স্থাপত্যকলার একটি বিমূর্ত অবদান হেরিটেজ ট্রেইল। স্থাপত্যচর্চার আদি অবস্থায় অর্থাৎ, ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যে এই ট্রেইলের ব্যাপ্তি ছিল। ট্রেইলের নামকরণ যে হেরিটেজ ট্রেইল ছিল, তা মূর্তমান ছিল না। বহু বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে লোকসমাজব্যবস্থায় গড়ে উঠেছে এই ট্রেইল। আধুনিক সময়ে একে স্থাপত্যকলার উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে চিহ্নিত করা হলেও আদিকাল থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত এর বিস্তৃত রূপ দেখা যায়। হেরিটেজ ট্রেইল এখন একটি বিভাগ, যা নগর-অঞ্চল ও সমাজব্যবস্থায় একটি পূর্ণাঙ্গ হালখাতাস্বরূপ। এই হালখাতায় প্রাগৈতিহাসিক স্থান, কাল, পাত্র, ঘটনাবলি ও স্থাপত্যকলা চোখের সামনে বারবার উত্থাপিত হয়। শহুরে সমাজব্যবস্থার পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও বিদ্যমান এই ট্রেইল। হেরিটেজ ট্রেইল সরাসরি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি হতে পারে একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের নির্মাণ, পুনর্র্নির্মাণ বা কনজারভেশন সিস্টেম। আবার এটি হতে পারে একটি নির্দিষ্ট স্থানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিষয়বস্তু অনুযায়ী আলেখ্য। তবে, এই দুইটার যেকোনো একটাই হোক না কেন, হেরিটেজ ট্রেইল হলো সম্পূর্ণভাবে পাবলিক স্পেসের উন্নয়ন। হেরিটেজ ট্রেইল নিয়ে স্থপতি মৃধা রাতুল-এর ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ –
হেরিটেজ ট্রেইল কী
হেরিটেজ শব্দের অর্থ ঐতিহ্য। এটা এমন একটা বিষয়, যা আমরা ভ‚ত বা অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সাদরে গ্রহণ করেছি। ইতিহাস আমাদের দুহাত ভরে দিয়েছে আর আমরা তা হয় বরণ করেছি, নয়তো অবমূল্যায়ন করেছি। বর্তমান অবস্থাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন ও উপভোগ করতে আমরা প্রায়ই অতীতকে অবজ্ঞা করে থাকি। এই অবজ্ঞাকে পরিহার করে অতীতের যথার্থ সম্মান প্রদর্শন, সংরক্ষণ ও ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে প্রেরণ করার নিমিত্তকেই হেরিটেজ বলে। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুযায়ী, ‘সম্পদ যা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতে পারে, তা একটি ঐতিহ্য বটে, আবার এটি এমন এক মূল্যবান বিষয় যেমন, ঐতিহাসিক ইমারত থাকে, যা পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে অধস্তন প্রজন্ম পর্যন্ত উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত হয়ে থাকে’। হেরিটেজের রয়েছে বহু রূপ। এটি হতে পারে ভৌত বস্তু এবং স্থান আবার হতে পারে, অদৃশ্য বা অভেদ্য অনুশীলন। অর্থাৎ যা অনুধাবন করা যায় কিন্তু হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না। যেমন, ভাষা, বাণী, গান, কলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, শিল্পবস্তু, শিল্প, সাহিত্য, পোশাক, আচার, সংস্কৃতি। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো হেরিটেজের কাতারে পড়বে ‘ইতিহাস’, ‘স্থাপনা’ ও ‘সেইসব মানুষ’।
