হাউস লিফটিং

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী। সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়কে এমনকি বাড়ির উঠোনে জমে যায় পানি; প্রবেশ করে ভবনের বেজমেন্টসহ নানা স্থানে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভবনের স্ট্রাকচার। এমনকি পানি জমে থাকায় মাটি নরম হয়ে বাড়ির ভিত দিন দিন দেবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বহু বছরের পুরোনো কোনো ভবন ধীরে ধীরে মাটিতে বসে গেছে, এমনটা হরহামেশাই দেখা যায়। কারণ সেই স্থানে একসময় পুকুর বা জলাশয় ছিল, যা ভরাট করা হয়েছিল। অথবা রাস্তার উচ্চতা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়েছে যে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার জন্য আরেকটা ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে রাস্তা থেকে নেমে নিচু হয়ে প্রবেশ করতে হয়। চট্টগ্রাম ও পুরান ঢাকার অনেক স্থানেই এই দৃশ্য দেখা যায়। বন্যা বা জলোচ্ছ¡াস হলে যতটুকু পানি ওঠে, ততটুকু পর্যন্ত বাড়িতে ঢোকার পথ আটকে দেওয়া হয়। অনেক স্থানে ঢালাই করে ফ্লোরের উচ্চতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে গ্রাউন্ডফ্লোরের উচ্চতা বলতে কিছু থাকে না। ভ‚মিকম্প হলে দেখা যায় অনেক ভবনই যায় হেলে। এই সমস্যাগুলো থেকে রেহাই পাওয়ার অনন্য এক সমাধান হাউস লিফটিং সার্ভিস। অর্থাৎ বাড়িকে ওপরের দিকে তোলা। কিন্তু শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, অবিশ^াস্য এই কাজটাই হতে পারে প্রকৌশলীদের জন্য আগামীর পেশা। হাউস লিফটিং বিষয়ে সবিস্তারে জানাচ্ছেন স্থপতি রাজীব চৌধুরী

হাউস লিফটিং করা হয় যেভাবে

প্রত্যাহিক জীবনে বাসাবাড়ি অথবা অফিসে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম বাড়ির নিচতলা থেকে রাস্তার উঁচু হয়ে যাওয়া। রাস্তা সাধারণত জমির চেয়ে নিচের স্তরে বা সমতলে থাকে। আগেকার দিনের বাড়িগুলোর প্লিন্থ লেভেল অনেক নিচু হতো। অনেক বাড়ির প্লিন্থ বলতে কিছুই থাকত না। মোটামুটি রাস্তার সমান হলেই বাড়ির জন্য উপযুক্ত ভাবা হতো। কিন্তু জমি রাস্তা থেকে নিচে নেমে গেলেই ঘটে বিপত্তি। আগেকার দিনের বাড়িগুলোর উচ্চতা থেকে রাস্তার উচ্চতা বাড়ছে। পানি, গ্যাস, ইন্টারনেটসহ নানা সার্ভিস যুক্ত হচ্ছে রাস্তায়। আর যেহেতু রাস্তা, নর্দমা ও বাড়ি এক অক্ষরেখায় থাকে না, তাই সামান্য বৃষ্টিতে পানি নর্দমায় না নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। 

