ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রাজধানী ঢাকা!

সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে শুধু তুরস্কেই ৬ হাজারের বেশি ইমারত ও স্থাপনা মুহূর্তে‍ই ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মাত্র ৪০ সেকেন্ডের স্থায়ী এই ভূমিকম্পনে বাদ যায়নি বিমানবন্দর ও অন‍্যান‍্য অবকাঠামোও। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই এলাকার মাটির নিচে থাকা অ‍্যারাবিয়ান প্লেটটি উত্তর দিকে সরে গিয়ে আনাতোলিয়ান প্লেটে ধাক্কা দিলে এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের তৈরি হয়। এর ফলে তুরস্ক ও সিরিয়ায় অসংখ‍্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে, কয়েক লাখ মানুষ আহত এবং গৃহহীন হয়েছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র/উৎসস্থল ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায়। ওই দিন এবং এরপর আরও অনেকবার প্রায় সমগ্র তুরস্ক ও সিরিয়া এবং আশপাশের অনেক দেশে এমনকি সুদূর কানাডা-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকায়ও এই ভূকম্পনের প্রভাবে মৃদু ভূকম্পন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ওই ভূমিকম্পের পর দেশ-বিদেশের সর্বত্র এর সবকিছু নিয়ে প্রচÐ উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে!

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস খুবই জটিল! এমন কোনো যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি, যার মাধ‍্যমে ভূমিকম্পনের পূর্বাভাস নির্ধারণ করা যায়! তবে মানুষের শাশ্বত বিশ্বাস, ভূকম্পনের আগমুহূর্তে পাখির কিচিরমিচির বা কুকুরের চিৎকার করা একধরনের পূর্বাভাস!! এবার তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পের আগেও নাকি সেখানে তীব্রভাবে পাখির কিচিরমিচির ও কুকুরের চিৎকার শোনা গিয়েছিল! যাক, সচরাচর ভূমিকম্পনের তীব্রতা নির্ধারণ করা হয় রিখটার স্কেলে সিসমোগ্রাফের মাধ‍্যমে। বিশ্ব আর্থ অবজারবেটরি সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান, বার্মা ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত এবং এই কারণেই ভূগর্ভস্থ এসব টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের মাধ‍্যমে এই অঞ্চলে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূকম্পন হতেও পারে!!

ভূমিকম্পের প্রধান বিবেচ‍্য বিষয় হলো, এর কেন্দ্র বা উৎপত্তিস্থল। বাংলাদেশে স্পষ্টতভাবে ভূমিকম্পের কোনো উৎপত্তিস্থল আছে কি না তা জানা নেই! তবে নদীমাতৃক ও বঙ্গোপসাগর লাগোয়া, পাহাড়-পর্বত ও হাওর-বাওড়ের এই দেশে ভূগর্ভে নদী/জলাশয়/পাহাড়কেন্দ্রিক অনেক ফাটল বা চ‍্যুতির (ফল্ট লাইনের) প্রাক্্-ঐতিহাসিক লক্ষণ আছে! যেমন ঢাকার অদূরে ‘ভালুকা-মধুপুরে’ এবং সিলেটের অদূরে ‘ডাউকি’ ফল্ট লাইন রয়েছে, যদিও বহু বছর ধরে এই ফল্ট লাইনগুলো সক্রিয় না নিস্ক্রিয় তা অজ্ঞাত!! আবার বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ যেমন মিয়ানমার ও নেপাল; ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসাম এবং ‘সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত আগরতলা, মেঘালয়, নাগাল‍্যান্ড, মিজোরামের পাশে অবস্থিত সিলেট-ঢাকা ও চট্টগ্রাম তো শাশ্বত আমল থেকেই ভূমিকম্পনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত!

