কয়েক দিন আগের কথা। একটা বাড়ির ইন্টেরিয়রের কাজে ক্লায়েন্টের সঙ্গে হাতিরপুল টাইলস মার্কেটে গিয়েছিলাম। মার্কেট দেখে বেশ ভালো লাগল। অনেক উন্নত হয়েছে টাইলসের মার্কেট। আগেকার দিনের সেই একঘেয়ে টাইলস বাজারে নেই। বর্ণিল সব টাইলস। কোনোটা পলিশড, কোনোটা মিরর পলিশড, কোনোটা আবার সিরামিক। প্রতিটি দোকানের সেলসম্যান নিজেদের টাইলস সেরা বলছেন। এটাই সাধারণত হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিদেশি টাইলসের দোকানদারেরা দেশি টাইলস ব্যবসায়ীদের একহাত নিচ্ছেন। দেশি টাইলস ব্যবসায়ীরা আবার আরেক কাঠি সরেস। নিজেদের টাইলস কেন ভালো, সে বিষয়ে জ্ঞান দিতে দিতে পরিস্থিতি ঘোলা করে ফেলছেন। অনেক বছর ধরে টাইলস কিনছি। বাড়ির ক্লায়েন্ট বোঝেন না বলে আমাকে নিয়ে যান আর্কিটেক্ট ও কনসালট্যান্ট হিসেবে। কিন্তু এই ক্লায়েন্ট একটু ভিন্ন। তিনি সঙ্গে করে আরও কিছু আত্মীয় নিয়ে এসেছেন, যাঁরা আমার চেয়েও বড় বিশেষজ্ঞ। অথচ কারও নিজের বাড়িতে টাইলস লাগানোর অভিজ্ঞতা নেই। ওনারা এসে ওনাদের পরিচিত দোকানগুলোতে নিয়ে টাইলস গছায়ে দিতে চাচ্ছেন। শেষে আমি পালিয়ে বাঁচলাম। সেই অভিজ্ঞতা মনে হতেই ভাবলাম টাইলস সম্পর্কে সবার যদি ভালো ধারণা থাকে, তাহলে আমরা অনেক ধরনের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। আসুন তবে মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
টাইলসের প্রাথমিক তথ্য
ফিনিশ ম্যাটেরিয়াল হিসেবে বাড়ির ফ্লোরে বা দেয়ালে টাইলস ব্যবহার হয়। রান্নাঘর, টয়লেট, বেডরুম সবখানেই টাইলস লাগানো হয়। আগেকার দিনে যখন টাইলসের প্রচলন ছিল না তখন ঘরের ফ্লোরের নিচে এক ফুট বা তিন ফুট পর্যন্ত চকচকে এনামেল পেইন্ট করে দেওয়া হতো। যেন দেয়ালে পানির ছাপ বা অন্য কোনোভাবে দেয়াল নষ্ট না হয়। আর ফ্লোরে ব্যবহার করা হতো নিট সিমেন্ট ফিনিশ। কখনোসখনো শৌখিন লোকজন লাল রঙের সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন। এতে চকচকে লাল একটি প্রলেপ পড়ত ফ্লোরে। এর বেশি তেমন কোনো ব্যবহার ছিল না ফ্লোর ফিনিশ ম্যাটেরিয়ালের। কিন্তু এর একটি সমস্যা ছিল। কিছুদিন পরেই এতে ফাটল ধরত। একসময় এটা উঠেও যেত। এরপর আবারও ফ্লোর ফিনিশ করতে হতো। এভাবে যখন সবাই প্রায় অতিষ্ঠ, তখনই আমদানি হয় টাইলস। বিশ্বের অনেক দেশে টাইলস অনেক আগে থেকে ব্যবহার শুরু হলেও আমাদের দেশে টাইলস ব্যবহারের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। এই তো আশির দশক বা তার কিছু আগে টাইলসের প্রচলন শুরু হয়। এর আগে শুধু শৌখিন লোকজন টাইলস ব্যবহার করতেন।
টাইলস মূলত মাটির একটি শক্ত স্তর, যা আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হয়। প্রাচীনকালে এই টাইলস আবিষ্কার করে। ধরা হয় পটারি বা মাটির পাত্র তৈরি পৃথিবীর সর্বপ্রথম কলাবিদ্যা। আর এই মাটির পাত্র তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ টাইলস আবিষ্কার করেছে। দুটোর তৈরির মূল পদ্ধতি একই। হয়তো পাত্র বানাতে গিয়ে কোনোভাবে সোজা কোনো ¯øাব তৈরি করা হয়েছিল। সেটা পোড়ানোর পর এর উজ্জ্বলতা বা সৌন্দর্য দেখে শিল্পী প্রতিদিন একই জিনিস তৈরি করতে শুরু করে, যা টাইলসের আদিরূপ বলে পরিগণিত হয়। এই তো কয়েূক দিন আগে প্রাচীন রোমে ব্যবহৃত আড়াই হাজার বছর আগের টাইলস আবিষ্কার হয়েছে মাটির নিচে চাপা থাকা অবস্থায়। সে হিসেবে টাইলসের ব্যবহার অনেক প্রাচীন। বিশেষ করে বিশ্বের অন্যতম মহাকাব্য মহাভারতে ’ইন্দ্রপ্রস্থ’ তৈরির উল্লেখ পাওয়া যায়, যা পঞ্চ পাÐবের জন্য তৈরি করেছিলেন ময় নামের এক দানব। সেই ইন্দ্রপ্রস্থে ছিল বিশালাকার সব অট্টালিকা। আর সেই সব অট্টালিকায় ছিল স্ফটিকের মতো চকচকে মেঝে, একই রকম জলাশয়। এখানে জলাশয়কে মেঝে ভেবে আছাড় খেয়েছিলেন কৌরবপুত্র দুর্যোধন। এতে দ্রৌপদী হেসেছিলেন বলে তিনি রাগান্বিত হয়ে পাশা খেলার আয়োজন করেন, যাতে পাÐবেরা সবকিছু হারিয়ে বনবাসী হন। এই উপাখ্যান খেয়াল করলে দেখা যায়, স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল মেঝে কেবল টাইলস বসালেই হতে পারে। আর পানি ও টাইলসের তফাত করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায় যখন খুব উন্নত মানের টাইলস বসানো হয়। এ থেকে জানতে পারি এই ভারতবর্ষের অনার্য জাতিদের (দ্রাবিঢ়, অস্ট্রিক) মধ্যে টাইলস বানানোর মতো কারিগর ছিলেন। যাদের মাধ্যমে টাইলস তৈরি হয়েছিল এবং ব্যবহারও হয়েছিল। বাড়ি ও টাইলস নির্মাণের দক্ষতা না থাকলে নিশ্চয়ই নির্মাণ করার মতো ক্ষমতা কারও থাকে না। এ থেকে বোঝা যায় অনেক প্রাচীনকাল থেকে এই উপমহাদেশে টাইলসের ব্যবহার ছিল।
টাইলসের প্রকারভেদ
টাইলস আছে নানা প্রকারের। তবে মোটাদাগে যদি প্রকারভেদ করতে হয়, তাহলে বলা চলে টাইলস সর্বমোট ১৫ রকমের। অবাক হবেন না, আসুন তবে দেখে নেওয়া যাক-
সিরামিক টাইলস
পোর্সেলিন টাইলস
গøাস টাইলস
মার্বেল টাইলস
গ্রানাইট
¯েøট
লাইমস্টোন
ট্র্যাভারটাইন
টেরাকোটা
সিমেন্ট টাইলস
মোজাইক
ভিনাইল কম্পোজিট টাইলস
এনকস্টিক টাইলস
ন্যাচারাল স্টোন টাইলস
মেটাল টাইলস
সিরামিক টাইলস
সিরামিক টাইলস হলো সিরামিকে তৈরি টাইলস। যে টাইলস তৈরিতে সিরামিক মিশ্রিত কাদামাটি ব্যবহার করা হয়, সেটাই হলো সিরামিক টাইলস। সিরামিক টাইলস মূলত বেশ কিছু উপাদানের সমষ্টি। এর মধ্যে আছে কাদামাটি, সাদা কাদামাটি, ট্যাল্ক, ফেল্ডপার, ইলিটিক কাদামাটি, ক্যাওলিনিটিক কাদামাটি, ক্যালকাইট ও ডলোমাইট। এই উপাদানগুলো মিশ্রিত করা হয় এবং এর ভেতর থেকে সব রকমের বড় পাথর বা অন্য ময়লা অপসারণ করা হয়। এরপর এতে পানি মিশিয়ে পাতলা একটা দ্রবণ তৈরি করা হয়। এরপর সেটি এটোমাইজার নামের একটা মেশিনে ড্রাই করা হয়। এটি শুকিয়ে কাদামাটি বা টাইলস তৈরির মূল উপাদান বানানো হয়। এটা ছাঁচে ফেলে এরপর সেটা থেকে টাইলস বের করা হয়। তারপর সেটা শুকিয়ে চুল্লিতে উচ্চ তাপে পোড়ানো হয়। এরপর চকচকে আস্তরণ স্প্রে করে তৈরি করা হয় সিরামিক টাইলস।
পোর্সেলিন টাইলস
