সব মাটিতেই যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব নয়। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অধিক ভার বহনক্ষম মাটি পাওয়া যায় না। প্রকৌশলগত কাজ; যেমন- বহুতল ভবন, সড়ক কিংবা রেলপথ, বিমানবন্দর, বাঁধ বা যেকোনো বড় ধরনের কাঠামো নির্মাণকল্পে মাটি দৃঢ়করণ প্রয়োজন। মাটি দৃঢ়করণের প্রধান উদ্দেশ্য মাটির ভারবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে নির্মাণ ব্যয় কমানো। তা ছাড়া যেখানকার মাটিতে পানির প্রভাব বেশি, সেখানে লিকুইফেকশনের ঝুঁকি কমানো। অর্থাৎ ভূমিকম্পের সময় অত্যধিক কম্পনের ফলে Pore Water Pressure যাতে বাড়তে না পারে এবং ভূপৃষ্ঠের ওপর নির্মিত কাঠামোগুলো যেন তার স্বস্থানে থাকতে পারে। এসবই মাটি দৃঢ়করণের প্রধান উদ্দেশ্য। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে নতুন নতুন পদ্ধতির মাটি উন্নতকরণ বা মাটি দৃঢ়করণ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কতিপয় পদ্ধতি হলো-
ভাইব্রোফ্লোটেশন (Vibroflotation)
ভাইব্রোফ্লোটেশন পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র দানাবিশিষ্ট মাটিতে ড্রাইকেটি শলাকা ব্যবহার করে অন্তত ১০০ ফুট গভীর পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। ভাইব্রেটিং শলাকার ভাইব্রেশনের ফলে ক্ষুদ্র দানাবিশিষ্ট মাটির কণা পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে দৃঢ় বন্ধন তৈরি করে। মাটির মধ্যস্থিত পানি, যা ভয়েড ভাইব্রেশনের ফলে ওপরের দিকে উঠে আসায় মাটি অনেকটাই দৃঢ়বদ্ধ হয়ে শক্ত লেয়ারে রূপান্তরিত হয়।
কম্পাকশন গ্রাউটিং (Compaction Grouting)
যে স্থানের মাটি অনেক Loose (লুজ) বা আগলা প্রকৃতির, সেখানে কম্পাকশন গ্রাউটিংয়ের মাধ্যমে মাটি দৃঢ়করণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে মাটির মধ্যে ইনজেকশনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে চাপ প্রয়োগ করে পানি, বালু, সিমেন্টের মিশ্রণকে প্রবেশ করানো হয়। পরবর্তী সময়ে সিমেন্ট মিশ্রণ জমাটবদ্ধ হয়ে একটি বাল্বের (Bulb) আকার ধারণ করে। গাউটিংসহ পাশের সব ক্ষুদ্র মাটির কণা অনেক শক্ত হয়ে অধিক ভারবহন ক্ষমতা অর্জন করে। সাধারণত যেখানে আগে বিল্ডিং বা অন্য কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়েছে অথচ যেকোনো সমস্যার কারণে এর ফাউন্ডেশন মজবুত বা উন্নত করার প্রয়োজন, সেখানে কম্পাকশন গ্রাউটিং একটি ভালো উদাহরণ। এই পদ্ধতিতে যেকোনো অ্যাঙ্গেল বা বিল্ডিংয়ের যেকোনো পাশ থেকে ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রাউট প্রবেশ করানো সম্ভব। ফলে মাটির অবস্থা দ্রুত উন্নত করা যায়। একই ভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মাটিকে কিছুদূর পরপর গ্রিড লাইন করে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর কম্পাকশন গ্রাউটিং করে মাটিকে ভারবাহী করা সম্ভব।

ড্রেনেজ টেকনিক (Drainage Technique)
