ঢাকায় অধিকাংশ ভবনই অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ!

দেশে ভবন নির্মাণ আইন, বিধিমালা এবং বিল্ডিং কোড থাকা সত্তে¡ও প্রায় ত্রæটিযুক্ত ঘরবাড়ি, ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ যেন পরিণত হয়েছে একধরনের নিয়মেই! এই অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে অগ্নিদুর্ঘটনা, বিস্ফোরণ, ধস ইত‍্যাদি ঘটছে। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ অনেক স্থানে আগুন লাগা। আর যদি ভূমিকম্প হয়, তাহলে বলা যায় করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আইন অনুযায়ী যেকোনো কিছু বা নির্মাণসামগ্রী দিয়ে বানানো যেকোনো ঘরবাড়ি, ভবন ও অবকাঠামোকে ভবন বলা হয়। ভবন নির্মাণ বিধিমালা মোতাবেক ঢাকার মহাপরিকল্পনা/ড‍্যাপ অনুসারে, কোনো বসবাসযোগ‍্য জমির ওপর যথানিয়মে ভূমি ব‍্যবহার ছাড়পত্র গ্রহণ এবং প্রস্তাবিত ইমারতের স্থাপত‍্য ও কারিগরি ডিজাইন তৈরি ও অনুমোদন করিয়ে উপযুক্ত নির্মাণসামগ্রী ব‍্যবহার করে এবং কারিগরি লোকজনের তত্ত¡াবধানে যেকোনো ধরনের ভবন নির্মাণ করা এবং বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা বাধ‍্যতামূলক। 

কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই ঘটছে এর ব‍্যত‍্যয়। অনেকে রাজধানীতে বসবাস করেও এসবের ব‍্যত‍্যয় ঘটিয়ে ও অনুমোদন না নিয়েই ভবন নির্মাণ করেছেন, করছেন বা এখনো করে চলেছেন। অপর দিকে যারা অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করে, তাদের বেশির ভাগও আবার প্রায় ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশার ব‍্যত‍্যয় ঘটিয়ে সমতলে ও ঊর্ধ্বমুখী ইমারতের সম্প্রসারণ এবং বিধি/কোডের পরিপন্থী করে ও কারিগরি লোকজনের অনুপস্থিতিতে ভবন নির্মাণ করে চলেছেন। তা ছাড়া যেভাবে অনুমোদন লাভ করে, তার ব‍্যত‍্যয় ঘটিয়ে ইমারতের ব‍্যবহার এমনকি বেসমেন্ট ফ্লোর ও (যা গাড়ি পার্কিংয়ের জন‍্য নির্মিত) যেন অন‍্যভাবে ব‍্যবহার করা একটা ফ‍্যাশনে পরিণত হয়েছে।

প্রচলিত নিয়মে বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড অনুসরণে যথাযথভাবে ভবন নির্মাণ শেষে অথবা ভবনের আংশিক নির্মাণ করে তা ব‍্যবহার করা বা ভাড়া দেওয়ার আগে নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ থেকে ইমারতের বসবাসযোগ‍্য সনদ বা অকুপেনসি সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে খুবই কমসংখ‍্যক ইমারতের মালিক/রিয়েল এস্টেট ব‍্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান এই সনদ গ্রহণ করে। এর প্রধান কারণ হলো- যথাযথভাবে অর্থাৎ অনুমোদন মোতাবেক ভবন নির্মাণ না করা, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা ইত‍্যাদি। প্রকৃত অর্থে, এ ধরনের প্রায় ভবনই ‘ত্রæটিযুক্ত’ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত! এতে বড় সমস‍্যা দেখা দেয়- যদি কখনো কোনো কারণে এসব ইমারতে আগুন লাগে, বিস্ফোরণ ঘটে বা ধসের সৃষ্টি হয়। কারণ, তখন তাৎক্ষণিকভাবে এসব ইমারতের অনুমোদনের তথ‍্য বা অনুমোদিত নকশা পাওয়া যায় না; এসব প্রায় ইমারতে ডিজাইন মোতাবেক অগ্নিনির্বাপণ ও অগ্নিপ্রতিরোধের তথ‍্যাবলি মেলে না এবং এতদ্্বিষয়ে কিছু লাগানো বা স্থাপন করা হলেও তা ভালোভাবে কার্যকর থাকে না। অন‍্যদিকে এসব ইমারতের নিচে বা আশপাশে পয়ঃপ্রণালি ও বিদ্যুৎ লাইন বা গ‍্যাসের লাইন ও লিকেজগত বিষয়ও একটি বড় সমস‍্যা। যদি এই অবস্থায় ঢাকায় বা আশপাশে বড় আকারের ভূমিকম্পন হয় তাহলে তো এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

