স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন এক নক্ষত্রের প্রয়াণ

বাংলাদেশের স্থাপত্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এ ক্ষণজন্মা পুরুষ নিজ পেশার গÐি পেরিয়ে হয়েছিলেন ক্রীড়া সংগঠক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রচিন্তক, পরিবেশবাদী, সমাজকর্মী তথা একজন সংগ্রামী সংস্কারক। স্থপতিদের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জনবান্ধব বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি এক বিরল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বন্ধন ম্যাগাজিনের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। বিভিন্ন ইস্যুতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বন্ধনে। ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের জীবন, স্থাপত্যচর্চা ও দেশমাতৃকার জন্য তাঁর অবদান সংক্ষেপে তুলে এনেছেন স্থপতি খালিদ মাহমুদ ও স্থপতি তাসলিহা মওলা।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষণজন্মা এ পুরুষ শুধু স্থপতিই নন, বরং সম্ভাবনার বাংলাদেশের একজন সংগ্রামী যোদ্ধা। বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশাগত জগতের বাইরেও তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আরও বৃহৎ পরিসরে, দেশের গÐি ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। আর তাই এশিয়া অঞ্চলের স্থপতিদের সম্মিলিত সংগঠন আর্কেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, ছিলেন কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টসের নির্বাচিত সভাপতি। 

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বেড়ে ওঠা বগুড়ায়; নানাবাড়িতে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সেই থেকে শুরু তাঁর পথচলা। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন স্থাপত্য অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ও অভিভাবক। বাংলাদেশের স্থাপত্যকলা ও নির্মাণশিল্পে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের রয়েছে অসামান্য অবদান। তিনি শুধু নিজেই স্থাপত্যচর্চা করে গেছেন তা নয়, বরং নিজের হাতে তৈরি করে গেছেন বেশ কয়েকজন অনুজ স্থপতিকে। ১৯৭৬ সালে বন্ধু স্থপতি মোস্তফা কামালকে সঙ্গে নিয়ে ‘অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট’ নামে নিজ প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে এটি ‘অ্যাসো কনসালট্যান্ট’ নামে নিবন্ধিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্থাপনা নকশাও নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো স্থাপত্যশৈলীর অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ২০০৯ সালে ভূষিত হয়েছেন এআইএ প্রেসিডেন্ট মেডেল অ্যাওয়ার্ডে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে পেয়েছেন আইএবি গোল্ড মেডেল। তিনি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের সম্মানসূচক সদস্য।

স্থপতি হিসেবে তাঁর অন্যতম সৃজনশীল অবদান গ্রামীণ ব্যাংক ভবন, যা মিরপুর-২-এ অবস্থিত। প্রথম পর্যায়ে নকশা ও নির্মাণ করা হয়েছিল প্রশাসনিক ও কার্যালয় ভবন। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণ করা হয় ২২ তলা গ্রামীণ ব্যাংক টাওয়ার। মিরপুর-৬-এ অবস্থিত অষ্টভুজাকৃতির প্রশিকা ভবন তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ। ১৩ তলা উচ্চতাবিশিষ্ট লাল ইটের এ অফিস কমপ্লেক্স বাইরে ও অন্দর উভয় ক্ষেত্রের নকশাই অত্যন্ত পরিমার্জিত ও দৃষ্টিনন্দিত। বেশ কিছু আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অবকাঠামো উদ্যোগের সঙ্গে দীর্ঘদিন সময় দিয়ে গেছেন। স্থাপত্যচর্চার শুরুর দিকে তিনি মাইজদীতে ড্যানিডার একটি ট্রেনিং সেন্টার ডিজাইন করেন। এই সংযোগ অব্যাহত থাকে পর্যায়ক্রমে।

সমগ্র বাংলাদেশে প্রশিকার বেশির ভাগ ট্রেনিং সেন্টার বা আরটিসিসমূহ তাঁর প্রতিষ্ঠানের নকশা করা। রংপুর ও লালমনিরহাটে অবস্থিত আরডিআরএস কমপ্লেক্স, চট্টগ্রামে বেশ কিছু ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং সাইক্লোন শেল্টার ভবনও তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে নকশা করা হয়। তিনি সামগ্রিক (যড়ষরংঃরপ) ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের অন্যতম পরিকল্পক ও রূপকার ছিলেন। সরকারি-বেসরকারি বহু ভবন ও বৃহদায়তন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর আরও দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো- চট্টগ্রামে নতুন রেলস্টেশনের নকশা এবং পুরোনো রেলস্টেশন রিস্টোরেশন ও রেনোভেশন। ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিলের যে জাদুঘরটি এখন আমরা দেখি, তার অন্দরসজ্জা স্থপতি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে ক্যাটালগ আনিয়ে সেই অনুযায়ী আসবাবের ডিজাইন করা হয়েছিল এখানে। 