নিষ্কাশনের মাধ্যমে বালু আর কাদামাটিকে দৃঢ়করণ করা খুবই কষ্টসাধ্য। কারণ, মাটির মধ্যে পানির পরিমাণ বাড়লে মাটির শক্তি কমে। আবার সম্পৃক্ত মাটি (Saturated Clay)-এর মধ্যে অধিক পরিমাণ পানির উপস্থিতিতে অন্তর্কণার দূরত্ব বাড়লে মাটি দুর্বল হয়। কাদায় অতিরিক্ত পানি যোগ করায় কণাসমূহের মধ্যকার বৈদ্যুতিক বিকর্ষণ (Electric Nepulsion) বাড়ে, যার ফলে মাটির সংশক্তি (Chesion) হ্রাস পায়। নিষ্কাশনের মাধ্যমে মাটি থেকে জলীয় অংশ অপসারিত হলে বিশ্লেষক বল (Absorptive Force) এর চাপ বাড়ে, যা মাটির শক্তি বৃদ্ধি করে। এভাবে নিষ্কাশনের মাধ্যমে মাটির দৃঢ়করণ করা যায়। মাটির জলীয় অংশ নিষ্কাশনের জন্য মূলত চারটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়-
১. বহিঃস্থ লোড প্রয়োগে মাটির মধ্য থেকে পানি অপসারণ (Application of an external load to the soil mass to squeeze out pore water)
২. পাম্পিং অথবা গ্রাভিটি অথবা উভয় পদ্ধতির সাহায্যে পোর ওয়াটার অপসারণ (Drainage of pore water by gravity or pumping or both)
৩. ইলেকট্রিক গ্রেডিয়েন্ট প্রয়োগ (By applying electric gradient)
৪. থার্মাল গ্রেডিয়েট প্রয়োগ (By applying thermal gradient)
স্যান্ড পাইল (Sand Pile)
মাটিতে গর্ত খনন করে উক্ত গর্ত বালু দ্বারা পূর্ণ করে পাইল তৈরি করা যায়। মাটিকে দৃঢ়বদ্ধ করার জন্য অথবা মাটির চেয়ে বালু বেশি লোড বহনক্ষম বলে ভারবাহী ক্ষমতা বাড়াতে এই পাইল ব্যবহৃত হয়। অগার দিয়ে গর্ত করে অথবা পাইপের নিচ প্রান্তে বন্ধ করে চাপের সাহায্যে মাটি অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে গর্ত তৈরি করা হয়। এ গর্তের ব্যাস হয় ২০ সেমি থেকে ৪০ সেমির মধ্যে। পরে খননকৃত গর্তকে বালু দিযে ভর্তি করে দৃঢ়ভাবে গাদান করা হয়। দৃঢ়বদ্ধ করার সময় বালুকে ভেজা রাখা হয়। পার্শ্বচাপের ফলে এই পাইল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় অথবা ভর্তি করা বালুকে রক্ষার জন্য পাইলের ওপর এক মিটার সিমেন্ট কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করা হয়। এই পাইল তৈরি করা যায় দুই থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত। সাধারণত পাইলগুলো কলামের নিচে স্থাপন করা হয়।
কম্পাকশন পাইল (Compaction Pile)
কম্পাকশন পাইল মাটি দৃঢ়করণের জন্য খুবই উপযোগী ও সহজ পদ্ধতি। কম্পাকশন পাইল সাধারণত প্রিস্ট্রেস (Pre-stressed) অথবা কাঠের হয়ে থাকে। মাটির মধ্যে কম্পাকশন পাইলগুলোকে ড্রাইভ করে স্থাপন করা হয়। প্রিস্ট্রেস কংক্রিট পাইল আগেই তৈরি করে শক্তি অর্জনের পর গ্রিড প্যাটেন করে ড্রাইভ করা হয়। এটা সর্বোচ্চ ৬০ ফুট ড্রাইভ করলেই কাক্সিক্ষত শক্তি পাওয়া যায়।
স্টোন কলাম (Stone Column)
স্টোন কলামগুলো সাধারণত ভূপৃষ্ঠের Gravel পাথর দ্বারা নির্মিত। স্টোন কলামগুলোকে Vibroflation মেথডের সাহায্যে মাটিতে প্রবেশ করানো হয়। এ ছাড়া এটা স্থাপনের জন্য অনেক সময় স্টিল ক্যাসিং ও ড্রপ হ্যামারের সাহায্য নেওয়া হয়। Franki মেথড ব্যবহার করে স্টিল ক্যাসিং মাটির মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। ওপর থেকে Gravel পূর্ণ করা হয়। তারপর ড্রপ হ্যামারের সাহায্যে ওপর থেকে টেম্পিং করা হয় এবং আস্তে আস্তে Steel Casing উঠিয়ে ফেলা হয়। Stone Column-টি স্থায়ীভাবে মাটির মধ্যে থেকে যায়।
