ট্রেইলের ইতিহাস
ট্রেইলের কনসেপ্টের শুরু প্রাণীর মস্তিষ্ক থেকে। পরবর্তী সময়ে প্রাণীদের থেকে মানুষ এই ধারণাকে অভিযোজিত করে তোলে। আদিকালে কিষানরা হাটে হাটে গবাদিপশু নিয়ে যেত। পশুরা একটা পথ অনুসরণ করত। সেই থেকে শুরু। সেই পথই ট্রেইল। আর এখন তো ট্রেইলের গল্পগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার। এখনকার সময়ে ট্রেইলকে বিনোদনমূলক ট্রেইলে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শিল্পাঞ্চলগুলোতে যে রুট কানেকশন দেখা যায়. তাতে বেশ প্রগতিশীলতা দেখা যায়। আর সেই প্রগতিশীলতা ট্রেইলকে সুষমামÐিত ও শিল্পাচার্য হিসেবে গড়ে তোলে। রেললাইনের রাস্তা দেখলে যেন মনে হয় হেঁটে হেঁটে দূরসীমানায় হারিয়ে যাই। আমাদের দেশে ট্রেইলের সূচনা আদিকাল থেকে হলেও আধুনিক সময়ে হরেক রকমের ট্রেইলের আতিশয্য দেখা যায়। অথচ, আদি ইতিহাসে যখন সিল্ক রোড, অ্যাম্বার রোড ছিল এবং পারস্য সা¤্রাজ্যের রয়্যাল রোডের মতো রুট কানেকশন ছিল, যা কি না একটা সাধারণ ট্রেইলকে ঐতিহাসিক ট্রেইলের মর্যাদা দিয়েছে। যেমন, আমাদের দেশের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড।
পৃথিবীর ইতিহাসে খ্রিষ্টীয় যুগের আগেও ট্রেইল ছিল। এখনো আছে। হয়তো ট্রেইলগুলো দূরত্ব বজায় রেখে এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। মিসরের রাজারা পায়ে হেঁটে যেতে অসম্মানজনক মনে করতেন। মানুষের কাঁধে নিয়ে বহনকৃত খাটিয়া বা পালকিতে চড়ে পথ নির্গমন করতেন। সেই ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তন হয়েছে এবং প্রাচীন ট্রেইল বিকশিত হয়েছিল। যেই হাঁটা একসময় দারিদ্র্যকে নির্দেশিত করত, সেই ট্রেইল এখন ভ্রমণসঙ্গী ও উচ্চাভিলাষী জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর হাতিয়ার।
অনেক অসুখের ওষুধ হলো সময় ধরে হাঁটা। প্রাচীনতম আরেকটি ট্রেইল বা ট্রাক হলো দ্য পোস্ট ট্র্যাক। এটি ইংল্যান্ড শহরের সমারসেটের //////ব্রু/////// নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। এটি একটি প্রাচীনতম ট্র্যাক। এটির সময়কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৩৮ সাল। সমগ্র ইউরোপজুড়ে ট্রেইল বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল দুইটা বিষয়ের জন্য। এক হলো অনুশীলন আরেক হলো আনন্দ। অষ্টাদশ শতকে এই কার্যাবলি বেশি বিকশিত হয়। আমেরিকায় এবং সম্ভবত বিশ্বের বিনোদনমূলক হাইকিংয়ের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত প্রথম ফুটপাত হলো নিউ হ্যাম্পশায়ারের হোয়াইট মাউনটেইনের ক্রফোর্ড পথ। এই পথটি ১৮১৯ সালে অ্যাবেল ক্রফোর্ড এবং তাঁর পুত্র ইথান অ্যালেন দ্বারা প্রজ¦লিত হয়েছিল। এটি একটা জনপ্রিয় ট্রেইল।
ট্রেইলের প্রকারভেদ
ট্রেইল হরেক রকম হয়ে থাকে। হরেক রকম ব্যবহারের জন্য ট্রেইলগুলো ভিন্ন ভিন্ন সেটিংসে অবস্থিত হতে পারে।
