বাংলাদেশের যে একটি সমৃদ্ধ ও গৌরবদীপ্ত ইতিহাস আছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ উয়ারী বটেশ্বর। শত শত বছর ধরে মাটির তলায় লুকায়িত ছিল বিপুল ঐশ্বর্যমন্ডিত বিখ্যাত এক সুপ্রাচীন নগরী। প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতাকে বুকে ধারণ করে রয়েছে উয়ারী-বটেশ্বর। প্রত্নতাত্বিক আবিস্কারটি শুধু এদেশেই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও যোগ করেছে নতুন এক মাত্রা। ইতিহাস খ্যাত এই এলাকাটি ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলার বেলাব থানায় অবস্থিত। এ স্থানটিতে যেতে প্রথমে নরসিংদী থেকে মারজাল যেতে হবে। সেখান থেকে সমতা বাজার। এই বাজারে রক্ষিত সাইনবোর্ডটি উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান জানান দেয়। উয়ারী-বটেশ্বর এক সাথে বলা হলেও আসলে এটি কিন্তু দু’টি গ্রাম। উভয় গ্রামেই খনন কাজ করা হয়েছে। খননকৃত এলাকাটিতে যেতে যেতে চোখে পড়বে মনোমুগ্ধকর গ্রামীন প্রাকৃতিক দৃশ্য। শান্ত, নীরব, ছায়াঘেরা গ্রাম দু’টির বেশ দুরে দুরে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাটির ঘর। গ্রামগুলোর বাড়িঘরগুলোও বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। চারপাশে দেখা মিলবে সবুজ গাছের সারি। জানা অজানা হরেক রকম গাছগাছালি ছাড়াও অনেক এলাকা জুড়ে রয়েছে লটকনের বাগান। এখানে প্রায় ১০ কিঃমিঃ জায়গা নিয়ে লুকিয়ে আছে অনন্য এক ইতিহাস। এই এলাকাটি মধুপুর গড়ের অংশ বিশেষ। এলাকাটিতে নানা ধরনের প্রত্নসম্পদ পাওয়ার শুরু ১৯৩৩ সাল থেকে। গৃহ নির্মান, হালচাষ, কুপ খনন, মাটি কাটা ইত্যাদি নানা উপায়ে পাওয়া গেছে প্রত্নসম্পদসমুহ। এই প্রত্নতাত্বিক নগরীটির আবিস্কার আমাদের অতীত ইতিহাস উদঘাটনের মাইলফলক।
২০০০ সালে প্রথম এর খনন কাজ শুরু হয় এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত এটির নয় দফা খনন কাজ চলেছে। এ কাজের পথিকৃৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি এই প্রত্নতত্বটির খনন কাজ পরিচালনা করেন। তিনিই প্রথম তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে খনন কাজ শুরু করেন। তবে ইতিহাস সমৃদ্ধ এই জায়গাটির আবিষ্কারক এলাকার ঐতিহ্যপ্রেমী স্কুল শিক্ষক প্রয়াত হানিফ পাঠান, যিনি উয়ারী-বটেশ্বরকে বিশ্ববাসীর সামনে নতুন করে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এই এলাকায় তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পুতিঁ, মুদ্রা, কুঠার, তৈজসপত্র ইত্যাদি খুজে পান এবং তা সংগ্রহ করেন। এ সব পুরাকীর্তির নির্মাণশৈলী দেখে অনুধাবন করেছিলেন এখানে এককালে কোন প্রাচীন নগরীর অস্তিত্ব ছিল। ১৯৩৩ সালে মাসিক মোহাম্মদীতে তিনি একটি নিবন্ধ লেখেন। এছাড়াও বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরতে থাকেন। তিনি ছাড়াও তার পুত্র হাবিবুল্লাহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। সে সময়ে (১৯৩৫-৩৬) প্রত্নতত্ববিদ এন কে ভট্টশালী এলাকাটি পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। পরে ক্যামব্রিজের প্রফেসর বিশিষ্ট প্রত্নতত্ববিদ দিলীপ কুমার চক্রবর্তী এই এলাকা ঘুরে যাবার পর এর প্রত্নতাত্বিক সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছিলেন। তিনি তার দক্ষিন এশিয়া সম্পর্কিত গবেষণায় গঙ্গার অববাহিকায় গড়ে ওঠা সভ্যতার ৪১ টি উপমহাদেশীয় নগরীর উল্লেখ করেছেন। তিনি তার লেখায় উয়ারী-বটেশ্বরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে পুরোনো ব্রক্ষপুত্র নদ এই এলাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায়, এখানে অতীতে একটি বিখ্যাত নদী বন্দর ছিল। সোনারগাঁয়ের পানাম নগরী ও বগুড়ার মহাস্থানগড়ও এই নদীর তীরেই ছিল। এসব কিছুই প্রমান করে যে, আসাম বা অন্য কোন দুরবর্তী অঞ্চলের সাথে পন্য দ্রব্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে এটি একটি প্রধান বন্দর ছিল। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর বানিজ্যে এ বন্দরের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। ঐতিহাসিকদের নিকট স্থানটির গুরুত্ব পাওয়া এবং প্রাপ্ত সব কিছুর প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে জায়গাটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল।
শুরু হলো খনন কাজ। অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকল এক অজানা সভ্যতার নতুন দিগন্ত। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাতব ও বস্তু বিজ্ঞান বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগ, জাবির ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ ভুতত্ব অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পরমানু গবেষণা কেন্দ্র ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দিপনার সাথে লেগে গেল ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার কাজে। একে একে বের হয়ে থাকল এক অনাবিষ্কৃত-অজানা সভ্যতা। অদ্ভুত সুন্দর পুঁতি, মুদ্রা, তাবিজ, চুন-সুড়কির রাস্তা, লেন, বাইলেন এক অজানা শহরের কথা তুলে ধরতে থাকে। ধারণা করা হয় এই এলাকাটি প্রাচীন কোন জনপদের রাজধানী ছিল। খননে একে একে বের হয়ে আসে অতীতে ব্যবহার্য নানা নিদর্শন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইনভারটেড ইটের স্থাপনা, অঙ্কিত মুদ্রা, পোড়ামাটির শিল্পকর্ম, ধাতব নিদর্শন, বাঘ, কচ্ছপ, হংস, ঘটদেবী, অ্যামলেট, হাত কুঠার, কূপ, মৃৎপাত্র, চুলা ইত্যাদি যা বহন করে এক সমৃদ্ধ অতীত সভ্যতার স্মারক। এখানে ৩২ x ১৮ ফুট আয়তনের ১২ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ইট দ্বারা নির্মিত একটি বিষ্ময়কর স্থাপনা পাওয়া গেছে। স্থাপত্যটি উপর থেকে নিচের দিকে ধাপে ধাপে ছোট হয়ে গেছে। যা দেখতে একটি উল্টানো পিরামিডের মত। এছাড়াও খননে ১৬০ কিঃমিঃ রাস্তাও পাওয়া গেছে।
গবেষক দল উয়ারী-বটেশ্বরের একটি ভুপ্রাকৃতিক মডেল তৈরী করেছেন। এতে দেখা যায়, পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদের তীরে সংশ্লিষ্ট এলাকার চারপাশে রয়েছে মাটির পরিখা, যা এটাকে একটি দূর্গ নগরী হিসেবে পরিচিতি করে। তাছাড়া এই এলাকায় একটি দূর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এখানে প্রাপ্ত মাটির মিসাইল এ সত্যতাকে আরও জোরালো ভিত্তি দিয়েছে। রুপার টাকা ও ধাতুর তৈজসপত্র থেকে এর প্রাচীনত্ব অনুমান করা যায়। এখানে প্রাপ্ত ধাতু ও পাথর থেকে ধারণা করা হয়, এখানে ধাতুর ব্যবসা ছিল। ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, গ্রিক ভুগোলবিদ টলেমি যে সোনাগৌড়ের (সৌনাগোড়া) কথা বলেছেন, বীর আলেক্সজান্ডার গঙ্গা নদীর তীরে যে মহাপরাক্রমশালী গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের কথা শুনে বাংলায় আক্রমন না চালিয়েই চলে যায় সেই অঞ্চলটিই এই উয়ারী বটেশ্বর। কারণ এ অঞ্চলে ইতিহাসখ্যাত গর্ত বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে, যা শুধু এদেশেই নয় ভারতীয় উপমহাদেশেও বিরল নিদর্শন। এটির আবিস্কার ইতিহাসবিদদের বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। তাছাড়াও খননে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের তৈরী ঘোড়া, কার্নেলিয়ান পাথরের তৈরী নেকড়ে বাঘসহ বিভিন্ন সামগ্রী এখানকার বিলুপ্ত পরাক্রমশালী ও সাহসী জাতির শৌর্য-বীর্য্যকে প্রমান করে। খননে প্রচুর পরিমান রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্বিকদের ধারণা তার কিছু মৌর্যযুগের এবং কিছু আরও পূর্বের খ্রীঃ পূর্ব ৬০০-৪০০ বছরের।
মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত নিদর্শনানুযায়ী, বাংলাদেশে জনবসতি গড়ে উঠেছিল প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। ধারণা করা হয় দ্রাবিড় ও তিববতীয় বর্মী জনগোষ্ঠী সে সময়ে বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং স্থানীয় ও বিদেশি শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। আর্য জাতির আগমনের পর খ্রিঃ ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল। এর ঠিক পরেই শশাঙ্ক নামে একজন স্থানীয় রাজা এই এলাকার ক্ষমতা দখলে নেন। প্রায় একশ বছরের অরাজকতা শেষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হয় এবং পরবর্তী চারশ বছর ধরে শাসন করে। এর পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। দ্বাদশ শতকে সুফি ধর্ম প্রচারকরা বাংলায় ইসলাম প্রচার করতে থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান এবং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
উয়ারি-বটেশ্বর থেকে ৪ কিঃমিঃ দুরে ধুপিরটেকে একটি পদ্মমন্দির (অনেকে মনে করে বৌদ্ধ মন্দির) আবিস্কৃত হয়েছে। আবিস্কৃত মন্দিরে লাল ইটে নির্মিত ৯ টি পদ্ম পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ৮টি পাপড়িযুক্ত একটি পদ্ম অক্ষত এথনও আছে। ধারণা করা হয়, এই ৮ টি পদ্ম বৌদ্ধধর্মের অষ্টমার্গের প্রতীক।
এখানে রয়েছে একটি প্রত্নতাত্বিক জাদুঘর। তবে তা ঠিক কোন সরকারী ভবনে নয়। এলাকায় পাঠান বাড়ি নামে পরিচিত মৃত হানিফ পাঠানের বাড়িতেই গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘরটি। এখানে রয়েছে উয়ারী-বটেশ্বরে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত নানান প্রত্নতাত্বিক প্রাচীন নিদর্শন। একমাত্র মনসামঙ্গলের পুঁথি, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পবিত্র কোরআন শরীফ, বেশ কিছু গয়না, মাদুলিসহ নানা রকম মাটির জিনিসপত্র। এলাকাটি আবিষ্কারের স্বপ্নদ্রষ্টা হানিফ পাঠানের ছবিও রয়েছে। বাড়ীর পাশেই পারিবারিক কবরস্থানে তার সমাধি রয়েছে। বর্তমানে তার ছেলে হাবিবুল্লাহ জাদুঘরটি দেখোশুনা করে।
উয়ারী-বটেশ্বরের চিহ্নিত ৪৮টি স্থানের মধ্যে মাত্র কয়েকটিতে খনন কাজ হয়েছে। এখনও খননের অপেক্ষায় রয়েছে বেশ কতকগুলো। এই এলাকাটি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানতে প্রয়োজন সব চিহ্নিত স্থানগুলোর খনন কাজ এবং দীর্ঘ গবেষণা। তবে খননকৃত জায়গাটি এখন ঢেকে রাখা হয়েছে। খুব শীঘ্রই আবার এর খনন কাজ শুরু হবে। তখন হয়ত বেরিয়ে আসতে পারে চমকপ্রদ নানা অনুষঙ্গ বা স্থাপনা। তবে সরকারী ও বেসরকারী সহায়তা ছাড়াও বিশাল এই এলাকাটির খনন কাজ সম্ভব নয়। এলাকাবাসী পুরাকীর্তিটির খননে স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহন করেছিল এবং তারাই স্থানগুলোর দেখভাল করে আসছে। সাধারণ মানুষ নিজেদেরকে এক গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকার ভাবছেন। তবে ইতিহাস যাই হোক এখনও এখানকার মানুষের মুখে বার বার ঘুরে ফিরে আসে এলাকাটি সম্পর্কে প্রচলিত অসম রাজার গল্প। নানী-দাদীদের কাছ থেকে শোনা গল্পটি প্রচলিত থাকবে হয়ত বা যুগের পর যুগ।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৩ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১২