সারা বিশ্বে নির্মাণ শিল্পে কংক্রিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ উপাদান। নির্মাণ প্রযুক্তি এবং নির্মাণ সামগ্রীর অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কংক্রিট বিষয়ক এক নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কংক্রিটকে আরো নির্মাণ উপযোগী ও শক্তিশালী করার জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। তাই বলা বাহুল্য যে, ভবিষ্যতেও নির্মাণ কাজে কংক্রিট শীর্ষ ভূমিকায় থাকবে। কংক্রিট প্রস্তুতির যত ধাপ আছে তার চ‚ড়ান্ত ধাপ কংক্রিটের কিউরিংকরণ। অনেক সময়ই দেখা যায়, বাড়ি নির্মাতার কিউরিং সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় অনেক টাকা খরচ করেও ভবন নির্মাণের সময় শক্তিশালী কংক্রিট পাওয়া যায় না। ফলে বহু আকাক্সিক্ষত বাড়িটির স্থায়িত্ব নির্মাণের সময়ই কমে যাচ্ছে।
কংক্রিট নির্মাণের সময় ব্যবহৃত সিমেন্ট ও পানির ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলে কংক্রিট শক্তিশালী হয় এবং কার্যক্রম ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত কংক্রিটের মধ্যে আর্দ্রতা বজায় থাকে। কংক্রিট ঢালাইয়ের ৩০ মিনিট পর থেকে কংক্রিট শক্ত হতে থাকে। এই সময় কংক্রিটের উপরের স্তর ক্রমান্বয়ে শুষ্ক হতে থাকে। তাই কংক্রিট ঢালাইয়ের ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর থেকে কিউরিং প্রয়োজন হয়। উৎকৃষ্ট মালামাল ব্যবহার এবং নিখুঁত ঢালাই করা সত্তে¡ও কিউরিংয়ের অবহেলায় কংক্রিট শক্তি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ঢালাইকৃত কংক্রিটের আর্দ্রতা বজায় রাখার প্রক্রিয়াকে পানি দ্বারা ভিজানো বা কিউরিং করা বলে। তাই সদ্য স্থাপিত কংক্রিট শক্ত হওয়ার জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। পানির সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে কংক্রিট জমাট বাঁধে। আর্দ্র ও অনুক‚ল তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার কাজ অব্যাহত থাকে। কংক্রিট শুকালে যে তাড়াতাড়ি শক্ত হবে এমনটি ধারণা করা ঠিক নয়। কংক্রিট তাড়াতাড়ি শুকালে ছিদ্রযুক্ত দুর্বল কংক্রিট পাওয়া যাবে। কংক্রিটকে শক্তিশালী করার জন্য কংক্রিটকে স্থাপন এবং কম্পাকশন করার পর কিছুদিন যাবত অবিরামভাবে আর্দ্র রাখা হয়। এই আর্দ্র রাখার পদ্ধতিকে কিউরিং (Curing) বলে। কংক্রিট স্থাপনের সময় সিমেন্টের পূর্ণ হাইড্রেশনের (hydration) জন্য এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি থাকে। কিন্তু উক্ত পানি রাসায়নিক ক্রিয়ার জন্য ধরে রাখা দরকার, যাতে কংক্রিটের শক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া চলতে পারে। আবার কংক্রিটের তাপমাত্রা যদি ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি হয়, তবে তার শক্তি কমে যায়। নিম্ন তাপে হাইড্রেশন আস্তে হয় এবং উচ্চ তাপে হাইড্রেশন ঘনীভূত হয় তাড়াতাড়ি। কিন্তু সঙ্কোচন বৃদ্ধির আশঙ্কা এত বেশি থাকে যে, কংক্রিট ফেটে যেতে পারে। সুতরাং কিউরিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাওয়ার হাত হতে রক্ষা করা, ত্বরিত সঙ্কোচনজনিত বিকৃতি ও অবাঞ্ছিত পীড়নের হাত হতে রক্ষা করা এবং ধীরে ধীরে চ‚ড়ান্ত শক্তি সঞ্চয়ে সাহায্য করা। কিউরিংয়ের কাজ কতদিন চলবে তা নির্ভর করে কংক্রিটের পুরুত্ব, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বাতাসের বেগের উপর। কমপক্ষে ৭ দিন কংক্রিট কিউরিং করা উচিত। ঠান্ডা আবহাওয়ায় সিমেন্ট ধীরে ধীরে জমাট বাঁধে বলে ১৪ দিন কিউরিং করা হয়। তবে ২৮ দিন পর্যন্ত কিউরিং করাই উত্তম।
কিউরিং পদ্ধতির ফলাফল (Effects of Curing method)