অন্যদিকে ট্রেইল শব্দের অর্থ পথ। এটি একটি ট্র্যাক সিস্টেমও বটে। একটি ট্রেইল হতে পারে সরু রাস্তা, কাঁচা রাস্তা, এঁদো গলির ধারের পথ বা একটি ছোট পাকা রাস্তা। ট্রেইলের প্রয়োগ ও ব্যবহার কম। হেরিটেজ ট্রেইলের মতো এটি এতটা বিস্তৃত নয়। একে মোটরচালিত যানের জন্য কেউ কেউ প্রযোজ্য মনে করে না। ট্রেইল শুধু হাঁটাহাঁটি, স্কুটি চালানো, সাইকেল চালানো, হাতি-ঘোড়া-গাধার পিঠে চড়া, স্নোশুয়িং বা ক্রস-কান্ট্রি স্কিইংয়ের জন্য নিবেদিত। এগুলোর চেয়ে বেশি কিছু নয়। যেমন, যুক্তরাজ্যে ব্রডলওয়ের ক্ষেত্রে ট্রেইল ভাগ করে ব্যবহার করা হয় এবং পথচারী, সাইক্লিস্ট এবং অশ্বারোহীরা একইভাবে এই ট্রেইলকে ব্যবহার করতে পারে। সাধারণত একটি প্রাকৃতিক এলাকার মধ্য দিয়ে একটি ট্রেইল বয়ে যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ট্রেইলের বিভিন্ন রকম প্রয়োগ দেখা যায়। যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যন্ডে এই ট্রেইল হয় পথচারী বা হাইকিং ট্রেইলের জন্য পছন্দসই একটা শব্দ। যেখানে এটিকে পথ বা ফুটপাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনুরূপ শব্দটি উত্তর আমেরিকায় নদী বরাবর একটি সহগামী রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং কখনো কখনো হাইওয়েতেও সরাসরি প্রয়োগ করা হয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এটি গ্রামে ও শহরে দুই রকম ব্যবহারে প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রে, ট্রেইল শব্দটি ঐতিহাসিকভাবে অভিযাত্রী এবং অভিবাসীদের দ্বারা ব্যবহৃত বন্য অঞ্চলে বা এর মধ্য দিয়ে একটি রুটের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এটাকে ওরেগন ট্রেইল বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ‘ট্রেস’ হলো ট্রেইলের একটি প্রতিশব্দ। যেমনটি নাচেজ ট্রেসে। সেখানে ট্রেইল শব্দের প্রয়োগ ও ব্যবহার কম দেখা যায়। ট্রেস শব্দের প্রয়োগ ও ব্যবহার দেখা যায়।
ট্রেইলের জন্য কিছু বিশেষত্ব মাথায় রাখতে হবে।
ভূখÐের কোথাও কোথাও ট্রেইলকে ট্রেসও বলা হয়ে থাকে।
একটি ট্রেইল হলো পথ বা রাস্তার একটি সিরিজ বরাবর একটি রুট।
ট্রেইল হবে কম ট্র্যাফিকযুক্ত ও অ-মোটরচালিত ব্যবহারের জন্য একটি পথ।
ট্রেইলের মতো পথে খেলাধুলা, র্যালি, রেস, গবাদিপশু চলাচল ও বিচরণও হতে পারে।
হরেক রকমের ব্যবহার ও প্রয়োগের ট্রেইলগুলো বিভিন্ন সেটিংসে অবস্থিত হতে পারে।
ট্রেইল মনোরম ব্যায়ামের পরিবেশ প্রদান করে থাকে।
হেরিটেজ ট্রেইলের সংজ্ঞা