আগেকার দিনে প্রায় মানুষ স্থানীয় বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নিজ নিজ তত্ত¡াবধানে নিজেদের ঘরবাড়ি বা ভবন নির্মাণ করতেন, আর এখন সেখানে প্রায় ক্ষেত্রেই নানা ধরনের এমনকি বর্জ‍্য, মিশ্র বা হালকা নির্মাণসামগ্রী দিয়ে স্থানীয় কনট্রাকটর বা ডেভেলপাররাই কোনো রকমে ভবন নির্মাণ করে থাকেন। সংগত কারণে এখানেই সৃষ্টি হয় সমস‍্যা! কারণ, সচরাচর বড় বা ভালো কনট্রাকটর বা ডেভেলপাররা অনুমোদিত ডিজাইন অনুসারে এবং গুণগতমান বজায় রেখে কমবেশি মোটামুটি ভালো ভবন নির্মাণ করে থাকেন। কিন্তু যাঁরা ছোট ঠিকাদার বা ওয়ান টাইম ডেভেলপার, তাঁরা খুব কম ক্ষেত্রেই যথাযথ নির্মাণসামগ্রী ব‍্যবহার ও বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করে থাকেন, ফলে এসব ইমারতে যত সব দুর্ঘটনা (অগ্নিদুর্ঘটনা, ফাটল ধরা, ধস ইত‍্যাদি) ঘটেই থাকে এবং আবার অনেক সময় কিছু ইমারতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা অপব‍্যবহারের কারণেও বিস্ফোরণ বা আকস্মিক ধসও ঘটে বসে, যা সাম্প্রতিককালে ঘটেছে সায়েন্স ল‍্যাবে, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ার সিদ্দিকবাজার ইত‍্যাদি এলাকায় কতিপয় ইমারতে।

লক্ষ‍ণীয়, ছোট ও অখ‍্যাত রিয়েল এস্টেট ব‍্যবসায়ী বা দুর্বল ঠিকাদার দ্বারা নির্মিত প্রায় ভবনই তুলনামূলকভাবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এসব লোকজনের প্রধান উদ্দেশ‍্যই থাকে প্রচুর মুনাফা করা। এ জন‍্য তারা ইমারতের সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণে অনেক ফাঁকি দেয়। যেমন, ডিজাইন মোতাবেক পাইলিং না করা, ঠিকমতো ফাউন্ডেশনের কাজ না করা, ব‍্যবহারের অনুপযোগী বেসমেন্ট তৈরি করা ইত‍্যাদি। অনুরূপভাবে তারা সুপার স্ট্রাকচার অর্থাৎ কংক্রিটে রড-সিমেন্ট কম দেয়, ভালো মানের খোয়া ও ইট ব‍্যবহার করে না এমনকি ভালো করে প্লাস্টার এবং কিউরিংও করে না! একই অবস্থা এমইপি ওয়ার্কসের ক্ষেত্রেও অর্থাৎ তারা কোনো রকমে ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল ওয়‍্যারিং, ফিটিংস লাগায় এবং সেনেটারি কাজও ঠিকমতো করে না! এসব বিভিন্ন কারণে একটি ভবন নির্মাণের পর থেকেই এটি ‘ত্রæটিযুক্ত’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবন হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। 

১৯ ফেব্রæয়ারি ২০২৩ তারিখ রাতে ঢাকার গুলশানে একটি অত‍্যাধুনিক ভবনে আগুন লাগার পর ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে দুইজনের মৃত্যু ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ভবনটিতে আগুন লাগার পর অগ্নিনির্বাপণের দায়িত্বে থাকা ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল সার্ভিস (এফএসসিডি)-এর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ করা হয় যে এই ভবনটি ত্রæটিপূর্ণভাবে নির্মিত হয়েছে, যেখানে ফায়ার এক্সিট ও ফায়ার অ্যালার্ম নেই, হাইড্রেন্ট নেই ইত‍্যাদি আরও অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে! ভবনটিতে আগুন লাগার কারণসহ সার্বিকভাবে বিষয়টি তদন্তের জন‍্য এফএসসিডির অধীনে পাঁচ সদসে‍্যর একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অপর দিকে রাজউক থেকে বলা হয়, এটি একটি অত‍্যাধুনিক ভবন এবং ভবনটির ব‍্যবহারের আগে এর বসবাসযোগ‍্য সনদও নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পরস্পরের মধে‍্য দায় এড়ানোর খেলা!