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের এক গবেষণায় প্রকাশ, প্রাক্্-ঐতিহাসিক যুগ থেকে উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে এ দেশের অনেক স্থানে বিভিন্ন মাত্রায় ভূমিকম্প হয়ে আসছে! সে যুগে ঢাকা ও এর আশপাশে অসংখ‍্যবার ভূমিকম্প হয়েছে এবং অনেক মানুষও মারা গেছে। ১৮২২ সাল এক ভয়াবহ ভূমিকম্পনে ঢাকায় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তবে সেই সময় ঢাকায় এত মানুষ ও ঘরবাড়ি ছিল না! এরপর ১৮৮৫ সালে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার এবং ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার আরেক শক্তিশালী ভূমিকম্পে (যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে) ঢাকার প্রায় ভবন/দালানকোঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন ঢাকায় ১০০ মতো পাকা ভবন এবং ৯০ হাজারের মতো জনসংখ‍্যা ছিল। ওই ভূমিকম্পে আহসান মঞ্জিলসহ পুরান ঢাকায় আরও অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর ১৯১৮ সালেও ঢাকা এবং এর আশপাশে আরেকটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল।

আসলে এভাবে বিশ্বের অনেক দেশেই প্রাক্্-আমল থেকে বিভিন্ন মাত্রায় ভূমিকম্পন হয়ে চলেছে এবং জানমালেরও ব‍্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এ জন‍্য অনেক দেশেই ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন‍্য নিজ নিজ ঊধৎঃযয়ঁধশব ইঁরষফরহম ঈড়ফব বা বিশেষ বিধিবিধান অনুসরণে ঘরবাড়ি/ইমারত ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এভাবে প্রায় ভূমিকম্পনভুক্ত দেশে বিল্ডিং কোড অনুসরণে এখন সুউচ্চ বহুতল ভবন ও অবকাঠামো নির্মিত হয়। তবে অনেক দেশে- যেমন অতিমাত্রায় ভূকম্পনভুক্ত দেশ জাপানে সাধারণ মানুষজনের প্রায় ঘরবাড়িই এখনো কাঠ-বাঁশ দিয়ে হালকাভাবে তৈরি, যাতে ভূমিকম্পনে জানমালের তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হয়। কিন্তু ইদানীং অনেক দেশে এসব নিষেধাজ্ঞা বা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই ভূকম্পনভুক্ত এলাকায়ও উঁচু ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে, যা ঘটেছে তুরস্ক ও সিরিয়ায়, এমনকি আমাদের দেশেও!!

ভূমিকম্প মোকাবিলায় মানুষের পক্ষে তেমন কিছু করণীয় না থাকলেও ভূমিকম্পনশীল ভবন নির্মাণ করতে পারলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমানো সম্ভব। ভূতাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সিলেট থেকে পার্বত‍্য চট্টগ্রাম ও এ অঞ্চলের মাটির নিচে কয়েকটি সাব-প্লেট থাকার কারণে এখানে ভূমিকম্পের উঁচু ঝুঁকি রয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবে ভূকম্পনের নিয়মানুসারে বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম এবং এর প্রভাবিত ঢাকায়ও প্রায়ই নি¤œমাত্রায় ভূকম্পন হয়ে চলেছে, যার বেশির ভাগই আমরা অনুভব করি না! এই তো গত বছরের শেষ দিকেই (সেপ্টেম্বরে) ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পন হয়েছে, যা হয়তো সবার নজরে আসেনি। কারণ এর উৎপত্তিস্থল ছিল অনেক দূরে এবং এ জন‍্য তেমন ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি! তবে কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে আরেক ভূমিকম্পে হামজারবাগ এলাকার ছয়তলা একটি ভবন ধসে গিয়েছিল এবং ঢাকায়ও অনেক ভবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে আশি-নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় যখন ঘন ঘন মৃদু ভূমিকম্পন হচ্ছিল, তখন কৃষি প্রকে‍ৗশল বিশেষজ্ঞ ড. আজহারুল ইসলামের (সাবেক চেয়ারম‍্যান ঢাকা ওয়াসা ও বিএডিসি) কাছ থেকে জেনেছি, নগরীর উত্তর-পশ্চিমে সাভার থেকে তুরাগ নদী হয়ে উত্তরা-কুর্মিটোলা বিমানবন্দর-খিলক্ষেত-বসুন্ধরা এলাকা ও পূর্বাচল নতুন শহর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব দিক পর্যন্ত বিস্তৃত নিচু এলাকা ঐতিহাসিকভাবে ফল্ট লাইনের আওতাভুক্ত ছিল। একইভাবে ঢাকার দক্ষিণ দিকে কেরানীগঞ্জ-বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে পোস্তগোলা-ডিঅ্যান্ডডি (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রাঙ্গেল) এলাকা ও শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাও ওই ফল্ট লাইনের অংশ! তাঁর ভাষ্যমতে, ‘যদি কখনো ঢাকায় বড় বা মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হয়, তাহলে উত্তরে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর, বিমানবন্দর সড়ক এবং দক্ষিণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোড বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে!!’ অথচ এর মধে‍্য এসব এলাকা বিভিন্নভাবে ভরাট করে সেখানে ইতিমধ্যে নতুন নতুন অনেক উঁচু স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। অথচ ঢাকার আগেকার বিভিন্ন ভূতাত্তি¡ক প্রতিবেদন এবং ১৯৫৯ সালে প্রণীত ঢাকার প্রথম মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সে সময় উল্লেখিত এসব এলাকায় কোনো রকম উন্নয়ন না করা তথা ইমারত বা অন‍্যান‍্য অবকাঠামোগত নির্মাণে একধরনের নিষেধাজ্ঞা বা বিধিনিষেধ ছিল, যা পরবর্তী সময়ে আর বহাল থাকেনি!!