হেরিটেজ ট্রেইল বলতে বোঝায়, যে পথে হেরিটেজকে স্পর্শ করা যায়, অবলোকন করা যায়, এর সামগ্রিক উন্নয়ন ও কাজ দেখা যায়। তদুপরি, ইতিহাসলব্ধ জ্ঞান অর্জন করা যায়। বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও এই ট্রেইলের ব্যাপকতা রয়েছে। একটা হেরিটেজ ট্রেইল সম্পূর্ণ হতে যত প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবটাই দেখা যায় দেশগুলোর ট্রেইলে, যা আমাদের দেশের জন্য একেবারেই অচেনা। এখানে ট্রেইল আছে কিন্তু ট্রেইলের সামগ্রিকতা কম। যার জন্য এগুলোকে পুরোপুরি হেরিটেজ ট্রেইল বলা যায় না। তবে অবশ্যই হেরিটেজ ট্রেইলে এ সম্পর্কিত থাকবে সাইনেজ এবং গাইডবুক। এই দুটির প্রয়োগ থাকে না বলেই অনেক ট্রেইলকে হেরিটেজ ট্রেইল বলা যায় না। এখন এই ট্রেইল হতে পারে হেঁটে হেঁটে। যাকে বলে ওয়াকিং ট্রেইল। যেমন, ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকায় হেঁটে হেঁটে হেরিটেজকে অবলোকন করা। আমরা, পুরান ঢাকায় অনেকেই হাঁটি। হেঁটে হেঁটে সবকটা হেরিটেজ সাইট ঘুরে বেড়াই কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাব থেকে যায়। আবার, স্থান বিশেষে এই ট্রেইলগুলো হয় ড্রাইভিং রুট ধরে ধরে। অর্থাৎ, হেরিটেজ কার বা বাস ট্রেইল। বাসে চড়ে হেরিটেজ দেখা যায়। যেমন, ভারতের মুর্শিদাবাদের হেরিটেজ ট্রেইল। বাস ট্রেইলের মাধ্যমে সব কটা ঐতিহাসিক স্থাপনাকে দেখা যায়। বাকি রইল ওয়াটার ট্রেইল। পৃথিবীর অনেক দেশে এমন ট্রেইলের ব্যবস্থা রয়েছে, যে ব্যবস্থার মাধ্যমে জলজ যানবাহন অর্থাৎ নৌকা, ওয়াটার বাস, জাহাজ, স্পিড বোট, ট্রলার ইত্যাদির মাধ্যমে সংঘটিত ট্রেইল। উদাহরণস্বরূপ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ঘুরতে বনের গভীরে যেতে অনেকেই জাহাজ বা লঞ্চে ভ্রমণ করে থাকেন, যেন কুমির ও বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচা যায়।
হেরিটেজ ট্রেইলের গুরুত্বপূর্ণ যত বিশেষত্ব
হেরিটেজ ট্রেইল হলো প্রকাশ্য স্থানে উন্নয়ন। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আরবান ডিজাইন।
ট্রেইলে অবশ্যই সাইনেজ এবং গাইডবুক প্রাধান্য পাবে।
হেরিটেজ ট্রেইল হলো সাংস্কৃৃতিক ঐতিহ্যের সুবিশাল বর্ণনা।
ট্রেইলের অন্তর্ভুক্তিকরণ হলো – ট্রেইলের প্রকৃতি সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, সম্প্রদায়ের সরাসরি অংশগ্রহণ, ঐতিহ্য আবিষ্কার, ট্রেইল উন্নয়ন।
হেরিটেজ ট্রেইলের ক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবেশে ও ড্রাইভিং সেটিংস থাকতে পারে।
হেরিটেজ ট্রেইল হলো নগর সংরক্ষণ কার্যক্রমের একটি দৃষ্টান্ত।
হেরিটেজ ট্রেইলের প্রয়োজনীয়তা
হেরিটেজ ট্রেইল হলো আরবান ডিজাইনের একটি বৃহৎ স্কেলের কাজ। এটি একটি অঞ্চল, নগর, ছোট শহর এমনকি গ্রামজুড়েও বিস্তৃত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে, সামগ্রিকতা হবে সামান্য। আবার, এই হেরিটেজ ট্রেইল একটা দেশজুড়েও হতে পারে। দেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হবে সামগ্রিকতা।
