্রকৌশলী। তিনি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে গ্লাস তৈরি করেন। তিনি বিরতিহীন ফ্ল্যাটগ্লাসের রিবন তৈরি করার জন্য দুটি রোলারের মাঝখানে স্থাপন করে গ্লাস শিট তৈরি করতে সক্ষম হন। এটা খুব ব্যয়বহুল কাচ তৈরির পদ্ধতি ছিল। কারণ গ্লাস শিট মসৃণ করার প্রয়োজন পড়ত। আমেরিকায় অনেকবার চেষ্টার পরও গ্লাসের মসৃণতা আনা যায়নি। ফ্ল্যাট গ্লাসের ক্রমোন্নতির পূর্বে বড় বড় প্লেট শিটের গ্লাস তৈরি করা হতো লোহার পাতের উপর গলিত কাচের কাস্টিং পদ্ধতিতে এবং কাচের উভয় তল মসৃণ করা হতো, যা খুব ব্যয়বহুল পদ্ধতি ছিল। ১৯৫৩ এবং ১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্যার এলেস্টার পিলকিংটন এবং যুক্তরাজ্যের কেনেথ বিকার স্টাফ প্রথম সফলভাবে বাণিজ্যিক উপায়ে গ্লাস তৈরি করতে সক্ষম হন। এতে তারা গলিত কাচকে এমনভাবে টিনের পাত্রে প্রেরণ করেন যাতে শুধু মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রয়োজন ছিল অর্থাৎ গলিত কাচ কোনো প্রকার বাধা না পেয়ে টিনের পাত্রে প্রবেশ করে নিজস্ব ওজনে ঠান্ডা হলে শক্ত গ্লাসে পরিণত হতো। ১৯৬০ সালে ফ্ল্যাট গ্লাস সম্পূর্ণ লাভজনকভাবে বিক্রয় অর্জন করে।

কাচ  তৈরির পদ্ধতি

ফ্ল্যাট গ্লাস বা সাধারণ কাচ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় সাধারণ বালু, সোডা ক্রাশ, ডোলামাইট, লাইমস্টোন এবং সল্টকেক ইত্যাদি। অন্যান্য কাঁচামালও ব্যবহার করা হয় কাচের রঙ পরিশোধন এবং ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ উন্নত করার জন্য। কাঁচামালসহ পুরনো ব্যবহৃত কাচ আনুপাতিক হারে মিশ্রিত করে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ফার্নেসে ১৫০০০ সে. তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়। সাধারণত ফ্ল্যাট গ্লাস ফার্নেসগুলো ৯ মিটার চওড়া এবং ৪৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে এবং ১২০০ টনেরও বেশি গ্লাস রাখার ক্ষমতা থাকে। একবার কাচ গলতে আরম্ভ হলে তা ১২০০০ সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত স্থির অবস্থায় রাখা হয় কাচের আপেক্ষিক গুরুত্ব সঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য।

গলিত কাচ প্রথমে টিনের তৈরি পাত্রে ঢালা হয়। টিনের পাত্রটি ৩ থেকে ৪ মিটার চওড়া, ৫০ মিটার লম্বা এবং ৬ মিটার গভীর হয়। কতটুকু গলিত কাচ টিনের পাত্রে ঢালা হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে একটি গেটের মাধ্যমে যাকে টুইল বলা হয়।

টিন সবচেয়ে ভালো পদার্থ ফ্ল্যাট গ্লাস তৈরির জন্য। কারণ টিনের আপেক্ষিক গুরুত্ব অনেক বেশি। আসঞ্জনশীর এবং অমিশ্রণযোগ্য গলিত কাচের জন্য। টিন স্বাভাবিক আবহাওয়ায় টিন-অক্সাইড তৈরি হয় এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এটি অপরিশোধিত অবস্থায় দৃঢ়ভাবে কাচ  লেগে থাকে যাতে অক্সিডেশন না হয় সে জন্য পজিটিভ প্রেসারে রাখা হয় নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন মিশ্রণ ব্যবহার করে।