কর্মজীবনে তিনি স্থাপত্যাচার্য মাযহারুল ইসলামের দর্শন ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করতেন। প্রকৃতিনির্ভর ও জনবান্ধব উন্নয়নকে তিনি স্থান দিয়েছেন সর্বাগ্রে। প্রশিকা এইচডিআরসি ও আরডিআরএস কমপ্লেক্স তাঁর অন্যতম উদাহরণ। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, কৈট্টায় অবস্থিত অফিস ভবন, ট্রেনিং সেন্টার ও রেস্ট হাউসসংবলিত এ স্থাপনাটি যারপরনাই দৃষ্টিনন্দন। রংপুরের সবুজঘেরা আরডিআরএস কমপ্লেক্স বলে দেয় তিনি কত যতœ নিয়ে কাজ করতেন। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের সার্বিক তত্ত¡াবধানে স্থপতি মোস্তফা কামাল ও স্থপতি সৈয়দ সিরাজুল হকের নকশায় গড়ে ওঠে দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন, সবুজঘেরা এ অফিস কমপ্লেক্সটি। পুরো কমপ্লেক্সের নকশা করা হয় তাঁর প্রতিষ্ঠান অ্যাসো কনসালট্যান্ট থেকে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে অফিস ভবন, ডরমিটরি ও গেস্ট হাউস মিলিয়ে বেশ কটি ভবনের প্রতিটি ড্রয়িং, প্রতিটি ডিটেইল তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। তাঁর বিশেষত্ব ছিল তিনি স্থাপত্যের প্রায়োগিক দিকগুলোর ওপর বেশি জোর দিতেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য টেকসই ও সহজলভ্য গ্রামীণ স্থাপনার একটা মডিউল তৈরি করে দেন, যেটির জন্য গ্রামীণ ব্যাংক আগা খান পুরস্কার পায়। এটা বলা যায়, মোবাশে^র হোসেনেরই উদ্ভাবনী কাজের স্বীকৃতি। এর সব ওয়ার্কিং ড্রয়িং মোবাশে^র হোসেনের প্রতিষ্ঠান থেকে করে দেওয়া। ইমপ্লিমেন্টেশনের গুরুত্ব অনুভব করেই খুব দ্রæতই তিনি পরামর্শকের পাশাপাশি নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার কাজে চলে আসেন। ১৯৯৫ সালের শেষদিকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘নীড় লিমিটেড’। রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায়ও নীড়ের বেশ কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ও মিশ্র ব্যবহার ভবন দেখা যায়। 

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সর্বমোট পাঁচবার। ‘নগর ও নাগরিক আন্দোলন’- প্রতিবাদের এমন অভিনব ও সম্পূর্ণ নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয় তাঁর হাত ধরে। পরবর্তীকালে এর ধারাবাহিকতায়ই তিনি বাংলাদেশ পরিবেশবাদী আন্দোলন (বাপা), কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ইত্যাদি সংগঠনের মাধ্যমে পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। স্থপতিদের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জনবান্ধব বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি ঢাকা শহর তথা সমগ্র বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রামে, আলোচনা সভায়, টকশোতে সরব থেকেছেন। পত্রিকায় মত ব্যক্ত করেছেন।

মোবাশ্বের হোসেনের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ঢাকা ক্রাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। যৌবনে দেশমাতৃকার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রণাঙ্গনে, পেছনে রেখে গিয়েছিলেন স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দেশের যে প্রান্তে অন্যায় দেখেছেন, অসংগতি দেখেছেন সেখানেই প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন, আদায় করেছেন অধিকার। ফিরিয়ে এনেছেন বহু মাঠ, জলাভূমি। পরিবেশ আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে দূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। তেঁতুলতলা খেলার মাঠ, ধানমন্ডি ৬ নম্বরের খেলার মাঠ উদ্ধারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, চালিয়ে গেছেন আইনি লড়াইও। নিজ অর্থে ও শ্রমে শুধু জনস্বার্থে আদালতে যাওয়ার এমন দৃষ্টান্ত আজকাল সত্যিই বিরল। যেখানেই তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর দেখেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন তরুণদের। প্রতিবাদী তরুণসমাজকে আখ্যায়িত করেছেন ‘একালের মুক্তিযোদ্ধা’ বলে। স্কাউটস বা গ্রিন ভয়েসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্বিক সহায়তা করে গেছেন আজীবন। চট্টগ্রামে সিআরবি রক্ষা আন্দোলন, টিএসসি, কমলাপুর রেলস্টেশন রক্ষা আন্দোলন, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভবন রক্ষা আন্দোলনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সাবেক সভাপতি। এ ছাড়া সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আহŸায়কও ছিলেন। ক্রিকেটারদের কল্যাণে নিজ প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাটও তিনি উপহার দিয়েছেন। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবকের মতো সার্বিক খোঁজ রাখতেন, বিশেষ করে বিসিবির যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন।

