ইন্টেরিয়র ডিজাইন কথন

ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোনোভাবেই শুধু নান্দনিক অন্দরসাজ কিংবা উচ্চাভিলাষ নয়। প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি ভবনের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকে অনেক বেশি কার্যকর ও ব্যবহারকারীর জন্য স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে তোলা ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মূল উদ্দেশ্য। এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, বাস্তবসম্মত নাগরিক জীবন সমাধান। একটি বাসস্থানের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মাধ্যমে এর বাসিন্দাদের ব্যক্তিত্ব, রুচি, শিক্ষা বা সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টেরিয়র ডিজাইন বা অভ্যন্তরীণ নকশার ধারণা তুলনামূলকভাবে নতুন এক ভাবনা। আর যেকোনো নতুন ধারণার ক্ষেত্রে সচরাচর যা হয়, এটিও তেমনই আবছা এবং সাধারণ মানুষের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। একজন সচেতন স্থপতি বা ইন্টেরিয়র ডিজাইনারই পারেন তাঁর ক্লায়েন্টের প্রয়োজন এবং কল্পনা অনুযায়ী সীমিত বাজেটে রুচিসম্মত একটি পরিকল্পনা করে তার বাস্তবায়ন করতে।

ইন্টেরিয়র ডিজাইন মানে অপ্রয়োজনীয় সাজসজ্জা নয়, ব্যয়বহুল অলংকরণ নয়। বরং প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি ভবনের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকে অনেক বেশি কার্যকর ও ব্যবহারকারীর জন্য স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে তোলা ইন্টেরিয়র ডিজাইনের প্রধান উদ্দেশ্য। ভবনের কাজের ধরনের ওপর ভিত্তি করে সঠিক আলোর ব্যবহার, সঠিক ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার, প্রয়োজনীয় রঙের ব্যবহার, নির্দিষ্ট কাজের ধরন অনুযায়ী সঠিক মাপের ফার্নিচারের ব্যবহার একটি ভবনের কাজের উপযোগিতা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। একই সঙ্গে ইন্টেরিয়র ডিজাইন হওয়া উচিত রুচিসম্মত ও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে উপস্থাপনের শক্তিশালী মাধ্যম।

যেমন ধরা যাক একজন সচেতন নাগরিক একটি জাপানি বা মেক্সিকান রেস্তোরাঁয় এসেছেন। শুধু কিছু সুস্বাদু জাপানি বা মেক্সিকান কুইসিনই কিন্তু তাঁকে পরিপূর্ণ পরিবেশ আর অভিজ্ঞতা দিতে পারবে না। বরং প্রতিটি আসবাব, মেঝে, দেয়াল, ছাদকে ব্যবহার করে উপযুক্ত আলো ব্যবহারের মাধ্যমে একটি নান্দনিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব, যাতে ওই রেস্তোরাঁয় আসা অতিথি পরবর্তী দুই-তিন ঘণ্টা অনুভব করেন যে তিনি এক টুকরো জাপান বা মেক্সিকোতেই আছেন। এই পরিবেশ তৈরির ব্যাপারটা শুরু হবে কিন্তু রেস্তোরাঁর প্রবেশমুখেই। এমনকি রাস্তা থেকেই যেন একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় রেস্তোরাঁটা কী ধরনের।

ই-লাইব্রেরি, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।মেঝে, দেয়াল ও ছাদে মার্জিত রঙের ব্যবহার, আলো-ছায়ার সামঞ্জস্য ও মানানসই আসবাবের ব্যবহার অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে করে তুলেছে রুচিপূর্ণ ,নকশা: স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদ, প্রতিষ্ঠান: স্থাপতিক।অস্ট্রেলিয়ার হোবার্টে অবস্থিত একটি স্থপতি প্রতিষ্ঠানের ইন্টেরিয়র, খুবই সাধারণ ও মার্জিত আসবাবের ব্যবহার, সুচিন্তিত রং এবং আলোর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে একটি কার্যকর ও নান্দনিক অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে , আলোকচিত্র: রুম ১১ আর্কিটেক্ট