প্রসঙ্গক্রমে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে নগরীতে আরও যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় প্রতিটার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, কিন্তু কখনো কোনো তদন্ত কমিটির ফাইন্ডিংস, সুপারিশ ইত‍্যাদি আজ অবধি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি। অগ্নিকাÐের অপরাধে এফএসসিডি থেকে কখনো কোনো ইমারতের বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও শোনা যায়নি! পুরান ঢাকার নিমতলী এবং চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনে পুড়ে অনেক মানুষ মারা যাওয়ার পরও ওই দুটি তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। ওই অগ্নিদুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে সব রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন ঢাকার বাইরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যা আজও কার্যকর হয়নি। বরং অল্প কয়েক দিনের ব‍্যবধানে এসব পুড়ে যওয়া ভবন ও স্থাপনায় পুনরায় প্লাস্টার ও রং করে সেখানে আবারও বসবাস এবং ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য শুরু করা হয়েছে।

ঘরবাড়ি ও ইমারতে আগুন লাগা বা অন‍্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটা নতুন কোনো বিষয় নয়। বিভিন্ন কারণে বিশ্বের সর্বত্র (উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই) এমনকি সম্পূর্ণভাবে সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ভবন এবং স্থাপনায়ও আগুন লাগে এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তবে প্রতিটি অগ্নিকাÐের ক্ষেত্রে কীভাবে বা কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটল, কীভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ল, কত জানমাল ক্ষতিগ্রস্ত হলো ও পরবর্তী করণীয়Ñ এসব বিষয় পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের দেশে আজ অবধি এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি! কোনো দুর্ঘটনার তদন্ত-উত্তর এসব তথ‍্য আর জানা যায় না বা পাওয়া যায় না! ইতিপূর্বে ঢাকা মহানগরী এলাকায় তথা দেশজুড়ে আরও যেসব ভবন ও স্থাপনায় আগুন লেগেছে, তার সব ভবনই যে ত্রæটিপূর্ণভাবে ডিজাইন করা ও নির্মাণ করা হয়েছিল, তাও ঠিক নয়! 

কারণ, ইদানীং যেকোনো ইমারতের উল্লেখযোগ‍্য অপব‍্যহার হলো- ইমারতে বেসমেন্ট নির্মাণ করে তা অন‍্য ব‍্যবহারে নিয়ে যাওয়া। একইভাবে ইদানীং কমবেশি সব অ্যাপার্টমেন্ট বা অফিস স্পেসে নানা ধরনের অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক কাজসহ অনেক ইন্টেরিয়র ডিজাইনের করা হয়, যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে ইমারতের স্থাপতিক ও এমইপি (মেকানিক‍্যাল-ইলেকট্রো ও প্লাম্বিং) কাজের। কিন্তু এসব কাজ যথাযথ ব‍্যবস্থাপনায় ও নির্মাণসামগ্রী দিয়ে এবং অগ্নিপ্রতিরোধকভাবে করা হচ্ছে বা হয়েছে কি না তা পর্যবেক্ষণ এবং সনদ প্রদান বা প্রত‍্যয়ন করার জন‍্য দেশে কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এমনকি রাজধানী ঢাকায়ও এসব কাজের পর্যবেক্ষণ ও তদারকির জন‍্য আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই! যদিও রানা প্লাজা ধসের পর বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপে দেশের কমবেশি সব আরএমজি (গার্মেন্টস শিল্পে) স্থাপনার নিরাপত্তা ও পরিবেশের উন্নয়নে দেশি-বিদেশি পেশাজীবী মহলের তত্ত¡াবধানে অনেক কাজ হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে সার্বিকভাবে দেশের প্রায় আরএমজি স্থাপনাগুলো এখন অনেকটা টেকসই বলা যায়!!

ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল ডিজাইন যেকোনো ইমারতের জন‍্য একটি অপরিহার্য দিক, বিশেষ করে ইলেক্ট্রিক্যাল সিস্টেমের ডিজাইন ইমারতের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা এবং মঙ্গল নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বজুড়ে বিদ‍্যমান ন্যাশনাল ফায়ার প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (এনএফপিএ) এর মতানুসারে, ইলেক্ট্রিক্যাল কাজের ত্রæটি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবাসিক আগুনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ। দৃশ‍্যত বাংলাদেশেও অগ্নিকাÐের অন্যতম কারণ হলো ইলেক্ট্রিক্যাল শর্টসার্কিট। তবে এটি বিভিন্ন কারণে হয় যেমন, ত্রæটিপূর্ণ তার ও সুইচ, ওভারলোড সার্কিট এবং ইলেক্ট্রিক্যাল সরঞ্জাম, যা সঠিকভাবে ইনস্টল বা রক্ষণাবেক্ষণ না করার জন‍্য। একটি পরিকল্পিত ইলেক্ট্রিক্যাল ব‍্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ এই বিপদগুলো অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে এবং ভবন ও এর বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমানে বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট অথরিটির অনুপস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরই (এফএসসিডি) হচ্ছে এই কাজের জন‍্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এ জন‍্য ক্ষেত্রমতো ছয় বা দশতলার উঁচু যেকোনো ভবন বা অন‍্যান‍্য সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণের আগে এফএসসিডির ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে এফএসসিডি তাদের ছাড়পত্র প্রদানের আগে প্রতিটা প্রস্তাবিত ইমারতের সাইট পরিদর্শন করে এবং তাদের নিজস্ব লোকজন বা নিয়োজিত উপদেষ্টাদের দ্বারা অগ্নিনির্বাপণব‍্যবস্থার সমুদয় নকশা প্রণয়ন করে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শর্তারোপ করে ছাড়পত্র প্রদান করে থাকে। সে মোতাবেক ইমারতের নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ এফএসসিডি প্রণীত অগ্নিনির্বাপণ নকশা ও শর্তাধীনে ইমারতের নকশা অনুমোদন করে থাকেন। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এফএসসিডি এসব ইমারতের নির্মাণকালে সেখানে তাদের দেওয়া ছাড়পত্রের শর্ত মোতাবেক ভবনটি নির্মিত হচ্ছে কি না তা দেখতে যায় অর্থাৎ উল্লেখযোগ‍্য ভবনই নির্মিত হয়/হচ্ছে এফএসসিডি বা এমইপি বিশেষজ্ঞদের তত্ত¡াবধানের বাইরে।

একই অবস্থা রাজউক বা চউকের ক্ষেত্রেও কখনো এসব কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকৌশলী, ভবন পরিদর্শক বা অথরাইজড অফিসাররা নির্মাণাধীন কোনো ভবন পরিদর্শন করতে গেছেন কি না সন্দেহ!! বলতে গেলে এখনো দেশে এ ধরনের কোনো পদ্ধতিও গড়ে ওঠেনি! এমনকি বিল্ডিং কোডে তা বলা থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হয়, অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে ইমারতের মালিক বা তার নিয়োজিত কনট্রাকটর/ডেভেলপারদের লোকজনের দ্বারা ও তাদের তত্ত¡াবধানেই দেশে প্রতিটা ভবন নির্মিত হয়/হচ্ছে। ভবন নির্মাণ বিধিমালা ও বিল্ডিং কোডে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রেই ইমারতের মূল স্থপতি/ডিজাইনার ও প্রকে‍ৗশলীরা নির্মাণকালে তা দেখতে বা পরিদর্শনে যান। আবার এটাও ঠিক যে অনেক ক্ষেত্রে কোনো একটা ইমারতের নির্মাণকালে কনট্রাকটর/ডেভেলপারের সাইট প্রকৌশলীদের ঘন ঘন সাইট পরিবর্তনের কারণেও কাজের মান এবং তদারকির ধারাবাহিকতা থাকে না। 

