কংক্রিট ও কংক্রিটিং (শেষ পর্ব)

একটি নির্মাণ প্রকল্পের যেকোনো অংশের কংক্রিট ঢালাইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালিত প্রতিটি কাজই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কাজের গুণগতমান রক্ষা করা এবং নির্মিতব্য কাঠামোর দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করণার্থে এ সংক্রান্ত কোনো কাজেই কোনো প্রকার শিথিলতা গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, কংক্রিট ঢালাইয়ের জন্য প্রদত্ত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সব মালামাল ব্যবহার করা এবং নিয়মমাফিক ঢালাইয়ের কাজ শেষ করাই শেষ কথা নয়। ঢালাইয়ের কাজ শেষ করার পর নিয়মানুযায়ী সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করত ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত শাটার খোলা এবং নিয়মিত কিউরিং করা অত্যাবশ্যক। উল্লেখ্য, একটি কাঠামোর বিভিন্ন মেম্বরের শাটার খোলা এবং কিউরিং করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন সময় নির্ধারণ করা থাকে, যা সঠিকভাবে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

শাটার খোলা
কোনো ইমারত নির্মাণকল্পে একটি কাঠামো তৈরি করতে ভিত থেকে শুরু করে সর্বশেষ ছাদ ঢালাই পর্যন্ত কাজগুলোর আলাদা আলাদা স্তর আছে এবং প্রতিটি স্তরের কাজের জন্য মালামালের স্পেসিফিকেশন ও কর্মপদ্ধতিও আলাদা। পূর্ণাঙ্গ একটি কাঠামো নির্মাণকাজের স্তরগুলো আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পাইল, পাইল ক্যাপ, গ্রেড বিম, সিঁড়ি, কলাম, রুফ বিম ও রুফ স্ল্যাব এগুলোকেই প্রধান অংশ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং প্রতিটি অংশই আলাদা আলাদা গুরুত্ব বহন করে একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি করে। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক কিছু অংশ আছে, যেমন- লিনটেল, সানশেড, ফলস ছাদ, ড্রপ ওয়াল, কার্নিশ, প্যারাপেট, রেলিং ইত্যাদি। উল্লেখিত প্রতিটি অংশই ঢালাইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এবং এগুলোর প্রতিটি আলাদা আলাদাভাবে ঢালাই করা হয়। যেকোনো কংক্রিট ঢালাই করার পর তা জমাট বেঁধে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চার করা পর্যন্ত কোনো রকম নাড়াচাড়া কিংবা এর ওপর হাঁটাচলা বাঞ্ছনীয় নয়। ফলে, একটি ইমারতের কাঠামো নির্মাণে প্রতিটি মেম্বরের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শাটার খোলার জন্য আলাদা আলাদা সময়সীমা নির্দেশিত থাকে, যা মেনে চলা অপরিহার্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্দিষ্ট সময়সীমার আগে শাটার খুললে ত্রুটিপূর্ণ এবং দুর্বল একটি কাঠামো নির্মিত হয়ে ভবিষ্যতে সমূহ ঝুঁকির সম্মুুখীন হতে পারে।