প্রতিদিনের ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে যেহেতু নালা আগেই ভরাট হয়ে গেছে, তাই সেই পানি আর কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতর। আর এরপরেই শুরু হয় যন্ত্রণা। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে পুরো বাসা। বিশেষ করে নিচতলা পুরোটাই ডুবে যায়। জীবন সংকটে পড়ে লোকজন। আর এসব সমস্যা সমাধানেই উদ্ভব হয়েছে হাউস লিফটিং। বাড়িটা একটু ওপরের দিকে তুলে সেখানে নতুন ফ্লোর যোগ করলেই কিন্তু এই সমস্যা থেকে সমাধান পাওয়া সম্ভব। অথবা একটু লিফট করে নিচের দিকে আরেকটা গ্রেড বিম দিলেই সমস্যা মিটে যায়। আবার চাইলেই বাড়ি খানিকটা ওপরের দিকে তুলে প্লিন্থ লেভেল ওপরের দিকে তুলে দিলেই কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়। আবার কারও জমিতে বাড়ি যদি সামনের দিকে থাকে, তাহলে পুরো বাড়িটা হাউস লিফট করে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, যেখানে উঁচু ভিত আছে। এখানে জমির মাটির ওপর এটা বেশ অনেকটাই নির্ভরশীল। মাটি নরম হলে হয়তো নতুন ভিতের জন্য পাইল প্রয়োজন হয়। শক্ত হলে প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান এই হাউস লিফট দিন দিন সহজ ব্যবহারযোগ্যতার জন্য হয়ে উঠছে জনপ্রিয়।

ভবন বা জমির স্তর যেভাবে নিচু হয়

বছরের পর বছর রাস্তায় বিটুমিনের লেয়ার দিয়ে এর উচ্চতা বৃদ্ধি হলে জমির স্তর নিচের দিকে নেমে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা ১০০ বছরের মধ্যে দুই বা ততোধিক ফুট হতে পারে। আর আগের চেয়ে নর্দমায় দূষণের মাত্রা বেশি বলে বৃষ্টিতে পানি জমে এই পানির স্তর ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে সহজেই। ভ‚মিকম্প বা বন্যার মতো দুর্যোগের জন্য ও বাড়ির ক্ষতি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, পাইল থাকার পরও ভ‚মিকম্প হলে বাড়ি এক দিকে হেলে পড়ে। আবার কোনো কোনো বাড়ি মাটির নিচে প্রবেশ করে খানিকটা। এসব ক্ষেত্রে বাড়ি লিফটিং করা ছাড়া ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কেউ হয়তো ভাবতেই পারে যে রাস্তার সঙ্গে ফ্লোরের লেভেল একই করে নিলে হয়তো সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এতে নিচতলার ফ্লোরের উচ্চতা কমতে থাকে। ফলে তা হয়ে পড়ে ব্যবহারের অনুপযোগী। তাই শেষমেশ বাড়ি ভেঙে নতুন করে বাড়ি তৈরি করা বা হাউস লিফটিং করা হয় বাধ্যতামূলক। অনেকের পক্ষেই তো বাড়ি ভাঙা সম্ভব হয় না। আবার অনেকেই পুরোনো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চান। কেউ কেউ নিজের প্রাচীন অতীতের স্মৃতিকে মুছে না ফেলার প্রত্যয়ে হাউস লিফটিং করান।

অন্যদিকে সম্প্রতি দেখা যায়, কিছু ভবন আশপাশে ভবনের কারণে মাটিতে দেবে যায়। আবার কোনো একটি পুরোনো বাড়ির ফাউন্ডেশনে কোনো পাইল থাকে না। কিন্তু পাশের ভবনের পাইল বসানোর সময় মাটিতে যে ঝাঁকুনি তৈরি হয়, এর ফলে বাড়িতে ফাটল ধরে; ফাউন্ডেশন দেবে যায়। শোর পাইল দেওয়ার পরও মাটির পাশ থেকে ¯øাইড হয়। বাড়ি মাটির ভেতর ঢুকতে শুরু করে। তখন হাউস লিফটিং করে বাড়ির ফাউন্ডেশন ঠিক করতে হয়। 

