সর্পিল এক ফুটওভারব্রিজ ওন্ডা আটলান্টিকা

শহরের অবকাঠামো উন্নয়নে নানা পরিকল্পনার কথা হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু এমন যদি হয়, সেই অবকাঠামোই হয়ে ওঠে শহরটির সৌন্দর্যের অনন্য এক ল্যান্ডমার্ক, যা একই সঙ্গে পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের জন্য পরিকল্পিত একটি ফুটওভারব্রিজ। ‘ওন্ডা আটলান্টিকা’ এই সেতুটির অনন্যতার কারণ দৃশ্যমান বড় কোনো সাপোর্ট ছাড়াই এক টুকরো কাগজের মতো সর্পিলাকারে শূন্যে ভাসছে বলে মনে হয়। শুনতে অবাক লাগছে? স্পেনের লাস পালমাস দে গ্রান কানারিয়া অঞ্চলের ভিগো শহরে এমনই এক সেতুর বর্ণনা উপস্থাপন করছেন 

স্থপতি তাহিয়া তাবাসসুম

ভাস্কর্যসদৃশ সেতুটিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ওন্ডা আটলান্টিশা’, যা মূলত ক্যান্টিলিভারযুক্ত ইস্পাত ও কংক্রিটের একটি কাঠামো। প্রজেক্টটি সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ায় এর অনুপ্রেরণাও সমুদ্র, যা এর নামের মাঝে বিদ্যমান। ইংরেজিতে এই নামের অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘আটলান্টিক ওয়েভ’ আর বাংলায় ‘আটলান্টিকের ঢেউ’! সেতুটি স্পেনের লাস পালমাস দে গ্রান কানারিয়া, যা স্পেনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের ভিগো শহরে অবস্থিত! স্পেনের এই শহরটি নানা বৈচিত্র্যের পাশাপাশি একাধিক সমুদ্রসৈকত এবং তীরবর্তী রিসোর্টগুলোর জন্য বিখ্যাত। 

সেতুটি ডিজাইন করেন স্থপতি জুয়ান কার্লোস ক্যাবানেলাস। ল্যান্ডমার্কটি ডিজাইন করেছেন স্থপতি জাভিয়ের হাদ্দাদ, রামন চেকা, লুইস গনজালেজ ও কার্লোস ফুয়েন্তের টিম। ২০০২ সালে উদ্বোধনের পর থেকে এটি শহরের অন্যতম একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হয়ে ওঠে। সেতুটির ল্যান্ডিংয়ের দুই পাশে দুটি প্লাজা ভেদ করে নিচের পার্শ্ববর্তী দুই পাশের রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত করে। পারাপারের সময় একনজরে পুরো শহরটি দৃশ্যমান হয়।  

প্রজেক্টটির আরবান কনটেক্সট

লাস পালমাস শহরটির পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে সেখানকার টাউন হল থেকে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার মধ্যে এই ফুটওভারব্রিজটি অন্যতম। শহর কর্তৃপক্ষ একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জাভিয়ের হাদ্দাদ ও রামন চেকার স্থপতি দলের সমন্বয়ে গঠিত দলটির নকশাকে চ‚ড়ান্ত করেন। ফুটওভারব্রিজটি তৈরির উদ্দেশ্য, সানাপু ডক বন্দরের সঙ্গে লাস ক্যান্টেরাস সৈকতকে সংযুক্ত করা। পাশাপাশি স্থানটিকে পর্যটন ও বিনোদনের অংশ হিসেবে গড়ে তোলা। ব্রিজটি লাস পালমাস দে গ্রান ক্যানারিয়ার অপরিহার্য কিছু হটস্পটে ভ্রমণে সুবিধার পাশাপাশি প্রধান পর্যটন আকর্ষণ পোয়েমা দেল মার অ্যাকোয়ারিয়াম এবং আশপাশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও বিনোদনের কেন্দ্রে ঘোরার সুযোগ করে দেয়।