স্ট্রাকচারে গ্রেড বিম ও কলাম

কোনো একটি ইমারত নির্মাণকাজের প্রতিটি স্তরের ঢালাই শেষে শাটার খোলার বিষয়গুলো আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই আসে পাইল। পাইল সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে, ১. প্রি-কাস্ট ও ২. কাস্ট-ইন-সিটু। এই দুই ধরনের পাইলের মধ্যে সিটু পাইলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্থানে একবারে মাটি বোর করে ঢালাই করা হয় বিধায় কোনো শাটার লাগে না। কিন্তু প্রি-কাস্ট পাইলের জন্য আলাদা করে শাটার তৈরি করা হয় এবং কংক্রিট জমানোর পর অত্র শাটার খোলা হয়। এ ক্ষেত্রে পাইলটি শোয়ানো অবস্থায় ঢালাই করা হয় এবং ঢালাই শেষ করার পর কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনোক্রমেই সাইড শাটার খোলা উচিত নয়। এরপর ন্যূনতম ২৮ দিন কিউরিং করার পর পাইলটি অন্যত্র সরিয়ে বটম শাটার খোলা যেতে পারে। প্রি-কাস্ট পাইল ড্রাইভ করা কিংবা কাস্ট-ইন-সিটু পাইল ঢালাই করার পর নির্দিষ্ট একটি মেয়াদান্তে নির্দেশিত লেভেল অনুযায়ী পাইলের মাথা ভেঙে তার ওপর পাইল ক্যাপ বা কলাম বেইজ ঢালাই করা হয়। অতঃপর গ্রেড বিমের তলার লেভেল পর্যন্ত কলামের অংশবিশেষ ঢালাই করে তার ওপর গ্রেড বিম ঢালাই করার পর পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন ফ্লোরের কলাম, রুফ বিম ও রুফ সø্যাব ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাইড ও বটম শাটার খোলার জন্য আলাদা আলাদা সময় নির্ধারণ করা থাকে। সাধারণত পাইল, পাইল ক্যাপ, গ্রেড বিম, সিঁড়ি, কলাম, রুফ বিম ও রুফ স্ল্যাবসহ সব ক্ষেত্রেই সাইড শাটার খোলার জন্য ঢালাই শেষ করার কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা এবং বিম ও ছাদসহ অন্যান্য মেম্বরের বটম (তলা) শাটার খোলার জন্য ঢালাই শেষ করার পর থেকে ন্যূনতম ১৫ দিন পার করা অপরিহার্য। এ ছাড়া নির্মিতব্য কাঠামোর আনুষঙ্গিক অংশগুলো ঢালাই ও শাটার খোলার ব্যাপারেও একই নিয়ম মেনে চলা উচিত। তবে কাজের ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী এর কিছু তারতম্য হতে পারে, যা সাধারণত ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশনা অনুসারে করা হয়ে থাকে। মনে রাখা দরকার, প্রায় ক্ষেত্রে নির্মাণকাজে নিয়োজিত একজন সাধারণ মিস্ত্রি এসব ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব কিছু মতামত দেওয়া এবং তদনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক থাকাটা বাঞ্ছনীয়।

কলাম ফাউন্ডেশন ও গ্রেড বিম, কলাম কিউরিং ও স্ল্যাব কিউরিং (উপরে বা থেকে)

কিউরিং
কংক্রিট বিভিন্ন ধরনের ভার বহনের শক্তি সম্পন্ন হয়, যা কাঠামোর গঠন এবং প্রস্তাবিত ভার বিচার বিশ্লেষণপূর্বক ডিজাইন করা হয়ে থাকে। একজন ডিজাইনার প্রস্তাবিত কাঠামোর ধরন ও ভারবহনক্ষমতা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করত কী মানের কংক্রিট তৈরি করতে হবে, কংক্রিট ও শাটার তৈরির কাজে কী কী কাঁচা মালামাল ব্যবহৃত হবে, শাটারের ডিজাইন কী হবে, কত দিন পর শাটার খোলা যাবে, কত দিন পর্যন্ত কীভাবে কিউরিং করতে হবে, যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে একটি সুষ্ঠু দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন, যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলা আবশ্যক।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কংক্রিট স্ট্রাকচারের কাঙ্খিত শক্তি সঞ্চার নিশ্চিত করার জন্য সুষ্ঠুভাবে কিউরিং সম্পন্ন করা মুখ্য একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে জ্ঞাতব্য যে নির্মাণাধীন স্ট্রাকচারটির যেকোনো মেম্বর ঢালাই করার পর তা সুষ্ঠুভাবে কিউরিং করা না হলে কংক্রিটের কাঙ্খিত শক্তি সঞ্চার বিঘ্নিত হতে পারে এবং ইমারতের স্থায়িত্ব কমে যেতে পারে। ফলে, যতই দামি কাঁচামাল ব্যবহার করা কিংবা ভালো মানের কর্মপদ্ধতিসহকারে কাজ সম্পন্ন করা হোক না কেন, পর্যাপ্ত কিউরিংয়ের অভাবে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। তাই সব ক্ষেত্রে ঢালাই শেষ করার ১০ ঘণ্টা পর থেকে নির্দেশিত সময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত কিউরিং করার বিষয়ে তীক্ষè নজরদারি জরুরি। আমাদের দেশে এই কাজটিতে বেশ অবহেলা করতে দেখা যায়, যা আদৌ কাঙ্খিত নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, ঢালাইকৃত মেম্বরের গায়ে চট বা জিওটেক প্যাঁচানো আছে ঠিকই কিন্তু তা পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে, এমনটি মোটেই কাঙ্খিত নয়। গায়ে প্যাঁচানো চট বা জিওটেক যাতে সারাক্ষণ ভেজা থাকে, সে ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া কিউরিং করার পদ্ধতিগত বিষয়েও আমাদের মাঝে বেশ শিথিলতা আছে, যা প্রশ্নাতীতভাবে পরিহার্য একটি বিষয়। উন্নত দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কিউরিং করা হয়, তন্মধ্যে স্টিম কিউরিংই প্রণিধানযোগ্য। যেখানে আমরা এখনো পানির ওপরই নির্ভরশীল। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চট কিংবা জিওটেক ব্যবহার করা হয়। যেভাবেই করা হোক না কেন প্রতিটি মেম্বরের ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত কিউরিং করার বিষয়টি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