ট্রেইল সেগ্রিগেশন বা বিচ্ছিন্নতা: ট্রেইল হল পথ। এই পথে মানুষ ও প্রাণীরা যেমন হাঁটে, তেমন যানবাহন চলে। এই যানবাহনের মধ্যে রয়েছে: মোটরচালিত যান ও অমোটরচালিত যান। সবকিছু মিলিয়ে পথ চলা সব সময় অবিরাম, ক্রমবর্ধমান সাধারণ ও বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে। এই অবস্থায় মানুষ, প্রাণিকুল ও যানবাহনের যথেষ্ট স্বাধীনতা ও একচেটিয়া ব্যবহার শুরু থেকেই আছে। কিন্তু, তা সঠিক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে, দরকার ট্রেইলের সেগ্রিগেশন বা বিচ্ছিন্নতা। এই সেগ্রিগেশন একটা নীতি হতে পারে, যা ভালোভাবে মেনে চললে ট্রেইলের জন্য ভালো হতে পারে। বাস্তবিক সরেজমিনে দেখতে পাই যে এক যানবাহনের জন্য প্রযোজ্য ট্রেইলে অপরাপর যানবাহন ও অবতরণ করে আসছে। কোথাও কোথাও বাইকের জন্য ট্রেইলে শুধু মোটর গাড়ির জন্য উন্মুক্ত নয়। বরং, এটি অন্যান্য যানবাহনের জন্যও উন্মুক্ত। অথচ, এটি কী আমাদের ট্রেইলের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা বা কাম্য ছিল? আবার, কতিপয় ট্রেইল অশ্বারোহী এবং মাউনটেইন বাইক বা অশ্বারোহী বা পর্বত বাইক উভয়ের দ্বারা ব্যবহারের জন্য আলাদা করা হয়। এ দেশের ট্রেইলের ক্ষেত্রে এক পথে হরেক রকমের যানবাহনের উপস্থিতি দেখা যায়। ভারতের মুর্শিদাবাদেও ট্রেইলে মোটরচালিত গাড়ি যেমন চলাচল করে আবার ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম চলাচল করে থাকে। আবার, নালন্দার ট্রেইলে শুধু টমটম ও টোটো গাড়ি চলাচল করে থাকে। আমাদের দেশে পুরান ঢাকায় অভ্যন্তরে বাস, ট্রাক প্রবেশ করা নিষেধ। কিন্তু সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম, ভটভটি সব চলাচল করে থাকে। এখানে নিয়ম করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আর ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি হতো না। মরুভূমি এলাকার ট্রেইলগুলোতে অচাকার ব্যবহারের জন্য আলাদা করা যেতে পারে, যা ব্যাকপ্যাকিং এবং ঘোড়া বা উট চলাচলের অনুমতি দেয়; তবে পর্বত বাইক এবং মোটরচালিত যানবাহনের অনুমতি দেয় না। প্রায়ই একটি নির্দিষ্ট ব্যবহারের জন্য ট্রেইল পৃথক্্করণের সঙ্গে ট্রেইল সিস্টেমের মধ্যে অন্যান্য ট্রেইলে সেই ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ট্রেইল বিভাজন সাইনেজ, মার্কিং, ট্রেইল ডিজাইন এবং নির্মাণ (বিশেষ করে ট্রেডসামগ্রী নির্বাচন) এবং সমান্তরাল ট্রেডগুলোর মধ্যে বিচ্ছেদ দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। দূরত্ব, খাদ, ব্যাংকিং, গ্রেডিং এবং গাছপালাসহ ‘প্রাকৃতিক’ বাধা দ্বারা এবং বেড়া, রোধ এবং দেয়ালসহ ‘কৃত্রিম’ বাঁধ দ্বারা বিচ্ছেদ অর্জন করা যেতে পারে।