গলিত কাচ যখন টিনের পাত্রের উপর ঢালা হয় তখন ভাসমান অবস্থায় তা ফিতার মতো মনে হবে। সে সময় কাচের উভয় তল মসৃণ থাকে ও গ্লাসের পুুরুত্বও সঠিক থাকে। গলিত কাচ  টিনের পাত্রে ঢালার পর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং ১১০০০ সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত উন্নীত হয়। টিন পাত্র থেকে রোলারে প্রবেশ করানোর পর গলিত কাচের তাপমাত্রা ৬০০০ সেন্টিগ্রেড থাকে। রোলারের গতি নিয়ন্ত্রণ করে গ্লাস শিট রোলার থেকে টেনে বের করা হয়। সে সময় গলিত কাচের পুরুত্ব এবং আয়তন নির্ধারণ করা হয়।

একবার গ্লাস শিট টিনের পাত্র থেকে ১০০ মিটার বের করার পর তা ধীরে ধীরে ঠান্ডা করা হয় যাতে তাপমাত্রা পরিবর্তনের জন্য কোনো স্থানে ফাটল না ধরে। সম্পূর্ণ ঠান্ডা হওয়ার পর তা ব্যবহার উপযোগী করে বিভিন্ন সাইজ অনুযায়ী মেশিনে কাটা হয়।

কাচের উপাদান ও বিভিন্ন ধরনের গ্লাসের ব্যবহার

যখন দানাদার সিলিকা (শক্ত খনিজ দ্রব্যবিশেষ) কোনো বিশেষ কাজের জন্য ব্যবহার করা হয় তখন স্বাভাবিক কাচকে গলানোর জন্য তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় ১২০০০ সেন্টিগ্রেডের উপর। সাধারণত অন্যান্য যৌগ ও দানাদার সিলিকার (বালু) সাথে মিশ্রিত করা হয় যাতে সহজেই কাচ  তৈরি করা সম্ভব হয়। সোডিয়াম কার্বনেট কাচ তৈরিতে তাপমাত্রা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কাচকে পানির মতো তরল করার জন্য সোডা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ক্যালসিয়াম অক্সাইড, ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড এবং গলিত অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডও মেশানো হয় যাতে রাসায়নিকভাবে বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে কাচ তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় যে কাচ তৈরি হয় এটাতে ৭০ থেকে ৭৪% বালু বিদ্যমান থাকে এবং এটাকে সোডালাইম গ্লাস বলা হয়। এই গ্লাসটি প্রায় ৯০% বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এ ছাড়া অন্যান্য উপাদান দ্বারাও কাচ তৈরি করা হয়। কাচের গুণাগুণ পরিবর্তন করে একে আরো মসৃণ এবং রিফ্র্যাকটিভ ইডেক্সকে 

বাড়ানো হয়। থোরিয়াম অক্সাইড গ্লাসের রিফ্র্যাকটিভ ইনডেক্সকে বাড়াতে সাহায্য করে। পূর্বে এই উপাদান ব্যবহার করে চোখের গ্লাসের লেন্স ব্যবহার করা হতো। অত্যাধুনিক চোখের চশমার জন্য থোরিয়াম অক্সাইডের স্থলে ল্যানথালাম অক্সাইড ব্যবহার করা হয়। লৌহজাতীয় যৌগও অনেক সময় কাচ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। গরম তাপ সহ্য করার জন্য অর্থাৎ তাপ ফিল্টারের জন্য বিশেষ করে যখন মুভি প্রজেক্টরে ব্যবহার করা হয়।

ফিউজ সিলিকা গ্লাস : এ ধরনের কাচ সাধারণত সিলিকন ডাই-অক্সাইড (SiO2) ব্যবহার করা হয়। এই কাচের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা তাপে প্রসারঙ্ক কম হয়। খুব শক্ত এবং উচ্চ তাপে (১০০০-১৫০০০ সে.) সহ্য ক্ষমতা বেশি। এ ধরনের কাচ  ফারনেসের টিউবে এবং কোনো দ্রব্য গলানোর জন্য যে পাত্রটি ব্যবহার করা হবে সেটি এই কাচ দ্বারা তৈরি করা হয়।

