মাথায় হলুদ হেলমেট, গায়ে উজ্জ্বল কমলা রঙের জ্যাকেট, পায়ে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত গামবুট পরা কাউকে অনেক দূর থেকে চলাচল করতে দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারে, ওখানে চলছে কোনো নির্মাণকাজ। যদিও বাংলাদেশে নির্মাণশ্রমিকেরা নিরাপত্তার ব্যাপারে এতটা সচেতন নয়, তারপরও এখন অনেক নির্মাণ সাইটের সাধারণ দৃশ্য কমবেশি এ রকমই বলা যায়। তবে এ রকম দৃশ্য আর বেশি দিন থাকছে না। মাথার ওপর বনবন করে চক্কর দেবে মানববিহীন ড্রোন, নির্মাণশ্রমিকের বদলে কাজ করবে কম্পিউটারচালিত বা দূরনিয়ন্ত্রিত বিশাল বিশাল সব রোবটিক যন্ত্র। স্বয়ংক্রিয় বুলডোজার আর থ্রি-ডি প্রিন্টার তৈরি করবে আকাশচুম্বী বহুতল ভবন।
প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে এসব আর কল্পনার বিষয় নয়। বর্তমানে প্রচলিত মানব শ্রমনির্ভর নির্মাণপ্রক্রিয়াকে দূরে ঠেলে দিয়ে সম্প্রতি আমেরিকান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘স্কাইক্যাচ’ তাদের কিছু কিছু প্রকল্পে ড্রোনের ব্যবহার শুরু করেছে। বাণিজ্যিক জটিলতার কারণে অবশ্য তারা এই ড্রোনের নতুন কোনো নামকরণ করেনি। ড্রোন ব্যবহার করে তারা বাড়তি কিছু সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। যেমন- তারা খুব সহজে প্রকল্পটিকে পাখির চোখে (Birds Eye View) পর্যবেক্ষণ করতে পারছে। নিচ থেকে প্রকল্পের অগ্রগতি যতটা না বোঝা যায়, তার চেয়ে ড্রোন ব্যবহার করে ওপর থেকে বেশি ভালোভাবে বোঝা যায়। ফলে সময়মতো দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় মালামাল পৌঁছানো সহজ হয়। এ ছাড়া পরিকল্পনায় বা নির্মাণকালে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা দিলে তা সহজেই চোখে পড়ে। তাই শুধরে ফেলতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না।
স্কাইক্যাচের ড্রোন ব্যবহারে জাপানের অন্যতম বৃহৎ কনস্ট্রাকশন মেশিনারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোমাতসু আরও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এসব ড্রোন কোমাতসুর স্বয়ংক্রিয় বুলডোজারগুলোয় চোখের মতো কাজ করছে। কিন্তু কীভাবে? এসব ড্রোন প্রকল্পের বা ভবনের সব দিক থেকে ছবি সংগ্রহ করে কম্পিউটারে একটা থ্রি-ডি মডেল পাঠায় এবং কম্পিউটার এই থ্রি-ডি মডেলের ওপর ভিত্তি করে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগুলোর জন্য একটা নির্দেশনা (Program/Code) তৈরি করে। আর এসব নির্দেশনা (Memory) মানুষবিহীন মেশিনের মাথায় ঢুকিয়ে দিলে তারা প্রদত্ত নির্দেশমতো নির্মাণকাজ চালিয়ে যেতে পারে।

স্কাইক্যাচের প্রধান নির্বাহী মনে করেন, প্রযুক্তির উপযুক্ত সমন্বয় ও সংযোগ সুন্দরভাবে একটা রোবোটিক কনস্ট্রাকশন সাইট চালিয়ে নিতে পারবে। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘একটি স্থানের যত দৃশ্যমান তথ্য বা উপাত্ত দেওয়া যাবে, সেখানে মানুষের চেয়ে তত বেশি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বা রোবট ব্যবহার করা সম্ভব হবে।’
