আবিষ্কারের উৎকর্ষতার এ যুগে অসম্ভব বলে যেন কিছুই নেই। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিকেরা ইট-বালু-সিমেন্ট মাথায় নিয়ে নিচ থেকে উঁচু উঁচু ভবনের তলায় যেত। যদিও তা একেবারে বন্ধ হয়নি কিন্তু দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজে যুক্ত হয়েছে সহায়ক নানা যন্ত্রাংশ, যেগুলোর সাহায্যে নির্মাণকাজ হয়ে উঠেছে আরও সহজ ও দ্রুত। তবে সম্প্রতি এ কাজে নতুন আরও একটি প্রযুক্তি যুক্ত হতে যাচ্ছে, সেটি ‘রোবট’, যা স্থাপত্য ও নির্মাণকাজে এনেছে ভিন্ন এক মাত্রা।
একবার ভাবুন তো আপনার ভবনের দেয়াল কিংবা ছাদটি নিখুঁত উপকরণের মাধ্যমে নকশা অনুযায়ী সুনিপুণ ও নির্ভুলভাবে করে দেবে রোবট। বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ হলেও আমাদের কাছে নিশ্চয় তা বিস্ময়কর। কারণ, এমনটা হয়তো আমাদের দেশে ভাবার সময় এখনো আসেনি। গত বছর (২০১৫) ভিয়েনায় একটি Rob/Arch Conference-এ এমনই দৃশ্য দেখা গেছে। এটিই কিন্তু প্রথম নয়, নির্মাণে রোবটিক প্রযুক্তির সংযোজন আগেও ছিল অল্পবিস্তর। বর্তমানে বিশ্বের উন্নত বেশ কয়েকটি দেশে প্রচলন রয়েছে বিশেষ এই পদ্ধতির। স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মাঝে যা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টা কিন্তু এখানেই থেমে নেই। রোবটিক নির্মাণ-বিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রির ব্যবস্থাপনাও যুক্ত হয়েছে এতে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্প সময়ে অনেক বড় বড় নির্মাণকাজ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নির্মাণের পুরো বৈজ্ঞানিক ব্যাপারগুলো (ড্রয়িং-নির্মাণ উপকরণ, কৌশল ইত্যাদি) রোবটের মধ্যে ইনপুট করা হয়। অর্থাৎ কম্পিউটারের মতো করে নির্দেশনা দেওয়া হয়, বাকিটা শুধু দেখার বিষয়। আর এভাবেই এগিয়ে চলেছে নতুন বিশ্বের নতুন স্থাপনা নির্মাণযজ্ঞ। যদিও বর্তমানে এমন প্রকল্প বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কারখানায় প্রস্তুত করা হয়। বিভিন্ন ধরনের মডিউল তৈরির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন এর উন্নয়নে।
জাপানের বিখ্যাত কোম্পানি Fujitsu বায়োমেট্রিক চিহ্নিতকরণের জন্য এবং দৈহিক নিরাপত্তার জন্য বাজারে এনেছে পামসিকিউর (Palmsecure) নামক বৈজ্ঞানিক যন্ত্র, যার মাধ্যমে মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্তনালির প্রবাহ, গতিপথ রূপরেখা চিহ্নিত করা যায় সহজেই। এভাবেই বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে সময় আর বিজ্ঞানকে যুগলবন্ধী করে।

ভাবতে অবাক লাগে, ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের Wysing Art Center যখন পুরো ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াবে, তখন কেমন লাগবে ব্যাপারটা। স্থপতি ও প্রকৌশল বিজ্ঞানীরা এমনই চলমান একটি স্থাপনা নির্মাণ করেছেন কেমব্রিজে, যেখানে সোলার সেলের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ছোট একটি উইন্ড মিল। যেখানে রয়েছে চলমান বৃষ্টির পানি ধারণ করতে সক্ষম কম্পোজিট টয়লেট, CO2 Neutral Heating System চলমান, যা ছয়টি পা সমৃদ্ধ। এটি যৌথভাবে নির্মাণ করেছে MIT এবং Danish Design Collective N55। স্থাপনাটি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে মানুষের মতো চলতে পারে। 3 GPS Program সংবলিত এ স্থাপনাটি সামনে-পেছনেও বাঁক নিতে সক্ষম।
