যিনি বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যকলার নতুন এক যুগের স্র্রষ্টা, যিনি এই স্বপ্নকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়, তিনি স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। পথিক যেমন দেখায় পথের সন্ধান, তেমনি তিনি দেখিয়েছেন অভিনব স্থাপত্য সৃষ্টির কৌশল। তার হাত ধরেই প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল এ দেশে বিশ্বমানের সব স্থাপত্য কর্ম। স্থানকালভেদে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, দেশীয় উপকরণের বিন্যাস, খোলা প্রান্তর, বাহুল্য বর্জন স্থাপত্যকলায় এ সবকিছুই করেছেন তিনিই প্রথম। তিনি স্থাপত্যকে ইট, কাঠ, লোহায় সীমাবদ্ধ না রেখে বেঁধেছেন প্রকৃতির বন্ধনে, যা মানুষের মনকে করে আন্দোলিত, এনে দেয় প্রশান্তির পরশ। যুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্থাপত্যকে সাজিয়েছেন নান্দনিক শৈল্পিকতার রূপধারায়। বিশ্বের দরবারে এ দেশের নান্দনিক স্থাপত্য চিন্তাকে তুলে ধরেছেন আপন মহিমায়।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুরে নানাবাড়িতে। পিতা ওমদাতুল ইসলাম ও মা মিসেস জাকিয়া খাতুন। স্ত্রী সালমা ইসলাম, দুই ছেলে স্থপতি রফিক মাজহার ইসলাম ও তানভীর মাজহার ইসলাম এবং ১ মেয়ে ডালিয়া নওশীনকে নিয়ে তার পরিবার। বাবা ছিলেন সরকারি কলেজের গণিতের অধ্যাপক। চাকরি সূত্রে শিক্ষকতা করেছেন বিভিন্ন সরকারি কলেজে। তবে পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কৃষ্ণনগরে কেটেছে তার বাল্যকাল। ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পড়তেন কৃষ্ণনগর স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে পিতা বদলি হন রাজশাহীতে। ভর্তি হন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। এখান থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। এর পর রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক এবং পরবর্তীতে একই কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর পর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য পাড়ি জমান কলকাতায়; ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৪৬ সালে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করেন কর্মজীবন। পূর্ব পাকিস্তানের কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং অ্যান্ড ইরিগেশন (সিবিঅ্যান্ডআই) মন্ত্রণালয়ে সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু করেন কর্মজীবন। কিন্তু বেশিদিন এ চাকরি না করে বন্ধু প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সাথে নিয়ে স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ‘বাস্তুকলাবিদ’ গড়ে তোলেন।
১৯৫০ সালে মাজহারুল ইসলাম উচ্চ শিক্ষার্থে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ভর্তি হন ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি যখন দেশে ফিরে আসেন তখন সর্বত্র চলছিল ভাষা দাবিতে স্বাধিকার আন্দোলন। তখন থেকেই তিনি চাইতেন দেশের জন্য কিছু একটা করতে। দীর্ঘদিনের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যখন দেশে চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন তিনি এই প্রতিষ্ঠানটির ডিজাইন করতে উদ্যোগী হন। ১৯৫৩ সালে শুরু হয় এর নির্মাণ কাজ। ছয় মাস একটানা পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে তোলেন আধুনিক এক স্থাপনা, যা এ দেশের মানুষ ভাবেনি আগে। আধুনিক স্থাপত্যকলা ইউরোপে অনেক আগেই বিস্তার লাভ করলেও বাংলাদেশের মাটিতে আধুনিক স্থাপত্যশৈলী ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত ও উপেক্ষিত। কেননা এ দেশে তখনও স্থাপত্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়নি। তাই ঢাকাতে আধুনিক স্থাপত্যের তেমন কোনো নিদর্শন ছিল না বললেই চলে। যদিও আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, সোনারগাঁসহ কতিপয় জায়গায় মুঘল স্থাপনার বেশ খ্যাতি ছিল। কিন্তু তা আধুনিক স্থাপত্য নিদর্শন ছিল না। ভিন্নধর্মী লাল রঙের ইটের গাঁথুনিতে পলেস্তারাবিহীন