একটি দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ, জাতীয়তাবোধ, স্বাধীনতা এ সবকিছুর চিত্রই ফুটে ওঠে সে দেশের ভাস্কর্যের মাধ্যমে। প্রতিটি জাতিরই রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু লোকগাথা। বাঙালি জাতিও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন সময়ে এদেশেও গড়ে ওঠেছে নানারকম ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটে ওঠেছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র যেমন, ফুল, পাখি, বন্যপ্রাণীও এ দেশের পরিচিতির অংশই বলা যায়। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছোট বড় নানারকম ভাস্কর্য রয়েছে। এগুলো একদিকে যেমন দেশের সংস্কৃতিকে প্রদর্শন করছে অন্যদিকে নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া এগুলো ঘুরতে আসা দর্শণার্থী বা পর্যটকদের জন্যও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে। আর এসব দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য নিয়ে বন্ধনের এবারের আয়োজন ভাস্কর্যে বাঙালিয়ানা।
শাপলা চত্বর
নদীমাতৃক প্রাকৃতিক নৈসর্গের অপার লীলাভূমি বাংলাদেশ। এদেশের খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, জলাশয় বা মাঠে জমে থাকা পানিতে ফুটে থাকে মন ব্যাকুল করা শাপলা ফুল। তাইতো রূপে অপরূপ এই ফুলটিকেই জাতীয় ফুলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ইট কাঠের এ নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বাংলার আবহমান প্রাকৃতিক এ ফুলটির ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র অফিসপাড়া বা বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনেই শাপরা চত্বরের অবস্থান। ঢাকা শহরের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে শাপলা চত্বর অন্যতম। এ ভাস্কর্যটির স্থপতি আজিজুল জলিল পাশা।

দোয়েল চত্বর
পাখিটি যেন একান্তই বাঙালির। সারাটা দিন ধরে বাড়ির আশপাশে পাতার ফাঁকে ফাঁকে শীষ দিয়ে গান গেয়ে যাওয়া শান্ত পাখিটিই দোয়েল। পাখিটি এদেশের গ্রামীণ প্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। জাতীয় এ পাখিটির ভাস্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনেই অবস্থিত। পাশাপাশি দুটি দোয়েলের নির্মাণশৈলী দেখে যে কারো চোখ আটকে যাবে বিস্ময়ে। সাদা-কালো রঙের কম্বিনেশনে গড়া মূর্তিটি দেখলে তা ভাস্কর্যের চেয়ে ঢাউস আকৃতির দুটি জীবন্ত দোয়েলই বলেই মনে হবে। শিল্পী আজিজুল জলিল পাশা ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন।

ইলিশ চত্বর
ভোজনবিলাসী জাতি হিসেবে বাঙালির বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। আর বাঙালির ভোজন তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইলিশ। পান্তাভাত সাথে ইলিশ ছাড়া বাংলা নববর্ষের বৈশাখবরণ কল্পনাও করা যায় না। এক সময়ে বড় বড় নদীতে বাংলাদেশের জাতীয় এ মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। ইলিশ আগের মতো আর পাওয়া না গেলেও মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটি চিরস্থায়ী করে রাখতে রাজধানীর ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনেই গড়ে তোলা হয়েছে রুপালী ইলিশের ভাস্কর্য। সবুজ গাছে ঘেরা ভাস্কর্যটিতে যখন ফোয়ারা চালু করা হয় (বিশেষ করে রাতে) তখন সেখানে এক নৈসর্গিক পরিবেশ রচিত হয়। মনে হয় যেন পদ্মা নদীতে এক দল মাছ মনের আনন্দে দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। নান্দনিক এ স্থাপনাটির স্থপতি শিল্পী হামিদুজ্জামান খান।

রাজসিক বিহার
ঢাকা শহরের ইতিহাস প্রায় চারশ বছরের পুরনো। এক সময়ে রাজা-বাদশা, নবাব, জমিদারেরা বাংলা শাসন করত। হাতি-ঘোড়াই ছিল তাদের চলাচলের প্রধান বাহন। নবাবী আমলের সেই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে হোটেল রূপসী বাংলার সামনে ভাস্কর্য শিল্পী মৃনাল হক নির্মাণ করেছেন রাজসিক বিহার। অনুপম সুন্দর এ ভাস্কর্যটিতে রাজকীয় জীবনাচারণ ফুটে উঠেছে। তাছাড়া এটি বিশ্বের কাছে বাঙালির শৌর্যও তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। সোনালী রঙের এ বহরটি বাংলার সোনালী দিনের কথাই তুলে ধরে বারবার।

দ্য স্ট্রাগল
বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাসে অনন্য এক নাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। তাঁর চিত্রকর্ম জগৎখ্যাত। আর তাঁরই বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য স্ট্রাগল’ বা ‘সংগ্রাম’ এর আদলেই গড়ে তোলা হয়েছে এক অনুপম ভাস্কর্য। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁ যাদুঘর) এর পাশেই এর অবস্থান। যাদুঘরটিতে প্রবেশের পথেই নজর কাড়বে সাদা রঙের ভাস্কর্যটি। এটি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের একটি। গ্রামীণ কৃষকের কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি কৃষিতে হালের গরুর অবদানও এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। জয়নুল আবেদীন নিজেই ভাস্কর্যটির স্থপতি ছিলেন।

বলাকা
রাজধানীর মতিঝিলের আদমজী কোর্টের সামনে রয়েছে বলাকা বা বক চত্বর। বক বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক অতীব পরিচিত পাখি। খালে-বিলে, নদী বা জলাশয়ে সাদা বকের ঝাঁক যেন দেশের প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ সাদা বকের দল নিয়েই ভাস্কর মৃণাল হক তৈরি করেছেন বলাকা। পিচঢালা রাস্তা আর সুউচ্চ অট্টালিকার মাঝে বলাকা যেন এক প্রশান্তির পরশ।

মিশুক
সুন্দরবন বাঙালির গর্বের বিষয়। এ বনের মায়াময় চিত্রাল হরিণ পৃথিবীর একটি আকর্ষণীয় প্রাণী। এ হরিণের আদলেই রাজধানীর শাহবাগে গড়ে তোলা হয়েছে একটি হরিণ শাবকের ভাস্কর্য যার নাম মিশুক। সুন্দর এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে এটি অত্যন্ত প্রিয়।

রানার
‘রানার ছুটেছে তাই, ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে/রানার চলেছে’ বিখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মতই সংগ্রামী জীবন ছিল বাংলার ডাক বাহকের। হাতে হারিকেন আর কাঁধে বল্লমে ঝুলানো ডাকের ব্যাগ বহনকারী খাকি পোশাক পরা ডাক হরকরার অতীত তুলে ধরতেই সে আদলেই তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্য ‘রানার’। রাজশাহী পোস্টাল একাডেমির গেট এ মনোরম ভাস্কর্যটি শোভা পাচ্ছে। ভাস্কর্যটি প্রতিষ্ঠা করেন আজমল হক সাচ্চু।
এসব স্থাপনার বাইরেও সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে আছে বাঙালি রঙে রঙিন বিভিন্ন ভাস্কর্য। শান্তির প্রতীক পায়রা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ক্রিকেট ভাস্কর্য, একতারা হাতে বাউল, লালন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, বেগম রোকেয়াসহ এলাকাভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী সব ভাস্কর্য দেশের প্রায় সব জেলাতেই রয়েছে। এসব ভাস্কর্যের মাঝেই রয়েছে বাঙালির প্রাণের স্পন্দন।

– সারোয়ার কবির
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৫ তম সংখ্যা, মে ২০১২