কাল যা ছিল স্বপ্ন, আজ তা বাস্তব। সত্যিই বিস্ময়কর এ আবিষ্কার! সব থেকে বড় বিষয় আবিষ্কারের পেছনের মানুষগুলোর চিন্তাভাবনা। কারণ, নতুন চিন্তার সঞ্চালন না হলে নতুন আবিষ্কারের নেশা থাকে না, হয় না নতুন কিছু।
সাধারণ স্থপতিরা যখন পুরানো দিনের স্থাপনার নির্মাণ উপকরণ পুনর্ব্যবহারে বেশি আগ্রহ দেখান, তখনই ‘Decker’-এর মতো স্থাপত্যের বিজ্ঞানীরা চিন্তা করছেন নতুন কোনো উপকরণ তৈরির, যা কিনা ফসিল ফুয়েল ব্যবহার কমাতে সক্ষম, যা স্থাপনাকে করবে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে এমন একটি Facade Screening System-এর উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে, যা কিনা কোনো বাহ্যিক অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন ছাড়াই অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। যেমন ধরা যাক, যদি ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা ছাড়ায় তাহলে Screening (পর্দা)টি আপনাআপনি খুলে যাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে। কারণ, মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রার রূপরেখাটি সেখানে আগে থেকেই দেওয়া আছে। অতি শীতে ঘরের অভ্যন্তরীণ সুনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার জন্য বিশেষ এই পর্দাটি ব্যবহৃত হবে তাপ উৎপাদনকারী উপকরণ হিসেবে। সেখানে ব্যবহৃত হবে সৌরশক্তি। ঘরের জানালায় যে কত কী হতে পারে? অবাক করার মতো বিষয়, এমনকি এমন সব কাচ বর্তমানে আবিষ্কৃত হচ্ছে, যা সারা দিনের সৌরশক্তিকে ধারণ করতে সক্ষম, যা পরে বাতি জ্বালাতে, টেলিভিশন যন্ত্রাংশ চালাতে এমনকি ঘরের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। স্থাপত্য এবং প্রকৌশলবিদ্যার সঙ্গে বিজ্ঞানকে সমন্বিত করতে না পারলে নির্মাণশিল্পে আরও নতুন কিছু পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। আর তাই বর্তমান যুগে অনেক স্থপতি ও প্রকৌশলী বিজ্ঞানের সঙ্গে স্থাপত্যচর্চায় মেলবন্ধন স্থাপন করছেন প্রতিনিয়ত।

ওপরের ঘটনাগুলো এই জন্য বলা, কারণ এবার আমরা চোখ ফেরাব আমাদের নিজেদের দিকে। আমাদের শহরের দিকে তাকালে সহজেই দেখতে পাই ধুলা মিশ্রিত বাতাস, যানজট, বিশেষ করে ঢাকা শহরে বছরের পর বছর ধরে ফ্লাইওভার তৈরির প্রকল্প, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, এমনকি কোনো নিয়মশৃঙ্খলা ছাড়াই সাধারণ জনগণকে দিনের পর দিন কষ্ট মানিয়ে জীবনযাপনে বাধ্য করা আমাদের এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে স্থাপনা নির্মাণে দীর্ঘমেয়াদি পুরোনো আমলের নির্মাণপদ্ধতি সময়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েক গুণ। অথচ আমরা একটু ইচ্ছা করলেই খুব সহজে এগুলোর পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারি। জনসাধারণের কথা চিন্তা করে অযাচিত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করে স্বল্প সময়ে স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ করতে পারি। যেখানে বিশ্ব এগিয়ে চলছে উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে। সময়ের সঙ্গে সেখানে আমরা এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছি আমাদের স্বপ্ন চিন্তার পরিধিতে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন খুব সহজে দেশীয় নতুন কোনো টেকসই প্রযুক্তি ও পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা টেকসই উন্নতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারব সহজেই।
– স্থপতি সজল চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