দেয়াল, ঝুলন্ত সিঁড়ি, সাদাসিধে স্থাপত্যিক তাক, কাঠের ফ্রেম, কাচ ও জালির কাজের পুনঃ পুনঃ ব্যবহারের মাধ্যমে চারুকলার নবনির্মিত ভবনটি হয়ে ওঠে একেবারে আনকোরা। সে সময়ে এ জায়গাটি ছিল প্রচুর গাছপালায় ঘেরা। ফলে স্থাপত্যটি নির্মাণে তার মাথায় খেলা করে কবিগুরুর ‘বাগানের মাঝে বাড়ি’র চিন্তাটি। তিনি কোনো গাছপালা না কেটে ছবির মতো করে সাজিয়েছেন এই ইনস্টিটিউটটিকে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। তবে বিপত্তিও কম পোহাননি। ইনস্টিটিউটটির জন্য নির্ধারিত জমির সার্ভে ম্যাপ তৈরি করার সময় তিনি প্রতিটি গাছের অবস্থান নির্ধারণ করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন এবং বিভিন্ন গাছের চিহ্ন এঁকে দেন। অবশ্য এ নিয়ে প্রকৌশলী মহলে তাকে যথেষ্ট বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরনের নানা প্রতিক‚ল পরিস্থিতির মধ্যে গতানুগতিকতার বাইরে এ দেশে আধুনিক স্থাপত্যের উন্মেষ ঘটান প্রথাবিরোধী স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। এ ছাড়াও প্রায় সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভবনের ডিজাইনও করেন। তার এই অসাধারণ শিল্পকর্ম নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক এবং ডিন স্থপতি শামসুল ওয়ারেস বলেন, ‘সৃষ্টিশীল ডিজাইনের মাধ্যমে মাজহারুল ইসলামই আধুনিক স্থাপত্যের সাথে দেশকে পরিচয় করিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তার সৃষ্টকর্ম পরবর্তী প্রজন্মের স্থপতিদের উৎসাহ জুগিয়ে যাবে বহুকাল।’
১৯৫৬ সালে মাজহারুল ইসলাম ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে বৃত্তিলাভ করেন এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডনের এএ স্কুল অব আর্কিটেকচারে (AA School of Architecture) ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচার বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নেন। সেখান থেকে ফিরে ১৯৬০ সালে যান যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে (Yale University)। সেখানে ১৯৬১ সালে বিখ্যাত স্থপতি পল রুডলফের অধীনে মাস্টার্স করেন। এই ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ই মাজহারুল ইসলামের জীবনকে পাল্টে দেয়। সেখানে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেন জগতখ্যাত স্থপতি লুই কানের এবং ধীরে ধীরে তিনি তার প্রিয় ছাত্রও বনে যান। তিনি লুইয়ের দর্শন, আদর্শ ও কাজের প্রতি ভালোবাসা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। সে সময়েই তিনি আরেক খ্যাতনামা স্থপতি পল স্ট্যানলি টাইগারম্যানকে তার অন্যতম সহপাঠী ও বন্ধু হিসেবে পেয়ে যান। এ সবের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন মনে-প্রাণে একজন খাঁটি স্থপতি।
পাকিস্তানের নাথিয়াগলিতে ১৯৫৯ সালের ১২ ও ১৩ জুন ঐতিহাসিক গভর্নেন্স কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানেই ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের ২য় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং মুখ্য কার্যালয় হিসেবে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে মাজহারুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পূর্তমন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে ইসলামাবাদে ডেকে পাঠান এবং ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানী শহরের মাস্টার প্লান ও ডিজাইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা তৈরির দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয়। কিন্তু মহান এই স্থপতি নিজে সেটি না করে তার প্রিয় শিক্ষক লুই কানকে কাজটি করার প্র্রস্তাব দেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন জাতীয় সংসদ ভবনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য প্রখ্যাত কানই পারবেন বিশ্বসেরা স্থাপত্যে রূপ দিতে। যুগে যুগে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই স্থাপনা দেখে অনুপ্রাণিত হবে এবং এটিই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে। মাজহারুল