পেডিস্ট্রিয়ান বা ফুটপাত: ট্রেইলের আরেকটি আনুষঙ্গিক অংশ হলো পেডিস্ট্রিয়ান বা ফুটপাত। একটি ফুটপাত হলো এমন একধরনের সরু রাস্তা, যা শুধু পথচারী চলাচলের জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে সব জায়গাতেই এই ফুটপাত সরু না। ক্ষেত্রবিশেষে এটি বড় আকারের ও হয়ে থাকে। ফুটপাতগুলোকে একটি দীর্ঘ-দূরত্বের ট্রেইল বা পথ তৈরি করতে সংযুক্ত করা যেতে পারে, যা দিনের হাইকার এবং ব্যাকপ্যাকার উভয়ই ব্যবহার করতে পারে। কিছু ট্রেইল ১ হাজার মাইল (১ হাজার ৬০০ কিমি) দীর্ঘ। আমাদের দেশে ফুটপাতে দোকানও বসে। আর সাইকেল ও মোটরসাইকেল দ্রæতবেগে চলাচল করে থাকে ও পথচারীদের বিঘিœত করে থাকে। আবার, ইউরোপ-আমেরিকার মতো বড় বড় মহাদেশগুলোতে ফুটপাত হলো পায়ে চলার পথ। এখানে সাইকেল চালানো একেবারেই নিষিদ্ধ। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে পথের যথেষ্ট অধিকার রয়েছে, যেখানে পথচারীদের ভ্রমণ করার আইনগতভাবে সুরক্ষিত অধিকার রয়েছে। তাই তো সেখানে পথে কোনো বিশৃঙ্খল নেই। জাতীয় উদ্যান, প্রকৃতি সংরক্ষণ, সংরক্ষণ এলাকা এবং অন্যান্য সুরক্ষিত প্রান্তর এলাকায় পথচারীদের জন্য সীমাবদ্ধ ট্রেইল ফুটপাত থাকতে পারে। আজকাল এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।
আরবান ট্রেইল: এটি হলো শহুরে ট্রেইল। শহুরে জীবন ব্যবস্থাপনায় দেখা যায়। এই ট্রেইল হলো অমোটরচালিত একটি পথবিশেষ। বহু ব্যবহারের পাথওয়ের একটি শহরব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করে থাকে, যা সাইকেলচালক, ওয়াকার এবং দৌড়বিদ উভয় পরিবহন এবং বিনোদনের জন্য ব্যবহার করে। শহুরে পথের প্রস্থ গড় ১০ ফুট এবং ডামার বা কংক্রিট দিয়ে পৃষ্ঠ করা হয়। কিছু ডোরাকাটা রাস্তা পছন্দ করে, যাতে দ্বিমুখী ট্রাফিক নির্দিষ্ট করা যায়। শহুরে ট্রেইলগুলো আশপাশের এলাকা, ব্যবসা, কর্মসংস্থানের জায়গা এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্ট স্টপের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে।
ফরেস্ট রোড বা বনময় পথ: ফরেস্ট রোড বা, বনময় পথকে ইকো-ট্রেইলও বলা হয়ে থাকে। এটি হলো জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশের প্রাথমিক একটা পথ, যাকে প্রবেশপথ বলা হয়ে থাকে। এই ট্রেইলকে মূলত বনশিল্পের জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে। এটি বিনোদনের একটি সর্বাপেক্ষা সুন্দর মাধ্যমও বটে। আমাদের দেশের বন-জঙ্গলে এই পথ কিঞ্চিৎ পরিমাণ দেখা গেলেও পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সুন্দর ট্রেইল দেখা যায়। একসময় গ্রেট ব্রিটেনের বেশির ভাগ বনায়নে ট্রেইল তৈরি করা হয়েছিল। এই ট্রেইলের কাজ ছিল ওয়াকার, সাইক্লিস্ট এবং ঘোড়সওয়ারদের পথ পরিক্রমা। এই ট্রেইলগুলো শুধু যে বনের সম্পত্তি ছিল তা নয়। এগুলো জনসাধারণের জন্যও উন্মুক্ত ছিল। কমিশনের বহিরাঙ্গন কার্যকলাপের প্রচারের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো স্কটল্যান্ডের ৭ংঃধহবং প্রকল্প, যেখানে অক্ষম সাইকেলচালকদের জন্য সুবিধাসহ পর্বত সাইকেল ট্রেইলের সাতটি উদ্দেশ্য নির্মিত এলাকা স্থাপন করা হয়েছে।