সিরামিক ও পোর্সেলিন টাইলসের তৈরির প্রক্রিয়া একই। তবে দুটো টাইলস পরিবর্তন হয়ে যায় প্রয়োগকৃত তাপের তারতম্যের ফলে। দেখা যায় পোর্সেলিন টাইলস অনেক বেশি পোড়ানো হয় এবং এর বানানোর প্রসেস এত ভালো যে এটি ঘরের বাইরে ও ভেতরে সমানভাবে ব্যবহার করা যায়।
সিরামিক ও পোর্সেলিন টাইলসের পার্থক্য
সব সিরামিক টাইলস পোর্সেলিন টাইলস নয়। সব পোর্সেলিন টাইলসই সিরামিক টাইলস
সিরামিক টাইলস বানানোর ক্ষেত্রে মাটিকে চাপ দিয়ে এর থেকে পানি বের করা হয়। এরপর সেটাকে হালকা তাপে উত্তপ্ত করা হয়। পোর্সেলিন টাইলসকে প্রথমেই উচ্চ তাপমাত্রায় পোড়ানো হয় বিধায় এর ভেতর থেকে সব পানি বাষ্পীভূত হয়।
সিরামিক টাইলস শুধু মাটি ও পানির মিশ্রণ থেকে তৈরি হয়। পোর্সেলিন টাইলস তৈরিতে রিফাইন্ড কাদামাটি, ফেল্ডস্পার, সিলিকা ও পানি থেকে তৈরি হয়।
সিরামিক টাইলস ভঙ্গুর। পোর্সেলিন টাইলসও ভঙ্গুর তবে সিরামিক টাইলসের চেয়ে শক্ত।
সিরামিক টাইলস দ্রæত পানি শোষণ করে পেছনের অংশ দিয়ে। পানি শোষণক্ষমতা ৩% বা এর বেশি হয়। পোর্সেলিন টাইলস খুব পানি শোষণ করে, যা ০.৫%-এরও কম।
০.৫%-এর বেশি কোনো টাইলস পানি শোষণ করলে সেটি কোনোভাবেই সিরামিক টাইলস নয়। বেশি পানি শোষণ করার ফলে পানিতে ভেজালে এটির ওজন খুবই কম পরিবর্তিত হয়।
সিরামিক টাইলসের ভেতরের অংশটির রং ভিন্ন থাকে। মাটির রঙের ওপর ভিত্তি করে কখনো লাল বা সাদা হয়। পোর্সেলিন টাইলসের ভেতরের অংশটি ওপরের গøসি অংশ থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
সিরামিক টাইলসের স্থায়িত্ব কম। পোর্সেলিন টাইলস দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একই রকম থাকে।
সিরামিক টাইলসের মধ্য দিয়ে কখনোই আলো প্রবেশ করতে পারে না। এটি অস্বচ্ছ ও বেশ ঘন হয়। পোর্সেলিন টাইলসের মধ্য দিয়ে আলো কিছুটা প্রবেশ করতে পারে।
সিরামিক টাইলসে আঘাত করলে ধাতব শব্দ হয় না। পোর্সেলিন টাইলসে আঘাত করলে পরিষ্কার মেটালিক শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।
সিরামিক টাইলসের ডেনসিটি বেশ কম। পোর্সেলিন টাইলস অনেক বেশি ডেনসিটির ও এটি বেশ ভারী।
সিরামিক টাইলসে সহজেই দাগ পড়ে। ওপরের চকচকে আস্তরণ দাগ থেকে রক্ষা করতে পারে না। বিশেষ করে তেলের পোড়া দাগ থেকে এর কোনো রেহাই নেই। পোর্সেলিন টাইলসের ওপরের লেয়ার অনেক শক্ত এবং এটি স্ক্র্যাচপ্রæফ।
সিরামিক টাইলসে প্রান্তগুলো হালকা গোলাকার থাকে এবং এটি চার প্রান্তে সমান থাকলেও মাঝখানের অংশটি বেশি মোটা বা চিকন হয়ে থাকে। পোর্সেলিন টাইলস মিরর পলিশ হয়ে থাকলে এদের প্রান্তগুলো সমানভাবে কাটা থাকে। এগুলোর পুরো শরীর সমানভাবে থাকে ফলে টাইলসের কাজ সুন্দর দেখায়।
সিরামিক টাইলস পোর্সেলিনের চেয়ে অনেক নরম। পোর্সেলিন টাইলস বেশ শক্ত। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো মেশিনে কাটতে বেশ কষ্ট হয়।
সিরামিক টাইলস ফায়ার রেসিস্ট্যান্ট নয়। অনেক সময় পোড়া দাগ পড়ে। বেশি পুড়লে নষ্টও হয়ে যায়। এটা সহজে পোড়ে না। এমনকি এটা আগুনও নেভাতে পারে।
সিরামিক টাইলস দেয়াল বা ফ্লোরে লাগানো সহজ। পোর্সেলিন টাইলস কাটতে কঠিন বলে এর স্থাপন প্রক্রিয়া কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ।
ভেঙে গেলে সিরামিক টাইলস ঠিক করা বেশ কষ্টকর। এটি তুলে ফেলাও বেশ কষ্টসাধ্য। অনেক ক্ষেত্রে এটি কাচের মতো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। পোর্সেলিন টাইলস বেশ শক্ত বিধায় অনেক চাপ ও তাপ সহ্য করতে পারে। সহজে ভাঙে না। ভেঙে গেলে মেরামত করাও সহজ। একই রকম টাইলস যদি স্টকে থাকে এবং সেটি দিয়ে রিপ্লেস করতে পারলে এটি বেশ সুন্দরভাবে আগের মতো হয়ে যায়।
সিরামিক টাইলসের স্থায়িত্ব বেশ কম। দেখা যায় লাগানোর পরেই এটি ধীরে ধীরে নিজের ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে এবং একসময় এটি আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। পোর্সেলিন টাইলস বছরের পর বছর একই রকম থেকে যায়। দামে একটু বেশি হলেও এটি ১৫ বা ২০ বছর পরেও একই রকম দেখায়। ধুলো-ময়লা থেকে এটাকে রক্ষা করতে পারলে দশকের পর দশক ধরে এটি নিজের মান বজায় রাখে।
সিরামিক টাইলস শুধু ইন্টেরিয়র স্পেসে ব্যবহারের জন্য। এটি বাইরের দেয়াল বা ফ্লোরে ব্যবহারের উপযোগী নয়। দ্রæত নষ্ট হয়ে যায় বলে এটি সব সময় মেইনটেন্যান্স করে রাখতে হয়। পোর্সেলিন টাইলস ঘরে-বাইরে, রোদে-বৃষ্টিতে ব্যবহার করা যায়। রোদে রং হারায় না। অনেক চাপ ও তাপ নিতে পারে বলে এটি পার্কিং এরিয়ায়ও ব্যবহার করা সম্ভব (থিকনেস প্রযোজ্য)।
সিরামিক টাইলস বেশ সস্তা। পোর্সেলিন টাইলস পোড়ানোর সময় বিবেচনায় সিরামিক টাইলসের চেয়ে দামি এবং অনেক ক্ষেত্রে একই রকম দেখতে টাইলসের পোড়ানোর সময়কালের ওপর ভিত্তি করে কমবেশি হতে পারে।
গøাস টাইলস
যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও ২৫০০ বছর আগে থেকে গøাস টাইলসের ব্যবহার দেখা যায়। প্রাচীন রোম ও গ্রিসের নানা শহরে ও অঞ্চলে গøাস টাইলস ব্যবহার হতো। তবে ভারতবর্ষে ৩য় খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রথম গøাস টাইলস উৎপাদন করা হয়। এর পর থেকে নানা স্থানে এই গøাস টাইলস ব্যবহার হয়েছে; এখনো হচ্ছে। এই টাইলস একটি আকর্ষণীয় এবং আধুনিকভাবে উদ্ভাবিত টাইলসের প্রকার, যা সাধারণত সাধারণ টাইলসের চেয়ে বেশ ভিন্ন। এটি কাঠামোগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং সুন্দর লুক দিতে পারে। এই টাইলস ব্যবহারের মাধ্যমে যেকোনো স্পেস অনেক সুন্দরভাবে ইন্টেলেকচুয়ালি ফুটিয়ে তোলা যায়।
