শীতের তীব্রতা বাড়ছে। হাড় কাঁপানো শীতে সবচেয়ে বিপাকে পড়ে শিশু ও বৃদ্ধরা। ঘরে ঘরে ঠান্ডাজনিত নানা অসুখ যেন লেগেই থাকে। তাই এ সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখা জরুরি। শীতপ্রধান দেশে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ¦ালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এতে ঝঁক্কিও নেহাত কম নয়। তবে ছোট আকারের একটি বৈদ্যুতিক ডিভাইস ব্যবহার করেই এই সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করা যায়। ঘরের উষ্ণতা বাড়াতে হালের সবচেয়ে সহজলভ্য ও জনপ্রিয় অনুষঙ্গ রুম হিটার। অনুষঙ্গটির কথকতা জানাচ্ছেন রিগ্যান ভূঁইয়া
রুম হিটার-কথন
রুম হিটার একটি গুরুত্বপূর্ণ হোম অ্যাপ্লায়েন্স। এটি বিশেষত একটি তাপ উৎপাদনকারী যন্ত্র, যা ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক। উৎপাদিত তাপ পাখার সাহায্যে পুরো ঘরে ছড়িয়ে দেয় হয় বলেই এ যন্ত্রের নাম রুম হিটার। শীতপ্রধান দেশে এটি একটি নিত্যদিনের অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শীতের তীব্রতা কম হওয়ায় এর ব্যবহার খুব বেশি ছিল না। তবে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে রুম হিটার পাওয়া যায় বলে সম্প্রতি রুম হিটারের চাহিদা বাড়ছে। তবে এ যন্ত্রটির দাম বেশি হওয়ায় এখনো আমাদের দেশে শৌখিন পণ্য হিসেবে দেখা হয়।
রুম হিটার যেভাবে কাজ করে
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের হিটার পাওয়া যায়। যদিও সব হিটার প্রায় একই নীতিতে কাজ করে, তবুও মেকানিজম এবং মডেলের সূ² বৈচিত্র্য রয়েছে। অনেক হিটার গ্যাস, তেল বা অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি দ্বারা চালিত হয়। কিন্তু ছোট হিটারগুলো বিদ্যুতেই চলে। আমরা যখন হিটার চালু করি, তখন যে বিদ্যুৎ প্রবাহ উৎপন্ন হয়, তা নিখ্রম (ঘরপযৎড়সব) তারের উপাদানগুলোকে উত্তপ্ত করে। এই নিখ্রম তারকে হিটিং কয়েল বলা হয়। কয়েলের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সে কারণেই বৈদ্যুতিক হিটারগুলোকে রেজিস্ট্যান্ট হিটিং ইউনিটও বলা হয়।
সাধারণত হিটারের ধরনের ওপরই নির্ভর করে এর কার্যকারিতা। সব হিটারে ফ্যান থাকে না। তাই কার্যপ্রণালি, গঠন ও তাপের উৎস অনুযায়ী হিটারও হয় ভিন্ন। ফ্যানযুক্ত হিটার বাইরের ঠান্ডা বাতাস টেনে উত্তপ্ত কয়েলের মধ্য দিয়ে গরম বাতাস প্রবাহিত করে। সহজ কথায়, রুম হিটার একটি হেয়ার ড্রায়ারের মতো কাজ করে। আমরা জানি, তাপ পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণÑ এ তিন প্রক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। রুম হিটার পরিচলন ও বিকিরণ প্রক্রিয়ায় সারা ঘরের উষ্ণতা বাড়ায়। হিটারে যদি ফ্যান না থাকে তবে সে নিচ থেকে বাতাস হিটিং ইউনিটে প্রবেশ করে বায়ুপ্রবাহ কয়েলের ওপর দিয়ে চালিত হয়ে উত্তপ্ত হয় এবং অবশেষে হিটারের শীর্ষ দিয়ে বেরিয়ে আসে। গরম করার এই প্রক্রিয়াটি রেডিয়েন্ট হিটিং নামে পরিচিত।
প্রকারভেদ
গঠন ও কার্যপ্রণালির ভিত্তিতে রুম হিটারকে প্রধানত দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। সেগুলো হচ্ছে-
কনভেকশন রুম হিটার
রেডিয়েন্ট বা ইনফ্রারেড রুম হিটার
কনভেকন রুম হিটার সাধারণত পরিচলন পদ্ধতিতে তাপ ছড়ায় এবং রেডিয়েন্ট রুম হিটার বিকিরণ পদ্ধতিতে। কার্যকারিতার ভিত্তিতে কনভেকশন ও রেডিয়েন্ট হিটার বিভিন্ন রকম।
কনভেকশন হিটারের প্রকারভেদ ও সুবিধা
ফ্যান বা বেøায়ার হিটার
এ ধরনের রুম হিটারে ফ্যান বা বেøায়ারের সাহায্যে গরম বাতাস ঘরের মধ্যে চালনা করা হয়। ফলে ঘরের ঠান্ডা বাতাস গরম হয়। এই হিটারের যেসব সুবিধা রয়েছে-
অন্যান্য হিটারের তুলনায় দাম কম হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বেশি
পোর্টেবল তাই সহজেই বহন করা যায়
কয়েল হিটারের ভেতরে থাকে বলে ঝুঁকিও অনেক কম
হিটার বন্ধ হওয়ার অনেকক্ষণ পরও ঘরের আবহাওয়া পর্যন্ত গরম থাকে
সিরামিক হিটার
