আপনি বাড়ি তৈরি করবেন। বাড়ির লে-আউট দেওয়া থেকে শুরু করে মাটি কাটা, শাটারিং, কাস্টিং বা ঢালাই, ইটের গাঁথুনির কাজ, প্লাস্টারিং অনেক কাজ। সব সময় প্রকৌশলী উপস্থিত থাকেন না। মাঝে মধ্যে কাজ দেখতে হতে পারে আপনাকে। তাই সাধারণ কিছু বিষয় জেনে নিন…
লে-আউট দেওয়ার সময় ভুল
মূলত সঠিকভাবে লে-আউট দেওয়া না হলে বিল্ডিংয়ের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে ঠিক করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সে জন্য লে-আউট দেওয়ার সময় বাড়ির বাইরের মাপ ঠিক আছে কিনা, কোনাগুলো ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কিনা এদিকে ভালোভাবে নজর দিতে হবে।
মাটি কাটার সময়
বাড়ি নির্মাণের শুরুতেই যেসব দুর্ঘটনা ঘটে তা মাটি কাটার সময় ঘটে। পাশের দেয়ালগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে দেয়াল ধসে পড়া একটা সাধারণ ব্যাপার। অথচ শুরুতেই যদি চারপাশে মাটি অথবা দেয়াল যাতে ধসে না পড়ে সে জন্য বল্লি দিয়ে অথবা শিট পাইলিং করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে না। অথচ সামান্য খরচের ভয়ে বাড়ির নির্মাতাগণ এ বিষয়টা এড়িয়ে যান। আর যখন পাড় ভাঙা শুরু করে কিংবা পার্শ্ববর্তী বাড়ির দেয়াল ভেঙে পড়ে তখন অনেক বেশি খরচ করে কাজটা করতে হয়। আবার দেয়াল ভাঙার জন্য ক্ষতিপূরণও দিতে হয়।
পাইলিং
ডিজাইন অনুযায়ী পাইল স্থাপন করতে হয়। প্রি-কাস্ট পাইলিংয়ে খরচ একটু বেশি হলেও কাজের গুণগত মান অনেক বেড়ে যায় এবং এর ফলে পরিবেশ দূষিত হয় না, চারপাশ পানি ও কাদায় নোংরাও হয় না। তবে আমাদের দেশে সাধারণত কাস্ট-ইন-সিটু পাইলিংই করা হয়। এ ক্ষেত্রে সেন্টার ঠিক রেখে পাইলিং করতে হবে, তা না হলে কলামের অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে।

ফাউন্ডেশন ঢালাইয়ের কাজ
মাটির নিচে থাকে, এই ভরসায় অনেকে ফাউন্ডেশনের ঢালাই কাজে সঠিক যত্ন নেন না। যদি পাইলিং না লাগে এবং সিঙ্গেল কলাম ফুটিং কিংবা কম্বাইন্ড ফুটিং হয় তবে মাটির উপরে অনেকে ফুটিং ঢালাইয়ের আগে গর্তের মধ্যে পলিথিন দেন, তার উপর সিসি ঢালাই হয় এবং তারও উপর ফাউন্ডেশনের জন্য রড বিছিয়ে ঢালাই কাজ করা হয়। পলিথিন দেওয়ার যুক্তি হলো পলিথিনটা নিচ থেকে পানি উঠতে বাধা দেয়। এটা সত্য, তবে সমস্যা হচ্ছে পলিথিন মাটি ও ফাউন্ডেশনের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং ভূমিকম্পের সময় বিল্ডিং উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সাধারণত মাটি কেটে সমান করার পর ইটের সলিং দিয়ে তার উপর সিসি ঢালাই দেওয়া হলে পলিথিন ব্যবহার না করেও পানির হাত থেকে বাঁচা যায়। অনেক প্রকৌশলীই অবশ্য পলিথিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন। কিন্তু পলিথিন উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে।
গাঁথুনির কাজ
ইটের কাজ ফ্রেমড স্ট্রাকচারে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা ভারবহনকারী দেয়ালের ক্ষেত্রে। বিম-কলাম-স্ল্যাব বিল্ডিংয়ে ইটের দেয়াল পার্টিশন ওয়াল হিসেবে কাজ করে আর Load Bearing Wall-এ ইটের দেয়াল বিল্ডিংয়ের ভার বহন করে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই নিচের বিষয়গুলোর দিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে, যাতে রাজমিস্ত্রিরা এ ধরনের ভুল না করতে পারে।
ছাদ ঢালাই