এই অবস্থায়, যখন কোনো ইমারতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ আগুন লাগে বা বিস্ফোরণ/ধস হয়, তখন শুরু হয় পরস্পরের মধে‍্য দোষারোপের খেলা। যেখানে এফএসসিডির লোকজন কখনোই কোনো ইমারতের অগ্নিনির্বাপণব‍্যবস্থা ঠিকমতো নির্মিত বা করা হয়েছে কি না তা পর্যবেক্ষণ না করেই রাজউক বা অন‍্যান‍্য সংস্থার ওপর দোষারোপ করতে থাকে! যেমন কয়েক বছর আগে ঢাকার পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি সেন্টারে আগুন লাগার পর এফএসসিডির একই রকম কথা ছিল- যদিও বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে ওই ইমারতে পুরো ফায়ার ডিজাইন ও বাস্তবায়ন একটি উপযুক্ত বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো, এভাবে ঢাকায় প্রতিটা ইমারতে অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এফএসসিডি আগেভাগেই তাদের দায়মুক্তি করে নেয়! 

অথচ গুলশানের ১০৪ নম্বর সড়কে অগ্নিকাÐের পর রাজউক থেকে বলা হয় যে এই ভবনটি বিধি ও কোড অনুসরণে নির্মিত হয়েছে এবং ভবনের মালিক রাজউক থেকে অকুপেনসি সার্টিফিকেটও গ্রহণ করেছেন। তাই এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, এফএসসিডি বিবেচ‍্য ভবনটির নির্মাণে ছাড়পত্র দেওয়ার পর কখনো তারা আর এই ভবনটির ইন্টেরিয়র নির্মাণসামগ্রী তথা এমইপির কাজ বিশেষ করে অগ্নিনির্বাপণের কাজ পরিদর্শন করেছে কি না? যেভাবে বিশ্লেষণ না করেই এফএসসিডি বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগার পর ওই ভবনটির অগ্নিনির্বাপণব‍্যবস্থাকে দোষ দিয়ে বসে- অতঃপর ওই ইমারতে আগুন লাগার কারণ আর আজ অবধি প্রকাশিত হয়নি!!

আসলে দেশে যথাযথভাবে ও টেকসই প্রক্রিয়ায় ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে বিশেষ করে ঢাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ন‍্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি-১৯৯৩) প্রণীত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিগত ৩০ বছরেও এই কোডটির কার্যকরণে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা হয়নি। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রায় ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক নিহত হওয়ার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত (সুপ্রিম কোর্ট) দেশব‍্যাপী এই কোডটির কার্যকরণে একটি শক্তিশালী কমিশন বা কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ দেন, কিন্তু আজ অবধি এই নির্দেশটিও আর কার্যকর হয়নি। ইতিমধে‍্য এই কোডটিকে আবার সংস্কার করে বিএনবিসি-২০২০ নামে জারি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানের অভাবে এটি এখনো একটি অপটিনাল ডকুমেন্ট হিসেবেই রয়ে গেছে!

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে রাজধানী ঢাকায় উপর্যুপরি ইমারতে অগ্নিকাÐ ও ভবনধসের পরিপ্রেক্ষিতে এক সরকারি আদেশের মাধ‍্যমে রাজউককে ঢাকায় এই কোডটির বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ জন‍্য রাজউকে আজ অবধি এতদ্্বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞ প্রকৌশলী বা বাড়তি কোনো জনবল প্রদান বা নিয়োজিত করা হয়নি। উল্লেখ‍্য, বিএনবিসি একটি সম্পূর্ণ কারিগরি দলিল, যেটি বোঝা ও এর অধীনে যেকোনো নির্মাণকাজের বাস্তবায়ন তদারকির জন‍্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর প্রয়োজন, কিন্তু ঢাকায় রাজউকের অথরাইজড শাখায় এ ধরনের কোনো কাজের তদারকি/মনিটরিং করার জন‍্য একজন প্রকৌশলীও নেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে!! অর্থাৎ রাজউকে নকশা অনুমোদনের জন‍্য নিয়োজিত তার নিজস্ব সীমিত জনবল দিয়েই এই কার্যক্রমও চালাচ্ছে, এতে ঠিকমতো না হচ্ছে নকশা অনুমোদন কার্যক্রম, না হচ্ছে ভবন নির্মাণকাজের তদারকি বা মনিটরিং!! 