মাটির সাধারণ গুণাগুণ হলো, এটিতে যত ইচ্ছা চাপ দেওয়া যায়। আর এ জন্য পুরোনো বাড়িগুলোর সঠিক উচ্চতা মাপলেই বোঝা যায় পাইল ছাড়া বাড়ি করলে সেই বাড়ি ধীরে ধীরে মাটির ভেতর প্রবেশ করতে শুরু করে। মাটির ভেতরে প্রবেশের এই হার অনেক কম হলেও বেশ কিছু বছর পর দেখা যায় এটা এক ইঞ্চি থেকে তিন ফুট বা এরও বেশি হতে পারে। ম্যাট ফাউন্ডেশনের বাড়িগুলোর ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়। মাটির স্তরের ¯øাইডিং সমস্যার কারণে (আগেই সেখানে যদি কোনো জলাশয় থাকে, তাহলে এই সমস্যাটা বেশি হয়) বাড়ির স্বাভাবিক ওজন নিজেই নিতে পারে না। পুরো বাড়িটিই নিচের দিকে ডুবে যেতে থাকে। তখন বাড়ির ফাউন্ডেশনে কিছু ঠিকঠাক করে নিলেই এই সমস্যা থেকে উতরে যাওয়া সম্ভব।

চাহিদার প্রয়োজনে অনেকের বাড়ির ফ্লোর স্পেস বেশি প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফাউন্ডেশন থাকে কম। আর এ জন্য ফাউন্ডেশনের শক্তি বৃদ্ধি করে বাড়ির তলার সংখ্যা বাড়াতে হয়, যার জন্য হাউস লিফটিং খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপায়। আবার সম্পত্তি নিয়ে নিজের ভাই অথবা আত্মীয়দের সঙ্গে সমস্যার জন্য অন্যের জমি বা সম্পত্তি পরিবর্তন হতে পারে। যে স্থানে বড় ভাইয়ের বাড়ি আছে, সেখানেই হয়তো ছোট ভাই ভাগ পেয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে পুরো বাড়ি সরিয়ে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতিতে হাউস লিফটিং বেশ কার্যকর। 

প্রকারভেদ

হাউস লিফটিং মূলত দুই প্রকার। হাউস লিফট ও হাউস মুভ। একটি বাড়ির উচ্চতা বাড়িয়ে নিচের বেইজ ঠিক করা। আরেকটি বাড়িকে অন্য স্থানে স্থানান্তর। আমরা এটাকে বিভাজিত করলেও দুটো সার্ভিসই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। বাড়ি করার সময় সামনে জায়গা কম রাখলে পরে সেই বাড়িতে চেক করার সময় যদি কোনোভাবে বাড়িটিকে পেছানো যায় তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। 

হাউস লিফটিংয়ের নিয়মকানুন

হাউস লিফটিং করার জন্য প্রথমেই যা জানা প্রয়োজন তা হলো একটি বাড়ির ওজন ঠিক কতটা। বাড়ির ওজন বের করার পদ্ধতি বেশ সহজ। কংক্রিট ও রডের পরিমাণ জানা থাকলে, বিশেষ করে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন যদি থাকে, তাহলে বাড়ির লোড প্রায় সঠিকভাবে বের করা সম্ভব। আমাদের দেশের বেশির ভাগ বাড়ির আর্কিটেকচারাল ডিজাইন না থাকলেও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন অবশ্যই থাকে। আর এই ডিজাইন থেকে বাড়ির ডেড লোড জানা সম্ভব। ডেড লোড যদি জানা সম্ভব না হয়, তাহলে এটা অনুমান করে নিতে হয়। যদি বাড়ির ফ্লোরের সংখ্যা বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে আনুমানিক একটা লোড ক্যালকুলেশন করে এরপর সেটার নিচে খুঁড়ে কাজ শুরু করতে হয়।

এরপর জানতে হবে নতুন স্ট্রাকচার যোগ করার ক্ষেত্রে এই বাড়ির ফাউন্ডেশন নতুন ওজন নিতে পারবে কি না। আমাদের অনেকের বাড়িতে পাইলিং করা হয়। সেই পাইলগুলো ঢুকে যায় মাটির ভেতর ৫০ থেকে ৭০ ফুট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। যত দূর শক্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগে যদি ৫ তলা ফাউন্ডেশন দেওয়া থাকে আর বাড়িটি যদি ২ তলা পর্যন্ত করা হয়, তাহলে সেটা লোড নিতেই পারবে। কিন্তু যদি দোতলা ফাউন্ডেশনে দোতলা বাড়িই থাকে, তাহলে নতুন করে ফাউন্ডেশন দিতে হবে। বাড়ির স্ট্রাকচারের সঙ্গে নতুন স্ট্রাকচার বানিয়ে নেওয়ার আগে মাটি পরীক্ষা করতে হবে। বাড়ির কলাম ও বিম  কিছুটা ভেঙে (যেসব স্থানে ভাঙলে স্ট্রাকচারের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই), সেখান থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যায় যে স্ট্রাকচার কতটুকু লোড নিতে পারবে। 