তিনি ছিলেন স্থপতি সমাজের অভিভাবক। নিজেকে স্থাপত্য পরিবারের একজন সাধারণ সদস্য ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত স্থপতিদের অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন। একেবারে শেষ সময়ে এসেও গেজেটকৃত ড্যাপের অস্যংতিসমূহ নিরসনে কাজ করে গেছেন এবং এর সংশোধনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি চিরবিদায় নেন এই নশ্বর পৃথিবী থেকে। তবে তাঁর কর্মচঞ্চল বর্ণাঢ্য জীবন উদাহরণ হয়ে থাকবে যে একজন মানুষের কর্মপরিধির ব্যাপ্তি কত বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে পারে। সফলতা-ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি কাজ করে গেছেন মানবকল্যাণে। মৃত্যুর পর নিজ দেহখানিও দান করে গেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে। এমনই মহাপুরুষ ছিলেন তিনি। তিনি ক্ষণজন্মা, তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম। তাঁর দেখিয়ে যাওয়া আলোর পথে, সত্যের পথে, প্রতিবাদের পথে হেঁটে পরবর্তী প্রজন্ম বয়ে আনবে কল্যাণ। 

তিনি ছিলেন ঢাকার বন্ধু

স্থপতি ড. আবু সাইদ এম আহমেদ

অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ এবং ডিন,

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক

সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট

মোবাশ্বের ভাই তাঁর সমসাময়িকদের কাছে নানাভাবে পরিচিত। স্থপতি ছাড়াও কেউ পরিবেশবিদ, কেউ নগর চিন্তক, কেউ বলে ক্রীড়া সংগঠক, কেউ বলে অ্যাক্টিভিস্ট। কিন্তু আমার কাছে তিনি প্রফেশনাল গÐি পেরিয়ে একজন শ্রেষ্ঠ বন্ধু। বন্ধু মানে যে একই বয়সের হতে হবে, কিংবা এক ক্লাসে পড়াশোনা করতে হবে তা নয়। বরং আমার চেয়ে ১৫ বছরের বড় হলেও বয়সের বাধা মুছে তিনি যে আমার বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন, সেটি কেবলই আস্থা এবং নিস্বার্থ ভালোবাসার জায়গা থেকে। একটা ছোট উদাহরণ দিই। তিনি যখন পরপর কয়েকবার বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে নিজে থেকেই বিরতি নেন, তখন সবারই আগ্রহ ছিল এর পরে সভাপতি কে হবেন। মোবাশ্বের ভাই আমাকেই প্রস্তাব দিয়ে বসলেন এই দায়িত্বে আগ্রহী হওয়ার জন্য। অথচ তাঁর সমসাময়িক আরও অনেকে ছিলেন, যাঁরা আরও অনেক অভিজ্ঞ। আমার ওপর তাঁর আস্থা বজায় ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। হয়তো উনি ভাবতেন তাঁর চিন্তাধারা আর আমার চিন্তাধারার মধ্যে একটা ঐকতান আছে। তাঁর স্বপ্ন বা ভাবনাগুলো নিয়ে আমি কাজ করতে পারব এমন একটা আশা তিনি পোষণ করতেন হয়তো। 