সিমেন্ট স্ট্যাবিলাইজেশন (Cement Stabilization)
গুঁড়া মাটি ও পোর্টল্যান্ড সিমেন্টকে একত্রে পানির সঙ্গে মেশানো হয়। মিশ্রণটিকে ভালোভাবে ঘনসন্নিবিষ্ট করে শক্ত পদার্থে পরিণত করার পদ্ধতিই Cement Stabilization. মাটি ও সিমেন্ট মিশ্রিত পদার্থ Soil Cement নামে পরিচিত। ১৯৫৯ সালে Mitchell ও Freitag সয়েল সিমেন্টকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন-
ক. সাধারণ সয়েল সিমেন্ট (Normal Soil Cement) : এতে আয়তনের ৫ থেকে ১৪ শতাংশ সিমেন্ট থেকে। পর্যাপ্ত পানি মেশালে শক্ত ও টেকসই নির্মাণসামগ্রীতে পরিণত হয়।
খ. প্লাস্টিক সয়েল সিমেন্ট (Plastic Soil Cement): সিমেন্টের পরিমাণ একই কিন্তু অধিক পানি মিশিয়ে ভেজা আসক্ততা (Wet Consistencey) বাড়িয়ে স্থাপন করা হয়। যেখানে রাস্তা প্রস্তুতির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য, সেখানে তথ্য খাড়া বা অসম হলে এই জাতীয় সয়েল সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়।
গ. সিমেন্ট মোডিফাইড সয়েল (Cement Modified Soil) : এতে ৫ শতাংশের কম সিমেন্ট থাকে। সয়েল সিমেন্টের ওপর প্রভাবকারী বিষয়গুলো হচ্ছে মাটির প্রকৃতি, সিমেন্টের পরিমাণ, পানির পরিমাণ, মিক্সিং ও কিউরিং। সিমেন্টের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য সয়েল সিমেন্টে মাঝে মাঝে অ্যাডমিক্সার ব্যবহার করা হয়। এটা ব্যবহার করলে প্রয়োজনের তুলনায় কম সিমেন্ট লাগে। লাইম ও ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড সচরাচর অ্যাডমিক্সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

Soil Cement-এর নির্মাণ পদ্ধতি (Construction Method of Soil Cement)
ধাপে ধাপে সয়েল সিমেন্টের দৃঢ়করণ-
১. সাবগ্রেড গঠন ও মাটি ঢিলাকরণ (Shaping sub grade and scarifying the soil)
২. মাটি গুঁড়াকরণ (Palavering the soil)
৩. সিমেন্ট যুক্ত করে মেশানো (Adding & Mixture Cement)
৪. পানি মেশানো (Adding Water & Mixing)
৫. কম্পাকটিং (Compacting)
৬. ফিনিশিং (Finishing)
৭. কিউরিং (Curing)
৮. ওয়্যারিং সারফেসিং (Wearing Surfacting)
এই পদ্ধতিগুলো ছাড়াও মাটিতে ইলেকট্রিক কারেন্ট প্রয়োগ ও তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়েও Soil Stabilization করা সম্ভব।
ইলেকট্রিক কারেন্ট সম্পৃক্ত মাটিতে প্রয়োগ করলে পানি ক্যাথেডের দিকে প্রবাহিত হয়। এই অবস্থায় পানি পাম্প করে ওঠানো যায়। ফলে মাটির আয়তন হ্রাস পায়, তখন Conslidation-এর মাধ্যমে মাটির স্ট্রেন্থ বাড়ানো হয়।
আবার মাটিতে তাপ প্রয়োগ করলে বা মাটিকে ঠান্ডা করলে এর গুণাগুণ পরিবর্তিত হয়। তাপমাত্রা সামান্য বাড়ালে মাটির কণার মধ্যকার বৈদ্যুতিক বিবর্তন বল হ্রাস পায়, যার ফলে মাটি শক্ত হতে থাকে। কারণ, থার্মাল গ্রেডিয়েন্ট প্রয়োগ করায় পানি বাষ্প হয়ে উঠে যাওয়ার ফলে ওয়াটার কনটেন্ট (Water Content) হ্রাস পায়। তবে এই পদ্ধতিতে মাটি দৃঢ়করণ অধিক ব্যয়সাপেক্ষ।
প্রকৌশলী সুবীর কুমার সাহা
engr_subir.bandhan@gmail.com
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫২ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৪