এরপর বুঝতে হবে আমাদের আসল চাহিদা কোনটা। চাহিদা যদি হয় বাড়ির ফাউন্ডেশন ঠিক করা বা নতুন করে করা, তাহলে সেটা করতে হবে। বাড়ির ভিত পর্যন্ত যেতে হবে। এরপর বাড়ির ফাউন্ডেশন চেক করে সেটা যদি ঠিক করা প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটা করতে হবে। 

হাউস লিফটিংয়ের প্রথম ধাপ- বাড়ির অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে আনতে হবে। যতটা সম্ভব বাড়ির লাইভ লোড কমাতে হবে। ভারী কোনো যন্ত্রাংশ বা আসবাব থাকলে তা স্থানান্তর করতে হবে। মানুষের থাকা বা না থাকা হাউস লিফটিংয়ে কোনো প্রভাব ফেলে না। আপনি হাউস লিফটিংয়ের সময় বাড়িতে ঘুমোতেও পারবেন। কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু বাড়িতে কোনো ইউটিলিটি রাখা যাবে না। যেমন, পানির লাইন, গ্যাস বা অন্যান্য সুবিধা রাখা চলবে না। ইলেক্ট্রিক্যাল কানেকশন পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে। বন্ধ রাখতে হবে অন্যান্য ইউটিলিটি যেমন ডিশ সংযোগ, ইন্টারনেট বা এ রকম অন্য কোনো লাইন। খেয়াল রাখতে হবে যেন এগুলো থেকে কোনো বিপদ তৈরি না হয়। যদিও মানুষ থাকা না থাকায় কোনো সমস্যা তৈরি হয় না, তবুও মানুষের ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন স্থানে ঝাঁকুনি তৈরি হতে পারে, যা বাড়ি উত্তোলনের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা। অনেকখানেই বাড়ির বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন লোড ক্যালকুলেশন থাকে। বাড়িতে স্প্যানশন জয়েন্ট থাকে। সে ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা অংশে কাজ করতে হয়। পুরো বাড়ি একসঙ্গেই ওপরের দিকে তোলা হয় বটে, কিন্তু পৃথক স্ট্রাকচার তৈরি করে এরপর কাজ করতে হয়। 

পুরো হাউস লিফটিং প্রসেসটিই করতে হবে শুকনো মৌসুমে। ভেজা মৌসুম হাউস লিফটিংয়ের উপযোগী নয়। আমাদের দেশে হাউস লিফটিংয়ের জন্য লম্বা বর্ষাকাল একটি বাধা বটে। কিন্তু নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে হাউস লিফটিং সম্ভব হয়, যদি সব নিয়ম মেনে কাজ করা যায়। এটি করতে খুব একটা বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। একটা দোতলা বাড়িকে লিফট করতে (১০০০-২০০০ বর্গফুটের) এক মাস সময় যথেষ্ট। তবে শুধু হাউস লিফট করলেই হয় না, এর বেইজ তৈরি বা নতুন বেইজ ঢালাই অথবা একে ওপরের দিকে তোলার কাজটা একটু সময় সাপেক্ষ। তবে সেটা ও এমন নয় যে মাসের পর মাস লেগে যাবে। মোট কথা, একটানা কাজ করতে হয় হাউস লিফটিংয়ের ক্ষেত্রে। আর এই পুরো সময়টাতে বাড়িতে বসবাস করা লোকজনের বাইরে কোথাও থাকতে হয়, যা একটু ব্যয়সাপেক্ষ।