গøাস টাইলস তৈরি করার জন্য মূলত কাচ ব্যবহার করা হয়, যা উচ্চ তাপমাত্রায় গলিয়ে এরপর নানা ছাঁচে ফেলে ও রং মিশিয়ে তৈরি করা হয়। গøাস টাইলসসের কাঠামোগুলো সাধারণভাবে সিন্থেটিক ম্যাটেরিয়াল দিয়ে বানানো হয়। কাচ এবং রঙের পিগমেন্টগুলো সেই ছাঁচ কাঠামোর জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত হয়। এই টাইলসের নানা রকমের থিকনেস থাকে এবং এতে নানা রকম আলো পড়ার ফলে স্পেসে যোগ হয় ভিন্নতর মাত্রা। এই টাইলস বিভিন্ন রং, আকার, আকৃতি এবং আকর্ষণীয় প্যাটার্নে পাওয়া যায়। ঘরের ইন্টেরিয়রে, বাথরুমে, রাস্তা প্রকল্পে, রেস্তোরাঁ এবং কমার্শিয়াল অ্যাপ্লিকেশনের জন্য বৃদ্ধি পেয়েছে এর ব্যবহার। গøাস টাইলসসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর ভার্সাটাইলিটি ও স্থিতিশীলতা। এটি যেকোনো স্পেসে ভিন্ন মাত্রা এনে দিতে পারে। এর নানা রকম ব্যবহার আছে। বাজারে অনেক ধরনের, অনেক প্রকারের গøাস টাইলস পাওয়া যায়। যদিও একটু দামি, তবুও এই টাইলসের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছেই।
মার্বেল টাইলস
বাসাবাড়িতে ফ্লোরে বা দেয়ালে ফ্লোর ফিনিশ হিসেবে এখন অনেক স্থানেই মার্বেলের ব্যবহার হচ্ছে। মার্বেল মূলত কঠিন শিলা, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশালাকার সব পাহাড় থেকে ¯øাব আকারে কেটে আনা হয়। সেগুলো ফ্লোরে বা দেয়ালে বসানো হয়। কাটিং ও ফিনিশিং করার পর এটি এলিগ্যান্ট লুক প্রদান করে, যা অন্য কোনো টাইলসে মিলে না। মার্বেল মূলত পাহাড়ের গঠনে থাকা পাথর, যা বড় বোল্ডার আকারে কেটে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেটি থেকে বিভিন্ন থিকনেসের টাইলস বের করা হয় কাটিংয়ের মাধ্যমে। সাধারণত ফ্লোরে ১৮ থেকে ২৫ মিলিমিটারের মার্বেল বসানো হয়। মার্বেল বসানোর এই পদ্ধতি সাধারণত দুই রকম হয়। সিমেন্ট ও বালুর মিশ্রণ ফ্লোরে ঢেলে সমান করে বসানো হয় ফ্লোরে। এরপর মার্বেলের টুকরো সেই স্থানে বসিয়ে ফ্লোর লেভেল করা হয়। এরপর হোয়াইট সিমেন্ট মেশানো পানি ঢেলে দিয়ে সেই টাইলস বসিয়ে দেওয়া হয়। দুই রকমের সিমেন্টের মিশ্রণে শক্ত ও টেকসই আস্তরণ টাইলসকে ধরে রাখে মাটি বা দেয়ালের সঙ্গে।
মার্বেল বেশ ভারী বিধায় দেয়ালে ব্যবহারের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। মার্বেলের বিভিন্ন টুকরো আস্ত টালির পেছনে বসানো হয়। এই বসানোর কাজে এরোলাইট নামে আঠা ব্যবহার করা হয়। এটি এমন এক এডহেসিভ, যা দিয়ে পাথর জোড়া লাগানো হয়। আসলে পাথরের ছোট ছোট টুকরো এনকরিংয়ের কাজে লাগানোর জন্য মার্বেলের পেছনে বসানো হয়। এই বসানোর প্রক্রিয়া তিন বা চার দিন ধরে চলে। সেই এনকরিং পাথরগুলো পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রে এমনিতেই দেয়ালে সনাতন পদ্ধতিতে মার্বেল বসিয়ে দেওয়া হয়। অনেক স্থানে উঁচু লেভেলে মার্বেল বসাতে হলে লোহার তৈরি ক্লাম্প ব্যবহার করে সেই মার্বেলের ভারী টুকরোকে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো হয়।
মার্বেলের বেশ কিছু সমস্যাও আছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে মার্বেলের দাগের সমস্যা। এতে যেকোনো বস্তুর তৈরি দাগ বসে যায়। বেশ নরম পাথর বলে এটি রং শোষণ করে। এই শোষণের প্রক্রিয়া এত দ্রæত ঘটে যে যেকোনো রং মার্বেলের সারফেসের পাঁচ মিলিমিটার ভেতরে প্রবেশ করতে মাত্র পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। কিন্তু এই দাগ কোনোভাবেই আর তোলা যায় না। অনেকেই সেই দাগের ওপর আবারও সাদা চুন বা কেমিক্যাল প্রয়োগ করেন। কিন্তু দাগ পুরোপুরি মোছা যায় না। বারবার মার্বেল ঘষে কাটিং করলেও এটিতে দাগ থেকে যায়।
মার্বেলের আরেকটি সমস্যা হলো এর ভঙ্গুরতা। দ্রæত ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা মার্বেলকে স্যাক্রেড ম্যাটেরিয়াল হিসেবে বাজারে পরিচিত করেছে। অনেকেই মার্বেল ব্যবহার করতে চান। কিন্তু এটি ভেঙে গেলে মেনে নিতে চান না। কিন্তু মার্বেল একটি প্রাকৃতিক পাথর। এটির ভেতর ফাটল থাকতেই পারে। বোল্ডার কাটার সময় এটি সজোরে মাটিতে ফেলা হয়। ক্রেন দিয়ে তুলে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আনা হয়। সজোরে আছড়ে ফেলা হয়। আর এসব কারণে ক্রাক আসতে পারে। যেটা মার্বেল কেনার সময়ও বোঝা যায় না। ইনস্টল করার সময়ও বোঝা যায় না। আবার কাটিং ও ফিনিশ করার আগ পর্যন্ত চোখে ধরা পড়ে না। কিস্তু একদম শেষ পর্যায়ে এসে চোখে পড়ে, যা সত্যিই হতাশার। বাজারের সবচেয়ে দামি টাইলস এই মার্বেল। এ জন্য অনেকেই বর্জন করেন বটে। কিস্তু মার্বেল ফ্লোরে হাঁটার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অনেকেই নানা ঝুঁকি সত্তে¡ও মার্বেল ব্যবহার করতে পিছপা হন না।
গ্রানাইট
মার্বেল ও গ্রানাইট একই সারির পদার্থ। তবে গ্রানাইট মার্বেলের চেয়ে বেশ শক্ত টাইলস। অনেকে ফ্লোরে দাগের ভয়ে মার্বেল না বসিয়ে গ্রানাইট বসান। আর দাগ না পড়ার জন্য গ্রানাইট বিখ্যাত। মার্বেল ও গ্রানাইট মূলত একই সারির বস্তু হলেও গ্রানাইট পাওয়া যায় মাটির ভেতরের স্তরে। যেখানে মার্বেল পাহাড়ের আস্তরণে পাওয়া যায়। গ্রানাইট টাইলস হিসেবে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত স্থান হলো রান্নাঘর, বাথরুম ও অন্যান্য স্যাঁতসেঁতে স্থান। যেখানে পানির দাগ ও অন্যান্য বস্তুর দাগ পড়ার আশঙ্কা আছে, সেখানে গ্রানাইট বেশি ব্যবহার করা যায়। মার্বেলের মতো একইভাবে গ্রানাইট ও ইনস্টল করা হয়। তবে গ্রানাইট মূলত গাঢ় ও কালো হয় বলে এতে হোয়াইট সিমেন্টের ব্যবহার তেমন হয় না।
¯েøট
¯েøট টাইলস হলো একটি প্রাকৃতিক স্টোন টাইলস, যা প্রাকৃতিক ¯েøট পাথর থেকে কেটে বের করা হয়। ¯েøট পাথর একটি স্থায়ী, ঘন এবং শক্ত প্রাকৃতিক পাথর, যা প্রকৃতি থেকে মার্বেল বা গ্রানাইটের মতোই সংগ্রহ করা হয়। ¯েøট টাইলসের রং, স্থায়িত্ব ও ব্যবহারে সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। ¯েøট নানা রঙের নানা আকৃতিতে প্রকৃতি থেকে আহরিত হয়। মার্বেল ও গ্রানাইটের মতোই এর ভ্যারিয়েশন হলেও এটি বেশ ভিন্ন একটি ম্যাটেরিয়াল। ¯েøট টাইলসের গঠন ও ভ্যারিয়েশন মডার্ন ইন্টেরিয়র ডিজাইনের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থপতি ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা ব্যবহার করে থাকেন। ¯েøট টাইলস বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রকল্পে বা কমার্শিয়াল ইন্টেরিয়র প্রকল্পে ব্যবহার করা যায়। এগুলো অবাসন, বার, রেস্টুরেন্ট, সুইট বাথরুম, অফিস ইন্টেরিয়র, রাস্তা প্রকল্প ইত্যাদির জন্য উপযুক্ত হতে পারে।