স্থান বিশেষে উদাহরণ- লালবাগ কেল্লার ট্রেইল, সোনাকান্দা কেল্লার ট্রেইল, সাভারের স্মৃতিসৌধের ট্রেইল, বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধিতে ট্রেইল ইত্যাদি।
এলাকা বা নগর বিশেষে উদাহরণ- পানাম নগরীর ট্রেইল, নগর কসবার ট্রেইল, শাঁখারি বাজার ট্রেইল, নিতাইগঞ্জ ট্রেইল ইত্যাদি।
শহর বিশেষে উদাহরণ- মুর্শিদাবাদ ট্রেইল, দিল্লির ট্রেইল, নারায়ণগঞ্জ ট্রেইল, পুরান ঢাকার ট্রেইল, বগুড়া শহরের ট্রেইল, নওগাঁ শহরের ট্রেইল, কুমিল্লা শহরের ট্রেইল, কলকাতার ট্রেইল ইত্যাদি।
হেরিটেজ ট্রেইল হলো একটি স্থানের আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত সম্পদ আবিষ্কারের একটি মাধ্যম। স্থানটি অবশ্যই ঐতিহাসিক হতে হবে, যার যথেষ্ট মূল্যবোধ ও আবেদন থাকবে। ট্রেইলের মাধ্যমে আবিষ্কৃত সম্পদের ভূমিকা অনেক। এগুলো দেশ, কাল ও সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে, যা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আবার এই ট্রেইল নগর সংরক্ষণ কার্যক্রমের একটি যথোপযুক্ত প্রয়াস, যেখানে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। একই সঙ্গে তাদের যথাযথ আগ্রহ ও আগ্রহের বিকাশ থাকতে হবে। সম্পৃক্ততা, আগ্রহ ও বিকাশ এই তিনের সম্মিলনে শহরের ইতিহাস নতুন করে রচিত হবে, যা কিছু পুরাতন তা-ই নতুন করে উত্থাপিত হবে। স্থানীয় লোকজনের সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও এটি অবদান রাখবে। হেরিটেজ ট্রেইলের মাধ্যমে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর সংরক্ষণ ও সুরক্ষার মতো প্রকল্পগুলোকে তাদের সম্পর্কে প্রামাণিক তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এটিকে বলা হয় ডকুমেন্টেশন। আবার, বিভিন্ন মাধ্যমে এটিকে এই ট্রেইলই প্রকাশ করে থাকে। তাদের সমর্থন করতে উৎসাহিত করতে পারে। বিশিষ্ট নাগরিকদের বাসস্থানও ঐতিহ্যের অংশ। সামাজিকভাবে, ঐতিহ্যগত সম্পদের একটি এলাকার জীবন ও পরিচয়ে অবদান রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, সেগুলো এমন জায়গা, যা সম্প্রদায়ের কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু, যেমন পাবলিক হলো, স্কুল, মেকানিকস ইনস্টিটিউট, ধর্মীয় উপাসনার স্থান ও পার্ক।
হেরিটেজ ট্রেইল সৃষ্টির নেপথ্যে
একটি ঐতিহাসিক এলাকার জন্য ঐতিহাসিক স্থাপনা তথা নিদর্শনগুলো যেমন অত্যাবশ্যক ভূমিকা রাখে, তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব বহন করে থাকে হেরিটেজ ট্রেইল। এই ট্রেইল একসময় ঐতিহ্যবাহী ট্রেইলে রূপান্তরিত হয়ে থাকে, যা দেশ, কাল ও সীমানাকে ছাড়িয়ে প্রাগৈতিহাসিক ট্রেইলের মর্যাদা পায়। হেরিটেজ ট্রেইলে অনেক স্টপেজ থাকে। এই স্টপেজ আবার ঐতিহাসিক যাত্রাকে বিরাম প্রদান করে থাকে ও দিকনির্দেশনা দেয়। একটি এলাকায় হেরিটেজ ট্রেইল তৈরি করার ক্ষেত্রে