দৈনিক প্রথম আলোর সম্প্রতি এক রিপোর্টে জানা যায়, দেশের অভ‍্যন্তরে এ রকম মোট ১৩টি এলাকা রয়েছে, যা মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম/পার্বত‍্য চট্টগ্রামের আশপাশে অর্থাৎ ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। যদি এসব এলাকায় কখনো ৭-৮ মাত্রায় ভূমিকম্পন হয়, তাহলে ঢাকা তথা ওইসব এলাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘাঁর আশঙ্কা রয়েছে। বাস্তবে বিশ্বব‍্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও বিগত কয়েক বছর ধরেই ভূকম্পন ও সুনামির মাত্রা বেড়ে গেছে। যেমন, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে দ্বীপদেশ হাইতি এক শক্তিশালী (৭ দশমিক ২ মাত্রায়) ভূকম্পনে কেঁপে ওঠে এবং এতে কয়েক শ মানুষের মৃত‍্যুসহ দেশটির উল্লেখযোগ‍্য অংশই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এর আগে ২০১০ সালে হাইতিতে আরেক ভয়াবহ ভূমিকম্পে সোয়া তিন লাখের মতো মানুষ মারা যায়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায় ৭ দশমিক ৫  মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ মারা যায়। এর আগে নেপালে ২০১৫ সালের এপ্রিলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার আরেক ভূমিকম্পনে প্রায় ১০ হাজার মানুষ মারা যায় এবং এতে নেপালের অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনাও চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। ২০১৩ ও ২০০৫ সালে পাকিস্তানে ৭ দশমিক ৭ ও ৭ দশমিক ৬ মাত্রার দুটি ভূকম্পনে সেখানে তথা আফগানিস্তান এমনকি পাশের ইরানেও অনেক জানমালের ক্ষতিসাধন হয়। 

এর আগে ২০১১ সালের মার্চ মাসে জাপানে ৯ মাত্রার এক ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রায় ২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যায় এবং ওই ভূমিকম্পে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ‍্যুৎকেন্দ্রেও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে, যেটি ছিল ১৯৮৬ সালে রাশিয়ার চেরনোবিলের পর সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক বিপর্যয়ের ঘটনা। তবে এটি উল্লেখযোগ‍্য যে বর্তমানে জাপানে মাঝারি আকারের ভূমিকম্পেও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় না। কারণ সেখানে প্রায় সব ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ভূকম্পনশীল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে নির্মিত। জাপানের ওই ভূমিকম্পনের প্রভাব প‍্যাসিফিক মহাসাগর পেরিয়ে আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে লস অ্যাঞ্জেলেস, ক‍্যালিফোর্নিয়া/ সানফ্রান্সিসকো পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অন‍্যদিকে, এর আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালের মে মাসে চীনে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে সেখানে দুর্বলভাবে ইমারত নির্মাণের কারণে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল।