বিদ‍্যমান ভবন নির্মাণ বিধিমালা ও বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) ইমারতের শ্রেণিবিন‍্যাস অনুসারে ডিজাইন ও তদারকির জন‍্য স্নাতক স্থপতি, প্রকৌশলী ও অপরাপর পেশাজীবীদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া থাকলেও প্রায়ই ক্ষেত্রে নকশা অনুমোদনের পর ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থপতি ও প্রকৌশলীরা আর এই নির্দিষ্ট বা বিবেচ‍্য ভবনের নির্মাণের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন না। তখন যেখানে দেখা যায় অর্থাৎ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অধস্তন বা অনভিজ্ঞ কিছু স্থপতি, প্রকে‍ৗশলী বা রাজমিস্ত্রিদের তত্ত¡াবধানে ভবন নির্মিত হতে! এ জন‍্য একটি ইমারতের নির্মাণ শেষে এর অকুপেনসি সার্টিফিকেট পেতে অনেক সমস‍্যার সৃষ্টি হয়!!

কিছুদিন আগে তুরস্কে এক শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর সেখানে হাজার-লাখ ভবন মুহূর্তের মধে‍্য ভেঙে পড়ে পুরো এলাকাটি একটা ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। এই ভূমিকম্পনে অনেক শক্তিশালী ভবনও ভেঙে পড়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত সেখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা গেছে এবং প্রায় আড়াই লাখ ভবন ভেঙে পড়ছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণের জন‍্য সেখানে প্রায় ১৫০ জন ঠিকাদার/ডেভেলপারকে আটকও করা হয়েছে। অথচ আমরাও একটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বসবাস করছি, যেকোনো মুহূর্তে‍ এখানে (ঢাকা বা সমগ্র দেশজুড়ে) বড় আকারের বা শক্তিশালী মাত্রার ভূমিকম্পন হতে পারে!! কিন্তু এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কারও কোনো মাথাব‍্যথাই নেই! আর যখনই কোনো ইমারতে আগুন লাগে, বিস্ফোরণ ঘটে বা ভূমিকম্প হয়, তখন পরস্পরের মধে‍্য গতানুগতিক নিয়মে বেøম গেম চলে এবং কয়েক দিন কিছু মিডিয়ায় আলাপ-আলোচনা হয়ে সবকিছু থেমে যায়। 

এখন অবস্থা এমনই যে ঢাকা মহানগরী এলাকায় প্রকৃত কত ঘরবাড়ি, বহুতল ভবন ও স্থাপনা/অবকাঠামো আছে তার কোনো পরিসংখ‍্যান রাজউক বা অন‍্য কোনো সংস্থার কাছেও নেই! রাজউকের এক পরিসংখ‍্যানে বলা হয় যে বর্তমানে ঢাকায় মাত্র ৪.৬ শতাংশ ইমারতের নকশা অনুমোদিত। অপর দিকে গৃহসংস্থান অধিদপ্তর (এইচবিআরআই) এর মতে ঢাকায় প্রায় ৬০ শতাংশ ভবনই বিভিন্নভাবে ঝুঁকিপূর্ণ! আর ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের (এফএসসিডি) মতে, দেশের সব ভবনই অগ্নিনির্বাপণের দৃষ্টিতে কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়!! তাহলে আমরা কোথায় বসবাস করছি? যে দেশে কোনো বাসস্থান, কর্মস্থল বা অবকাঠামোই নিরাপদ নয়, সেখানে যদি বড় মাত্রায় ভূমিকম্পন হয়, তাহলে কী অবস্থাই-না হবে?