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের সব চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশ। দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, স্থপতিদের নিয়ে, শহর নিয়ে তাঁর আর আমার ভাবনাগুলো কেমন যেন মিলে যেত। আমি ১০ বছর প্রবাস থেকে পিএইচডি শেষ করে দেশে থাকব এমন চিন্তা করেই ফিরে আসি। অনেকেই কিন্তু আমাকে নানাভাবে বলেছে কেন আমি দেশে ফিরলাম। অহেতুক কেন সময় নষ্ট করছি। বাইরে অনেক ভালো সুযোগ আছে, কনজারভেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কনসালট্যান্সিতে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারি। কিন্তু মোবাশ্বের ভাইয়ের কথা ছিল সবার ব্যতিক্রম। তিনি বলতেন এ দেশেও প্রচুর সম্ভাবনা আছে, আছে কাজ করার অনেক ক্ষেত্র। সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা নিয়ে কাজ করতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ওনার এই দেশ নিয়ে ভাবনাই আসলে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটাকে আরও গাঢ় করে দেয়। আমাদের চিন্তার সূত্র একই ছিল বলেই প্রথম প্রথম যখন টেলিভিশনে বক্তা হিসেবে তাঁর আমন্ত্রণ আসা শুরু করল, তখন মাঝে মাঝে তিনি আমার সঙ্গে গল্প করতেন। আমার ভাবনাগুলোও জেনে নিতেন। কোন কোন ইস্যুতে কথা বলা উচিত বা কোন মন্তব্যের জবাব কী হতে পারে, এসব নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। 

মোবাশ্বের ভাইয়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করার অনেক স্মৃতি, যা অল্প পরিসরে বলে শেষ করা সম্ভব না। শুধু আমার সঙ্গেই নয়, বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন শ্রেণির সুধীজনের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সমগ্র শহরের জন্য তাঁর কর্মপরিল্পনা ছিল। স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি হলেও কীভাবে বাসযোগ্য নগর গড়া যায়, এ নিয়ে কাজ করেছেন। পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, আইনজীবী বা রাজনীতিক এবং সর্বোপরি কাজ করেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। আমি বলে থাকি তিনি আসলে ঢাকা শহরের বন্ধু। ঢাকা শহরকে বাঁচানোর জন্য তিনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন। মাঠ বাঁচানো, পার্ক-জলাশয় রক্ষা করা, শ্রমিকদের জন্য কাজের পরিবেশ তৈরি করা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ঠেকানো- প্রতিটা ইস্যুতে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। গুলশান অ্যাভিনিউর দিকে যদি তাকান, তাহলে আজকের শহরের এই যে পরিবর্তন, তার জন্য মোবাশ্বের হোসেন একজন নীরব কারিগর। মুক্ত পরিসর, সামনে সবুজ গাছ, ফোয়ারা খুব কম শহরে, এমনকি আমাদের উপমহাদেশের আরও অনেক নামকরা শহরেও খুব একটা পাওয়া যাবে না। সাম্প্র্রতিক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা কিংবা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার অসংগতি নিয়ে প্রচুর খেটেছেন। 

মোবাশ্বের ভাইয়ের চলে যাওয়া আমাদের জন্য বড় ক্ষতি। বিশেষ করে নগর পরিকল্পনা নিয়ে এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। তবে তাঁকে ঢাকাবাসী নিঃসন্দেহে স্মরণ রাখবে। সাবেক মেয়র আনিসুুল হককে যেমন মানুষ ফুটপাত, রাস্তার জন্য স্মরণ করে, মোবাশ্বের হোসেনকে মানুষ স্মরণ করবে ২০০৮ বিধিমালার আলোকে সুন্দর ঢাকার জন্য। এটা সত্য যে তিনি বিধিমালা প্রণয়নের জন্য কোনো তালিকাভুক্ত সদস্য ছিলেন না। কিন্তু মোবাশ্বের ভাই এই পরিকল্পনাকে আলোর মুখ দেখা এবং বাস্তবায়ন করার জন্য সোচ্চার এবং সাহসী ভ‚মিকা পালন করেছেন। বিধিমালাকে সরকারের কাছে, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে গিয়েছেন। মানুষকে সহজভাবে বোঝানোর জন্য তিনি টকশো করেছেন, মিটিং করেছেন, যেকোনো গণভিত্তিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। আপনি গুলশান অ্যাভিনিউর দিকে তাকান আবার একই সঙ্গে কামাল আতাতুর্ক রোডেও তাকান। কামাল আতাতুর্ক রোডেও স্থপতিরাই কাজ করেছেন, ওই রকম চেহারা আসেনি। ওই সময় স্থপতিদের ইচ্ছা থাকলেও সে সুযোগ হয়নি অথচ ২০০৮ সালের বিধিমালা তাঁর জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। স্থপতি শহরের জন্য একটা ব্রিদিং স্পেস তৈরি করে দিয়েছে। দুটো গাছ লাগানোর সুযোগ তৈরি করেছে, পানিটা মাটির নিচে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছেন। এটা দিয়েই কিন্তু ওনাকে আমরা স্মরণ করব।