ক্রস-কান্ট্রি স্কিইং: ক্রস-কান্ট্রি স্কিইংয়ে, একটি পথকে ট্র্যাক বলা হয়। যার অপর নাম পিষ্ট। বিনোদনমূলক ক্রস-কান্ট্রি স্কিইংকে ভ্রমণও বলা হয়, যা দেখা যায় ইউরোপে। কিছু স্কিয়ার বুশওয়াকার এবং হাইকারদের মতো তাঁবু এবং সরঞ্জাম ব্যবহার করে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাইরে থাকে, অন্যরা রক্ষণাবেক্ষণের ট্রেইলে স্কি রিসোর্ট থেকে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ করে। কিছু দেশে, সংস্থা শীতকালে ক্রস-কান্ট্রি স্কিয়ারদের ব্যবহারের জন্য কুঁড়েঘরের একটি নেটওয়ার্ক বজায় রাখে। উদাহরণস্বরূপ, নরওয়েজিয়ান মাউন্টেন ট্যুরিং অ্যাসোসিয়েশন ৪০০টিরও বেশি কুঁড়েঘর রক্ষণাবেক্ষণ করে, যা শত শত কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ট্রেইল হাইকাররা গ্রীষ্মে ব্যবহার করে এবং স্কাইয়াররা শীতকালে ব্যবহার করে।
অশ্বারোহী ট্রেইল: সরাসরি হাতি, ঘোড়া, গাধা, উট এদের পিঠে চড়ে অবতরণ করা ও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হলো এক একধরনের ট্রেইল। এদের একটি হলো অশ্বারোহী ট্রেইল। অশ্বারোহী ট্রেইলে ঘোড়ার গাড়ি বা, টমটম ও ব্যবহৃত হতে পারে। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এই ট্রেইল একটা জনপ্রিয় মাধ্যম। এই ট্রেইলে ঘোড়াগুলো সাধারণত হাইকারদের মতো পথ চলতে পারে। তবে সব সময়ের জন্য নয় এই পথ চলা।
হোলোওয়ে ট্রেইল: হোলোওয়ে ট্রেইল হলো একটি ফাঁপা বিশেষ পথ। এখানে, ফাঁপা বলতে একটি নিরেট পথ বা গলিকে বোঝায়, যা অন্ধ গলি বিশেষ, ডুবে যাওয়া পথ কিংবা যে পথে পথে সমস্যা ক্রমশ বিরাজমান। এটি মূলত এমন একটি পথ বা ট্র্যাক, যা উভয় পাশের জমি থেকে অনেকটাই নিচুভূমিতে অবস্থিত। এটি কিন্তু রাস্তা কেটে তৈরি করা বাঁক নয়, যা শুরু থেকেই প্রকৌশলী শক্তি নিয়ে গঠিত এবং অনেক বেশি বয়সসম্পন্ন। অনেকটা আদিকাল ধাঁচের। এটিকে বোধ শক্তি দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। আবার, ভিন্ন আঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করে অনেকেই, যা ঠিক নয়। এর পেছনে মূলত কারণ হিসেবে রয়েছে জল ও যানবাহনের প্রভাব।
জল ও যানবাহনের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে এই ট্রেইল একেকটা গর্তস্বরূপ, যাকে ইংরেজিতে হোলোওয়ে ট্রেইল বলা হয়ে থাকে। এই ট্রেইলকে মাটি ভরাট করে সমতল করে ফেললে তখন কিন্তু আর নিরেট শব্দটি থাকে না। এটি সাধারণ ট্রেইল হিসেবে পরিগণিত হবে। হোলোওয়ে ট্রেইল এর আরও কিছু ট্রেইল সম্পর্কিত দিক থাকতে পারে। যেমন, গবাদি পশুপাখি পালনে সহায়তার জন্য বাঁধ খনন ও সেই বাঁধের ব্যবহার, এস্টেটের সীমানা চিহ্নিত করার জন্য ডাবল ব্যাঙ্ক খনন করা ইত্যাদি। এগুলো সবাই হতে পারে, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।