অতএব, অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি নিশ্চিত করণার্থে ঢালায় সম্পন্ন করার আগেই সুষ্ঠুভাবে কিউরিং সম্পন্ন করার সব প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। সুষ্ঠুভাবে কিউরিং সম্পন্ন নিশ্চিত করার জন্য হরিজেন্টাল মেম্বরের ক্ষেত্রে চারদিকে বালু-সিমেন্টের বাঁধ দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভার্টিক্যাল কিংবা হরিজেন্টাল মেম্বর, যেখানে পানি আটকানোর ব্যবস্থা করা যাবে না, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই চট বা জিওটেক পেঁচিয়ে তা সারাক্ষণ ভেজা রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত কলাম কিউরিংয়ের ক্ষেত্রেই চট বা জিওটেক ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সার্বক্ষণিক ভিজিয়ে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় না। তাই মনে রাখা দরকার, কলাম ইমারতের সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি মেম্বর, যার গুণগত মানের ওপর পুরো ইমারতটির স্থায়িত্বতা নির্ভর করে। সুতরাং কলাম ঢালাইয়ে মালামাল ও কাজের গুণগতমান রক্ষা করা এবং সুষ্ঠুভাবে কিউরিং সম্পন্ন করার বিষয়গুলোর ওপর সর্বোচ্চ নজরদারি অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি অন্যান্য মেম্বরের ক্ষেত্রেও অত্র কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আদৌ কোনো অবহেলার সুযোগ নেই।

কংক্রিট প্রি-কাস্ট পাইল ফাউন্ডেশন

যা হোক, একটি স্থায়ী ও মজবুত কাঠামো নির্মাণকল্পে সার্বক্ষণিক তদারকি নিশ্চিত করা, মালামাল ও কাজের গুণগতমান রক্ষা করা, দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া, একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর দিকনির্দেশনা নেওয়া এবং তদনুযায়ী সব কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করার কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং, যেকোনো একটি ইমারত নির্মাণকল্পে আমরা যে যার অবস্থান থেকে সবকিছু সঠিকভাবে বুঝে নিয়ে সব কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করণার্থে সক্ষমতা অর্জন করব এবং সার্বিকভাবে সচেতন হব, এটাই হোক আমাদের আজকের প্রত্যয়।

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ, জীবন ফেলো, আইইবি (এফ-৭৫৯৭), জীবন সদস্য, বিএসটিকিউএম বিএএএস, এওটিএস (জাপান), ডিজিএম (কিউএ অ্যান্ড এমআর), দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লি.

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top