ঢাকায় আইনানুগভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও অবকাঠোমো চিহ্নিত করা এবং অপসারণের দায়িত্ব উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওপর। পুরান বা নতুন ঢাকা এমনকি নগরীর আশপাশে অসংখ‍্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি ও ভবন রয়েছে, কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে কখনো ডিএনসিসি বা ডিএসসিসি কর্তৃক কোনো ব‍্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি! এই অবস্থায় কয়েক বছর আগে বনানীর ‘এফ আর টাওয়ারে’ আগুন লাগার পর ওই ভবনটি ডিএনসিসি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে তা পরিত‍্যক্ত করে রাখা ছাড়া আর কোনো ব‍্যবস্থা নেয়নি। একইভাবে কয়েক বছর আগে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় ‘চাঁদনী চক’ মার্কেটসহ আরও কয়েকটা মার্কেট ও স্থাপনাকে সিটি করপোরশনস কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত‍্যক্ত ঘোষণার পরও এখনো এসব ভবন/স্থাপনায় দেদারসে ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য চলে আসছে। বরং সিটি করপোরেশন নগরীতে এ ধরনের আরও অনেক চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা থেকে হোল্ডিং ট‍্যাক্স উত্তোলন করে, সেগুলোকে এখনো বৈধ ইমারতের মতো স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে, হোল্ডিং ট‍্যাক্স ইত‍্যাদি তুলছে!! এই অবস্থায় ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন একধরনের ‘গলার কাঁটায়’ পরিণত হয়েছে।

মোট কথা, রাজউক ঢাকায় কোনো একটা ইমারতের নকশা অনুমোদন করেই ক্ষান্ত। অর্থাৎ ভবনটি অনুমোদিত নকশা ও বিল্ডিং কোড মোতাবেক নির্মিত বা নির্মাণ করা হচ্ছে কি না তা দেখতে বা এই দায়িত্ব পালনে ব‍্যর্থতার পরিচয়ে অভিযুক্ত, তেমনি ফায়ার ব্রিগেড/এফএসসিডি এবং অপরাপর সংস্থা যেমন ওয়াসা, তিতাস ও বিদ্যুৎ বিভাগ কোনো একটা ইমারতের নকশা অনুমোদনের আগেই তাদের পক্ষ থেকে ছাড়পত্র ও কিছু সুপারিশ দিয়েই ক্ষান্ত। অর্থাৎ তারাও কখনো তাদের সুপারিশকৃত ডিজাইন অনুসারে ভবনটি অগ্নিপ্রতিরোধনীয় করে নির্মিত বা নির্মাণ করা হচ্ছে কি না কখনো তা দেখা বা পরখ করেনি! এর ফলেই ঢাকায় প্রতিনিয়ত যত দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। আর কোথাও আগুন লাগলে ‘রাজউকের ওপর’ সব দোষ চাপিয়ে এফএসসিডিসহ অন‍্যরা নিজেরা এর অগ্রিম দায়মুক্তি নিয়ে নেয়!! 

প্রকৃত পক্ষে, এখন দেশের নগর এলাকায় কোনো একটি ইমারতে আগুন লাগা ও ত্বরিত ছড়িয়ে পড়ার অন‍্যতম কারণ হলো দাহ‍্যসামগ্রী দিয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা। আর অনেকেই এসব কাজ করিয়ে থাকেন অনভিজ্ঞ ডিজাইনার বা লোকজনকে দিয়ে। নিয়ম হলো অবশ‍্যই সব ইন্টেরিয়রের কাজ অদাহ‍্য বস্তু দিয়ে করা এবং এ কাজের জন‍্য প্রত‍্যয়নের ব‍্যবস্থা থাকা অথচ বর্তমানে এ জন‍্য কোনো ব‍্যবস্থা নেই! আর এসব কাজ হচ্ছে- ‘ভুঁইফোঁড়’ একটি মহল কর্তৃক এবং আবার অনেকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অ্যাপার্টমেন্ট ও অফিস স্পেসে মাত্রাতিরিক্ত ইন্টেরিয়রের কাজ করিয়ে একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বসেন। বাস্তবে কিছু মালিক বা ভাড়াটিয়াদের বাড়াবাড়িতেও এ ধরনের অনাহূত কাজ হয়ে থাকে, যা যেকোনো ভবনকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

আরেকটি বড় বিষয় হলো, যেকোনো ভবন নির্মাণের পর তা ব‍্যবহারের আগে অকুপেনসি সার্টিফিকেট বা বসবাসের সনদ গ্রহণ করা। কিন্তু যেহেতু প্রায় ক্ষেত্রেই নকশা মোতাবেক ভবন নির্মিত হয় না, সে জন‍্য সবার পক্ষে এই অকুপেনসি সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভবপর হয় না! তাই আইন অনুযায়ী এসব ভবন ‘অবৈধ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে!! রাজধানী ঢাকার চৌহদ্দিতে এ ধরনের (বিভিন্ন মাত্রায়) কত অবৈধ/ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি/ভবন ও স্থাপনা আছে, তা কখনো যথাযথভাবে জরিপ বা বিশ্লেষণ করা হয়নি! আর এই অবস্থায় বিভিন্ন সংস্থা/কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমানভিত্তিক তথ‍্য প্রদান করা হয়ে থাকে! এতদ্্বিষয়ে কোনো বিআইএম (বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং) বা কারও কাছে এর কোনো ডেটাবেইসও নেই!!