গলি ট্রেইল: শহুরে আরবান সেটিংসে যে ফুটপাত দেখা যায়, সেই ফুটপাতগুলো কখনো কখনো এঁদো সরু এলাকাময় স্থানে গিয়ে মিশে আর একেই গলি ট্রেইল বলে। বাংলায়, এটি মূলত একটা গলিবিশেষ। এই ধরনের শহুরে পথ বা ফুটপাতগুলো সরু, সাধারণত পাকা এবং প্রায়ই ভবনের দেয়ালের মধ্যে থাকে। এই ধরনের সাধারণত সংক্ষিপ্ত এবং সোজা হয় এবং খাড়া মাটিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ পদক্ষেপ থাকতে পারে। বাংলাদেশে এই ধরনের গলি ট্রেইল নামকরণ আকারে না দেখা গেলেও গলি আকারে দেখা মেলে। যেখানে গলির ব্যাপ্তি একটা ট্রেইলের চেয়ে কোনো অংশেই কম না। উদাহরণস্বরূপ, পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারের সরু গলিময় অবস্থা। এই সড়কে বহু প্রাচীন ইমারত বিদ্যমান। এই ইমারতগুলো গা লেপ্টে পাশাপাশি দাঁড়ানো। প্রতি দুই ইমারতের মাঝে একটি করে গলি ট্রেইল বিদ্যমান। ইউরোপের অনেক পুরাতন শহরে ও শহরতলিতে গলি ট্রেইল দেখা যায়। ওখানে, এগুলোকে মধ্যযুগীয় রাস্তার নেটওয়ার্ক বা রাইট-অফ-ওয়ে হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। এগুলোর সমন্বিত ফুটপাতও বেশ পুরোনো ধাঁচের। চার্লসটন, সাউথ ক্যারোলিনা, নিউ ক্যাসেল, ডেলাওয়্যার এবং পিটসবার্গ, পেনসিলভানিয়ার মতো কিছু পুরানো উত্তর আমেরিকার নগর, শহর এবং বন্দরেও অনুরূপ পথ বিদ্যমান।
ওয়াটার ট্রেইল: ওয়াটার ট্রেইলকে ভিনদেশি ভাষায় ‘বøু ওয়ে ট্রেইল’ বা ‘প্যাডলিং ট্রেইল’ নামেও পরিচিত। বাংলায় বলা হয় জলের ট্রেইল। ওয়াটার ট্রেইলের জলপথকে অবশ্যই নৌযান চলাচলযোগ্য হতে হবে। এই জলপথ হতে পারে নদী, খাল, বিল, দিঘি, হ্রদ, উপক‚লরেখা ইত্যাদি। জলপথে মোটরচালিত যান যেমন ট্রলার, স্পিডবোট, জাহাজ হতে পারে আবার, অমোটরচালিত যান যেমন নৌকা, ভেলা, ক্যানো, কায়াক ইত্যাদি হতে পারে। জলের ট্রেইলের ক্ষেত্রে বিশেষ আনুষঙ্গিক উপাদানসমূহ যুক্ত হতে পারে। এসব উপাদানের মধ্যে রয়েছে- চিহ্ন, রুট মার্কার, মানচিত্র, পার্কিং, ডক, বোট, র্যাম্প, ক্যাম্প, মাইকিং এবং পিকনিক করার মতো জায়গার সুবিধা। বাংলাদেশে অসংখ্য নদ-নদী ও জলাধারসমৃদ্ধ। তাই, এখানে জলের ট্রেইল করার স্কোপ সবচেয়ে বেশি আছে। হাতিরঝিলে জলের ট্রেইল বর্তমানে চলমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াটার ট্রেইলের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রাম এবং অন্যান্য প্রচার-প্রচারণা রয়েছে। আমেরিকান ক্যানো অ্যাসোসিয়েশন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াটার ট্রেইলের এশটি ডেটাবেইস সংকলন করেছে। ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস রিভারস, ট্রেইল এবং সংরক্ষণ সহায়তা প্রোগ্রাম জলের ট্রেইলের সম্পদ, সাফল্যের গল্প এবং জলের পথের জন্য রাজ্যব্যাপী পরিচিতির একটি তালিকা সংকলন করেছে।
ট্রেইল বনাম হেরিটেজ ট্রেইল