ক্যাপিটাল আর্কিটেকচারের নতুন এ আইকনটি অবকাঠামোগত দিক দিয়ে স্থাপত্য ও প্রকৌশলের একটি আন্তর্জাতিক মানদÐে পরিণত হয়েছে। ব্রিজটি লাস ক্যান্টেরাস সৈকত এবং লা আইসলেটারের মধ্যবর্তী ইথসমাসে (সাগরের মাঝে থাকা ভূমির একটি সংকীর্ণ স্ট্রিপ, যা দুটি বৃহত্তর স্থলভাগকে সংযুক্ত করে এবং দুই পাশের জলের ধারাকে পৃথক করে রাখে) স্থাপন করা হয়েছে। স্থানটিতে কিছুদিন আগ পর্যন্তও জোয়ার-ভাটা হতো। বছরের পর বছর ধরে নগর উন্নয়নের ফলে সমুদ্রের পাশে নানা স্থাপনা এদের দুই পাশকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে এবং সম্প্রতি একটি উচ্চগতিসম্পন্ন হাইওয়ে সরু পথের ইথসমাসকে আরও বিস্তৃত করেছে।

সর্পিল নকশার কারণ 

ওন্ডা আটলান্টিকা ফুটব্রিজ আপাতদৃষ্টিতে নকশা ও অবকাঠামোর এক সৃজনশীল পরিকল্পনা, যা স্থাপত্য আর প্রকৌশলের এক নান্দনিক মিশ্রণ! এর নকশাটি জাহাজ নির্মাণের প্রযুক্তি ও আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউ থেকে অনুপ্রাণিত বলে এর অনন্য বক্রাকার নকশাটির জন্য এর ওপর দিয়ে চলাচল করার সময় সাগরের ওপর জাহাজে ভ্রমণের মতো অনুভূত হয়। এই নকশাটি সাইটের নানা সীমাবদ্ধতার খাতিরে উদ্ভূত হয়েছে। যেমন, স্প্যানের প্রসারণ জয়েন্টগুলোর কাঠামোগত কর্মক্ষমতা সর্বোচ্চ বজায় রাখা, সাইটের আশপাশের গাছগুলোকে বিবেচনায় রেখে ডিজাইন করা, স্বল্প খরচে ও ন্যূনতম পর্যায়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও টেকসই ডিজাইনের মাধ্যমে শহরে একটি পাবলিক প্লেস তৈরি করা- এসবের মধ্যে অন্যতম! প্রাথমিকভাবে সেতুটির স্ট্রাকচার আর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এর সর্পিল আকার দেওয়ার জন্যই এর ডিজাইনে ইস্পাতের ব্যবহার করা হয়।

স্থাপত্য, ডিজাইন ও প্রযুক্তিগত বিবরণ

২৮৩ মিটার লম্বা ফুটওভারব্রিজটি নির্মাণের সময় স্থপতিরা নৌ-প্রকৌশলের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হন। সে অনুযায়ী পুরো সেতুটি একটি ধাতব কাঠামোর ওপর নির্মিত হয়। সেতুটির কাঠামো ইস্পাত এবং কংক্রিট দিয়ে তৈরি এবং এর গঠন দুটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত, যার মধ্যে একটি হলো ডেক আর অন্যটি সাপোর্ট সিস্টেম। ডেকটি মূলত একটি বাঁকা পৃষ্ঠ, যা তরঙ্গ আকারে এর মূল রূপে রূপলাভ করেছে। আর এর সাপোর্ট সিস্টেম হলো একটি ক্রমেই সরু এবং বাঁকা স্তম্ভ, যা ডেকটিকে ধরে রাখার পাশাপাশি এর স্বতন্ত্র পিলার হিসেবে কাজ করে। 

ফুটব্রিজটি দৃশ্যমান কোনো সমর্থন ছাড়াই পরপর ৬৩ মিটার ও ৬ দশমিক ২৪ মিটার প্রস্থের তিনটি দীর্ঘ স্প্যানে পরস্পর সংযুক্ত। কংক্রিট স্প্যানের ওপর ইস্পাতের ধাতব আবরণ দিয়ে স্প্যানগুলো তৈরি, যা পুরো কাঠামোটিকে একটি শক্ত ভিত্তি প্রদান করেছে। সেতুটির ৩টি জায়গায় ভি-আকৃতির প্রোফাইল রয়েছে, যা সেতুটির জন্য পিলার হিসেবে কাজ করে, যা অনেকটা নৌকা বা জাহাজ তৈরি করার সময় ব্যবহৃত ক্রেডলের মতো, যা উপক‚ল বা শুষ্ক জায়গায় জাহাজ বা নৌকাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে।