প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। প্রয়াত আনিসুল হক মেয়র থাকাকালীন প্রতি শুক্রবার গাড়ি নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই এদিক-সেদিক যেতেন। শহরের কোথায় কী হচ্ছে দেখতেন। প্রায়ই তাঁর এ যাত্রায় মোবাশ্বের ভাই সঙ্গী হতেন। আমাকেও কখনো কখনো তিনি ডেকে নিতেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, সেটাও যেমন একটা কারণ, তবে তা ছাপিয়ে তিনি চেয়েছিলেন তাঁর অবর্তমানেও যেন স্থপতিদের ভূমিকা অব্যাহত থাকে। সে জন্য তিনি আমাকে সঙ্গে নিতেন; যেকোনো পরামর্শ বা প্রস্তাবনায় আমাকে সহযোগী করতেন। আমি তখন স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি ছিলাম এবং তিনি সেভাবেই সিটি করপোরেশন এবং মেয়রের কাছে আমাকে উপস্থাপন করতেন। এটা করার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই সম্পর্কটা যেন কেবল ব্যক্তিগত না হয়ে বরং স্থপতি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক হিসেবে ধারাবাহিকতা থাকে। পেশাজীবী এবং সরকারের মধ্যে কমিউনিকেশনটা যেন পরম্পরায় চালু থাকে। এখান থেকে শিক্ষণীয় হচ্ছে, কেবল নিজের বড়ত্বকে প্রদর্শন না করে নতুনদের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব তৈরি করা। ব্যক্তিকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং কমিউনিটি গ্রæপকে উপস্থাপন করা। এভাবে তিনি পুরো স্থপতি সমাজকে রিপ্রেজেন্ট করতেন। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের এই কর্মোদ্যমকে  নিয়েই আমাদের সামনে এগোতে হবে। 

তারুণ্যের সম্ভাবনাকে তিনি উৎসাহিত করতেন

স্থপতি ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ

অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়

সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট

মোবাশে^র ভাই যখন তাঁর নিজ গÐি পেরিয়ে সুধীসমাজে পরিচিত হয়ে উঠেছেন, আমরা তখন নবীন স্থপতি হিসেবে পেশাজগতে প্রবেশ করেছি। সে সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক ভবন এবং প্রশিকা ভবনের সুবাদে স্থপতি মোবাশে^র হোসেন এবং তাঁর অ্যাসো কনস্যালট্যান্টস পরিচিতি অর্জন করেছে। তারপরে পেশাচর্চার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি নির্মাণশিল্পে প্রবেশ করেন। বয়সে আসলে আমাদের চেয়ে বেশ খানিকটা বড় হওয়ার কারণে স্থাপত্য সংযোগ নিয়ে কখনো কাজ করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বরং আমাদের কাছে তাঁর পরিচয় বড় হয়ে ওঠে একজন সমাজসচেতন সংগঠক হিসেবে। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয় আইএবিতে কাজ করতে এসে। স্থপতি শামসুল ওয়ারেসের নেতৃত্বে থাকাকালীন নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করি। তার আগে-পরে মোবাশে^র ভাইও বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন নেতৃত্বসুলভ কর্মকাÐের মধ্য দিয়ে। 

মোবাশে^র ভাইকে আরেকটু কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুবাদে। চতুর্থ বা পঞ্চম বর্ষের ছাত্রদের স্টুডিও প্রজেক্টের জুরি প্রোগামে তাঁকে আমরা আমন্ত্রণ জানাতাম। ভবিষ্যৎ স্থপতিদের কাছে আশার বার্তা পৌঁছানোর মতো একজন হিসেবে তাঁকে আমরা বিবেচনা করতাম। তিনি তাঁর শত ব্যস্ততার মাঝেও অংশ নিতেন। তরুণ স্থপতিদের নিয়ে তাঁর ছিল ব্যাপক আগ্রহ। তাঁর আগ্রহের একটা জায়গা ছিল স্থাপত্য নিয়ে তরুণদের কাজের অভিনবত্ব এবং উদ্ভাবনী শক্তি। স্থাপত্যের ছাত্রদের তিনি বিশেষভাবে উৎসাহিত করতেন দেশের জন্য কিছু করার। তাঁর পেশাগত এবং জীবনধর্মী অভিজ্ঞতার আলোকে কথা বলতেন কীভাবে স্থপতিরা দেশ গড়ার কাজে নিজেদের সংযুক্ত করতে পারেন। আমরা একাডেমিতে মূলত তাত্তি¡ক বিষয় শেখাতাম। স্টুডিও টিচার হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল প্রজেক্টের আর্কিটেকচারাল পটেনশিয়ালস এবং গ্রামার নিয়ে পর্যালোচনা করা। অপর দিকে মোবাশে^র ভাই শেখাতেন কীভাবে তত্ত¡কে বাস্তবতায় পরিণত করতে হয়। নিজের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেন তাদের উৎসাহী করার জন্য। 