হেরিটেজ ট্রেইল ইন্দোনেশিয়ায় বেশ আলোচিত। ইন্দোনেশিয়া থেকে এর সামগ্রিকতা আক্ষরিক অর্থে শুরু হলেও বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও সমাদৃত। বিশ্বের প্রতিটা দেশেই ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ঐতিহাসিক স্থাপনাসংবলিত এলাকা রয়েছে। আর সেগুলোকে ঘিরেই গড়ে উঠছে একটি শক্তিশালী ট্রেইলব্যবস্থা। শুধু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও এলাকাসংবলিত নয় বরং যেখানে সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আচার ও কলা রয়েছে সেখানে হেরিটেজ ট্রেইলের প্রয়োজন এসে দাঁড়িয়েছে। ধারণাটি মূলত বিশ্বব্যাপী একটি শহরের ঐতিহাসিক এলাকাগুলোর অস্তিত্ব পরিচালনা করে ও পুনর্বিন্যস্ত করে থাকে। প্রবর্তিত ধারণাগুলো তারপর তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যসহ সমস্ত দেশে প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থানের শর্ত অনুসারে প্রয়োগ এবং অভিযোজিত হয়। যেমনটি আগে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এই হেরিটেজ ট্রেইল কার্যকলাপটি সর্বদা একটি ঐতিহাসিক এলাকায় ঐতিহাসিক ভবনগুলোর উপস্থিতির সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাই এই হেরিটেজ ট্রেইল কার্যকলাপটি সর্বদা ঐতিহাসিক ভবনগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
হেরিটেজ ট্রেইলের প্রকারভেদ
হেরিটেজ ওয়াকিং ট্রেইল বা হাঁটার ট্রেইল
হেরিটেজ কার ট্রেইল বা বাস ট্রেইল
হেরিটেজ ওয়াটার ট্রেইল বা জলের ট্রেইল
হেরিটেজ ট্রেন ট্রেইল বা রেল ট্রেইল
হেরিটেজ ওয়াকিং ট্রেইল বা হাঁটার ট্রেইল
ওয়াকিং ট্রেইলের সুবিধা: হাঁটার পথ হলো এমন একটি পথ, যা মানুষের চলার জন্য ডিজাইন করা হয়। এটি পার্ক, বন এবং অন্যান্য বহিরাঙ্গন এলাকায় হয়। পথে সাধারণত ট্রেইলের দূরত্ব এবং দিক নির্দেশ করে এমন চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। হাইকাররা প্রায়ই হেঁটে যাওয়া ট্রেইল ব্যবহার করে একটি এলাকা অন্বেষণ করার জন্য হারিয়ে যাওয়া বা অফ-ট্রেল যাওয়ার বিষয়ে চিন্তা না করে। বয়স বা অক্ষমতার মতো শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে যারা দীর্ঘ দূরত্বে যেতে পারে না, তাদের জন্য তারা সহজ অ্যাকসেসও সরবরাহ করে। একটি হাঁটাপথ দ্বারা আচ্ছাদিত ভূখÐ তার অবস্থান এবং উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে, এটি কেবল সমতল ভূমি অনুসরণ করতে পারে, অন্যদের ক্ষেত্রে, এটি খাড়া পাহাড়ের ধারে বা পাহাড়ের ক্লিফের মতো পাথুরে ভূখÐের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। কিছু ট্রেইল এমনকি ¯্রােত এবং নদী অতিক্রম করে, যেগুলো নিরাপদে অতিক্রম করার সময় বিশেষ যতেœর প্রয়োজন।
হাইকিং ট্রেইলের সংজ্ঞা
ওয়াকিং ট্রেইলে যেমন পথ হাঁটতে হয়, হাইকিং ট্রেইলেও তেমন পথ হাঁটতে হয়। পার্থক্য শুধু, হাইকিং ট্রেইলে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হাঁটতে হয়। এতে করে মনে হতে থাকে যে হাইকিং ট্রেইল হাঁটার পথের অনুরূপ কিন্তু তাদের সমকক্ষদের তুলনায় আরও চ্যালেঞ্জিং ভূখÐ অফার করে।