এখানে উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশও অচিরে পারমাণবিক বিদ‍্যুৎ উৎপাদনের দেশে পরিণত হতে চলেছে। ভূমিকম্প ছাড়াও এতে কখনো কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে (যেমন রানা প্লাজাধস), কীভাবে তা থেকে রক্ষা পাওয়া ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালিত হবে, তা স্পষ্ট নয়! কারণ, এক রানা প্লাজাধসের পর সেনাবাহিনী নিয়োগের পরও প্রায় এক মাস মতো সময় লেগেছিল উদ্ধারকাজ শেষ করতে। যদি কখনো এখানে তুরস্ক ও সিরিয়ার মতো ভূমিকম্প হয় এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি/ইমারত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তো সতি‍্য এখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হবে! কারণ ঢাকা ইতিমধ্যে একটি অত‍্যাধিক জনবহুল, ঘিঞ্জি ও একটি অচল এলাকা হিসেবে পরিণত হয়েছে। যুগে যুগে এই শহরের প্রায় সব খাল-জলাভূমি ভরাট করে সেখানে ভরাটকৃত বা অনুন্নত জমিতে (নরম ও কাদা/বালুমাটির ওপর) বহুতল ভবন নির্মাণের প্রবণতা খুবই বেড়ে গেছে! এতে সংগত কারণে শহর এলাকায় পানির (অ্যাকুইফার লেভেল) উচ্চতাও অনেক নিচে নেমে গেছে, যার কারণে এখন ঢাকায় মরুময়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরিবেশদূষণসহ আরও নানা সমস‍্যার সৃষ্টি হয়েছে।

এখানে উল্লেখ‍্য, ভূমিকম্পে মানুষের মৃত‍্যুর ৯০ শতাংশই হয় ইমারত ধসের মাধ‍্যমে! অথচ দেশে ইমারত নির্মাণের জন‍্য আইন, বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রেই এগুলোর প্রয়োগ আছে, অনুসরিত হয় বা হচ্ছে। ১৯৫১-৫২ সাল থেকেই দেশে ইমারত নির্মাণ আইন আছে, বিধিমালা আছে এবং ১৯৯৩ সাল থেকে ন‍্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) আছে, কিন্তু কখনো এই আইন, বিধিমালা/কোড অনুসরণের জন‍্য আলাদা করে কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়নি। এমনকি রানা প্লাজাধসের পর মহামান‍্য উচ্চ আদালত থেকে এতদ্্বিষয়ে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়ার পরও অদ‍্যাবধি কোড এনফোর্সমেন্ট অথরিটিও গঠিত হয়নি। এই অবস্থায় ঢাকার নগর পরিকল্পনাকারী সংস্থা রাজউকের ওপরই এই দায়িত্ব অর্পিত হয়ে আছে, কিন্তু এই বিশাল জনবহুল নগরীতে পরিকল্পনা মোতাবেক ও ঠিকমতো ইমারত নির্মিত হচ্ছে কি না তা দেখার জন‍্য রাজউকে তেমন কোনো জনবল বা সিস্টেম নেই। ফলে রাজউক ঢাকায় শুধু নকশা অনুমোদন করেই ক্ষান্ত, এমনকি অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ঘরবাড়ি বা ইমারত নির্মিত হচ্ছে কি না তা দেখার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষ বা অদক্ষ জনবল নেই!