সঠিক জ্যাক নির্বাচন হাউস লিফটিংয়ের প্রধান শর্ত। একটি জ্যাক দিয়ে সাধারণত প্রতি বর্গমিটারে ২০ মেট্রিক টন লোড ওপরের দিকে তোলা সম্ভব হয়। কোনো একটি বাড়ির প্রতি বর্গমিটারে যদি ৫৬ মেট্রিক টন লোড থাকে, তাহলে এই বাড়ির প্রতি বর্গমিটারে জ্যাক প্রয়োজন হবে নি¤েœাক্ত উপায়ে।

প্রতি বর্গমিটারে বাড়ির ওজন

=                  জ্যাকের পরিমাণ

জ্যাকের ওজন ধারণের ক্ষমতা

এর মানে বাড়ির ওজন যদি প্রতি বর্গমিটারে ৫৬ মেট্রিক টন হয়, তাহলে জ্যাক প্রয়োজন হবে প্রতি বর্গমিটারে ৩টি। আর এভাবে বাড়ির ফাউন্ডেশনে জ্যাক বসাতে হবে। এর চেয়ে কম জ্যাক বসালে ফাউন্ডেশন ক্র্যাক করার আশঙ্কা থাকবে, যা একটি বাড়ির সার্বিক অবস্থার জন্য হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর থাকবে জ্যাকের স্পেসিং। একটা বাড়ির ওজন যদি কম হয়, তাহলে জ্যাকের স্পেসিং হবে বেশি। আবার বাড়ির তলার সংখ্যা ও লোড যদি বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই কম কম দূরত্বে জ্যাক বসাতে হবে।

বাড়ির ঝুলন্ত সব স্ট্রাকচার ভেঙে ফেলা জরুরি। যেমন, কিচেন ¯ø্যাব বা বাথরুমের বেসিন ¯ø্যাব। এগুলো না ভাঙলে বাড়ি লিফট করার সময় এগুলো ভেঙে পড়ে বিপদ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাড়ির যেসব অংশে বড় স্প্যানের মাঝে গ্যাপ, যেমন বারান্দা বা বড় জানালা আছে, সেগুলো ইট দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে যেন সবখানে সমান লোড বজায় থাকে। অনেক সময় বাড়ির ঝুলবারান্দাগুলো হাউস লিফট করার সময় ভেঙে যায়। এ জন্যই এই সতর্কতা। 

বাড়ির ক্যান্টিলিভার অংশগুলো অবশ্যই অতিরিক্ত সাপোর্ট দিয়ে এরপর সেখানে জ্যাক স্থাপন করতে হবে। নইলে সেগুলো ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এসব ক্ষেত্রে সাপোর্ট না দিলে ক্যান্টিলিভার ভেঙে প্রাণহানির আশঙ্কাও বেড়ে যায়। বাড়ির যেসব অংশে কোনো ইটের দেয়াল নেই বা যেখানে শুধুই কাচ দেওয়া থাকে, সেখানে অবশ্যই এমএসের আই বিম বসিয়ে অতিরিক্ত সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে হয়। শুধু তা-ই নয়, যেখানে পয়েন্ট লোড পড়ে, সেখানে লোড ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবস্থা করতে হয়।

জ্যাক বসানোর আগে খনন করে বাড়ির স্ট্রাকচার পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়, যেখানে স্ট্রাকচারের নিচে আরেকটা শক্ত কংক্রিট স্ট্রাকচার বসাতে হয়, যার ওপর জ্যাকগুলো বসবে। এই কংক্রিট স্ট্রাকচার বানানো শুরু করতে হয় বাড়ির বাইরের অংশ থেকে। পুরো বাইরের অংশটা জ্যাক বসিয়ে এরপর ভেতরের অংশের জ্যাক বসানোর কাজ শুরু করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাড়ির লোড ক্যালকুলেশন ঠিক না থাকলে সমূহ বিপদ ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়, যা খুব সাবধানের সঙ্গে করতে হয়। 