ঢালাই বলতে আমরা বুঝি তৈরিকৃত কংক্রিট স্থাপন করাকে। সাধারণত দেখা যায় বাড়ির মালিক ছাদ ঢালাইকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তার পরও বড় বড় ভুল ছাদ ঢালাইয়ের সময়ই ঘটে থাকে। প্রথমত নির্মাণ সামগ্রীর গুণগত মান। ঢালাই বা কাস্টিং হয় সিমেন্ট, বালি, খোয়া ও পানির সংমিশ্রণে। ঢালাইয়ের মধ্যে প্রত্যেকটি উপাদানই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সিমেন্ট ভালো দিলাম অথচ বালি দিলাম খারাপ, তা হলে ভালো ঢালাই পাওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে খোয়া বা পানিও ভালো হতে হবে। সাধারণত ছাদ ঢালাইয়ে ১ : ২ : ৪ (সিমেন্ট : বালি : খোয়া) অনুপাতে কংক্রিট তৈরি করা হয়।
ঢালাইয়ের সময় নিম্নবর্ণিত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে-
- বালি হতে হবে দানাদার অর্থাৎ এফএমের মান ২.৫ হতে হবে। ঢাকায় সিলেট বালি হিসেবে পরিচিত লাল বালি এই কাজের জন্য উপযোগী। তবে দাম বেশি হওয়ার কারণে অনেকে সিলেট বালির সঙ্গে লোকাল বালি দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে পরিমাণে সিলেট বালিই বেশি হতে হবে।
- ব্যবহারের পূর্বে বালি ধুয়ে ছেঁকে নিতে হবে, যাতে এর মধ্যে কোনো প্রকার কাদামাটি, গাছের শেকড়, সুরকি ইত্যাদি না থাকে।
- খোয়া হতে হবে বিভিন্ন সাইজের। সর্বনিম্ন কোয়ার্টার ইঞ্চি পর্যন্ত প্রত্যেকটি সাইজের খোয়া থাকতে হবে। ব্যবহারের পূর্বে খোয়া ছেঁকে নিতে হবে যাতে এতে সুরকি না থাকে।
- ব্যবহারের পানি পরিষ্কার হতে হবে।
- মিশ্রণের অনুপাত ঠিক রাখতে হবে। যদি ১ : ২ : ৪ অনুপাতে ঢালাই হয় তবে তাতে ১ ভাগ সিমেন্টের সঙ্গে ২ ভাগ বালি ও ৪ ভাগ খোয়া ব্যবহার করতে হবে। মিশ্রণে সিমেন্টের পরিমাণ কম দিলে চলবে না।
- ঢালাইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে W/C (Water/Cement) Ratio বা পানি ও সিমেন্টের অনুপাত। ঢালাইয়ের মধ্যে পানির পরিমাণ বেশি হলে ঢালাই দুর্বল হয়ে পড়ে আবার প্রয়োজনের চেয়ে পানি কম হলে ঢালাই স্থাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রতি ১ ব্যাগ সিমেন্টের জন্য ঢালাইয়ে সর্বোচ্চ ২৫ লিটার পানি ব্যবহার করা যাবে।

গাঁথুনির কাজ
- একদিনে সর্বোচ্চ সাড়ে চার ফুট পর্যন্ত গাঁথুনির কাজ করা যাবে। তা না হলে উপরের ইটের ওজনে নিচের ইটগুলোর জোড়ার মসলা থেকে পানি বের হবে ও জোড়াগুলোকে দুর্বল করে দেবে।
- দুই ইটের মাঝখানে ও পাশে জোড়া হিসেবে আধা ইঞ্চির বেশি মসলা দেওয়া চলবে না।
- সাধারণত প্রতি ৪ বর্গফুট গাঁথুনিতে ১৯-২০টি পূর্ণ সাইজ ইটের প্রয়োজন, যেখানে উচ্চতার দিকে প্রয়োজন ৮টি এবং দৈর্ঘ্যরে প্রয়োজন ২.৫টি ইট।
প্লাস্টারিং
- প্লাস্টার কখনো আধা ইঞ্চির চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়।
- প্লাস্টার করার পর পানি ঝরে গেলে (অর্থাৎ ১ ঘণ্টা পর) সেটা ব্যবহার করা যাবে না।
- প্লাস্টারিংয়ের পূর্বে ইটগুলোর গা থেকে ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- সিলিং ভালো করে চিপিং করতে হবে।
- ইটের দেয়ালে পানি দিয়ে সম্পূর্ণরূপে ভিজিয়ে নিতে হবে, যাতে দেয়াল প্লাস্টার থেকে পানি শোষণ করতে না পারে।
- বাড়ি নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ের এ সমস্ত সাধারণ সমস্যার দিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখলে নির্মাণ কাজের গুণগতমান অনেক ভালো হয়।
মেহেদী হাসান
ই-মেইল-mehdy [email protected]
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