ইসলাম বিশ্বসেরা এই স্থপতিকে তার অনেক ব্যস্ততা সত্তে¡¡ও এ দেশে আনতে সক্ষম হন। বড় মাপের মানুষের মনও যে বড় হয়, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এ ধরনের একটি স্থাপত্যের কাজ থেকে বিরত থেকে সেটাই প্রমাণ করেছেন। তবে সংসদ ভবনের স্থপতি লুই কান হলেও তিনি যাবতীয় সাহায্য সহযোগিতা করেছেন এটি নির্মাণে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি শেখ আহসান উল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘তাঁর স্থাপত্য প্রতিটি মানুষকেই আন্দোলিত করে। তিনি যে শুধু স্থাপত্য চর্চা করেছেন তা নয়, কিভাবে তা মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় সেভাবেই স্থাপত্য ডিজাইন করেছেন। এ ছাড়াও গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন সংগঠন। তিনি কাজ করেছেন দেশের জন্য। সে প্রেক্ষিতেই সংসদ ভবনের মতো বিখ্যাত স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে। তার প্রতিটি কাজই স্থপতি তথা সব ধরনের মানুষকে উৎসাহিত করে।’
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্থাপত্যের হাল ধরেন মাজহারুল ইসলাম। কারণ সময়টাই ছিল দেশকে এগিয়ে নেওয়ার। কিন্তু তিনি জানতেন দেশটা গরিব। চিন্তা করেন স্থাপত্যের মতো একটা ব্যয়বহুল খাতকে কিভাবে স্বল্প খরচে, বাহুল্য বর্জন করে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আবাসন কাঠামো তৈরি করা যায়। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের প্রকৃতি, জলবায়ু, আলো-বাতাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং তার সাথে পাশ্চাত্য ধারার আধুনিক স্থাপত্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিভাবে স্থাপত্য গড়া যায় সে বিষয়টিও তিনি গভীরভাবে চিন্তা করেন। অতীত কাজের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একের পর হাত দেন নান্দনিক স্থাপনায়। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ, জয়পুরহাট চুনাপাথর খনি ইত্যাদি স্থাপনায় যেখানে ফুটে উঠেছে প্রকৃতি ও স্থাপত্যের এক নিবিড় বন্ধন। এ ছাড়া তিনি ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমির ভবন ডিজাইনের জন্য আমেরিকার বিখ্যাত স্থপতি ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের তৎকালীন প্রধান পল রুডলফকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন এবং রুডলফ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কাজের স্বাক্ষরও রাখেন। এ ছাড়াও সায়েন্স ল্যাবরেটরি (বিসিএসআইআর) কমপ্লেক্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের নিপা ভবন, স্থপতি স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে যৌথভাবে ৫টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ডিজাইন করেন। এসব স্থাপত্য পেয়েছে এক আদি ও অকৃত্রিম রূপ। এগুলো মিশে একাকার হয়েছে প্রকৃতির আপন কোলে। তিনি তার স্থাপত্যিক ডিজাইনে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এমনকি আধুনিক স্থাপত্যের মহান গুরু ডল কর্ব্যুসীয়রের প্রত্যক্ষ প্রভাবও তার এসব সৃষ্টিতে রয়েছে। ভূসংলগ্ন নিচতলায় খোলা জায়গা, চতুষ্কোণ ঘনক্ষেত্র বিশিষ্ট (কিউবিক) ভবনের গঠন, অবাধ মুক্ত স্তম্ভের ব্যবহার, ভারমুক্ত বিভাজক দেয়াল, কংক্রিটের কাঠামো, সমতল ছাদ, বৈচিত্র্যময় সিঁড়ি এবং বিশেষ করে সূর্যের প্রখরতা কমাতে উদ্ভাবিত লুভ্যার (Brise-soleil) যেন এক মহান ও আদর্শ সৃষ্টিরই বহির্প্রকাশ। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ক্ষেত্রেও এ প্রভাব লক্ষণীয়। মাটির কাছাকাছি নিচু ছড়ানো (একতলা ও দোতলা বিশিষ্ট) ভবন, ঝুলন্ত সিঁড়ি অবাধ প্রকৃতির মাঝে বিচরণ ক্ষেত্র এ সবই তার মনোরম সৃষ্টি। লাইব্রেরি ভবনে চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলামের দেয়ালচিত্র, বহিরাঙ্গনে ভাস্কর নভেরা গওহরের আধুনিক ভাস্কর্য সংযোজন তার শিল্পী মনেরই বহির্প্রকাশ। এসব কর্ম মানুষের মাঝে ঘটায় চেতনার উন্মেষ, যা দেশের শিল্পকর্মের সমন্বয়ে উন্নত পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা উন্মোচিত করে। মাজহারুল ইসলাম মনে করতেন এ দেশের সুষ্ঠু স্থাপত্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে চোখের সামনে কিছু বিখ্যাত স্থাপত্য থাকতে হবে, যা এ দেশের স্থপতিদের চিরকাল অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস জোগাবে। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান আবু সাইদ মোস্তাক আহমেদ মনে করেন, ‘তিনি শুধু এ দেশেরই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ স্থপতি। তিনি তার স্থাপত্যে ব্যয়বহুল বিদেশি উপাদান পরিহার করে সব সময় দেশীয় উপাদানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তার স্থাপত্যে যে মূলধারা, ব্যাকরণ, প্রাকৃতিক দানের ব্যবহার ও জলবায়ু সহিষ্ণুতা রচনা করেছেন তা দেখে তরুণ স্থপতিরা দারুণভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবে।’
নিজ দেশের প্রতি যদি কারও ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা ও কিছু দেওয়ার প্রত্যয় থাকে তা হলেই যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করা সম্ভব। এই বিশ্বাসটাই প্রবলভাবে ছিল স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মনে। তিনি তার স্থাপত্যকর্ম শুধু ভবনেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রকৃতি ও স্থাপত্যের মিশেল ঘটিয়ে তাকে করে তুলেছেন জীবন্ত। তাই জীবনে অর্জন করেছেন বিরল সম্মান, খ্যাতি, স্বীকৃতি ও মানুষের ভালোবাসা। তার জীবনটাও পেয়েছে রংধনুর রঙের মতোই বৈচিত্র্যময়তা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৫৩-৫৪ সালে আহসানউল্লাহ কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে স্থাপত্য অনুষদ চালু করার ক্ষেত্রে তার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। ১৯৫৮-৬৪ পর্যন্ত ছিলেন পাকিস্তানের সিনিয়র অর্কিটেক্ট। ১৯৬১ সালে স্টেট অব কনটেম্পোরারি আর্কিটেক্চার ইন ইউরোপ কর্তৃক রকিফেলার ফেলোশিপ অর্জন করেন। ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন বুয়েটের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য। ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট পাকিস্তানের সভাপতি পদে নিযুক্ত ছিলেন। তার উদ্যোগেই ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠে এ দেশের একমাত্র স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৭২-৭৫ ও ১৯৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে জেনেভাতে প্রথম আগা খান পুরস্কারের সম্মানিত বিচারক এবং পরবর্তীতে জাকার্তা, জর্ডান, কায়রো, মরক্কো ও ঢাকার একজন সম্মানিত সদস্য ও মাস্টার জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮১ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ডিজাইন নির্বাচনে বিচারক ছিলেন। ১৯৯৩ সালে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস, বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণ পদক লাভ করেন। এ ছাড়াও চেতনা নামক একটি আর্কিটেচারাল স্টাডি গ্রæপ গড়ে তোলেন এবং ১৯৯৬ সালে এর সভাপতি নিযুক্ত হন। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে তার কর্মের উপর প্রদর্শনী হয়। ১৯৯৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস, ইনস্টিটিউট অব ডালাস, টেক্সাস ইত্যাদির সম্মানিত ফেলোশিপ অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিজয় স্তম্ভের সেরা ডিজাইন নির্বাচনে জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ইস্তাম্বুলে ফয়সাল মসজিদ, জেদ্দায় ইসলামি ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, রিয়াদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হেডকোয়ার্টার ভবনসহ বিভিন্ন ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে অংশ নেন। ভারতের জে কে সিমেন্ট আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড এবং জয়পুরে আয়োজিত সাউথ এশিয়ান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে স্থাপত্য শিল্পে শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য ‘গ্র্যান্ডমাস্টার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০০৫ সালে মাজহারুল ইসলামের ৮২তম জন্মদিন উপলক্ষে তার জীবনী ও কাজ নিয়ে স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের পরিচালনায় একটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম ‘তিনি’ (The Architect) নির্মিত হয়। ফিল্মটি ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ থেকে মুক্তি পায়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা, আর্কিটেকচার রিভিউ পত্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা পত্রিকায় তাকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নানা প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে তিনি তার স্থাপত্য বিষয়ক স্মারক বক্তৃতা দিয়েছেন। এ ছাড়াও আয়োজিত নানা সেমিনারেও তিনি অভিসন্দর্ভ উপস্থাপন করেছেন।
এক সৃতিচারণে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভিাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন,
বিস্ময়ের এই মহান মানবের একক হাতেই সৃষ্টি হয়েছে এ দেশের বিস্ময়কর স্থাপত্যিক সৃষ্টিকর্ম। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন আধুনিক হয়ে উঠছে তার সব স্থাপনা। দেশের প্রতি ভালোবাসা, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, ভবিষ্যৎ স্থপতিদের জন্য একটি আদর্শ পথ রচনা এ সবকিছু থেকেই তিনি তার সকল স্থাপত্য ডিজাইন করেছেন। সৃষ্টির পাশাপাশি দেশপ্রেম, রাজনৈতিক, সামাজিক চিন্তাচেতনায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন দার্শনিক হিসেবে। তিনি সব সময় বলতেন, ‘নিজের কাছে সৎ থাকো, দেশকে ভালোবাসো, দেশের সমস্যাগুলোকে ভালোবেসে সমাধান করো।’ স্থপতিরা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছু দেবে এটাই তার ছিল চাওয়া। পৃথিবীর মায়া এই মহামানবকে আর বেঁধে রাখতে পারেনি। গত ১৫ জুলাই ৮৯ বছর বয়সে মারা যান দেশবরেণ্য এ স্থপতি। মানুষটি আর নেই। তবে রয়ে গেছে তার স্থাপত্য। এ দেশের প্রকৃতিঘেরা আধুনিক ভবনগুলো মাথা উঁচু করে বলবে, ‘কে বলেছে তুমি নেই, তুমি বেঁচে থাকবে এ দেশের স্থাপত্যে, এ দেশের মানুষ ও স্থপতিদের হৃদয়ে।’ গুণী এ মানুষটির প্রতি বন্ধন পরিবার জানাচ্ছে বিনম্র শ্রদ্ধা।
স্থাপত্য কর্ম
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা (১৯৫৩-৫৪)
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভবন (১৯৫৩-৫৪)
- খিলগাঁও রেলওয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প, ঢাকা (১৯৬৩-৬৪)
- নতুন রাঙামাটি শহর পরিকল্পনা, রাঙামাটি (১৯৬৩-৬৪)
- চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য আবাসন প্রকল্প, আজিমপুর, ঢাকা (১৯৬২)
- বিসিএসআইআর লাইব্রেরি ভবন, ঢাকা (১৯৬৩-৬৫)
- নিপা ভবন, ঢাকা
- কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, মতিঝিল, ঢাকা (১৯৬৫-৭১)
- ২৭তলা জীবন বীমা ভবন, মতিঝিল, ঢাকা (১৯৬৫-৭১)
- রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশালের জন্য পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (১৯৬৫-৭১)
- সড়ক গবেষণা পরীক্ষাগার, ঢাকা (১৯৬৫-৭১)
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার প্লান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন (১৯৬৮-৭১)
- রূপপুরে আণবিক শক্তি কমিশনের আবাসন প্রকল্প (১৯৬৮-৭১)
- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার প্লান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন (১৯৬৮-৭১)
- জয়পুরহাট কয়লা ও সিমেন্ট প্রকল্প (১৯৮০-৮৪)
- জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভ ভবন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা (১৯৮০-৮৪)
- বিশ্বব্যাংক অফিস ভবন, ঢাকা (১৯৮৭)
- ২০ তলা ‘গার্ডেন সিটি’ প্রকল্প, ঢাকা (১৯৯৫)
মারুফ আহমেদ
তথ্য সূত্র
উইকিপিডিয়া, মাজহারুল ইসলামের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট, স্থপতিদের মন্তব্য ও দেশ-বিদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত তার সাক্ষাৎকার।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২