যে বিষয়টা মাথায় রাখতে হয় তা হলো একটি সুদীর্ঘ গল্প রচনা করা। এই হেরিটেজ ট্রেইলের যাত্রা হয় গল্পময়। এটি হবে ওই স্থানের নিজস্ব পরিচিতি। এই যাত্রায় কী কী গল্পাংশ থাকবে ও সিদ্ধান্ত হবে, তাও গল্পের রচয়িতাকে ঠিক করতে হয়। হেরিটেজ ট্রেইলের গল্পের মুখ্য দিক হলো সার্বিক ইতিহাসকে তুলে ধরা ও সবাইকে বোঝানো। এখানে সংমিশ্রিত হবে আকর্ষক, চিত্তাকর্ষক, মজাদার, তথ্যপূর্ণ পথ পরিকল্পনা। একটা গল্প পড়তে পড়তে পাঠক কখনো ক্লান্ত হয় না। বরঞ্চ, সামনের দিকে কী আছে তা জানার প্রয়াস থাকে। হেরিটেজ ট্রেইলের গল্পের উপস্থাপনও তেমন করেই হতে হয়। একটি হেরিটেজ ট্রেইলকে সার্থক করে রূপদান করে গড়ে তোলার পেছনে মোটামুটি কয়েকটি নেপথ্য ভাগ থাকে। আর এখানে তা সুদীর্ঘ আলোচনায় মাধ্যমে তুলে ধরা হলো।
ক্যাটাগরি নির্বাচন
একটি হেরিটেজ ট্রেইল গড়ে তোলার প্রারম্ভে লক্ষ্য স্থির করতে হবে। সবার আগে হেরিটেজ ট্রেইলটা কোন ক্যাটাগরির হবে তা নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এটি হেরিটেজ বাস ট্রেইল হবে নাকি ওয়াটার ট্রেইল হবে, তা বুঝতে হবে। ধরা যাক, রাজধানীর পুরান ঢাকা অংশে বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। আবার, ঢাকার এই অংশটায় আছে বুড়িগঙ্গা নদী। তাই, শুরুতেই ভাবতে হবে এখানে ওয়াকিং ট্রেইল দিয়ে হেরিটেজ সাইটের সংযোগ সাধন সম্ভব কি না। আবার, এটিও ভাবতে হবে যে এখানে কার বা বাস ঢোকানো সম্ভব কি না। যেহেতু শহরের প্রধান সমস্যা ট্র্যাফিক জ্যাম। তাই বাস ট্রেইলের পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। যেহেতু লোকজন পুরোনো শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখতে পছন্দ করে, তাই ওয়াকিং ট্রেইলটা জরুরি। আবার নদীর সঙ্গে সংযোগ রেখা বিদ্যমান বলে ওয়াটার ট্রেইল নিয়েও ভাবা যায়। হেরিটেজ ট্রেইলের লক্ষ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে এখানে আরও কিছু প্রশ্নকে ঢেলে সাজাতে হবে। যেমন- হেরিটেজ ট্রেইলে স্থানের কোন সম্যক অবস্থাকে ফোকাস করতে হবে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন হবে। ঠিক কতগুলো হেরিটেজ সাইট সংযুক্ত করতে চাই তারও একটা লিস্ট বা তালিকা করা অত্যাবশ্যক। সাইটের কমবেশি সংযুক্তিকরণে নেই কোনো বাধাধরা। অনেক বেশি বা কম সাইটও যুক্ত করা যেতে পারে। এই সাইট সংযুক্তকরণের মূল উদ্দেশ্য হলো সম্পদের সংরক্ষণে জনগণকে উৎসাহিত করা। তা ছাড়া, পর্যটনের মাধ্যমে এর অর্থনৈতিক প্রভাব ঠিক কেমন পড়বে তাও জানাটা অত্যাবশ্যক। সবকিছুতেই যেন স্থানীয় লোকজনের বা সম্প্রদায়ের অবদান নিশ্চিত হয়।
হেরিটেজ পথ নির্মাণ