বাসস্থান নির্মাণের আরেকটি সম্ভাবনাময় সমাধান হলো থ্রি-ডি প্রিন্টিং। এটা ইতিমধ্যেই কম খরচে, কম সময়ে ভবন ও বাড়ি তৈরি করে নির্মাণশিল্পে বেশ সাড়া ফেলেছে। জাতিসংঘ ধারণা করছে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৩০ কোটি লোকের বাসস্থান তৈরি সমস্যার সমাধান হতে পারে থ্রি-ডি প্রিন্টিংয়ের মতো প্রযুক্তির সাহায্যে। ২০০৭ সাল থেকে লওবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি দল বাড়ি বা ভবন তৈরির জন্য থ্রি-ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর কাজ করছে। ইতিমধ্যে তারা থ্রি-ডি কংক্রিট প্রিন্টার ও এর জন্য রোবোটিক আর্ম তৈরি করেছে। এ ছাড়া চায়না কোম্পানি উইনসানসহ আরও অনেকেই সার্থকভাবে থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে অল্প সময়ে কম খরচে বাড়ি ও ভিলা তৈরি করেছে। থ্রি-ডি কংক্রিট প্রিন্টার ও এর রোবোটিক আর্ম মানুষের চেয়ে ১০ গুণ দ্রুত কাজ করতে পারে। এমনকি তাত্তি¡কভাবে অসংখ্য ডিজাইন, ফর্ম, কার্ভ ও জটিল জ্যামিতিক নকশা অনুযায়ী যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরিতে সক্ষম।
এ প্রযুক্তি কতটা জনপ্রিয় হতে চলেছে তা বোঝা যায় ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখলে। কংক্রিটের মতো রসকষহীন একটা বিষয়ের দর্শক যখন পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়, তখন তা অবশ্যই চোখে পড়ার মতো একটি বিষয়। এ তথ্য থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, থ্রি-ডি প্রিন্টারের প্রতি সাধারণ মানুষ ও নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের যে আগ্রহ তাতে এটি নির্মাণকাজে পাবে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা। বিশেষ করে এর কর্মদক্ষতা, নান্দনিকতা ও তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিহীন হওয়ার জন্য।

থ্রি-ডি প্রিন্টারকে সামনে রেখে বছর দু-এক আগে অধ্যাপক ও গবেষক সাইমন অস্টিনের নেতৃত্বে নির্মাতা কোম্পানি স্ক্যানকা, স্থপতি ফস্টার ও তার সঙ্গীরা, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টারমাক ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রোবটিকস কোম্পানি এবিবি একত্র হয়। ইতিমধ্যে এদের একটি দল থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে একটা ইন্ডাস্ট্রি প্রোটোটাইপ বানায়, যা কোভেনট্রির ম্যানুফ্যাকচারিং টেকনোলজি সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এটাই বিশ্বের একমাত্র দল, যেখানে হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি ও কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি যৌথভাবে কাজ করছে।
স্ক্যানকারের একজন পরিচালক রব ফ্রান্সিস এ প্রযুক্তি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী। তিনি মনে করেন, থ্রি-ডি কংক্রিট প্রিন্টিংয়ে নির্মাণের সময়কে সপ্তাহ থেকে ঘণ্টায় নামিয়ে আনবে। এর কর্মদক্ষতা ও গুণগতমান এমন পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব যে এর আগে নির্মাণশিল্প কখনোই সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। তবে এর গবেষক অধ্যাপক অস্টিন একটু অন্যভাবে দেখছেন বিষয়টিকে। তাঁর মতে, এটা বসতি নির্মাণের সনাতনী ব্যবস্থাকে সরিয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাপী বিশাল সাড়া জাগানোর মতো কিছু হতে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। কারণ, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর রয়েছে সস্তা শ্রম, আর স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে শত বছরের পুরোনো বাড়ি তৈরির পদ্ধতি, সেখানে এ ধরনের প্রযুক্তি খুব বেশি জনপ্রিয় হওয়ার কারণ নেই। তা ছাড়া বিশাল গ্যানট্রির সঙ্গে একটা প্রিন্টার বসিয়ে একটা সম্পূর্ণ বাড়ি তৈরি সহজসাধ্য বিষয় নয়। তবে কোথাও ছোট ছোট অংশ তৈরি করে নিয়ে এসে তা নির্দিষ্ট স্থানে যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হলে এর জনপ্রিয়তা বাড়বে। এ ছাড়া এর মনোমুগ্ধকর জ্যামিতিক নকশা অবশ্যই মানুষের নজর কাড়বে।

থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে পুরো একটি বাড়ি বানাতে অনেক জটিলতা থাকলেও ভেতরে ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত ইট বানাতে তেমন কোনো জটিলতা নেই। যেমন ‘ইমার্জিং অবজেক্ট’ নামের প্রতিষ্ঠানটি বানিয়েছে ‘কুল ব্রিক’। এই ইটের বৈশিষ্ট্য হলো, এর ভেতরে অনেক ছোট ছোট ছিদ্র থাকে। আর এই ছিদ্রের মধ্যে যখন পানি ভর্তি করে দেওয়া হয়, তখন ঘরের তাপমাত্রা কমে আসে। এ কারণেই এটাকে বলা হচ্ছে ‘কুল ব্রিক’। প্রতিটি থ্রি-ডি প্রিন্টেড কুল ব্রিক একটি ত্রি-মাত্রিক ঝাঁজর বিশেষ। স্পঞ্জ যেমন তার ছিদ্রের মধ্যে পানি ধরে রাখে, ঠিক তেমনিভাবে কুল ব্রিকও পানি ধরে রাখতে পারে। যখন এ ইটের মধ্য দিয়ে বায়ু চলাচল করে তখন বাতাসের মধ্যে বাষ্পীভূত অবস্থায় থাকা পানি ঠান্ডা হয়ে ছিদ্রের মাঝে জমা হয়। কুল ব্রিকের নির্মাতারা দাবি করছেন, একটি বাড়ির সব দেয়াল এই ইটের তৈরি হলে এর মাঝে জমে থাকা পানি পুরো বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রাকে কমিয়ে ফেলতে পারবে। উষ্ণ এলাকার জন্য প্রাকৃতিক উপায়ে তাপমাত্রা কমানোর জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা।
প্রকৃতিকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসার অব্যাহত প্রচেষ্টার আরেকটি কারণ হচ্ছে এমন এক ধরনের ছাদ তৈরি করা, যেন রৌদ্রোজ্জ¦ল দিনে আপনাআপনি খুলে যায় আর বৃষ্টি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। ইনস্টিটিউট অব কম্পিউটেশনাল ডিজাইনের একটি দল ঠিক এ ধরনের কিছু তৈরির চেষ্টা করছে, যা প্রকৃতির বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবে।
নির্মাণকাজে যা কিছু ব্যবহার হয় তার সবকিছুই আমরা পাই প্রকৃতি থেকে। কিন্তু প্রকৃতিকে আমরা কী দিচ্ছি? বাহ্যিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিটি নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর প্রকৃতি আমাদের কাছ থেকে পাচ্ছে কিছু জঞ্জাল, কিছু বর্জ্য, কিছু দূষণ এই সব। অবশ্য কেউ কেউ ভালো কিছু ফেরত দেওয়ার চেষ্টা যে করছেন না তা কিন্তু নয়! যেমন এলিগ্যান্ট অ্যাম্বেল্লিশমেন্ট কোম্পানির এলিসন ড্রিং। তিনি বাড়ির সামনের অংশটুকুকে বিশেষভাবে ডিজাইন করে টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইডের তৈরি একধরনের পেইন্ট দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এটি গাড়ির ধোঁয়া শোষণ করতে থাকে। আর শোষিত ধোঁয়াকে প্রথমে নাইট্রিক অ্যাসিডে পরিণত করে এবং পরে নাইট্রিক অ্যাসিডকে ক্যালসিয়াম নাইট্রেটে রূপান্তর করে। এই ক্যালসিয়াম নাইট্রেট মানুষ বা পরিবেশ কারও জন্যই ক্ষতিকর নয়। মেক্সিকো সিটির একটি হাসপাতালের পাশে এভাবে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার গাড়ির দূষণ কমানো সম্ভব হচ্ছে বলে জানান এলিসন ড্রিং।

ডিজাইনার আর স্থপতিরা যেমন তাঁদের কর্মে প্রকৃতির ছোঁয়া রাখতে চান, তেমনি একই সঙ্গে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থাপনা বা বাড়িটিকে করে তুলতে চান স্মার্ট। কিন্তু জটিল সব যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার, সেন্সর যখন পুরোনো হয়ে যাবে বা ঠিকমতো কাজ করবে না তখন? এসব স্মার্ট ভবন বা বাড়িকে কীভাবে স্মার্ট রাখবে? ভাবনার কিছু নেই, এ নিয়ে অবিরাম কাজ করে চলেছেন বিশেষজ্ঞরা। সমস্যা যত বড় হয়, তার সমাধানটাও তত সহজ হয়।
আবু সুফিয়ান
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৬ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৬