এই যে ‘পরিপূর্ণ পরিবেশ’, এটি একটি ধাপে ধাপে ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্জিত হয়। একজন সচেতন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার যেকোনো প্রজেক্ট শুরু করার আগে ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে ধারণা নেন। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে জাপান বা মেক্সিকোর ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিবেশ, আবহাওয়া, কী ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহৃত হতে পারে, এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান নিয়ে রেস্তোরাঁর অভ্যন্তরীণ বিন্যাসকে অর্থবহ, ব্যবসায় সফল ও আকর্ষণীয় করে তোলেন। একই সঙ্গে একটি রেস্তোরাঁর কার্যক্রমে আরও কিছু বিষয় জড়িত। যেমন- রান্নাঘর, খাবার প্রস্তুত করার জায়গা ও পরিষ্কার কক্ষ এটিও খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত। কী ধরনের খাবার প্রস্তুত হবে, কতজন কর্মী কাজে নিযুক্ত থাকবে, কাঁচামাল ও রান্নার উপকরণ কোথায় থাকবে, কোন জায়গায় প্রস্তুতি ও কাটাকাটির কাজটি হবে, কোন জায়গায় কী পরিমাণ আলো প্রয়োজন, কী ধরনের মেঝের ব্যবহার কাজের ও খাবারের প্রস্তুতকরণকে নিরাপদ করে তুলবেÑ এসবই ইন্টেরিয়র ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ইন্টেরিয়র ডিজাইনের প্রয়োজনীয়তা শুধু কাজের ক্ষেত্র থেকেই নয়, আমাদের নাগরিক জীবনে বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের গুরুত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ এবং এর ভূমির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই অল্প জায়গায় অধিক মানুষ ও অনেক বেশি প্রয়োজনীয়তার সংকুলান করতে হয়, বিশেষত শহর অঞ্চলের ভবনগুলোতে। একটি সুচিন্তিত, ব্যবহারিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন এই অল্প জায়গায় প্রয়োজনীয়তার সংকুলান ঘটাতে পারে সঠিকভাবে। আমাদের আধুনিক নগরজীবন এক ইন্টেরিয়র থেকে অন্য ইন্টেরিয়রে আবর্তিত হয়। একজন নাগরিকের সকালে ঘুম ভাঙে নিজস্ব ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টে, যা মূলত ইন্টেরিয়র। তারপরে সে তার শিক্ষা কেন্দ্র বা অফিসে যায়, তাও একধরনের ইন্টেরিয়র। আবার বিকেলে কোনো সিনেমা বা থিয়েটার হল থেকে বেরিয়ে একটা রেস্তোরাঁর ইন্টেরিয়র পরিবেশ উপভোগ করে, আবার নিজের ফ্ল্যাটে ফেরা। তাই আধুনিক জীবনে বাড়ি, ফ্ল্যাট, অফিস, ব্যাংক, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শোরুম, সিনেমা, থিয়েটার হল, শপিং মল, পার্লার, আর্ট গ্যালারি, মেলা ইত্যাদিও ইন্টেরিয়রের গুরুত্ব অপরিহার্য। এসবই ইন্টেরিয়র স্পেসের অন্তর্ভুক্ত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরও মনে রাখা প্রয়োজন, নাগরিক জীবনের অপরিহার্য এই ‘ইন্টেরিয়র স্পেস’, বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকা শহরে অত্যন্ত উচ্চমূল্যায়িত বিষয়। তাই শুধু নান্দনিক অন্দরসাজ বা অলংকরণ নয়, বরং সম্পূর্ণ স্পেসকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করা, প্রতিটি আসবাবের বাস্তবসম্মত ও উপযোগিতা দেওয়াও ইন্টেরিয়র ডিজাইন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি প্রতিটি কোনার ব্যবহার করা, উপযুক্ত আলো বা রঙের ব্যবহারে ছোট স্পেসকে বড় দেখানোÑ এসবই ইন্টেরিয়র ডিজাইনের আওতাভুক্ত।