হেরিটেজ ট্রেইলে আপনাকে হেরিটেজ পথ তৈরি করতে হবে। তাই পূর্ববর্তী ট্রেইলে এ পথ থাকাটা অতি জরুরি। যেকোনো ধরনের পথ ছাড়া হেরিটেজ ট্রেইল সম্ভব না। যদি, এমনটাও ভাবতে হয় যে অনেক হেরিটেজ সাইট আছে কিন্তু একটাও পথ নেই, তবে একটি কৃত্রিম পথ তৈরি করে নিতে হবে। পথ ছাড়া হেরিটেজ পথ নির্মাণ অসম্ভব। এই হেরিটেজ পথটি বেসিক হেরিটেজ ট্রেইল হিসেবে কাজ করবে, যা একটি মুদ্রিত গাইডলাইন হবে। যেমন, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সার্চ করলে আমরা বহু হেরিটেজ সাইটের সমন্বয়ে হেরিটেজ পথ দৃশ্যমান দেখি। যেটিকে ভ্রমণপথ বলে। এটি আবার হেরিটেজ সাইটের অবস্থান ও ডকুমেন্টেশন প্রদান করে থাকে। আজকাল এই পথটিকে গাইডবুক, অডিও ট্যুর, ব্যাখ্যামূলক চিহ্ন বললেও অত্যুক্তি হবে না। আমাদের হেরিটেজ ট্রেইল নির্মাণের সময় সম্পূর্ণ পরিষেবা ট্রেইল রুট, দর্শনার্থী কেন্দ্র, বিশেষ ইভেন্ট এবং ট্যুর বরাবর ওয়েফাইন্ডিং সাইনেজ এসব বিষয়ে নজর রাখাটা অতীব জরুরি।
হেরিটেজ ট্রেইলের জন্য যেমন স্থান বা শহর
একটি ছোট সাইট থেকে শুরু করে নগর পরিধি, ছোট-বড় শহর, গ্রাম হতে পারে হেরিটেজ ট্রেইলের জন্য উপযুক্ত। শহুরে জীবন ব্যবস্থাপনায় দেখা যায়, উন্নয়নের চাপের গ্যাড়াকলে পড়ে আছে মানুষের জীবনযাত্রা তথা তাদের কৃষ্টি, কালচারÑ সবকিছুই। এখানে দ্রæত আর্থসামাজিক উন্নয়নব্যবস্থা দেখা যায়, যা প্রগতিশীলতার সঙ্গে হাত মেলায়। এ ক্ষেত্রে, প্রাচীনত্বের কী হাল? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা বেশির ভাগ অবহেলিত, নিগৃহীত, নিপীড়িত ও শোষিত। এই শব্দগুলো কি কেবল মানুষ বা জীবের জন্য প্রযোজ্য? এগুলো স্থাপনা ও কৃষ্টি, কালচারের সঙ্গেও জড়িত। অনেকেই মনে করেন, পুরোনো স্থাপনাগুলোকে ভেঙে ফেলা উচিত বা এদের ভেঙে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করে আধুনিকায়ন সম্ভব। কিন্তু, এইটা মোটেও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নয়। যারা এই ধরনের চিন্তা করে থাকে, তারা প্রকৃতপক্ষে বাকিদের ভুল বুঝিয়ে থাকে। তাই, এই মানসিকতার যথেষ্ট পরিবর্তন দরকার। আজকাল যেকোনো স্থানেই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থানসমেত জায়গাগুলো কেমন যেন তাদের আবেদন হারিয়ে ফেলছে। প্রাচীনত্ব বলে যে একটা শক্তি ছিল তা যেন ¤্রয়িমাণ। প্রাচীন নিদর্শন হারাচ্ছে প্রাচীনত্ব। এর পেছনে শক্তভাবে কাজ করছে কয়েকটা বিষয়। যেমন, নতুন ভূমির পরিমাণ কম তাই অনেকেরই দৃষ্টি গিয়ে পড়ে সেই প্রাচীন জমির প্রতি; জমির দাম বহুগুণে বেড়ে যাওয়া অর্থাৎ, প্রাচীনকাল থেকে একই স্থানের জমির দরদাম পুনঃপুনঃ পরিবর্তিত হয়, জমি ব্যবহারের ধরন ও প্রকরণ, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অভাব, সর্বোপরি তাত্তি¡ক দিকনির্দেশনার অভাব ইত্যাদি।