সোডালাইম সিলিকা গ্লাস বা জানালার কাচ : এই কাচ তৈরি করতে সিলিকা (বালু) ৭২% সোডিয়াম অক্সাইড ১৪.২%, ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড ২.৫%, লাইম ১০% এবং অ্যালুমিনা ০.৬% প্রয়োজন হয়। এই গ্লাস স্বচ্ছ। খুব সহজেই তৈরি করা যায় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় জানালার কাচ  হিসেবে কিন্তু তাপ সহ্য করার ক্ষমতা (৫০০-৬০০০ সে.)। এই কাচ সাধারণত জানালা, পাত্র, বাল্ব এবং টেবিলওয়্যারে ব্যবহার করা হয়।

সোডিয়াম বোরোসিলিকেট গ্লাস, পাইরেক্স : এই গ্লাস তৈরি হয় সিলিকা (৮১%), বোরিক অক্সাইড ১২%, সোডা ৪.৫%, এবং অ্যালুমিনা ২%-এর মিশ্রণে। এটা উচ্চ তাপ বহন করতে সক্ষম ও জানালার কাচ থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো। এ ধরনের গ্লাস সাধারণত গ্লাসওয়্যার, কুকিং গ্লাস, গাড়ির হেডলাইটের কভার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বোরোসিলিকেট গ্লাসের প্রধান উপাদান হচ্ছে সিলিকা এবং বোরন অক্সাইড। যার জন্য থার্মাল স্কট থেকে প্রাপ্ত গ্লাসগুলি ভেঙে যায় না। সাধারণত রি-এজেন্ট বোতল, গ্লাস জাতীয় দ্রব্যাদি এবং বাসায় রান্নাঘরের ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈরিতে এই কাচ ব্যবহার করা হয়।

লিড অক্সাইড গ্লাস, ক্রিস্টাল গ্লাস : এই গ্লাস তৈরি করতে সিলিকা ৫৯%, সোডা ২%, লিড অক্সাইড ২৫%, পটাশিয়াম অক্সাইড ১২%, অ্যালুমিনা ৪% এবং জিঙ্ক অক্সাইড ১.৫% প্রয়োজন হয়। এই গ্লাসের গুণাগুণের মধ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রিফ্র্যাটিভ ইনডেক্স রয়েছে, ক্রিসটাল গ্লাস তৈরি করা যায় যা দেখতে খুবই উজ্জ্বল, কারখানায় বেশি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তাপ সহ্য করার ক্ষমতা অনেক কম।

অ্যালুমিনোসিলিকেট গ্লাস : এই গ্লাস তৈরি করতে সিলিকা ৫৭%, অ্যালুমিনা ১৬%, বোরিক অক্সাইড ৪%, বেরিয়াম অক্সাইড ৬%, ম্যাগনেশিয়াম ৭% এবং লাইম ১০% দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। এই ধরনের গ্লাস সাধারণত ফাইবার গ্লাস, গ্লাস ইনফোর্সমেন্ট প্লাস্টিক (নৌকা, মাছ ধরার রড ইত্যাদি) এবং হ্যালোজেন বাল্বে ব্যবহার করা হয়।

অক্সাইড গ্লাস : এ ধরনের গ্লাস অ্যালুমিনা ৯০% এবং জারমেনিয়াম অক্সাইড (এবঙ৩) ১০% মিশ্রণে তৈরি হয়। এটি খুবই স্বচ্ছ কাচ এবং অধিকাংশ সময় ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশন ব্যবস্থায় ব্যবহার হয়ে থাকে। এ ধরনের ফাইবার অপটিকসের মাত্র ৫% লাইট ক্ষতি হয় প্রতি ১ কিলোমিটার ফাইবার গ্লাসের দ্বারা তৈরিকৃত তার দ্বারা।

প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top