জ্যাক যেখানে বসানো হচ্ছে, সেই কংক্রিটের বেইজ যেন খুব শক্ত হয়, বা নির্দিষ্ট শক্তির হয়, সেদিকে খুব ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হয়। জ্যাক কোনোভাবেই নিচের দিকে দেবে গেলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে ওয়াটার লেভেল মিলিয়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। জ্যাক যখন টার্ন করা হবে, তখন প্রতিটি জ্যাক একই সমানে ওপরের দিকে তুলতে হবে। জ্যাকের প্লেসমেন্ট ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কংক্রিট বেইজ, এরপর জ্যাক বসিয়ে এর ওপর রাখতে হবে একটি কাঠের টুকরো, যার ওপর থাকবে লোহার বার, যেগুলো লোড নিয়ে সেই লোড জ্যাকের ওপর ডিস্ট্রিবিউট করবে। লোহার বারগুলোর মাপ হবে সর্বনি¤œ ৩ ইঞ্চি বাই ৩ ইঞ্চি এমএস বক্স পাইপ, যেগুলোর ভেতর কংক্রিট দিয়ে ভর্তি করে এগুলোর শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এই স্টিল গার্ডার যার সঙ্গে বাড়ির গ্রেইড বিম থাকবে, এর ওপর দিতে হবে আরেকটি কাঠের লম্বা টুকরো, যেটা বাড়ির লোড সমান ডিস্ট্রিবিউট করতে সহায়তা করবে। 

প্রথমেই খননকাজ শুরু করতে হবে। খনন করতে করতে যখন বেইজে গিয়ে পৌঁছাবে, তখন কলামগুলো কাটার কাজ শুরু করতে হবে। কলামের সঙ্গে বেইজের কানেকশন বন্ধ করে দিয়ে সেখানে হাইড্রোলিক জ্যাক বসাতে হবে এবং কাজ শুরু করতে হবে। প্রথমে বাড়ির পেরিফেরির সব কলামে জ্যাক বসাতে হবে। এরপর ভেতরের দেয়ালগুলোতে জ্যাক বসানোর কাজ করতে হবে। এ জন্য বেইজমেন্ট অথবা গ্রাউন্ড ফ্লোরের কিছু অংশ ভেঙে সেখান থেকে কাজ করতে হবে।

বাড়ির লিফটিংয়ের কাজ একটি নির্দিষ্ট অংশ পর্যন্ত হয়ে গেলে সেখানে নতুন ফাউন্ডেশন বানাতে হবে, যার ওপর বাড়ির ওজন থাকবে। অথবা নতুন তলা সংযুক্ত করতে হলে অন্তত ১০ ফুট পর্যন্ত লিফট করে সেখানে নতুন ফ্লোর স্পেস বানাতে হবে। প্রথমে নতুন ছাদ বানাতে হবে। এরপর বানাতে হবে নতুন গ্রাউন্ডফ্লোরের তলা এবং এরপর বানাতে হবে ইন্টারনাল দেয়ালগুলো।

যদি কোনো বাড়ি স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই প্রসেস একটু জটিল। কিন্তু অসম্ভব নয়। বাড়ি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে জ্যাকের প্লেসমেন্ট চেঞ্জ করার মাধ্যমে পুরো বাড়িটাকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব।