প্রথমেই আমাদের যথোপযুক্ত অঞ্চল বা স্থান বাছাই করতে হবে। প্রাচীন এই অঞ্চলগুলোতে আমাদের টার্গেট থাকবে হেরিটেজ ট্রেইল প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, কালচার ও সেসব সংস্কৃতিমনা মানুষগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। যার সাক্ষীস্বরূপ রয়েছে বহু নিদর্শন। যেমন স্থাপত্যকলা, প্রাচ্যকলা, নন্দনকলা ইত্যাদি। স্থাপত্যের সবচেয়ে বেশি অবদান থাকে এই পর্যায়ে। পর্যায়টাকে আমরা আবার কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত দুইটা পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি। কাঠামোগত পর্যায়গুলোতে থাকবে সব স্থাপনা, পথ, ঘাট, ভাস্কর্য, চিত্রকলা ইত্যাদি। আর অবকাঠামোগত পর্যায়ে থাকবে সেসব সংস্কৃতিমনা মানুষজন ও তাদের সতীর্থগণ।
ট্রেইল হবে হেরিটেজ
হেরিটেজ ট্রেইল হবে ঐতিহ্যগত পর্যটনের প্রবর্তন ও আবর্তন। যেখানে, পুরোনো শহরে ট্রেইলটি হবে পর্যটন ট্রেইল। এই ট্রেইলটি প্রাথমিক অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থার উন্নয়নের স্মারক হয়ে ফুটে উঠবে। পর্যটন ট্রেইলের মধ্যে এমন অনেক কিছুই জুড়ে থাকবে, যা ভাষাতীত ও বর্ণনাতীত। যেমন, পুরোনো ব্যবহার্য কাপড়চোপড়, আসবাব, গয়না, ভাস্কর্য ইত্যাদি। হেরিটেজ ট্রেইল এখন কেবল ট্রেইল নয়, এটি পুরো শহরজুড়ে একটা আরবান প্যাটার্নমাত্র। অন্যভাবে বলা যায়, একটি হেরিটেজ ট্রেইল হলো একটি নির্দিষ্ট স্থানের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলা এবং উদ্ভিদরাজি ও প্রাণীবর্গের পুনরায় আবিষ্কারের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক স্থান এবং অন্যান্য স্থানের মধ্যে একটি হেরিটেজ সিরিজ সৃষ্টি ও ক্রমাগত তৈরি করা এবং এই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে একটি লম্বা জার্নি বা যাত্রাবিশেষ।
হেরিটেজ ট্রেইল যখন আকর্ষক গল্প
একটি হেরিটেজ ট্রেইলকে বেশি আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করে গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে, শুরুতেই গল্প নির্বাচন করতে হবে। গল্পটি হবে আকর্ষণীয়! এই গল্পের পরিপ্রেক্ষিতে থাকবে কিছু প্রায়োগিক বিষয়। যেমন, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার। প্রতিটা স্থানের একটা নিজস্ব সংজ্ঞা থাকে। যেমন এই স্থানটি একটি বিশেষ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আবার, এই ঘটনার মুখ্য নায়ক অমুক ব্যক্তি। সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে। দেখা যায় যে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে অসংখ্য পুরোনো স্থাপনার অনুসন্ধান মেলে। তাহলে এই অংশে হেরিটেজ ট্রেইল গড়ে তুললে অবশ্যই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপনকে প্রাধান্য দিতে হবে। আবার, রেসকোর্স ময়দান বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এই স্থানকে ঘিরে কোনো হেরিটেজ ট্রেইল গড়ে তুলতে চাইলে এখানে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে ফোকাস করতে হবে। সুতরাং, গল্প হবে ঘটনা, স্থাপনা ও নায়কনির্ভর। আর এসব বিষয়কে আরও বেশি প্রাণবন্ত করে গড়ে তুলতে হলে জাদুঘর, ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক, ঐতিহাসিক পাড়া বা উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডস্কেপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