ধরা যাক একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের কথা। তিনি যখন তাঁর ডিজাইন করা পোশাকগুলো তাঁর শোরুমে প্রদর্শন করতে চাইবেন, তখন কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত উচ্চমূল্যের শোরুমটির এক ইঞ্চি জায়গাও অপচয় করা যাবে না, প্রতিটি কোনার যথোপযুক্ত সদব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি ডিসপ্লে ইউনিটকে এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে আর তার ওপর এমন আলোর ব্যবহার করতে হবে, যাতে প্রতিটি পোশাক আলাদা আলাদাভাবে সমান গুরুত্ব পায়। এ ছাড়া দুইটি ডিসপ্লে ইউনিটের মাঝে উপযুক্ত চলাচলের জায়গা রাখা, শোরুমের আবহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফার্নিচার, ক্যাশ কাউন্টার, এন্ট্রি ও এক্সিট পয়েন্টÑ এই সবদিক ডিজাইনের অপরিহার্য অংশ। তা ছাড়া ‘উইন্ডো ডিসপ্লে’ তো আছেই, সেটিকে যথোপযুক্তভাবে ডিজাইনের মাধ্যমে শোরুমের বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকেই ক্রেতারা শোরুমটি সম্পর্কে ধারণা পান। আর অন্দরসাজ বিশেষজ্ঞ তথা একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারই পারেন সঠিক বিষয়গুলো ডিজাইন চিন্তায় মাথায় রেখে ক্লায়েন্টের কল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামগ্রিকভাবে সুন্দর সমাধান দিতে।

কেএসআরএম-এর অফিস ইন্টেরিয়র। মেঝের কার্পেটে কালো রং এবং সিলিংয়ের বিপরীত রং হিসেবে সাদা, দিনের আলোর সঙ্গে পরিমিত কৃত্রিম আলোর ব্যবহার, পর্যাপ্ত জায়গার সংকুলান একটি নান্দনিক ও ব্যবহারোপযোগী অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, আলোকচিত্র: কনটেক্স বিডি ওয়েবসাইট, নকশা: স্টুডিও এক্সটেনশন

একজন সচেতন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ‘ওয়েস্ট ক্যালকুলেশন’ বিষয়টিকে তাঁর ডিজাইন ভাবনায় অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অনেক সময় প্রথমে ‘ওয়েস্ট ক্যালকুলেশন’ করে তার পরিপ্রেক্ষিতেই নির্দিষ্ট ফার্নিচারের ডিজাইন নির্দেশনা দেওয়া হয়, যার ফলে ম্যাটেরিয়ালের সর্বোচ্চ অপচয় রোধ করা যায়। এ ছাড়া উচ্চমূল্যের বিদেশি ম্যাটেরিয়ালের পরিবর্তে দেশি দীর্ঘস্থায়ী তুলনামূলকভাবে স্বল্পমূল্যের ম্যাটেরিয়ালের প্রয়োগ আর কৌশলী সম্পাদনার মাধ্যমে একজন সচেতন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারই পারেন ইন্টেরিয়র ডিজাইন কনসেপ্টকে মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে এনে দিতে। আবার পরিবেশবান্ধব উপাদানের ব্যবহার, অন্দরসজ্জায় ল্যান্ডস্কেপিং, টেরেস গার্ডেনিং, ফোয়ারা এসবের প্রয়োগে ইট-কাঠের নাগরিক জীবনে একটু প্রকৃতির ছোঁয়া এনে দেওয়া সম্ভব সুদক্ষ ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মধ্য দিয়ে।

আকাক্সিক্ষত ফল পেতে হলে সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য যথোপযুক্ত ও দক্ষ মানুষের প্রয়োজন। যদি চক্ষু বিশেষজ্ঞ কাছেই থাকেন, একজন চোখের রোগী সর্বোত্তম চিকিৎসা পেতে কখনোই সাধারণ একজন চিকিৎসকের কাছে যাবেন না। তেমনই অন্দরসাজের বিশেষজ্ঞ হলেন একজন স্থপতি এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, তাই যেকোনো ইন্টেরিয়রের জন্য সম্পূর্ণ আর নির্ভুল সমাধান তিনিই দিতে সক্ষম।

ইট, কংক্রিট ও কাঠের সমন্বয়ে একটি আবাসিক বাড়ির ইন্টেরিয়র, নকশা ও আলোকচিত্র: মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস

স্থপতি শফিক রাহ্‌মান, প্রভাষক, স্থাপত্য বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারজানা চৌধুরি নুপুর, প্রভাষক, ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি (এসএমইউসিটি)

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৪ তম সংখ্যা, জুন ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top