বিক্রমপুর হাউস। নাম শুনেই কারও বা মনে হতে পারে ঢাকার বিক্রমপুরের বিখ্যাত কোনো বাড়ি এটা। হয়তো বিখ্যাতই। তবে এটি পুরোনো কোনো সম্রাট কিংবা রাজা-বাদশার প্রাসাদ নয়। অতীত নিদর্শনের তেমন কোনো ছোঁয়াও নেই বাড়িটিতে। বিক্রমপুরের নাগেরহাটের এই বাড়িটি নির্মিত হয়েছে বছর কয়েক আগে, সমসাময়িক স্থাপত্য ধারার পরিপূর্ণ ছোঁয়া নিয়ে। স্বপ্নীল এ বাড়িকে ঘিরে রয়েছে বিশাল পুকুর, খোলামেলা শানবাঁধানো ঘাট, চারপাশে ছায়াঢাকা পায়েহাঁটা পথ আর বর্ণিল সব ফুলের উপস্থিতি। কমতি নেই ফলগাছেরও। বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসের লন। দেখলেই বোঝা যায় আবহমান বাংলার চিরচেনা রূপটাকেই স্থপতির তুলিতে বাস্তবে ফুটিয়ে তোলার কার্যকর প্রয়াস রয়েছে এ স্থাপনাটিতে।
বিক্রমপুর হাউস মূলত প্রকৃতিপ্রেমী একজনের অবসরস্থল। হাউসটির কর্ণধার আনোয়ার হোসেন পেশায় ব্যবসায়ী হলেও শিল্প-সংস্কৃতি প্রেম আর রুচিবোধে অনন্য। ব্যস্ত জীবনের ছকে বাঁধা সময় আর ঢাকার বিরক্তিকর একঘেয়ে জীবন ছেড়ে সুযোগ পেলেই চলে আসেন সবুজের কাছে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে, কখনো বা বিভিন্ন উৎসবে স্বজনদের নিয়ে এখানেই মেলেন প্রাণের উৎসবে। দক্ষিণা খোলা বাতাস আর নরম রোদের খেলায় নিজেকে মেলে ধরে সময় কাটিয়ে দেন সামাজিক কাজেও। ক্ষণিকের সময় কাটানো আর গ্রাম-বাংলার সরল মানুষের সঙ্গে মেলামেশার উদ্দেশ্যেই উদ্ভব বিক্রমপুর হাউসের।

বাড়িটির স্থাপত্যিক ডিজাইন খুব সাদামাটা। পাখির চোখে দেখলে মনে হবে একটা লম্বা আয়তাকৃতির মূল ভবনের ভেতর থেকেই ছোট ছোট আয়তনের কিউব বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করে দিচ্ছে সবুজ গাছ, পানির আধার, রোদের মায়াবী ছায়া। স্বচ্ছ কাচে ঢেকে যাচ্ছে কিয়দংশ। পুরো ভবনটি তার পারিপার্শ্বিক সবুজের মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ঠিক যেন ক্লান্ত পথিক হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে খোলা প্রান্তরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হচ্ছে প্রকৃতি। আর্কওয়েভ কনস্যালট্যান্টসের প্রধান স্থপতি খালিদ মাহমুদ তাঁর ডিজাইন কনসেপ্টকে ঠিক এভাবেই ব্যাখ্যা করছিলেন। বিক্রমপুর হাউসের স্থাপত্য ডিজাইন মূলত তাঁরই হাতের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছে অনবদ্য। ল্যান্ডস্কেপিং ডিজাইনও তিনি নিজেই করেছেন। স্থপতি মীর নাইয়ান সাকিব, স্থপতি রিয়াজুল হক, স্থপতি আবু ইমরানসহ অন্যরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁকে।
স্থপতি এই প্রকল্পটিকে ডিজাইন করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে; শিল্পের সবটুকু রস ঢেলে দিয়ে। কোনো কৃত্রিম প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই বাড়িটি তার বাসিন্দাদের জন্য হয়ে উঠেছে আরামদায়ক, একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব। ডিজাইনটা লম্বাটে ধরনের হওয়ায় প্রতিটা কক্ষে প্রচুর আলো-বাতাসের প্রবেশ নিশ্চিত করা গেছে। পূর্বমুখী প্রধান দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে আটকে যায় বিশাল ড্রয়িংরুমে। কয়েক ধাপ এগোলেই সামান্য উঁচু