এই পথ প্রায় আপনাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যায়, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঘেরা থাকবেন, এমন কিছু যা আপনার গাড়ির জানালার আরাম থেকে সব সময় অনুভব করা যায় না। এই রুট দ্বারা আচ্ছাদিত ভূখÐ অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত, এতে খাড়া বাঁক/পতন এবং পাথুরে পৃষ্ঠ রয়েছে, যেগুলো নিরাপদে অতিক্রম করার সময় সতর্কতা প্রয়োজন। হাঁটার পথের বিপরীতে যা সাধারণত একসঙ্গে পর্যাপ্ত কাছাকাছি থাকে, যাতে কেউ সহজে হারিয়ে না যায়। হাইকিং রুটগুলো বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যদি কেউ ট্র্যাক থেকে সরে যায়। তবে নেভিগেশন আরও কঠিন করে তোলে (যার কারণে অনেক হাইকার মানচিত্র নিয়ে আসে!) উপরন্তু, এই পথগুলো প্রায়ই ঘন গাছপালা যেমন ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে যায়, যা কিছু সময়ে অগ্রগতি ধীর করে দেয় কিন্তু তবুও অন্বেষণ করা মূল্যবান!
ওয়াকিং ট্রেইলের সুবিধা
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মানসিক অনীহা থেকে মুক্তির পথ হলো ওয়াকিং ট্রেইলে নির্গমন ওই পথ ধরে হাঁটা। এই পথ ধরে হেঁটে গেলে মানুষ মানসিক শান্তি লাভ করে থাকে। যার ফলে লোকজনের মন প্রফুল্ল থাকে ও দেহে শান্তি লাভ করে থাকে। এটি একটি শারীরিক অনুশীলনও বটে।
আরবান সেটিংস ব্যবস্থায় সড়কের পাশাপাশি ফুটপাত হলো একটি চমকপ্রদ ওয়াকিং ট্রেইলের দৃষ্টান্ত। এটি ধরে লোকজন হেঁটে গেলে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে, যা প্রধান সড়কে সমস্যাই বটে। কেননা, প্রধান সড়কের ট্রেইলে অধিকতর বাধাবিপত্তি থাকে।
সাধারণত বড় রাস্তায় বহু যানবাহন থাকে। পথে পথে ছোট-বড় দোকান থাকে, গাড়ি পার্কিং করা থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে রাস্তায় বহু কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপাত্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে ওয়াকিং ট্রেইলের পথ সর্বাপেক্ষা নিরাপদ ও কম বাধাসম্পন্ন।
পার্কগুলোতে আরবান ওয়াকিং ট্রেইলের অস্তিত্ব দেখা যায়। বেশির ভাগ পার্কে অসংখ্য ট্রেইল ছড়ানো অবস্থায় নকশাবন্দী হয়ে থাকে। এই ট্রেইলের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের বসার জন্য অনেক ধরনের সিট তথা বেঞ্চি থাকে। এই বেঞ্চ লোকজনের মনোরম ল্যান্ডস্কেপ প্রদানের পাশাপাশি পার্কে দীর্ঘ সময় অবকাশ যাপনের ও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ প্রদান করে থাকে।
ওয়াকিং ট্রেইলে ট্রাফিক জ্যামমুক্ত থাকার সম্ভাবনা যারপরনাই বেশি। এই পথ শুধু পথচারীদের ঢল নামার জায়গা। তাই একে, পথচারী মলও বলা হয়ে থাকে। এটি মূলত ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে চিন্তা না করে লোকজন কত দূর যেতে চায় তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ব্যক্তিদের আরও বেশি স্বাধীনতা দেয়।
তাই সংক্ষেপে বলতে গেলে, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভূখÐ এবং হারিয়ে যাওয়ার মতো বাহ্যিক শক্তি সম্পর্কে খুব বেশি চিন্তা না করেই এটি একটি সামান্য অনুশীলন করার একটি উপায়।
