পৃথিবীতে এমন অনেক প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন আছে, যা কখনো কখনো আমাদের আশ্চর্যও করে। অনেক রহস্যময় স্থাপত্য নিদর্শন আছে, যার বাস্তব সত্য উদ্্ঘাটনও হয়নি এখনো। তবুও কালের সাক্ষী হয়ে এসব স্থাপনা ইতিহাসকে আমাদের চোখে জীবন্ত করে তোলে। শেল গ্রোটো এমনই একটি নিদর্শন। ঝিনুকের গুহাখ্যাত যুক্তরাজ্যের এক অনন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘শেল গ্রোটো’। এটি একটি ভূগর্ভস্থ গিরিপথ। যুক্তরাজ্যের কেন্টের মার্গেটে এই নন্দিত অলংকারিক প্যাসেজওয়েটি অবস্থিত।
আয়তনে গিরিপথটি প্রায় ২০০০ বর্গফুট বা ১৯২ বর্গমিটার। এর পুরোটি বিভিন্ন রকম শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি মোজাইক দিয়ে আবৃত। পুরো এই প্যাসেজওয়েটি নির্মাণে প্রায় ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ঝিনুক ব্যবহার করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, মার্গেটের শেল গ্রোটো ১৮৩৫ সালে প্রথম আবিষ্কার করা হয়। নিশ্চিত না হওয়ায় এর বয়স ও উদ্দেশ্য আজও পর্যন্ত মানুষের কাছে রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। এটি ছাড়াও যুক্তরাজ্যে মোট ২০০টি গ্রোটো রয়েছে। বর্তমানে মার্গেট গ্রোটো যুক্তরাজ্যের একটি প্রথম সারির স্থাপনার অন্তর্ভুক্ত এবং সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
শেল গ্রোটোর ডিজাইন ও কারুকার্য
শেল গ্রোটোতে প্রবেশের আগে একটি রুমের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, যাকে অলটার চেম্বার বলা হয়। ১৫-২০ ফুটের এই চেম্বার পার হলেই শুরু হয় শেল গ্রোটোর সুড়ঙ্গ। শেল গ্রোটোর মূল গিরিপথের উচ্চতা প্রায় ৮ ফুট এবং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ ফুট। শেল গ্রোটোতে প্রবেশের পথটি খুব বেশি মসৃণ নয়। পথের শুরুটা দেখতে পুরোনো ভাঙা প্রাচীরের মতো মনে হলেও খাদে নামলেই চোখ কপালে উঠবে। দেয়াল এবং ছাদজুড়ে শুধুই ঝিনুক আর ঝিনুক। বাহারি রকমের ঝিনুক। কোথাও ছোট, কোথাও মাঝারি, কোথাও রয়েছে শামুকেরও টেক্সার। সর্পিলাকার শুরুর খাদটি শেষ হয়েছে একটি খিলানযুক্ত দরজার পাশে। এ পর্যন্ত দেয়াল এবং ছাদের কারুকার্য এক মোহনীয় আবহে তৈরি, যা অত্যন্ত যতœসহকারে ডিজাইন করা হয়েছে।
খিলান পেরিয়ে সামনে গেলে একজন দর্শনার্থী একটি বৃত্তাকার কলামের মধ্যে প্রবেশ করবে, যা ওপরে গম্বুজের মতো উঠে গেছে। এই সুড়ঙ্গ আকৃতির কলামের ভেতর দিয়ে ওপর থেকে সূর্যের আলো ভেতরে প্রবেশ করে ভেতরের পরিবেশকে আরও মোহনীয় করে তোলে। এই কলামটি শেল গ্রোটোর কেন্দ্রস্থল। এর দেয়ালেও রয়েছে অসংখ্য ঝিনুকের মোজাইক। অন্ধকার সুরঙ্গে তীক্ষè আলোর রশ্মি গিরিপথের দেয়ালে আলোর ঝলকানি তৈরি করে। ঝিনুক থেকে সৃষ্ট প্রতিবিম্ব আলোর তীব্রতার ভিত্তিতে আলোর নাচন তৈরি করে, যা না দেখে বোঝা প্রায় অসম্ভব।
শেল গ্রাটো দুটি প্রধান চেম্বার নিয়ে গঠিত, প্রথমটি একটি গম্বুজযুক্ত সিলিংসহ একটি বৃত্তাকার চেম্বার এবং দ্বিতীয়টি একটি আয়তক্ষেত্রাকার প্যাসেজ, যা বৃত্তাকার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। দেয়াল, ছাদ, এমনকি গ্রোটোর মধ্যে বেদির মতো কাঠামোগুলো বিভিন্ন ধরনের ঝিনুকের খোলস দ্বারা আবৃত। নকশাগুলোতে প্রধানত কোকল (ঈড়পশষব), হুইল্ক (ডযবষশ), ঝিনুক (গঁংংবষ) এবং ঝিনুকের খোলস (ঙুংঃবৎ ঝযবষষং) দিয়ে তৈরি। শেলগুলো জটিল জ্যামিতিক এবং পুষ্পশোভিত প্যাটার্নে সাজানো হয়েছে। নকশায় তারকা, ফুল, হৃদয় এবং আরও অনেক কিছুর প্রতিকৃতি তৈরি করা হয় শুধু সামুদ্রিক ঝিনুক দিয়েই।
কেন নির্মাণ করা হয়েছিল শেল গ্রোটো
শেল গ্রোটো একটি অনন্য এবং রহস্যময় ভূগর্ভস্থ কাঠামো, যা সম্পূর্ণরূপে সামুদ্রিক ঝিনুক (ঝবধ ঝযবষষ) দিয়ে সজ্জিত। ধারণা করা হয়, এটি ১৮৩৫ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে এর সঠিক উৎস এবং উদ্দেশ্যটি জল্পনা ও বিতর্কের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। শেল গ্রোটো কেন নির্মাণ করা হয়েছিল, এ ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে জনশ্রæতি অনুযায়ী কেউ কেউ মনে করেন, মার্গেটের শেল গ্রোটো আসলে ১৮ বা ১৯ শতকের কোনো এক ধনী ব্যক্তির বোকামির ফল। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটি তৎকালীন কোনো ক্যালেন্ডার, যা সমসাময়িক জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল। কেউ মনে করেন শ্রমিকেরা অবসর থাকলে শখের বশে অনেক কিছুই করেন, এটি এমনই একটি শিল্পকর্ম।
কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক অনুশীলনের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। জটিল ঝিনুকসজ্জা প্রকৃতির উপাদানের প্রতীক বা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ধারণ করে। এ রকম বিশ^াস স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ছিল, তবে এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। আরেকটি তত্ত¡ হলো, শেল গ্রোটো লোকশিল্পের একটি রূপ বা একটি আলংকারিক কাঠামো হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। সম্ভবত এটি দর্শকদের বিনোদন এবং শৈল্পিক সৃজনশীলতা প্রদর্শনের জন্য একটি অনন্য আকর্ষণ হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছিল। আরও একটি অনুমানমূলক তত্ত¡ হলো, গ্রোটো গোপন আচার-অনুষ্ঠান বা কাল্ট বা গোপন সমাজের সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ, এর গোপন প্রকৃতি এবং শেল অলংকরণের মধ্যে যে নিদর্শনের ছাপ পাওয়া যায়, তা অনেকটাই রহস্যময় প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শেল গ্রোটো তার রহস্যময় প্রকৃতি এবং জটিল শেল ডিজাইনের কারণে একটি জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। এটা সম্ভব যে এটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন।
গ্রোটোর গ্রহণযোগ্যতা ও স্থাপত্যশৈলী
মার্গেটের শেল গ্রোটো অনেক আগে আবিষ্কৃত হলেও ২০০৭ সালের পর তা কিছুটা স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৭ সালে রোমের প্যালাটাইন পাহাড়ের নিচে একটি গম্বুজযুক্ত গুহা আবিষ্কারের পর থেকে মার্গেটের আয়তক্ষেত্রাকার চেম্বারসহ গোটা গ্রোটোর স্থাপত্য নিদর্শনকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেওয়া হয়েছে। প্রথম সহস্রাব্দ ইঈঊ-এর দ্বিতীয়ার্ধে এ স্থাপনাটি ফিনিশিয়ানরা তৈরি করেছিল। ফিনিশিয়ানদের নির্মিত গুহার খিলানগুলোতে গথিক শৈলীর ছাপ পাওয়া যায়, যা ১২ শতকের সাক্ষ্য দেয়।
স্থাপত্যের ক্ষেত্রে প্রাগের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও একই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সময় ছিল গথিক যুগ। গথিক ক্যাথেড্রালগুলো উচ্চতায় রোমানেস্ক বিল্ডিং ছাপিয়ে অনেক উঁচু পর্যন্ত যায়। গথিক যুগ বলতে বর্তমান চেক রিপাবলিকে (পূর্ববর্তী বোহেমিয়া, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল কিংডম অব বোহেমিয়া এবং মারগ্রাভিএত অব বোহেমিয়া) মধ্যযুগে বহুল প্রচলিত একটি স্থাপত্য যুগকে বোঝায়। গথিক স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এর ভবনগুলোর তীক্ষè চূড়া এবং ঝুলন্ত বাটরেস। এ ছাড়া আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল- দÐাকার ভল্ট, যাতে থাকত তীক্ষè চূড়াযুক্ত আর্চ। আর্চগুলো জনপ্রিয় ছিল। কারণ এগুলো ছিল হালকা এবং রোমানেস্ক স্টাইলের তুলনায় বেশ বৈচিত্র্যময় ও মজবুত। বেশির ভাগ স্থাপত্যই নির্মাণ হতো পাথর দিয়ে, যা ছিল মূলত স্যান্ডস্টোন।
এ গথিক স্টাইল চেকভূমিতে প্রথম উদ্ভব হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এবং এটি বেশ সমাদৃত হয়। সেইন্ট অ্যাগনেস অব বোহেমিয়া কনভেন্ট ছিল সর্বপ্রথম আর্লি গথিক কমপ্লেক্স, যা নির্মিত হয় ১২৩৩ থেকে ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে গথিক স্টাইলে কিছু পরিবর্তন আসে।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা না থাকলেও পর্যটকের বিনোদন, অভিজ্ঞতা অর্জন এবং ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে শেল গ্রোটো। শিকড়ের অনুসন্ধান হয়তো আরও শত শত বছর চলবে, তবুও শেল গ্রোটোর মায়াময় এমন নন্দিত শৈল্পিক নিদর্শন এমনই জীবন্ত থাকবে পর্যটন ও নির্মাণশিল্পে।
রিগ্যান ভূঁইয়া
ৎরমধহনযঁরুধহ৪৩২@মসধরষ.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৭ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০২৩