স্থপতি হিসেবে মোবাশে^র হোসেনের একটা বড় অর্জন হচ্ছে তিনি স্থপতিসমাজকে দেশ ও জাতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন। আমরা স্থপতিরা প্রায়ই নিজেদের একটা বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলি। চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে এসে কখনো স্বার্থপর হয়ে যাই। নিজেকে নিয়ে ভালো থাকার প্রবণতা থাকে। কিন্তু মোবাশে^র ভাই বৃত্ত ভেঙে সবার জন্য হয়ে গিয়েছেন। নিজের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে সবার জন্য কাজ করেছেন। তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সামনাসামনি যুদ্ধ করেছেন। সে সাহস দৃঢ়তা অব্যাহত ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। পরিণত বয়সে সে দৃঢতাকে কাজে লাগিয়েছেন সমাজ গড়ার কাজে। 

তরুণ স্থপতিদের জন্য তাঁর আরেকটি যোগ্যতা অনুসরণীয় হতে পারে, সেটা হচ্ছে সবার ভাষায় কথা বলার যোগ্যতা, সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা। আমরা স্থপতিরা সমাজের একটা বিশেষায়িত পেশাজীবী। আমাদের কিছু স্পেশাল দক্ষতা আছে সেটা আমরা দাবি করতে পারি। তবে সার্বিকভাবে ভাবতে গেলে আমাদের কাজ কিন্তু মানুষের সঙ্গে। তিনি যে ভাষায় কথা বলতেন, সেটা সাধারণ মানুষের জন্য খুব সহজবোধ্য ছিল। আমরা কিন্তু সহজে সেই কাজটা করতে পারিনি। আমাদের  সুদক্ষ স্থপতিরা তাঁদের কাজ এবং অবদানে বেশ সুপরিচিত হলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক কিন্তু খুব উল্লেখযোগ্য কিছু না। অথচ মোবাশে^র ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁকে সবাই চিনত। তাঁর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর ব্যবহারে তাঁকে পছন্দ করত; সমীহ করত। এটাকে বলা যায়, সফট স্কিল। একটা কাজে সফল হতে হলে হার্ড স্কিলের পাশাপাশি সফট স্কিল থাকতে হয়। স্থাপত্য একটা শিল্প, স্থাপত্য একটা পেশা এবং স্থাপত্য এক অর্থে একটা ব্যবসাও। শুধু ডিজাইন করা এক জিনিস কিন্তু এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় আছে, যা নেগোসিয়েশন করতে হয়। নৈতিকতা বজায় রেখেও বিভিন্ন দাবি আদায় করতে জানতে হয়, অপরকে সন্তুষ্ট বা আশ্বস্ত করে নিজের মূল্য বা সম্মান নিশ্চিত করতে হয়। সুতরাং স্থপতিদের সফট স্কিল ডেভেলপ করা দরকার। আমরা এখন যেমন চিন্তা করছি স্থপতি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে কীভাবে বিশেষ করে তরুণ স্থপতিদের সফট স্কিল বাড়ানো যায়। মোবাশ্বের ভাইয়ের সহজাত সফট স্কিল ছিলেন। এ জন্যই তিনি সব পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে পারতেন। যেকোনো ইস্যুতে মোবাশ্বের ভাইয়ের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণ সে কাজকে সহজ করে দিত। আমার মনে হয়, স্থাপত্য কমিউনিটিতে এ ক্ষেত্রে মোবাশ্বের ভাইয়ের অভাব অনুভূত হবে।

লেখক 

খালিদ মাহমুদ, প্রধান স্থপতি, আর্কিটেক্টস ওয়াল

তাসলিহা মওলা। স্থপতি, নগরবিদ। 

সাক্ষাৎকার: খালিদ মাহমুদ

বিশেষ কৃতজ্ঞতা

স্থপতি আসিফ এম আহসানুল হক

স্থপতি মীর নাইয়ান সাকিব

ছবিসূত্র:

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top