কাঠামোটি জাহাজ নির্মাণের পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত বলে পাঁজরের মতো প্রতি ৩ দশমিক ২ মিটার পরপর একে অপরের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ মিলিমিটার পুরু স্টিলের প্লেট দ্বারা সংযুক্ত। সেতুর ডেকের অংশটি ১০-১২ মিলিমিটারের ইস্পাত কাঠামোর ১৮টি পৃথক টুকরো, যার প্রতিটির ওজন প্রায় ১৮ টন এবং এতে ব্যবহৃত মোট ইস্পাতের পরিমাণ ১ হাজার ২০০ টন! সেতুর অংশগুলো সেভিলের একটি ইস্পাত মিলে নির্মাণ করা হয়। 

ডেকের পৃষ্ঠ ইস্পাতের আবরণে আচ্ছাদিত বলে এটি পথচারীদের জন্য নিরাপদ এবং চলাচলে বেশ আরামদায়ক। সেতুর দুই পাশ স্টেইনলেস-স্টিলের হাতল দ্বারা সুরক্ষিত, যা এর দৈর্ঘ্য বরাবর বাঁকানো আর এর জন্য নিরাপত্তার পাশাপাশি এটি পথচারীদের ঝুঁকতে এবং আশপাশের ল্যান্ডস্কেপ উপভোগ করতে সাহায্য করে। প্রকল্পটি মোট ১ হাজার ৮০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত, যার মধ্যে রয়েছে তিনটি ওয়াকওয়ে এবং এর অ্যাভেনিদা মারিটিমার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া অংশে এর উচ্চতা সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৫ মিটারে পৌঁছানোর পাশাপাশি এর মেঝের স্তর রাস্তা থেকে থেকে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছে। ফুটব্রিজটি দিয়ে শুধু পথচারী এবং সাইকেল আরোহীরা চলাচল করতে পারেন। অ্যাক্সেসিবিলিটির নির্দেশিকা অনুযায়ী পারাপারের সুবিধার জন্য এর ঢাল রাখা হয়েছে ৬ শতাংশ। প্রকল্পটির নির্মাণকাজে মোট ব্যয় হয়েছে ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন ইউরো আর এর পুরো কাজ সম্পন্ন হতে সময় লেগেছে ৩ বছর। 

এ ছাড়া কংক্রিট আর ইস্পাতের এ কাঠামোটি যেন পরিবেশের ওপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলে, ওজনে হালকা ও টেকসই হয়, সে দিকগুলোও সমান বিবেচনায় রাখা হয়েছে। ইস্পাতের ধাতব ফিনিশ ছাড়াও এতে ৩ স্তরের পেইন্ট করা হয়েছে, যা ক্ষয়কারী সামুদ্রিক পরিবেশের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আলোকসজ্জা। হাতলের পাশে এম্বেড করা হয়েছে এলইডির লাইট প্যানেল আর এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে ১০০ মিটারের সোলার প্যানেল, যা পুরো সেতুতে ব্যবহৃত এলইডির আলো চার্জ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। লাইটগুলো প্রোগ্রামযোগ্য অর্থাৎ বিভিন্ন রং ও প্যাটার্ন সেট করা যায় আর এর মাধ্যমে সেতুটিতে রাতে চমৎকার আলোর প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। 

ওন্ডা আটলান্টিকা ফুটব্রিজ নির্মাণের এই উদ্যোগটি ছিল উন্নত প্রকৌশল এবং নির্মাণকৌশলের মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার প্রমাণ, যা শহরটির প্রগতিশীল চেতনা ও উদ্ভাবনের প্রতি নিজস্ব ভাবনা ও অঙ্গীকারের এক অনুকরণীয় প্রতীক। 

ঃধযরধঃধনধংংঁসঃৎবহধ@মসধরষ.পড়স

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top