লাইমস্টোন
মানুষের তৈরি টাইলসগুলোর মধ্যে লাইমস্টোন টাইলস হলো এমন এক প্রকার, যা প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট ডিজাইনের এক অপূর্ব সমন্বয়। লাইমস্টোন টাইলস এক প্রকারের কম্পোজিট টাইলস, যা সিমেন্ট, লাইম পাউডার, পার্টিকেল বোর্ড এবং ন্যাচারাল মিনারাল ফাইবার ইত্যাদি উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হয়। লাইমস্টোন টাইলসের প্রধান উপাদান হলো সিমেন্ট এবং লাইম, যা এই টাইলসসের স্থায়িত্ব প্রদান করে। লাইমস্টোন টাইলস ভার্সেটাইলিটি প্রদানের জন্য বিশ্বনন্দিত। লাইমস্টোন টাইলস বিভিন্ন রঙের এবং আকৃতিতে পাওয়া যায়, ডিজাইনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে এই টাইলসের জুড়ি নেই। বিভিন্ন ইন্টেরিয়র ডিজাইনে বাথরুম, কিচেন, ফ্লোর, ওয়াল, ব্যাকস্প্ল্যাশ, প্রাইভেট স্পেস, কমার্শিয়াল ইন্টেরিয়র, রাস্তা প্রকল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে লাইমস্টোন টাইলস ব্যবহার হয়। এর ইনস্টলেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্যান্য টাইলস প্রক্রিয়ার তেমন কোনো ভিন্নতা নেই।
ট্র্যাভারটাইন
আপনি যদি আগে ট্র্যাভারটাইন টাইলের কথা না শুনে থাকেন, তাহলে আপনি বাজারের সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে মার্জিত ইন্টেরিয়র ডিজাইনের অনুষঙ্গ মিস করছেন! এটি একধরনের প্রাকৃতিক পাথর, যেমন আপনার রান্নাঘরের গ্রানাইট বা আপনার বাথরুমের মার্বেল। ট্র্যাভারটাইন হলো একটি পাললিক পাথরের একধরনের চুনাপাথর, যা প্রাকৃতিক স্প্রিংস থেকে খনিজ দিয়ে তৈরি। এটি ট্র্যাভারটাইনকে একটি স্বতন্ত্র এবং আকর্ষণীয় চেহারা দেয়, যা সত্যি অনন্য।
ট্র্যাভারটাইনের প্রকারভেদ
ট্র্যাভারটাইন খুব টেকসই পাথর এবং এটি বহুমুখী, তাই এটি সাধারণত মেঝে এবং ব্যাকস্প্ল্যাশ উভয়ের জন্যই ব্যবহৃত হয়। সাধারণত চার প্রকারের ট্রাভারটাইনের কথা জানা যায়। সেগুলো হচ্ছে-
ব্রাশড ট্র্যাভারটাইন: ব্রাশড ট্র্যাভারটাইনের একটি অ্যান্টি শাইন, ম্যাট ফিনিশ ম্যাটেরিয়াল, যা দেখতে দারুণ। এই চেহারা দেওয়ার জন্য তারের তৈরি ব্রাশ ঘষার মাধ্যমে এর এই খসখসে আস্তরণ তৈরি করা হয়।
হন্ড ট্র্যাভারটাইন: হন্ড (ঐড়হবফ) ট্র্যাভারটাইন সেমিগøস টাইলস। এটি একটি সুষম, সূ²ভাবে পলিশ চেহারা তৈরি করে। স্পর্শ করলে চামড়ার মতো অনুভূতি দেয়। ট্র্যাভারটাইনের অসমাপ্ত পাশকে ওভারল্যাপ করে ইনস্টলেশনের মাধ্যমে সুন্দর লুক নিয়ে আসা হয়।
পলিশ ট্র্যাভারটাইন: পলিশ ট্র্যাভারটাইন একটি নজরকাড়া, পরিশীলিত ডিজাইনের টাইলস। এলিগ্যান্ট লুকের ইন্টেরিয়রে পলিশ ট্র্যাভেন্টাইনের জুড়ি নেই।
টাম্বলড ট্র্যাভারটাইন: টাম্বলড ট্র্যাভারটাইন টাইলস ডিজাইনে ভিনটেজ লুক দেয়। একটার ওপর আরেকটা সূ²¥ভাবে তুলে দিয়ে আলো-ছায়ার খেলা তৈরি করে ভিন্টেজ ইন্টেরিয়র লুক নিয়ে আসার জন্য টাম্বলড ট্যাভারটাইন সেরা।
ট্র্যাভারটাইনের সুবিধা
সৌন্দর্য: ট্র্যাভারটাইন ফ্লোরের জমকালো, শাস্ত্রীয় সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে। স্থাপত্যকলায় ক্ল্যাসিক ভাব নিয়ে আসতে ট্যাভারটাইনের জুড়ি অস্বীকার করা অসম্ভব।
স্থায়িত্ব: এটি দীর্ঘস্থায়ী। শিশু ও পোষা প্রাণীদের জন্যও এটি বিপজ্জনক নয়। এটা ফাটে না। বাড়ির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জুড়ি নেই।
মান: ট্র্যাভারটাইন ফ্লোরিং হলো মার্বেল বা গ্রানাইটের মতো অন্যান্য উচ্চমানের পাথরের তুলনায় কম দামে একটি বাজেট-বান্ধব বিকল্প। ট্র্যাভারটাইন মেঝে ইনস্টল করা আপনার বাড়ির মানও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নন-¯িøপ: ট্র্যাভারটাইন মেঝে প্রাকৃতিকভাবে পিচ্ছিল নয়, যা এটিকে আর্দ্রতা-প্রবণ স্থান যেমন বাথরুম এবং রান্নাঘরে ব্যবহারের জন্য আদর্শ।
ট্র্যাভারটাইনের কিছু সমস্যা
কোমলতা: যেহেতু ট্র্যাভারটাইন একধরনের পাথর, তাই এটি মেঝে তৈরির অন্যান্য উপকরণের তুলনায় শক্ত। এটা বেশ ভারী। বাড়িতে অধিক ব্যবহার করলে পুরো স্ট্রাকচারের ওপর খানিকটা বেশিই ডেড লোড যোগ করে।
তাপমাত্রা: অন্যান্য প্রাকৃতিক পাথরের টাইলের মতো, ট্র্যাভারটাইন বেশ ঠান্ডা থাকে। গরমের দেশে এটি বেশ আদর্শ হলেও শীতপ্রধান দেশগুলোর জন্য এটা বেশ ভালো একটি সমস্যা।
সংবেদনশীলতা: ট্র্যাভারটাইন টেকসই হলেও, এটি ভিনেগার, কফি, জুস ও অ্যালকোহলের মতো অ্যাসিডিক পদার্থের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। ছিটকে গেলে, অ্যাসিডিক তরল দাগ ফেলে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে কারণ তারা ট্র্যাভারটাইনের ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। আপনি যদি গতানুগতিক ধারার টাইলিংয়ের বদলে ভিন্ন কোনো লুকে নিজের ঘর ও কাজের জায়গা সাজাতে চান, তাহলে আপনি ট্র্যাভারটাইনকে বেছে নিতেই পারেন।
টেরাকোটা
টেরাকোটা হলো আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত পোড়ামাটির টাইলস। এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি টাইলসে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা রকমের ডিজাইন। এই ডিজাইনগুলো দিয়ে বাড়ির ফ্লোর বা দেয়াল ঢেকে দেওয়া হয় বলে এটিও টাইলস উপকরণের মধ্যে পড়ে যায়। এটি নানা ডিজাইনে নানা রকম দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত ডিজাইনাররা এটিকে প্রথমে মাটি দিয়ে বানান। এরপর যে স্থানে এটা বসবে, সেখানে সেই মাটির টালি ইনস্টল করেন। অথবা আগে থেকে মাপ জেনে নিয়ে টাইলস পুড়িয়ে সাইটে গিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুরো কাজটি বেশ সময় সাপেক্ষ এবং এটি বাস্তবিক ক্ষেত্রে একটি চারুকলাবিদ্যা। একটি দেয়ালে পেইন্টিং যেমন, তেমনই টেরাকোটা। এটি দিয়ে খুব সহজেই মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করা যায়। বাংলাদেশের বহু দালানে টেরাকোটা দেখতে পাওয়া যায়।
সিমেন্ট টাইলস
সিমেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন রং মিশিয়ে তৈরি করা টাইলস সিমেন্ট টাইলস বা টেরাজো (ঞবৎৎধুুড়)। বহু শতাব্দী প্রাচীন এই সিমেন্ট টাইলস আবিষ্কার হয়েছিল ইজিপ্টে। সে আমলে ইজিপ্টে রং ও সিমেন্ট নিয়ে তৈরি করা টাইলসের প্রচলন হয়েছিল। আর এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল শিল্পবিপ্লব। শিল্পী তার মনের মতো করে রং মিশিয়ে টাইলস তৈরি করতে শুরু করেন। আর এতেই সৃষ্টি হয় ইতিহাস। মূলত ৮ ইঞ্চি বাই ৮ ইঞ্চির এই টাইলস (ক্ষেত্রবিশেষে যা বাড়তে পারে) দেখতে যেন একেকটি শিল্পকর্ম। ঘরের বিশেষ বিশেষ অংশে ব্যবহার করা হলে এই টাইলস নানন্দিকতার এক অন্য রকম সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে তোলে সেই স্থান।
এই টাইলস বানানোর মূল উপাদান মাটি, হোয়াইট সিমেন্ট ও লাইমস্টোন। এগুলো গুঁড়ো করে মিহি দানায় রূপান্তরিত করা হয়। রূপান্তরের এই প্রক্রিয়া বেশ কষ্টসাধ্য। অনেক সময় সিমেন্টের ভেতর ময়লা থাকে। আবার মিহি দানায় পরিণত না হলে আবার সেটাকে চালুনি দিয়ে চেলে নিয়ে হাতে গুঁড়ো করে নিতে হয়। এই প্রক্রিয়া বেশ কষ্টসাধ্য। এর পরের প্রক্রিয়া হলো রং তৈরি। বিভিন্ন রং তৈরিতে প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই রংগুলো হতে হয় পানিতে অদ্রবণীয়। মানে এটা প্রথমে পানিতে দ্রবণীয় হলেও টাইলস থেকে যেন ধুয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। এভাবে ভারী ও অদ্রবণীয় নিজেদের মধ্যে অমিশ্রণযোগ্য রং তৈরি করে সেই রং লোহার তৈরির ছাঁচে নির্দিষ্ট ডিজাইনে ফেলতে হয়। ছাচের মধ্যে রং পূর্ণ হলে সেই রং থেকে খুব সাবধানে ছাঁচ তুলে ফেলতে হয়। রঙের সব দ্রবণ যদি সমান না হয় তাহলে একটার সঙ্গে আরেকটা রং মিশে যেতে পারে। এ জন্য এই প্রক্রিয়া বেশ সাবধানে করতে হয়। একবার এক রঙের সঙ্গে আরেক রং মিশে গেলে পুরো প্রক্রিয়া নতুন করে তৈরি করতে হয়।
রঙের দ্রবণ থেকে লোহার ছাঁচ তুলে ফেলার পর মুহূর্তেই এর ওপর দেওয়া হয় সিমেন্ট ও মাটির মিশ্রণ, যা কিছুটা আর্দ্র থাকে। আর্দ্র সিমেন্ট মিক্সচার সেই ছাঁচে দেওয়ার পর সেটাকে একটা হাইড্রোলিক প্রেস মেশিনে চাপ প্রদান করলে কয়েক সেকেন্ড সময়ের মধ্যে এটি একটি টাইলস হিসেবে প্রস্তুত হয়ে যায়। শুকানোর প্রয়োজন হয় না। আগুনে তাপ বা পোড়ানোর প্রয়োজনও হয় না। কোনো বিশেষ প্রক্রিয়া ছাড়াই এটা পরমুহূর্তেই ব্যবহারের উপযোগী একটি ম্যাটেরিয়ালে পরিণত হয়।
টেরাজো টাইলসের মূল অংশ অনেক। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো এর ছাঁচ তৈরি করা। ছাঁচ তৈরির জন্য প্রথমেই একটা বড় দেয়াল কল্পনা করে স্কেচ তৈরি করতে হয়। সেই স্কেচ অনুযায়ী ছোট ছোট টুকরায় ছাঁচ বানাতে হয় লোহার পাত দিয়ে। এই ছাঁচ তৈরি বেশ কঠিন। সুন্দরভাবে পুরো প্রক্রিয়া হওয়ার পর এক একটা ছাঁচ দিয়ে এক একটা টাইলস তৈরি করা হয়। প্রাচীন গ্রিসে প্রথম এই ধারার টাইলস তৈরি হওয়া শুরু হলেও অনেক বছর এটা বন্ধ হয়ে ছিল। ইউরোপে ১৮০০ শতকে এসে এটির আবারও প্রচলন ঘটে। তখন এটিকে ফ্যাক্টরি প্রস্তুত করে তৈরি শুরু হয়। যদিও এরপর আবার নানা রকম টাইলস বাজারে আসায় এটির প্রোডাকশন প্রায় বন্ধের পথে। তবুও এটি কিছু কিছু দেশে সামান্য কিছু কারিগরের জন্য বেঁচে আছে।
মোজাইক
মার্বেল বা গ্রানাইটের কাজ করতে গেলে বেশ কিছু গুঁড়ো বা টুকরো বের হয়, যেগুলো কোনো কাজে লাগে না। সেই টুকরোগুলোই আবার একটা ছাঁচে ফেলার পর হোয়াইট সিমেন্ট ও আঠা দিয়ে টাইলস বানিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় মোজাইক টাইলস মেকিং। মোজাইক টাইলস অবশ্য বহুমাত্রিক হতে পারে। যখন এতে মার্বেল বা গ্রানাইটের টুকরো ব্যবহার করা হয়, তখন এটিকে গ্রানাইট বা মার্বেল মোজাইক টাইলস বলা হয়। আবার মেটালিক টাইলসকেও মোজাইক টাইলস বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে একটা প্যাটার্ন তৈরি করা হয় বলে মোজাইক টাইলস।
ভিনাইল কম্পোজিট টাইলস
পলিভিনাইল ক্লোরাইড দিয়ে তৈরি এই ধরনের টাইলস বা ফ্লোর ফিনিশ ম্যাটেরিয়াল ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ১৯৮০ সাল থেকে পিভিসি চিপস দিয়ে তৈরি এই টাইলস পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিনাইল কম্পোজিট টাইলস মূলত নরম পিভিসি ম্যাটেরিয়াল, যা বিভিন্ন স্থাপনায় নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে বা বিদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে এখন আর ফ্লোর টাইলস ব্যবহার হয় না। ব্যবহার করা হয় ভিনাইল কম্পোজিট টাইলস। এগুলো ব্যবহারের মূল কারণ, এতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোনো রকম জয়েন্ট ছাড়াই টাইলস লাগানো যায়। আমরা জানি যে টালির মাঝে যে ফাঁক থাকে, সেটা হোয়াইট সিমেন্ট ও নানা রকম রঙিন রাসায়নিক দিয়ে ভরাট করা হয়। আবার এটা বিভিন্ন সময় ময়লা হয়ে কালচে হয়ে যায়। কিন্তু এটা হাসপাতালের হাইজেনিক পরিবেশের জন্য বাধাস্বরূপ। এ জন্য হাসপাতালের ফ্লোরের স্কারটিং এরিয়াতে টাইলস ফ্লোর থেকে কার্ভ করে তুলে দেওয়া হয়। এবং এতে একটি সুন্দর মোলায়েম ফ্লোরিং তৈরি হয়। এতে খালি পায়ে হাঁটতে সুবিধা হয়। আবার রোগ-জীবাণু সহজেই পরিষ্কার করে ফেলা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে টাইলস থেকে কম খরচ বলে এই পিভিসি ফ্লোরিং ব্যবহার করা হয়। যেমন, আসল কাঠের ফ্লোরিং বেশ দামি হলেও কাঠের টেক্সচার প্রিন্ট করা উডেন পিভিসি ফ্লোরিং ব্যবহার বেশ সহজলভ্য ও সুন্দরভাবে কম সময়ে ইনস্টল করা যায়। পিভিসি ফ্লোরিং ইনস্টল করার জন্য সমান একটি ফ্লোর হয়ে গেলেই হয়। অনেক ক্ষেত্রে ফ্লোরের ওপর নিট সিমেন্ট ফিনিশ করে ফেলার পরেই এতে পিভিসি টাইলস বিছিয়ে দেওয়া যায়। যেকোনো আঠা দিয়ে আটকে দিলেই এটি প্রস্তুত। তবে অধিক তাপ ও চাপ প্রয়োগে এটি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় এটি পানিতে আঠার আস্তরণ নষ্ট হয়ে যায় বলে উঠে চলে আসে। যদি আবার আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়, এটি আবারও নতুন হয়ে যায়।