হাইকিং ট্রেইলের সুবিধা
দৈনন্দিন জীবনের অনীহা থেকে পরিত্রাণের সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো হাইকিং ট্রেইল অনুসরণ করা। এটিকে হাইকিং অভিযানও বলা হয়ে থাকে। মানুষের অস্থিরতা ও ভোগান্তি যখন চরম পর্যায়ে উপনীত হয়ে থাকে, তখন ওয়াকিং ট্রেইলের পরিবর্তে হাইকিং ট্রেইলের ব্যাপারটি চোখের সামনে চলে আসে।
হাইকিং হলো দুঃসাহসিক অভিযান। শহুরে জীবনব্যবস্থায় বøকের চারপাশে সাধারণ হাঁটা বা ওয়াকিং ট্রেইলের বিপরীতে, হাইকিংগুলো দুঃসাহসিকদের আরও প্রকৃতির মধ্যে যেতে দেয়।
হাইকিংয়ের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের কারণে বৃদ্ধি, মানসিক স্বচ্ছতা উন্নত করে এবং অন্য কোথাও খুব কমই দেখা দর্শনীয় দৃশ্যের উল্লেখ না করে।
যেহেতু বেশির ভাগ জাতীয় উদ্যান আজকাল প্রতিটি অঞ্চলজুড়ে উপলব্ধ বিভিন্ন রুটের রূপরেখা দিয়ে বিশদ মানচিত্র সরবরাহ করে, এটি পরিকল্পনাকে সহজ করে তোলে, ভ্রমণকারীদের যাত্রার আগে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে সক্ষম করে, যার ফলে অপরিচিত জমিজুড়ে বর্ধিত ভ্রমণের সময় দিশেহারা হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করে।
ওয়াকিং ট্রেইল বনাম হাইকিং নির্বাচন
ওয়াকিং ট্রেইল এবং হাইকিং দুটোই পথ চলা। একটি হলো সহজ উপায়ে সহজ পথে হাঁটা. যাতে কোনো বাধা-বিঘœ নেই। আরেকটি হলো এবড়োখেবড়ো পথ ধরে ধরে বাধাবিঘœ মোকাবিলা করে হাঁটা। এইটা কেবল একজন পথ আরোহীর সিদ্ধান্ত যে সে কোনটা বেছে নেবে। সহজ পথ নাকি দুর্গম পথ। একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রিক দুর্গম পথে বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে পথ চলতে পছন্দ করে থাকে। তবে বেশির ভাগ মানুষই সাধারণ ওয়াকিং ট্রেইলে পথ চলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে। সুতরাং, দুইটা ট্রেইলই শেষ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে চাওয়া পছন্দসই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত পছন্দে নেমে আসে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি মানসিক স্থবির দিনগুলো থেকে দূরে যেতে চান, তিনি কাছাকাছি পার্কে ছোট ভ্রমণের জন্য ওয়াকিং ট্রেইলের পথ বেছে নিতে পারেন। অতএব, পছন্দ যা-ই হোক না কেন, নির্বাচিত গন্তব্য নির্বিশেষে, আগে থেকে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে দুটোর প্রতিই আসক্তি থাকা উচিত। বলা যায় না, কখন কোন ট্রেইল বেশি কাজে লেগে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের দিনগুলোতে হাইকিং ট্রেইল জরুরি হয়ে পড়তে পারে। যেখানে, সাধারণ দিনগুলোতে ওয়াকিং ট্রেইলের বিকল্প নেই।
স্থপতি মৃধা রাতুল
(চলবে)
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৮ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২৩