হাউস লিফটিং শেষ হলে প্রথমেই এর জ্যাকগুলো সরিয়ে নিয়ে পুরোনো বেইজের সঙ্গে নতুন কলামগুলো জুড়ে দেওয়ার কাজ শুরু করতে হয়। এরপর কলামগুলো জুড়ে গেলে নতুন দেয়ালগুলো বেইজ পর্যন্ত নামিয়ে এনে নতুন ফ্লোর তৈরির কাজ শুরু করতে হয়। এর মধ্যে বাড়িতে পানি-গ্যাস-ইলেক্ট্রিক ও অন্যান্য কানেকশন দেওয়া শুরু করতে হয়। বাড়ির ক্যান্টিলিভার অংশ থেকে খুলে ফেলতে হয় সব সাপোর্ট। এভাবে সব কিছু আগের মতো হয়ে যাওয়ার পর রং করা বা টাইলস লাগানোর মতো কাজগুলো করতে হয়। যাঁরা বাড়িকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তর করেন, তাঁদের বাড়ির নতুন স্থানে আগে থেকে বেইজ তৈরি করে সেখানে বাড়িকে স্থানান্তর করতে হয়। এ জন্য প্রসেস একই। শুধু ইউটিলিটিগুলো নতুন করে নতুন স্থানে দেওয়া সংযুক্ত করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে টয়লেটের পজিশন সরাতে হয়। দিক পাল্টে গেলে টয়লেটের কমোড ও অন্যান্য ফিচার সরাতে হয়। সে ক্ষেত্রে ইউটিলিটি লাইন সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এতে বাড়ির আর্কিটেকচারাল ডিজাইন চেঞ্জ হয়ে যায়। এটুকু মেনে নিতেই হয়। নতুন করে আবারও ডিজাইন করতে হয়। পুরো হাউস লিফটিংয়ের প্রসেসটা করতে ২০ দিন থেকে দুই মাস পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে বাড়ি স্থানান্তর করতে ৬ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে দূরত্বের ওপর নির্ভর করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাউস লিফটিং

আমাদের দেশে হাউস লিফটিং একেবারেই আনকোরা নতুন কোনো ব্যপার হলেও বিদেশে এটা হরহামেশা ঘটে যাওয়া ঘটনা। আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট এই সময়টাতে এসে ভয়াবহ বন্যা হানা দিচ্ছে। এ জন্য ক্যালিফোর্নিয়া বা অন্য অঞ্চলের লোকজন তাঁদের মেয়রের কাছ থেকে ১০০ বছরের ফ্লাড প্ল্যান সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। এতে যদি এলাকায় উন্নয়নের কোনো প্ল্যানিং না থাকে, তাহলে নিজেরাই নিজেদের বাড়ি লিফট করে উঁচু করে নিচ্ছেন। এই প্রক্রিয়াটি এখন বিভিন্ন অঞ্চলে গেলেই দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের মতো আমেরিকার অধিবাসীরা নিজেদের বাড়ি ইট-সিমেন্ট দিয়ে বানায় না। ওদের আবহাওয়ায় কাঠের তৈরি বাড়ি অনেক বেশি আরামদায়ক হয়। বছরের বিরাট একটা সময় ওখানে সূর্য দেখাই যায় না কুয়াশা আর বরফের জন্য। তাই সেখানে হাউস লিফটিং হরহামেশাই দেখতে পাওয়া একটা ঘটনা।

আমেরিকায় দেখা যায়, সেখানে হাইট রেস্ট্রিকশন বা এলাকায় ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য অনেক স্টেটে দোতলার বেশি বাড়ি উঁচু করা হয় না। এ জন্য বেইজমেন্টে বেশ কিছুটা ব্যবহারযোগ্য জায়গা রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু অনেকেরই সেই জায়গায় উচ্চতা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে সময়ের প্রয়োজনে। আর তখনই সেখানে হাউস লিফট করে নেওয়া হয়। আরেকটা ব্যাপার দেখা যায় সেখানে, সেটা হলো হাউস রিলোকেশন। অনেক ঐতিহাসিক বাড়ি সেখানে হরহামেশাই রিলোকেশন করা হয়। সরকারি কোনো প্রজেক্ট হোক বা এলাকায় উন্নয়নের জন্য হোক- সবাই সম্মতিক্রমে কোনো একটা ঐতিহাসিক ভবন বা অফিস এভাবে চাকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় নতুন স্থানে। যেহেতু ইট-সিমেন্টের ব্যবহার কম হয়, তাই এগুলো রিলোকেশনও হয় বেশ সহজে। তবে আমেরিকায় হাউস লিফটিংয়ের জন্য মেয়রের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সেখানে কতটুকু বাড়ানো হবে, কীভাবে বাড়ানো হবে, কে বাড়াবেÑএসব চেক করে নেওয়া হয়। যেসব কোম্পানি এই কাজগুলো করে, তাদের ডিটেইল স্পেসিফিকেশন দিতে বলা হয়। তাদের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মেয়রের পক্ষ থেকে ইঞ্জিনিয়াররা চেক করে দেখেন যে এই কাজ করা সম্ভব হবে কি না। এ ক্ষেত্রে সয়েল টেস্ট রিপোর্ট- স্ট্রাকচারাল রিপোর্টসহ আনুষঙ্গিক নানা ডকুমেন্ট জমা দিতে হয় নগর ভবনে। এরপর সেখান থেকে হাউস লিফটিংয়ের অনুমোদন হয়। আমেরিকা ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও চালু আছে এই সার্ভিস। এমন কি আমাদের পাশ^বর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনেক আগে থেকেই চলমান রয়েছে হাউস লিফটিং সার্ভিস। 