হেরিটেজ ট্রেইলের গল্পে থিম নির্বাচন
থিম নির্ধারণ করুন। একবার গল্পের একটি তালিকা তৈরি করে ফেললে আপনি আপনার ঐতিহ্যের পথটি বলতে চান, একটি অত্যধিক থিম বা এমনকি বিভিন্ন থিম আছে কি না তা দেখুন। একটি থিম বা একাধিক, পথটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুসংহত তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। এটি আপনাকে একটি নাম নিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে।
স্টপ ম্যাপ নির্ধারণ করা
ট্রেইল বরাবর ধাপে ধাপে স্টপ ম্যাপ তৈরি করতে হবে। প্রতিটা স্টপকে আপনার শনাক্ত করা গল্প জানিয়ে দেওয়া উচিত। যেন সর্বত্র একই রকম ফিল হয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এত আরবান ডিজাইনে //////ডিস্টর্শন////// হবে না। আপনার পথের থিমে অবদান রাখা উচিত এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি তরল পথ তৈরি করা উচিত। স্টপ নির্বাচন করার সময় বিবেচনা করার জন্য কিছু প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত: এলাকাগুলো কি ইতিমধ্যেই দর্শকবান্ধব? আশপাশে কি থাকার জায়গা, ডাইনিং বা কেনাকাটা আছে? তারা সহজে অ্যাকসেসযোগ্য? দর্শকদের কি কাছাকাছি পার্কিং, বিশ্রামাগার বা গ্যাস স্টেশনগুলোতে অ্যাকসেস থাকবে?
দর্শককে নিয়ে ভাবনা
আপনি কীভাবে গল্প বলবেন তা নির্ধারণ করুন। প্রতিটি স্টপে তার নিজস্ব গল্প এমনভাবে বলা উচিত, যা দর্শকদের জড়িত করে এবং নতুন উপায়ে এলাকার মানুষ, স্থান এবং ঘটনাগুলো সম্পর্কে চিন্তা করার জন্য তাদের চ্যালেঞ্জ করে। আপনি যে উপকরণগুলো তৈরি করতে চান তার জন্য পরিকল্পনা শুরু করুন, যা দর্শকদের অভিজ্ঞতা বাড়াবে। মুদ্রিত উপকরণ থেকে শুরু করে অডিও থেকে বিশেষ ইভেন্ট পর্যন্ত, আপনি কী ধরনের পথ তৈরি করতে চান, তার দ্বারা এগুলো আংশিকভাবে নির্ধারিত হবে। আপনার তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করুন এবং সব গাইডবুক, ব্রোশিওর, মানচিত্র এবং অন্য অংশগুলো সত্য নিশ্চিত করুন। আপনার ট্যুর গাইডদের প্রশিক্ষণ দিন, যদি আপনার কাছে থাকে। নিশ্চিত করুন যে প্রতিটি স্টপে থাকা সংস্থানগুলো সংরক্ষিত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ- লোকজনের হেঁটে যেতে দেবেন না এবং এমন জায়গাগুলো পরতে দেবেন না, যা সুরক্ষিত করা উচিত।
‘বিভিন্ন কোণ থেকে ইতিহাস ব্যাখ্যা করা এটিকে কেবল আরও আকর্ষণীয় নয়, আরও সত্য করে তোলে।’ জন হোপ ফ্র্যাঙ্কলিন, ইতিহাসবিদ এবং লেখক
লেখক
স্থপতি, মৃধা’জ ড্রয়িং হাউস, নারায়ণগঞ্জ
মড়ফযঁষুষড়মড়হবব@মসধরষ.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৭ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০২৩