এইচডিএফ
এইচডিএফ বা হাইডেনসিটি ফ্লোরিং হালের সবচেয়ে আধুনিকতম টাইলস সংস্করণ, যা ইচ্ছেমতো আঁকার ও আকৃতিতে পাওয়া যায়। এটা বাসস্থান ও অফিস বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতে পারে আধুনিকতার ছোঁয়া। এইচডিএফ মানে হলো হাইডেনসিটি ফ্লোরিং টাইলস বানানো হয় কাঠ ও প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া বর্জ্য ও নানা কেমিক্যালের মিশ্রণে, যা সহজেই ভেঙে যায় না। এই এইচডিএফ বোর্ডের মধ্যে মেইল ফিমেইল জয়েন্ট থাকে, যাতে এটি সহজেই কোনো রকম জয়েন্ট ছাড়াই ফ্লোরে বসে যায়। তবে এটি বসানোর জন্য ফ্লোরে প্রথমেই ফোমের একটি পাতলা আস্তরণ দিতে হয়, যাতে সহজে নড়াচড়া না করে। আমাদের হাঁটাচলার সময় ফ্লোর যেন না নড়ে ওঠে এ জন্যই এটি দেওয়া হয়। ফোমের ওপর কোনোরকম আঠা ছাড়াই এটি শুধু বিছিয়ে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে এটি ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। কাঠের টেক্সচার দেওয়া এইচডিএফ বোর্ড নানা রকম রঙে পাওয়া যায়। এবং এটি ইনস্টল করতে খুবই কম সময় লাগে। অনেকের কাঠের ফ্লোরে বাস করার ইচ্ছে থাকলেও এর দামের জন্য ব্যবহার করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে এইচডিএফ একটি খুবই প্রয়োজনীয় বিকল্প হতে পারে। এটি কাঠের ফ্লোরের চেয়ে বেশ কমদামি। এতে আছে থিন পলিমারের লেয়ার, যা দাগ ও স্ক্র্যাচপ্রæফ। আবার অনেক ভার বহন করতে পারে বলে এটি বেশ সহজে ব্যবহারযোগ্য টাইলস।
মেটাল টাইলস
মেটাল বা ধাতব নানা বস্তু দিয়ে তৈরি টাইলসই হলো মেটাল টাইলস। মেটাল টাইলস বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফ্লোরিং হিসেবে মেটালের ব্যবহার নতুন নয়। তবে দেয়ালে আস্তরণ হিসেবে মেটালের ব্যবহার বেশ আধুনিক। কয়েক দিন আগেও এটি ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য হলেও এখনকার সময়ে এটির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। মেটালিং টাইলস নানা রকমের হতে পারে। এতে ধাতু হিসেবে অ্যালুমিনিয়াম ও তামার ব্যবহার দেখা যায় বেশি। এগুলোর ইনস্টলেশন প্রসেস একটু ভিন্ন। এটি লাগানোর নানা রকম প্রক্রিয়ার একটি হলো আঠা পদ্ধতি। হোয়াইট সিমেন্টের আস্তরণ দিয়ে লাগিয়ে দেওয়ার পর এর ফাঁকগুলোও একই রঙের হোয়াইট সিমেন্ট দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়। আবার এরোল্ডাইট দিয়ে আঠা প্রস্তুত করে ও এটি ইনস্টল করা হয়। তবে এটি যে সারফেসে লাগানো হয়, সেই সারফেস অবশ্যই রাইট অ্যাঙ্গেলে থাকা আবশ্যক।
টাইলসের ইনস্টলেশন
টাইলস নানা পদ্ধতিতে ইনস্টল করা হয়। সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরি মসলা, যা দিয়ে তৈরি মিশ্রণের ওপর টাইলস বিছিয়ে দেওয়ার পর আবার টাইলস তুলে ফেলা হয়। এরপর বেশি করে পানি দিয়ে মিশ্রিত সিমেন্টের পানি (ঘোলা) দিয়ে সেই মিশ্রণ ভিজিয়ে দেওয়া হয়। এরপর এর ওপর টাইলস বিছিয়ে রাবারের তৈরি হাতুড়ি দিয়ে প্রেশার দিলে টাইলস লাগানোর কাজ শেষ হয়। সম্প্রতি টাইলস বসানোর জন্য নানারকম ডিজাইন করা হয়। বাসাবাড়িতে ডিজাইন মোতাবেক টাইলস বসানো হলে দেখতে মনোমুগ্ধকর। অথচ একই দামের টাইলস ডিজাইন ছাড়া লাগানোও যায়। টাইলস নানা রকম করে বসানো যায়। যেমন রানিং বন্ড, স্টেক বন্ড, জিগজ্যাগ বন্ড ইত্যাদি।
হ্যারিংবোন প্যাটার্ন
হ্যারিংবোন প্যাটার্ন হলো ক্ল্যাসিক টাইলস ইনস্টলেশন প্যাটার্ন। এটি টাইলস লাগানোর একটি সনাতন পদ্ধতি। সাধারণত ক্ল্যাসিক্যাল ইন্টেরিয়ারে লাগানো হতো প্রাচীন ব্রিটেনের স্থাপত্যে।
ডায়মন্ড প্যাটার্ন
ডায়মন্ড প্যাটার্ন অনুযায়ী টাইলস লাগালে টাইলস থেকে সাধারণত সোজাসুজি দেখতে কৌণিকভাবে লাগানো দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের টাইলসকে স্বাধীনতা ডায়মন্ড প্যাটার্ন নিয়ে টাইলস বসানো হয়েছে বলে জানা যায়। লাগালে অনেক বেশি ওয়েস্টেজ হয় বলে এটি সাধারণত খুব একটা বেশি দেখা যায় না।
ব্রিক বন্ড প্যাটার্ন
ব্রিক বন্ড প্যাটার্ন একটি খুবই সুন্দর প্যাটার্ন টাইলস। সাধারণত আয়তকার টাইলস ব্রিকবন্ড প্যাটার্নে বসানো হয়। এটি হচ্ছে অনেকটা বাড়ির দেয়ালে যেভাবে আমরা ইট বসাই, সেভাবে বসাতে হয়। এই ব্রিকবন্ড প্যাটার্ন আরও কয়েক রকম করে হতে পারে। যেমন, আমরা যদি টাইলসকে মাঝখান থেকে না বসিয়ে তিন ভাগের দুই ভাগ অংশ থেকে বসানো শুরু করি, তখনো এটি ব্রিকবন্ড প্যাটার্নই বলা হয়। নানা রকমভাবে এই ব্রিক বন্ড প্যাটার্ন ক্রিয়েট করা হয় এবং এটি দেখতে খুবই সুন্দর দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে দেয়ালে টাইলস এভাবে বসানো হয়। তবে ফ্লোরে টাইলস যদি আয়তকার হয় বা দেয়ালের টাইলস যদি আয়তক্ষেত্রাকার হিসেবে থাকে, তাহলে এটি বসালে খুব সুন্দর দেখায়। তবে ফ্লোরেও বসানো যেতে পারে, সেটি দেখতে একই রকম নান্দনিক মনে হয়। আবার বর্গাকার টাইলসও এই নিয়মে বসানো যায়।
লিনিয়ার বন্ড প্যাটার্ন
লিনিয়ার বন্ড হলো সেই প্যাটার্ন, যেটাতে আসলে সাধারণত আমরা টাইলস বসিয়ে থাকি। এই প্যাটার্নটি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এটি ব্যবহার করে টাইলস বসানো অনেক সহজ এবং এটি ব্যবহার করে টাইলস বসালে দেয়াল বা ফ্লোর দেখতে খুব সুন্দর দেখায়।
টাইলসের গ্যাপিং