এ ব‍্যাপারে সম্প্রতি বিশ্বব‍্যাংকের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় রাজউকের অধীনে আরবান রেসিলেন্স প্রজেক্ট (টজচ) শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় কিছু সমীক্ষা ও কেস স্টাডি হয়েছে। আমি নিজেও এই কাজটির সঙ্গে কিছুদিন সংযুক্ত ছিলাম। কিন্তু বাস্তবে রাজউকের ঊর্ধ্বতন মহল তথা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আন্তরিকতার অভাবে এই প্রকল্পটির সুপারিশমালার কার্যকরণ এখনো শুরু হয়নি! সতি‍্যকার অর্থে, যেই আগ্রহ ও উদ্যোগে এই প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল, সেভাবে এটি সম্পন্ন বা শেষ হয়নি!! আর যা সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলোরও তেমন কোনো বাস্তবায়ন হয়নি, এমনকি ঢাকার বর্তমান অবস্থার বিবেচনায়ও এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না!

যেমন, এই প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক এক সমীক্ষায় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ৩১৪টি বহুতল ইমারতে বিভিন্ন ধরনের সমস‍্যা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এসব ভবনের কোনটি কোন মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ এবং এসব ভবনকে রেট্রোফিটিং করে ঠিক করা সম্ভবপর হবে কি না, তার কোনো কাজ শেষ করা যায়নি! অনুরূপভাবে ঢাকার কোন এলাকার মাটিতে বহুতল ভবন বা বড় স্থাপনা নির্মাণযোগ‍্য, তাও বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ‍্যমে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু এই কাজও পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি! একইভাবে ঢাকায় নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়াকে উন্নত (ডিজিটাইজেশন) করার জন‍্য ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমেটিং সিস্টেম (ঊঈচঝ) নামে যেসব সফটওয়্যার তৈরি, বিধিমালা প্রণয়ন এবং হার্ডওয়্যার সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেগুলোও প্রকল্পের গোডাউনে পড়ে আছে!!

অপর দিকে দীর্ঘদিন পর ঢাকার উন্নয়নে নতুন ড‍্যাপ (২০২২-২০৩৫) প্রণীত হয়েছে, কিন্তু এর বিভিন্ন প্রস্তাবনা নিয়ে প্রচÐ আলোচনা- সমালোচনার মুখে বর্তমানে এটির সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। খুবই আশ্চর্যে‍র বিষয় হলো, এই ড‍্যাপে ঢাকায় অবৈধ, অননুমোদিত বা অনুমোদনের ব‍্যত‍্যয় করে নির্মিত ইমারতের জরিমানা তার অনুমোদনের জন‍্য সুপারিশ করা হয়েছে। এ জন‍্য ইতিমধে‍্য ১২ সদসে‍্যর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে! যদি এর প্রতিটা ভবনকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে এবং জরিমানা দিয়ে এগুলো ভবনকে নিয়মিত করা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে অচিরে ঢাকার ভয়াবহ সর্বনাশ ঘটবে!! যদি অনতিবিলম্বে ভবন নির্মাণ আইনের আওতায় বিএনবিসি অনুসরণে জাতীয়ভাবে একটি শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ গঠন করা, বিআইএম বিআইএমের মাধ‍্যমে ডেটাবেইস করা এবং কোড এনফোর্সমেন্ট অথরিটিতে এতদ্্বিষয়ে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ লোকজনের পদায়নের ব‍্যবস্থা করা ও টেকসইভাবে ভবন নির্মাণ না করা হয়, তাহলে চলমান প্রক্রিয়ায় অচিরে একটি ভয়াবহ পরিণতির জন‍্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে!!

প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম

লেখক

সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৩ তম সংখ্যা, মে ২০২৩

Scroll to Top