বেøায়ার হিটারের কয়েল তারের কিন্তু সিরামিক হিটারে সিরামিকের কোর থাকে বলেই তাকে সিরামিক হিটার বলা হয়। বেøায়ার হিটারের চেয়ে সিরামিক হিটারে কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। যেমন-
সিরামিক হিটার বাতাসে থাকা অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কম পোড়ায় ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় না
সিরামিকের কোর হওয়ায় ঝুঁকি অনেক কম
তেলচালিত হিটার
শুনতে মনে হতে পারে তেলচালিত হিটারের তাপের উৎস তেল কিংবা তেল পুড়িয়ে তাপ উৎপাদন, বাস্তবে এমন নয়। এটি বিদ্যুতের সাহায্যেই চলে। মূলত বিকিরণ পদ্ধতিতে বাতাসের অণুগুলোকে উত্তপ্ত করার ফলে রুমের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। মেশিনের মেটাল কলামগুলো তেলের মাধ্যমে গরম করা হয় এবং উত্তপ্ত কলামগুলো তাপ ছড়ায়। মেশিনের ভেতরে থাকা তেল গরম করা হয় বৈদ্যুতিক হিটারের মাধ্যমেই। মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলে তেল গরম হয়ে ধাতব কলামগুলোও গরম হয়। রুমের তাপমাত্রা গরম হতে একটু সময় লাগলেও তেলচালিত হিটার সবচেয়ে নিরাপদ। তাই এর দাম তুলনামূলক বেশি। এই হিটারের যেসব সুবিধা রয়েছে-
অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প কোনোটিকেই হ্রাস করে না, এমনকি পোড়ায় না। অন্যান্য হিটারের তাপীয় উপকরণ সরাসরি বাতাস ও জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে থেকে তাপ দেয়, ফলে অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প কমে যায়। তেলচালিত হিটারের কয়েল যেহেতু বাতাসের সংস্পর্শে থাকে না, তাই তা অনেক নিরাপদ
হঠাৎ বন্ধ করে দিলেও তেল যতক্ষণ উষ্ণ থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত রুমে তাপমাত্রা ছড়ায় এ ধরনের হিটার
স্থায়িত্ব অনেক বেশি
রেডিয়েন্ট রুম হিটারের প্রকারভেদ
এটি এমন একধরনের রুম হিটার, যা শুধু বিকিরণ পদ্ধতিতেই ঘরের উষ্ণতা বাড়ায়। আপনি ক্লিয়ার বাল্ব জ্বালিয়ে একধরনের হাতে তৈরি রুম হিটার বানালেন, তবে তা-ই হবে একটি রেডিয়েন্ট রুম হিটার। তিন প্রকার রেডিয়েন্ট রুম হিটার প্রচলিত।
কোয়ার্টজ হিটার: এ হিটারে ব্যবহার করা হয় কোয়ার্টজ টিউব, যা আলো প্রতিফলনের মাধ্যমে তাপ উৎপাদন করে
হ্যালোজেন হিটার: এ হিটারের কয়েল হ্যালোজেন গ্যাসের হওয়ায় উষ্ণ আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে ঘরের উষ্ণতা বাড়ায়
কার্বন হিটার: হিটারে কার্বন কয়েল থেকে তাপ উৎপাদিত হয়
রুম হিটারের ক্ষতিকর যত দিক
রুম হিটারের কী কী ক্ষতিকর দিক আছে, তা একবারও ভাবি না আমরা। দৃশ্যত যা আরামদায়ক তার পেছনে কিছু ক্ষতিকর বিষয়ও থাকে। এসিতে কিংবা রুম হিটারের সাহায্যে ঠান্ডা বা গরম তাপমাত্রা গ্রহণ করি, তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই করা হয়। যখন স্বাভাবিক পরিবেশে প্রবেশ করি, তখন বিপরীত তাপমাত্রা অনুভব করি। ঘন ঘন তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে। ইমিউনিটি কমে গেল সহজেই যেকোনো রোগ-ব্যাধি আমাদের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। তাই শীতে রুম হিটার ব্যবহারের আগে কী কী সমস্যা হতে পারে তাও জানা দরকার। কোন ধরনের হিটার আপনার জন্য প্রয়োজন, তা বুঝে-শুনেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রুম হিটারের উল্লেখযোগ্য অসুবিধাগুলো হলো:
রুম হিটার ঘরের বাতাসের আর্দ্রতা শুষে নেয় এবং অক্সিজেন ধ্বংস করায় উভয়ের মাত্রাই কমতে থাকে, যা শরীরের জন্য হুমকি
হিটারের গরম বাতাস আমাদের ত্বককে রুক্ষ ও শুষ্ক করে দেয়
কনভেকশন হিটারের নিয়মিত ব্যবহার অসুস্থতার বড় কারণ হতে পারে
নিয়মিত রুম হিটার ব্যবহারের ফলে অনিদ্রা, মাথাব্যথা এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে
হিটার থেকে নির্গত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বাতাসের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশ করে সাধারণ অসুস্থতাসহ যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে
অ্যাজমা, অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে রুম হিটার ব্যবহারের ফলে তা মাত্রাতিরিক্ত বাড়তে পারে
হিটারের খুব কাছাকাছি বসলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে
সাইনাস ও ব্রঙ্কাইটিস আক্রান্তদের রুম হিটার ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ
গ্যাস হিটার ব্যবহারে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন না করলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে
বাসাবাড়িতে নিয়মিত রুম হিটার ব্যবহারের ফলে শিশুদের অ্যাজমা ও অ্যালার্জির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে
রুম হিটার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কারণ রুম হিটার থেকে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। আমরা যদি রুম হিটার চালিয়ে ঘুমিয়ে যাই আর ঘরে যদি বাইরের বাতাস চলাচল করতে না পারে, তবে কার্বন মনোক্সাইড আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে মৃত্যুর কারণ হতে পারে
রুম হিটারের সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। তবে কি রুম হিটার ব্যবহার করা যাবে না? অবশ্যই যাবে। রুম হিটার ব্যবহারে খুব বেশি সচেতন হতে হবে। সচেতনভাবে রুম হিটার ব্যবহার করলে সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে। সে ক্ষেত্রে যেসব সতর্কতা অবলম্বন জরুরি-
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যাজমা ও অ্যালার্জি আক্রান্ত ব্যক্তিরা রুম হিটার ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই তেলচালিত হিটার ব্যবহার উচিত।
সাইনাস ও ব্রঙ্কাইটিসের সমস্যা থাকলে হিউমিডিফায়ারের ব্যবহার সবচেয়ে ভালো
সাধারণ হিটার ব্যবহার করার সময় ত্বকের সুরক্ষায় ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন
কখনো ভুল করেও কম্বলের নিচে হিটার রাখবেন না, এতে অগ্নিকাÐের ঘটনাও ঘটতে পারে
গলার আর্দ্রতা বজায় রাখতে কিছুক্ষণ পরপর চা, কফি, স্যুপ খান
হিটারের তাপমাত্রা কম রাখার চেষ্টা করুন
একটানা হিটার চালিয়ে না রেখে বিরতি নিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা ভালো
নিয়মিত রুম হিটার ব্যবহারের ফলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিডনি ও ত্বক। তাই নিয়মিত রুম হিটার ব্যবহারকারীদের বেশি বেশি পানি পান করতে হবে।
দরদাম
বাজারে বিভিন্ন দাম ও ব্র্যান্ডের রুম হিটার পাওয়া যায়। সাধারণ মানের ছোট আয়তনের হিটার ৭০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। তবে উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যের দাম ৭ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে পাবেন। এগুলোতে সেন্সর ও রিমোর্ট কন্ট্রোলার থাকে। এ ছাড়া বাজারে প্রচলিত কিছু রুম হিটারের চলতি মূল্য তুলে ধরা হলো-
ব্র্যান্ড
ধরন
ক্ষমতা
(ওয়াট)
দাম (টাকা)
নোভা পোর্টেবল হিটার
ইলেকট্রিক হিটার
৮০০
১,৪৮৯
নোভা ঘঐ-১২০৬
ইলেকট্রিক হিটার
২,০০০
১,৭৫০
লাক্সেল ৯ ঋরহ ঙরষ জধফরধঃড়ৎ
অয়েল ফিল্ড
১,৫০০
১৬,২০০
মিয়াকো চঞঈ১৫৮ং
ইলেকট্রিক হিটার
২,০০০
৩,২০০
নোভা
ইলেকট্রিক হিটার
২,০০০
১,৫৯০
ওয়ানডার মিনি পোর্টেবল হিটার
ইলেকট্রিক হিটার
৪০০
১,৩৯৯
ওয়ালটন ডজঐ-চঞঈ০০১
ইলেকট্রিক হিটার
৭৫০-১,৫০০
২,৬০০
ওয়ালটন ডজঐ-চঞঈ৩০২ড
ইলেকট্রিক হিটার
১,০০০-২,০০০
৫,১০০
ভিশন
ইলেকট্রিক হিটার
১,০০০-২,০০০
১,৫৮০
ভিশন জধফরধঃড়ৎ
ইলেকট্রিক হিটার
২,০০০
৩,৯৫০
যেখানে পাবেন
দেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস শোরুমগুলোতে পাবেন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রুম হিটার। এ ছাড়া ভিশন, ওয়ালটন ও অন্যান্য ব্র্যান্ড শপগুলো থেকেও কিনতে পারেন। এ ছাড়া দারাজ, অথবা ডট কম, বিডিস্টলসহ বিভিন্ন অনলাইনে অর্ডার করেও কিনতে পারেন।
ৎরমধহনযঁরুধহ৪৩২@মসধরষ.পড়স
তথ্যসূত্র:
এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, জাগোনিউজ, যবধষঃযংযড়ঃং.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৪৯ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৩