টাইলসের গ্যাপিং কেন দেওয়া হবে অথবা টাইলসের গ্যাপ কেন দেওয়া হবে না এই নিয়ে নানা রকম মত দেখতে বা শুনতে পাওয়া যায়। কারণ অনেকে টাইলসের গ্যাপিং দিতে চান না। বিশেষ করে রাসটিক টাইলস, যেগুলো আমরা ব্যবহার করি সেগুলো গ্যাপ দিয়ে বসালে একটু অদ্ভুত দেখায় আবার আমাদের দেশে যে সমস্ত সিরামিক টাইলস পাওয়া যায়, সেগুলো গ্যাপ না দিয়ে বসালে অনেক ক্ষেত্রে টাইলস বা ফ্লোরে টাইলস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণত এক-দুই বছরে এই ক্ষতিটা টের পাওয়া যায় না। বেশ কিছু বছর পর অনেক ক্ষেত্রে টাইলসের নিচের অংশে পানি শোষণ করে টাইলস ফুলে ওঠে এবং একটা সময় এটি উঠে যায় বা ভেঙে যায়। ফ্লোর থেকে উঠে যাওয়ার এই প্রবণতা লক্ষ করা যায় সিরামিক টাইলসের ক্ষেত্রে। আমরা ফ্লোর পরিষ্কার করার জন্য পানি ব্যবহার করি এবং এই পানির ব্যবহার কমবেশি প্রতিদিনই হয়ে থাকে। আমরা প্রতিদিন ফ্লোর যে পানি দিয়ে মুছে থাকি, সেই পানির কিছু অংশ টাইলসের গ্যাপ দিয়ে ঢুকে গিয়ে টাইলসের নিচের অংশে গিয়ে জমে থাকে এবং সেখান থেকে টাইলস এই পানিটাকে শোষণ করে কিছুটা বৃদ্ধি পায় এই বৃদ্ধি আমরা সাধারণত চোখে দেখি না কিন্তু এটি প্রতিটা টাইলসের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এখন যদি আমরা এই গ্যাপটা না দিই তাহলে প্রসারণ হওয়ার জায়গা পায় না বলে সেটি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে এবং মাটি থেকে আলগা হয়ে যায় এবং এই আলগা হয় বলেই টাইলস সাধারণত গ্যাপ দিয়ে বসানো হয়। সাধারণত গ্যাপ দেওয়ার জন্য কিছু স্পেসার পাওয়া যায়, এগুলো দেড় মিলিমিটার বা দুই মিলিমিটার বা ক্ষেত্রবিশেষে তিন মিলিমিটার হতে পারে কিন্তু কখনো যদি ডিজাইনার বা স্থপতি টাইলসের ডিজাইনের ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি গ্যাপ রাখতে চান, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন বস্তু দিয়ে এই গ্যাপিং করতে হয়। বিশেষ করে আউটসাইড ওয়ালে অনেক সময় টাইলস বসানোর ক্ষেত্রে সাধারণ ১ দশমিক ৫ মিলি বা ২ মিলিমিটারের গ্যাপের পরিবর্তে ১ ইঞ্চি বা হাফ ইঞ্চির একটি গ্যাপ রাখা হয়, যা সাধারণত অনেক দূর দেখতে সুন্দর লাগে। নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলে।
টাইলসের এই গ্যাপিংয়ের জায়গাটাতে সব কাজ এবং ইনস্টলেশন শেষ করার পর হোয়াইট সিমেন্ট দিয়ে এটি ফিল করে দেওয়া হয়। এই সিলিং প্রক্রিয়া সাধারণত হোয়াইট সিমেন্ট দিয়েই হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্কিটেক্ট টাইলসের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল মিশ্রণ করে এই হোয়াইট সিমেন্টকে নিয়ে টাইলসের কাছাকাছি রঙে নিয়ে আসা হয় এবং সেটি দিয়ে এই গ্যাপটা সিল করা হয়। সিলিংয়ের ক্ষেত্রে আবার অনেক সময় আমরা সিলিকন ব্যবহার করি। কারণ অনেক ক্ষেত্রে যদি টাইলস ব্যবহার করার সময় বেশি গ্যাপিংয়ের প্রয়োজন হয়, তখন সেই গ্যাপের মধ্যকার হোয়াইট সিমেন্ট ভেঙে যায়, যার ফলে সেটি হোয়াইট সিমেন্টের বদলে সিলিকন ব্যবহার করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই টাইলসের গ্যাপে যদি এক ইঞ্চি বা এর চেয়ে বেশি গ্যাপ থাকে, সে ক্ষেত্রে এই গ্যাপটাকে টাইলসের ছোট টুকরো দিয়েই ফিল করা হয় এবং সে ক্ষেত্রে এটি বেশ নান্দনিক দেখতে হয়। এসব ছাড়াও টাইলস বা গ্রানাইট বা অন্য যেকোনো টাইলস ম্যাটেরিয়াল বিভিন্ন ধরনের সিলেট দিয়ে সিল করা হয় এবং এই গ্যাপগুলো হোক রাখাই হয় যাতে টাইলস ম্যাটেরিয়াল সংকুচিত ও প্রসারিত হতে পারে। এর মধ্যে মাস্টিক, গ্রে সিমেন্ট অন্যতম।
টাইলস কাটিং
টাইলস কাটার জন্য সাধারণত গ্রান্ডিং মেশিন ব্যবহার করা হয়। ডিজাইন মোতাবেক মাপ মেলানোর পর গ্রান্ডিং মেশিন দিয়ে টাইলস কেটে ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া অনেক সময় টাইলস ডিজাইন করে বসাতে গেলে বেশ কিছু ওয়েস্টেজ হয়। সেগুলো আবার মাপমতো স্কার্টিংয়ে ব্যবহার করা হয়। এসব কাজে গ্রান্ডিং মেশিন ছাড়া মোটেও চলে না। এ ছাড়া অনেকেই টাইলস কাটার মেশিন স্ন্যাপ কাটার ব্যবহার করেন। মাপমতো একটা কাটলে টাইলস দুই ভাগ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এই স্ন্যাপ কাটার বহুল ব্যবহার হচ্ছে বর্তমানে। স্ন্যাপ কাটার দিয়ে সোজাসুজি বেশ সুন্দরভাবে কম সময়ে টাইলস কেটে ফেলা যায়। হোমোজিনিয়াস টাইলস খুব সুন্দরভাবে স্ন্যাপ কাটার দিয়ে কেটে ফেলা যায়। তবে বিশেষ কোনো ডিজাইন- যেমন ফুলের নকশা বা কার্ভ লাইন থাকলে তখন গ্রান্ডিংয়ের বিকল্প থাকে না।
টাইলস লাগানোর মিক্সচার ‘কনমিক্স’ কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্যাকেটজাত বস্তু। পাউডারসদৃশ বস্তুটিকে পানির সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। প্রথমে সিমেন্টের একটা আস্তরণ দিয়ে প্লাস্টার করা হয়। এরপর এটি দিয়ে টাইলস লাগানো হয়। খুব কম পরিমাণে লাগে বলে এটি দিয়ে সহজেই টাইলস ইনস্টলেশন সম্ভব এবং বর্তমানে বহুল ব্যবহার হওয়া ইনস্টলেশন ম্যাটেরিয়াল এটি। এটি পানিরোধী বস্তু। বর্তমানে এর ব্যবহার বেড়েছে। বেশ দ্রæত শুকিয়ে যায় বিধায় এর ব্যবহার সুবিধাজনক।
টাইলসের কর্নার জয়েন্ট
টাইলস কর্নার জয়েন্টের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রবিশেষে পেছন থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে কেটে এরপর জোড়া দেওয়া হয়। তবে সিঁড়ি বা ফ্লোরের মতো জায়গায় এসব কাটিং করা যায় না। কারণ টাইলস একটু ভালো মানের না হলে কাটিং করার সময় ভেঙে যায়। আর এতে ওয়েস্টেজ অনেক বেশি হওয়ার দরুন কাজের দাম বেড়ে যায়। সময় ও অনেক নষ্ট হয়। এ জন্য অনেকেই ওভারল্যাপিং বা বাটেড পদ্ধতিতে কর্নার জয়েন্ট করেন। আউট সাইড ওয়ালে টাইলস কেটে ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। টয়লেটের ভেতর যদি কোনো কলামের ভাঁজ থাকে সে ক্ষেত্রে সাবধানে কোনা মিলিয়ে কাজ করা হয় বটে। কিন্তু ওভারল্যাপিং পদ্ধতিতেই বেশির ভাগ টাইলস লাগানো হয়। এখনকার দিনে এই কর্নার জয়েন্টের নানা রকম পদ্ধতি আছে।
মিটার্ড জয়েন্ট বা কর্নার জয়েন্ট: এটি বেশ প্রচলিত হলেও এটি বেশ কষ্টসাধ্য। দুই দিকের টাইলস গ্র্যান্ডিং মেশিন দিয়ে কেটে সমান কোণ মিলিয়ে বসাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই টাইলসের মান ভালো না হলে কোনা ভেঙে যায়। ফলে অনেকেই এই ধরনের জয়েন্ট করতে চান না। তবে করতে পারলে এটির মতো সুন্দর জয়েন্ট আর হয় না।