হাউস লিফটিংয়ের খরচ

হাউস লিফট করতে খরচ খুব একটা কম না হলেও পুরো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করার তুলনায় বেশ কম। বাড়ির লিফটিংয়ে প্রতি ফুট লিফট করতে ৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। হাউস লিফটিং কোম্পানি বাংলাদেশে তেমন দেখা না গেলেও ভারতের হরিয়ানাসহ নানা রাজ্যে এদের বেশ কিছু কোম্পানি দেখতে পাওয়া যায়, যারা পুরো ভারত এবং ভারতের বাইরে সার্ভিস দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভারতে প্রতি ফুট লিফট করতে প্রতি বর্গফুটে ২৫০-৩০০ টাকা খরচ হয় দোতলা বাড়ির ক্ষেত্রে। বাড়ির উচ্চতা ও তলা বাড়লে এই রেট বাড়তে থাকে। পুরো এক তলা লিফট করলে নতুন ফ্লোর বানানোর খরচ এর সঙ্গে যোগ হয়। একটা দোতলা বাড়ি ভেঙে আবার ও নতুন বাড়ি বানাতে যেখানে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, –সেখানে হাউস লিফট করালে এই খরচ থেকে প্রায় ৩০% কমেই কাজ শেষ করা যায়। অন্যদিকে পুরোনো সেই বাড়িটি অক্ষত থাকে। ফলে বাড়ির স্বকীয়তা বজায় থাকে। তবে হাউস লিফট মানেই বাড়ির নিচতলার একেবারে ধ্বংস করে ফেলা। এটা না ভেঙে তো হাউস লিফট করাই যায় না। তাই বলা যায়, নিচতলায় নতুন করে রড ফেলে ঢালাই করতে হয়। এরপর আবার ও টাইলস ইনস্টলেশন অথবা নিট সিমেন্ট ফিনিস করার খরচ যোগ হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় এর মজুরি। সব মিলে যা খরচ হয় তা অবশ্যই নতুন বাড়ি বানানোর খরচের চেয়ে বহুগুণ কম। 

সব শেষে বলা যায়, এই বর্তমান বাংলাদেশে হাউস লিফটিং একটি নতুন বিষয় হলেও নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় আজাদ প্রোডাক্টসের বিল্ডিং প্রথম হাউস লিফটিং করে ওপরের দিকে তোলা হয় এর ফাউন্ডেশন ঠিক করার জন্য। এরপর যদিও এ রকম সার্ভিসের বাংলাদেশে কোনো খবর পাওয়া যায় না। তবে অতি শিগগিরই যে হারে বন্যা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে চলেছে এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনসাধারণ নতুন বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে অনাগ্রহী হচ্ছে তাতে এরকম হাউস লিফটিংয়ের খবর আমরা হরহামেশাই শুনতে পাব, এটা তো বাজি ধরে বলাই যায়। 

ধৎপযরঃবপঃ.ৎধলরন@মসধরষ.পড়স

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৩ তম সংখ্যা, মে ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top