হয়ে তার সঙ্গে আছে উন্মুক্ত ডাইনিং। ডাবল হাইট স্পেসের মধ্য দিয়ে একটি পেঁচানো সিঁড়ি গিয়ে মিশেছে দোতলার ফ্যামিলি লিভিং স্পেসের সঙ্গে। নিচতলায় রয়েছে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। আর দ্বিতীয়তলা একান্তই পারিবারিক অঙ্গন। ফ্যামিলি লিভিং স্পেসকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে তিনটি বেডরুম, যার জানালার স্বচ্ছ কাচের মধ্য দিয়ে দৃষ্টি চলে যায় দিগন্ত সীমায়। বৃষ্টি না হলে কাচের দেয়াল পেরিয়ে খোলা ব্রিজে এসে দাঁড়ালে হয় অনন্য এক অনুভূতি। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মুক্ত আকাশ, উদার জমিন। দূরে শান্ত জলরাশি, নিচে তাকালেই স্বচ্ছ পানির আধার। ব্রিজের গা বেয়ে চারদিক দিয়ে ঝরঝরিয়ে পানি যখন নিচে পড়তে থাকে, তখন সৃষ্টি হয় ভিন্ন এক অনুভূতির। মন চাইলে খোলা ঝুলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া যায় ছাদ অবধি। বাড়িটি তিনতলার সমান হলেও মূল অংশ দোতলা পর্যন্ত। তৃতীয় তলায় একটি সুপরিসর কক্ষ আর সংলগ্ন বিশালাকৃতির সাজানো খোলা ছাদ, যেকোনো পারিবারিক মিলনমেলার জন্য উৎকৃষ্ট স্থান। বাড়িটির চারপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে বাগান আর জলাধার থাকায় এটি হয়ে উঠেছে প্রকৃতির অংশ; সৃষ্টি হয়েছে নান্দনিক প্রাকৃতিক পরিবেশ।

বাড়ির দক্ষিণ দিকে রয়েছে দ্বিতীয় আরেকটি প্রবেশপথ। ডাইনিং স্পেস থেকে কয়েক ধাপ নিচু হয়ে দরজা পেরিয়ে ধাপে ধাপে নামতে হয় পারিবারিক বাগানে। হাঁটতে হাঁটতে একদম চলে আসা যায় পুকুরপাড়ে। বাড়িটির দক্ষিণ পাশে পুকুর থাকায় দক্ষিণা বাতাস পানি ছুঁয়ে যায়। তাই গরমের দিনেও অনায়াসে ঠান্ডা বাতাস বাড়িটিকে ঘিরে রাখে। আর শীতের দিনে এটিই হয়ে ওঠে রোদ পোহানোর উঠোন। বাড়িটি মোট পাঁচটি ধাপে থরে থরে প্রায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা। তাই বর্ষায় অথবা প্রাকৃতিক বন্যায় এখানে পানি ওঠার বা আটকে থাকার আশঙ্কা নেই একদমই।
বিক্রমপুর হাউসের নির্মাণকাজ শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় চার বছর। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু তৈয়বের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন আর প্রকৌশলী কাজী আবিদ হাসানের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডসহ আনুষঙ্গিক নিয়ম মেনে ভবনটি নির্মিত। কম উচ্চতাসম্পন্ন ভবন হলেও ভূমিকম্প, ঝড়, মাটির অবস্থা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় রেখেই সব ধরনের ডিজাইন ও স্থাপনাটির নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে। বিক্রমপুর হাউস স্থানীয় অধিবাসীদের চোখে তাই শান্তির নীড় হিসেবেই বিবেচিত। ঢাকা-মাওয়া সড়ক হয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে নাগেরহাটের ছোট খালের তীর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এ নীড় যেকোনো পথিকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কাছে টানবে এর আঙিনায় একটু সময় কাটিয়ে যেতে।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫১ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৪