বাটেড জয়েন্ট: টাইলস কারিগরদের পছন্দের জয়েন্ট এটি। বাটেড বা ওভারল্যাপিং পদ্ধতিতে জয়েন্ট করলে এটি বেশ সুন্দরভাবে মিলে যায়। হোমোজিনিয়াস টাইলসের ক্ষেত্রে এটির তেমন সমস্যা হয় না। কারণ হোমোজিনিয়াস টাইলস কাটলেও ভেতরে একই রকম দেখতে ম্যাটেরিয়াল থাকে। কিন্তু লাল মাটির সিরামিক টাইলসগুলো সাধারণত লাল মাটির আস্তরণ শুকালে এর ওপর ইউভি প্রিন্ট করে এর টেক্সচার বসানো হয়। এবং এর পরেই চুল্লিতে যায়। ফলে এটির পাশ থেকে লাল মাটির পোড়া অংশটি দেখা যায়। এটি বাটেড জয়েন্ট সিস্টেমে বসালে পাশ থেকে লাল মাটির অংশ দেখা যায়, যা মোটেও দৃষ্টিনন্দন নয়।
ফিটেড কর্নার জয়েন্ট: এটি বেশ ব্যয়সাপেক্ষ টাইলস জয়েন্ট। দুটো সমান মাপের টাইলস মুখোমুখি বসে। এরপর মাঝের গ্যাপে আরেকটি ছোট্ট টাইলসের টুকরো বসে ছবির মতো সেকশন তৈরি করে। এটি বেশ সুন্দর তবে ব্যয়সাপেক্ষ। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মাঝের টাইলসের টুকরোটি কাটিং করতে গিয়ে ভেঙে যায়। আবার গ্রান্ডিং মেশিন দিয়ে এত ছোট টুকরো কাটাও যায় না। ফলে অনেক বেশি ওয়েস্টেজ হয়। অনেক স্থপতি এই মাঝের অংশটি ছাড়াই এই টাইলস বসিয়ে ডিটেইল ডিজাইন দেন। এটিও দেখতে মন্দ লাগে না।
টাইলস রক্ষণাবেক্ষণ
টাইলস শুধু লাগালেই হয় না। একে প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয়। সিরামিক টাইলস হোক বা রাস্টিক টাইলস প্রতিদিন বা কদিন পর পর নিয়ম করে পরিষ্কার করতেই হয়। নইলে এতে স্থায়ী দাগ পড়ে যায়। পানির ভেতর থাকলে শেওলা পড়ে এতে স্থায়ী দাগ পড়তে পারে। আবার ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়ে টাইলসের রং পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
যেভাবে পরিষ্কার
ক্স পানি ও ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে টাইলস পরিষ্কার করলে ভালো হয়। এতে টাইলস দেখতে সুন্দর দেখায়। এর আগে অবশ্যই ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
ক্স ক্লিনিংয়ে ফ্লোর ক্লিনার ব্যবহার করতে হবে। লাইজল বা ভিক্সল ব্র্যান্ডগুলো বাদে আরও নানা রকম ফ্লোর ক্লিনার পাওয়া যায়। এগুলো পরিমাণমতো পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা আবশ্যক। পরিমাণে একটু বেশি হলেই দামি টাইলসে দাগ পড়ে যায়। তাই ব্যবহারে সাবধানতা আবশ্যক। এগুলো বেশ ক্ষার-জাতীয় পদার্থ হয় বলে সাবধান না হলে শরীরের ক্ষতি ও হতে পারে।
ক্স টাইলস এর কোনায় কোনায় বেশি ময়লা জমে। বিশেষ করে স্কারটিংয়ের ওপর ময়লার আস্তরণ জমে। কোনায় ও জমে যায় নানা আস্তরণ। এগুলো টুথব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে।
ক্স তেল ঝোল বা চর্বি-জাতীয় খাবার টাইলসে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে দাগ পড়ে না সত্য, কিন্তু দীর্ঘ সময় পড়ে থাকলে টাইলসের ওপরের শক্ত আস্তরণের ভেতর ময়লা ঢুকে যায়। মার্বেল হলে পরিষ্কার করা যায় দ্রæতই। কিন্তু টাইলসের ক্ষেত্রে কোনো সমাধান নেই। দ্রæত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে জায়গাটা।
ক্স ১ : ৫ অনুপাতে ভিনিগার ও পানি মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে টাইলসের ওপর ছিটিয়ে বা ভিজিয়ে দিলে দ্রæত টাইলস তার আগের রূপ ফিরে পায়। এরপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
ক্স টাইলস পরিষ্কারের পর আগের উজ্জ্বলতা ফিরে না এলে পাতলা কাপড়ে বেকিং সোডা নিয়ে সেই জায়গায় মুছতে হবে। কয়েকবার মুছলে টাইলসে নতুন করে দাগ পড়ে না। ফোম ঘষে দিতে হবে টাইলসে। খানিক পরেই দেখা যাবে টাইলস নতুনের মতো চকচক করছে।
ক্স বিøচিং পাউডার দিয়েও টাইলস পরিষ্কার করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিøচিং পাউডার, বেকিং সোডা ও পানি ১ : ৩ : ৫ অনুপাতে মিশিয়ে নিয়ে টাইলসে ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়। এরপর ভালোমতো ঘষে দিলে টাইলস আবার আগের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ক্স টাইলস জীবাণুমুক্ত করার জন্য ডেটল বা স্যাভলন ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য টাইলস পরিষ্কার রাখার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ডেটল বা স্যাভলন কতটা জীবাণুমুক্ত করতে পারে এ ব্যাপার পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। লাইজল বা এ ধরনের প্রোডাক্টগুলো বিক্রির জন্য নানা মুখরোচক গল্প বলে টেলিভিশন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচার হয় ঠিকই। কিন্তু এসব বিজ্ঞাপনের কতটা সত্য সেটাই হলো আসল প্রশ্ন।
টাইলস ফ্লোর বা দেয়াল যেখানেই লাগানো হোক, এটি রক্ষণাবেক্ষণ বেশ জরুরি। টাইলস অপরিষ্কার থাকলে বা টাইলসের ফাঁকে ময়লা জমে এটি মানব শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে। শিশুরা সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে যদি টাইলস পরিষ্কার রাখা না হয়। বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর বাসা যাতে টাইলস না হয়ে এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত টাইলস পরিষ্কার রাখলে এটি অনেক বছর পর্যন্ত একই রকম থাকে। একটি ঘরের অন্দরমহল কেমন হবে তা অনেকাংশেই টাইলসের ওপর নির্ভর করে। তাই টাইলস লাগানো ও এর রক্ষণাবেক্ষণে সচেতনতা বেশ জরুরি।
প্রতিদিন নিত্যনতুন রকমের টাইলস বাজারে আসছে। চেষ্টা করেছি সব রকম টাইলস নিয়ে আলোচনা করার। কিন্তু এর বাইরেও প্রতিনিয়ত টাইলসের বাজার উন্নত হচ্ছে। স্পেন বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলো টাইলস ডিজাইনের জন্য উচ্চমূল্যে স্থপতি নিয়োগ দিচ্ছেন। ফলে প্রতিনিয়ত টাইলসের বাজারে প্রবেশ করছে উন্নত ও অত্যাধুনিক মানের ও বহুমূল্য নানা টাইলস। আর এসব টাইলস দিয়ে সাজছে বাংলাদেশ। যদিও বেশ ব্যয়সাপেক্ষ, তবুও আশা করা যায় যে অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়নে টাইলস শিল্পের উন্নয়ন হবে এবং এটি দেশের অর্থনীতিকে যেমন সমৃদ্ধ করবে, তেমন নান্দনিকতায় ছাড়িয়ে যাবে বহির্বিশ্বের টাইলস শিল্পকেও।
স্থপতি রাজীব চৌধুরী
অৎপযরঃবপঃ.ৎধলরন@মসধরষ.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৮ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২৩