অপর দিকে নগরীর আশপাশের সব নিচুভূমি ও জলাশয় এলাকায় বালু ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে বা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভূমি উন্নয়নের কারণে সেখানে খরয়ঁবভধপঃরড়হ (ভূমি তরলায়িত হওয়া) এর সম্ভাবনাও রয়েছে। আর এসব প্রায় এলাকায় প্রায় মানুষজনই রাজউক থেকে ভূমি ব‍্যবহার ছাড়পত্র (ষধহফ ঁংব পষবধৎধহপব) গ্রহণ ব‍্যতিরেখে এবং নকশা অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই স্থানে স্থানে অনেকেই বহুতল ইমারত নির্মাণ করে চলেছে। এভাবে দিনে দিনে ঢাকা মহানগরী এখন একটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। দেশের গৃহ গবেষণা অধিদপ্তর এনবিআরআইয়র মতে ঢাকায় ৫৫% ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। অর্থাৎ যদি কখনো ঢাকা বা এর আশপাশে তুরস্ক-সিরিয়ার মতো ভূমিকম্পন হয়, তাহলে পুরো নগরীই প্রায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে!

বাস্তবে কোনো এলাকায় ভূমিকম্পনের পর এর আফটারশকসই হলো অত‍্যন্ত অধিক পরিমাণে ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন তুরস্ক-সিরিয়ায় এবারের ভূমিকম্পনের পর সেখানে ওই দিন ২০-২৫ বার আফটারশকস হয়েছিল। ঢাকা ও এর আশপাশে বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্পনোত্তর নগরীতে নিয়ম মেনে স্থপতি-প্রকৌশলীদের তত্ত¡াবধানে ঘরবাড়ি ও বহুতল ইমারত নির্মাণ করা এবং ভবনগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও অকুপেনসি সার্টিফিকেটস গ্রহণ ও রিনিউকরণের ব‍্যাপারে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে, বিধিবিধানও প্রণীত হয়েছে এবং বিভিন্ন সময় অনেক ধরনের পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কখনো এসবের কোনোটিরই কাক্স্ক্ষিত বাস্তবায়ন হয়নি। যেমন, ভারতের গুজরাটের ‘বুজ’-এ ভূমিকম্পনে জানমালের বিশাল ক্ষয়ক্ষতির পর ঢাকায় সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের মাধ‍্যমে নগরীর বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক কনটিনজেনসি প্ল্যানস প্রণয়ন করা হয়েছিল, কিন্তু এর অল্প কিছুদিন পরেই ওই কার্যক্রম থেমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।

একসময় পুরান ঢাকাই ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। কারণ সেখানে একটি ইমারত আরেকটি ইমারতের গায়ে গায়ে লাগানো এবং প্রায় ভবনই জরাজীর্ণ অবস্থায়। ঐতিহাসিকভাবে পুরান ঢাকা নগরীর বাণিজি‍্যক কেন্দ্র বিধায় সেখানকার অলিগলিতেও অসংখ‍্য দোকানপাঠ এবং ব‍্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থানও। কিন্তু এখন নতুন ঢাকারও একই অবস্থা! নগরীর পরিকল্পিত-অপরিকল্পিত সব এলাকাই এখন একাকার হয়ে গেছে। ভারতের গুজরাটের বুজ এলাকায় ২০০১ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পনের পর ঢাকায় সমন্বিত দুর্যোগ ব‍্যবস্থাপনা কর্মসূচি (ঈউগচ) কর্তৃক ঔওঈঅ-এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয় যে কখনো ঢাকায় বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজারের বেশি ইমারত/স্থাপনা ধসে পড়বে এবং অগণিত মানুষ মারা যাবে! তবে প্রকৃত অবস্থা নিশ্চিত হওয়ার জন‍্য অবিলম্বে পুরো নগরী তথা দেশের সব ইমারতের অডিট শুরু করা প্রয়োজন।