কিউরিং পদ্ধতি কংক্রিটের ঘনীভূত হওয়ার জন্য সর্বদা আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে। ফলে পানির সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে সিমেন্ট জমাট বাঁধে এবং কংক্রিট শক্তি অর্জন করে। যতক্ষণ কংক্রিটে পানি থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত কংক্রিটের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার পর পানির সাথে দ্রুত ক্রিয়া হ্রাস পায়। তাই কিউরিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কাজ। কংক্রিটকে অবিরাম আর্দ্র রাখার জন্য কিউরিংয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আর উত্তম কিউরিংয়ের উপর কংক্রিটের শক্তি অনেকাংশে নির্ভর করে।
উত্তম কিউরিং সুবিধা
- ক্ষয় প্রতিরোধ (Wear resisting) এবং আবহাওয়া প্রতিরোধ গুণাগুণ বৃদ্ধি করে
- কংক্রিটের অভেদ্যতা এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে
- সঙ্কোচন প্রবণতা হ্রাস করে
- ঘর্ষণ ক্ষয় (Abrasion) প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- জ্বালারোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
কিউরিং পদ্ধতি (Methods of Curing)
কাজের ধরন এবং জলবায়ুর অবস্থার উপর নির্ভর করে কিউরিং পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়। নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে কিউরিং করা হয়। যথা :
(ক) ঘের তৈরি করে
(খ) পৃষ্ঠদেশ আবৃত করে
(গ) পানি ছিটিয়ে
(ঘ) ছায়াময় করে
(ঙ) ঝিল্লি কিউরিং
(চ) বাষ্পীয় কিউরিং
ঘের পদ্ধতি(Ponding)
এটি সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি। আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রচলিত কিউরিং পদ্ধতি ঘের পদ্ধতি। আনুভূমিক তলে পানি জমা করে কিউরিং করা হয়। যেমন মেঝে, ছাদ, রাস্তা ইত্যাদি। কংক্রিট স্থাপনের পর প্রথমে ঈধহাধং দ্বারা পৃষ্ঠকে ঢেকে দেওয়া হয়। ২৪ ঘণ্টা পর আচ্ছাদন উঠিয়ে গাঁথুনি, আস্তর অথবা এঁটেল মাটি দ্বারা ছোট ছোট বর্গাকার বা আয়তাকার ঘের তৈরি করে তার মধ্যে পানি পূর্ণ করা হয়। এই পদ্ধতি উত্তম, তবে পানির প্রয়োজন হয় বেশি।
ছায়াময় করে (Shading)
এই পদ্ধতির প্রয়োগ খুবই সীমিত। এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য হলো কংক্রিটের বাষ্পীভবন প্রতিরোধ করে অবিরাম ভিজিয়ে রাখা। এটি তাপ, সরাসরি সূর্যকিরণ এবং বাতাস থেকেও কংক্রিট পৃষ্ঠকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ঠান্ডায় শেডিং (Shading) তাপ সংরক্ষণ করে সিমেন্টের বিক্রিয়ায় সাহায্য করে। তাঁবু টানিয়ে পানিরোধী কাগজ বা প্লাস্টিক বিছিয়ে বাষ্পীভবন প্রতিরোধ করা যায়।
পৃষ্ঠদেশ আবৃত করে (Covering of Surface)
এই পদ্ধতিতে বস্তা, ঘাস, খড়কুটা, কচুরিপানা ইত্যাদি দ্বারা আচ্ছাদিত করে মাঝে মধ্যে এটির উপর পানি ছিটিয়ে কিউরিং করা হয়। এই পদ্ধতি খাড়া এবং ঢালু পৃষ্ঠের জন্য বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। কিউরিং চলাকালে অল্প সময়ের জন্যও শুকাতে দেওয়া উচিত নয়।
পানি ছিটিয়ে (sprinkling Wate)
এই পদ্ধতিতে কিউরিং করতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। এতে নির্দিষ্ট সময় পর পর পানি কংক্রিটের উপর ছিটিয়ে দেওয়া হয় এবং কখনও পৃষ্ঠকে শুকাতে দেওয়া উচিত নয়।
ঝিল্লি কিউরিং (Membrane curing)
পানিরোধী মেমব্রেন দ্বারা কংক্রিট পৃষ্ঠকে আচ্ছাদিত করে এই প্রকারে কিউরিং করা হয়। এক সপ্তাহ ধরে এই কাজ করা হয়। কংক্রিটের বাষ্পীভবন প্রতিরোধ করাই এই কিউরিংয়ের উদ্দেশ্য। মোমের ইমালশন, বিটুমিনের ইমালশন, বিটুমিনের পানিরোধী কাগজ এবং প্লাস্টিক শিট ইত্যাদি সাধারণ মেমব্রেন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটা সিলিং কম্পাউন্ড (Sealing Compound) হিসেবেও পরিচিত। আর্দ্র কিউরিংয়ের চেয়ে এই পদ্ধতিতে কিউরিংয়ে কংক্রিটের শক্তি কম হয়।
বাষ্পীয় কিউরিং (Steam Curing)
আমাদের দেশে বাষ্পীয় কিউরিংয়ের প্রচলন কম। ছোট ছোট প্রি-কাস্ট মেম্বারে জলীয় বাষ্প প্রয়োগ করে স্বল্প সময়ে কিউরিং করা হয়। ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় কিউরিং কাজ ত্বরান্বিত হয়। এই কিউরিংয়ের জন্য পানির স্প্রে ব্যবহার করা হয়।
সুবীর কুমার
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২