কথা হলো, ওই সমীক্ষা পরিচালনার পর আজ প্রায় ১২-১৩ বছর উত্তীর্ণ হয়ে গেছে এবং এর মধ্যে ঢাকায় আরও লাখ লাখ নতুন ইমারত নির্মিত হয়েছে, কিন্তু এসব ইমারতগুলো ভূমিকম্পনের দৃষ্টিকোণ ও বিবেচনা রেখে ডিজাইন করে নির্মিত হয়েছে কি না, তা-ই মূল বিষয়!! যদি কখনো কোনো ভূমিকম্প বা অন‍্য কোনো দ্বৈবচক্রে এর অংশবিশেষও ভেঙে পড়ে, তাহলে এই হতে সৃষ্ট কোটি কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ (কংক্রিট কেকস) অপসারণ করা এবং তার ভেতর থেকে আক্রান্ত/ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনকে বের করে আনা এবং উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা একটি সতি‍্য অকল্পনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে! এর পেছনে প্রধান কারণ হলো, বর্তমানে ঢাকার প্রায় এলাকায় সড়কের চওড়ার স্বল্পতার পাশাপাশি কোথাও তেমন কোনো মাঠ-ময়দানও অবশিষ্ট নেই, যেখানে মানুষজন ভূমিকম্পের পর আশ্রয় নিতে পারেন।

প্রাপ্ত তথ‍্যমতে, বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ২১ লাখ মতো বিভিন্ন আকারের ইমারত/ভবন আছে এবং এর মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলা বা তার উঁচু, যার উল্লেখযোগ‍্য অংশই বিভিন্নভাবে ঝুঁকিপর্ণ অবস্থায়। দুর্বলভাবে নির্মাণের কারণে সাভারে ‘রানা প্লাজা’ ভবনধসের পর বুয়েটের এক গবেষণায় রাজউককে বলা হয়েছিল, এসব ভবন কতটা ভূমিকম্পনসহনশীল, তা নির্ধারণ ও তালিকা করে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে ‘লাল’ রং দিয়ে, মাঝারি ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে ‘হলুদ’ রং দিয়ে এবং ভূমিকম্পসহনশীল ভবনগুলোকে ‘সবুজ’ রং দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়ার জন‍্য। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এই কাজটি আর করা হয়নি। তা ছাড়া বিভিন্ন মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে রেট্রোফিটিং করে ভবনগুলোর শক্তিমাত্রা বৃদ্ধি করার জন‍্যও সুপারিশ করা হয়, কিন্তু অদ‍্যাবধি এই সুপারিশও প্রতিপালিত হয়নি।

কিছুদিন আগে ঢাকা ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ‍্যালয়ের যৌথ উদে‍্যাগে পরিচালিত আরেক সমীক্ষায় বলা হয় যে ঢাকায় যদি কখনো কোনো ভয়াবহ ভূকম্পন হয়, তাহলে খুবই খারাপ অবস্থা হবে। এর পেছনেও অন‍্যতম কারণ অলিগলি সড়ক, আর বিভিন্ন সড়ক ও ভবনে এলোপাতাড়ি বিদ‍্যুৎ-সংযোগ ও অন‍্যান‍্য বিভিন্ন ধরনের সংযোগ লাইন। এর ফলে ভূমিকম্পে এসব স্থানে আগুন লেগে যাওয়া এবং বিস্ফোরণের আশঙ্কাও রয়েছে। এতে উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া ভূতাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ১০০ বছর অন্তর নাকি আবার একটি বড় ধরনের ভূকম্পন হয়, সেই হিসাবে (১৮৯৭ বা ১৯১৮ সালের পর) এখন ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প অভার ডিউ হয়ে গেছে!!

এই অবস্থায় ঢাকা মহানগরী এলাকায় টেকসই উন্নয়ন ও ইমারত নির্মাণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নতুন ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (উঅচ) প্রণীত হয়েছে। তা ছাড়া কয়েক বছর আগে বিশ্বব‍্যাংকের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ‘আরবান রেসিলেন্স প্রজেক্ট’ শীর্ষক একটি প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়, যার আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের কয়েকটি অভিজ্ঞ উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ঢাকার সার্বিক বিষয়ে ও সবকিছু সমীক্ষা করে এবং সব স্টেকহোল্ডারের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ঊষবপঃৎড়হরপ ঈড়হংঃৎঁপঃরড়হ চবৎসরঃঃরহম ঝুংঃবস (ঊঈচঝ) বিষয় চালু করার জন‍্য বিভিন্ন টুলস, সফটওয়্যার বিধিমালা ইত‍্যাদি তৈরি করে দেওয়া হয়। কিন্তু অদ‍্যাবধি এতদ্্বিষয়েও কোনো কার্যকর ব‍্যবস্থা বা তা বাস্তবায়নের ব‍্যবস্থা গৃহীত হয়নি, যা সতি‍্য একটি লজ্জা ও হতাশার বিষয়!!

বাস্তবে দেশের সবকিছু কেন্দ্রায়িত বা ঢাকামুখী হয়ে পড়ায় এখন রাজধানী ঢাকায় মানুষ আর মানুষ, কেউ বলে এখন ঢাকায় মানুষের সংখ‍্যা ২ কোটির ওপর আর অনেকে বলে থাকেন ৩-৪ কোটির কম নয়! এই অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে এমনকি ২০২০-২১ সালে করোনাকালেও ঢাকায় কয়েকটি মধ‍্যম মাত্রার ভূমিকম্পের কারণে অনেক ভবন এমনকি কিছু বহুতল ভবনেও ফাটল সৃষ্টি হয়ে আছে। এহেন অবস্থায় তথা ২০১৫ সালে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পনের পর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় দুর্যোগ ব‍্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে অবিলম্বে দেশে ‘ন‍্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করার জন‍্য, কিন্তু আজ অবধি এর আর কিছুই হয়নি এবং এরপর এই কমিটির আর কখনো কোনো সভাও হয়নি এবং এ বিষয়ে কখনো কোনো ধরনের অগ্রগতিও মনিটরিং করা হয়নি।

উন্নত বিশ্বে দেখেছি, একটি শহর বা এলাকায় জনসংখ‍্যা ২০-২৫ লাখ হলেই সেখানে সরকার বিকল্প চিন্তা করা শুরু করে অর্থাৎ কীভাবে তার নিয়ন্ত্রণ ও ব‍্যবস্থাপনা করবে? কিন্তু আমাদের এই দেশে কখনো কোনো সরকার এ ব‍্যাপারে চিন্তাভাবনা করেছেন বলেও মনে হয় না!! ফলে স্বাভাবিকভাবে এই কেন্দ্রীভুত, জনাকীর্ণ ও হতদরিদ্র ঢাকা মহানগরীতে জনসংখ‍্যা ও ইমারত নির্মাণ বেড়েই চলেছে। ঢাকা থেকে কোনো কিছুই বিকেন্দ্রীকরণের কোনো লক্ষণও নেই!! এভাবে মানুষ ও ইমারতের চাপে ভবিষ্যতে ঢাকায় যদি শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প হয়, তাহলে এই নগরী আপনাতে হারিয়ে বা অদৃশ‍্যও হয়ে যেতে পারে!!! দেশের ভূতাত্তি¡ক ও নগর বিশ্লেষকদের মতে, নগর এলাকার যথাযথ ভূতাত্তি¡ক বিশ্লেষণ ব‍্যতীত কোনো কিছুই নির্মাণ বা গড়ে তোলা সঠিক নয়।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অবৈধভাবে বা অনুমোদন ব‍্যতিরেকে নির্মিত ইমারতকে জরিমানা দিয়ে বৈধ করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। যতটুকু জানা যায়, নতুন ড্যাপে এ ধরনের একটি প্রস্তাব আছে এবং এই ড্যাপ এর ভিত্তি হলো ‘স্ট্রাকচারাল প্ল্যান’, যেটি প্রস্তুত করেছেন তুরস্কের উপদেষ্টারা। তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পন ও হাজার হাজার ইমারতের ধ্বংসস্তূপ থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, কোনো অবস্থায় যেন ঢাকায় অবৈধ বা অনুমোদন ছাড়া নির্মিত ভবন/ইমারতকে জরিমানা দিয়ে বৈধ না করা হয় এবং এ জন‍্য অনতিবিলম্বে ড্যাপের সংশোধনও অনিবার্য।

প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম

লেখক

সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top