সুন্দরের কোনো সংজ্ঞা হয় না; এর কোনো ব্যাখ্যাও হয় না! সৌন্দর্য শুধুই উপভোগ করতে হয়। সুন্দর মানুষ, দেশ, আবার কোনো কোনো শহরও সুন্দর হয়। সুন্দর হওয়ার অনেক কারণ থাকে। যেমন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা কিংবা আধুনিক উপকরণ, সরঞ্জাম বা প্রযুক্তির ব্যবহারেও কোনো কোনো শহর সুন্দর। তাই ভাস্কর্যের জন্য কোনো শহর সুন্দর হতে কোনো মানা নেই। আমেরিকার ওহাইও রাজ্যের হ্যামিলটন এমনই এক নগর, যার নান্দনিকতা বৃদ্ধি করেছে হাজারো ভাস্কর্য। স্থানে স্থানে ভাস্কর্যের ছড়াছড়ির কারণেই হ্যামিলটনকে বলা হয় ভাস্কর্যের নগরী। এই নগরের বৈচিত্র্যময় কিছু ভাস্কর্যেও তথ্য জানাচ্ছেন কামরুন নাহার
হ্যামিলটনের রয়েছে এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। অনেক উত্থান-পতন আর সংগ্রামের পর অবশেষে একটি কৃষিজ গ্রাম থেকে নগরে রূপ নিয়েছে আজকের হ্যামিলটন। নাগরিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর ব্যাপক গবেষণার ফলে নগরায়ণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে যুক্ত হয়েছে নানামাত্রিকতা। নগরজুড়ে নির্মিত প্রায় ১ হাজার ৯৪২টি ভাস্কর্য হ্যামিলটনের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কীর্তি আর অর্জনের গাঁথা মাল্য। ১ হাজার ৫০০ আউটডোর স্কাল্পচার (ভাস্কর্য) তার বহির্দৃশ্যায়নমাত্র।
কেমন ছিল হ্যামিলটনের ইতিহাস?
নগর প্রতিষ্ঠার বহু বছর আগের কথা। ওহাইও রাজ্যের বর্তমান হ্যামিলটন এলাকাটি ফোর্ট হ্যামিলটন নামে পরিচিত ছিল। ওহাইওর ট্রেজারি সচিব আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের নামানুসারে ১৭৯১ সালে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় ফোর্ট হ্যামিলটন। এই ফোর্ট হ্যামিলটন তখন সৈন্যদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে ১৮০০ সালের পর থেকে তা আর সামরিক কাজে ব্যবহার করা হতো না। বিস্তীর্ণ ফাঁকা এলাকা হওয়ায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে শুরু করেন স্থানীয় লোকজন। পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয় হ্যামিলটন। ১৮১০ সালে ওহাইও সাধারণ পরিষদের উদ্যোগে ফোর্ট হ্যামিলটন আনুষ্ঠানিকভাবে আগের সব আরোপ থেকে মুক্তি নিয়ে হ্যামিলটন হিসেবে পরিচিত হতে থাকে।
১৮ শতকের মাঝামাঝি হ্যামিলটন একটি উল্লেখযোগ্য উৎপাদন শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলের খামারের পণ্যগুলো ছিল বাষ্প ইঞ্জিন, খড় কাটার, কাটার এবং থ্রেসারগুলো প্রক্রিয়া করার জন্য ব্যবহৃত মেশিন ও সরঞ্জাম। অন্যান্য উৎপাদনের মধ্যে রয়েছে মেশিন টুলস, হাউস হার্ডওয়্যার, কলের করাত, কাগজ, কাগজ তৈরির যন্ত্রপাতি, গাড়ি, বন্দুক, হুইস্কি, বিয়ার, পশমি পণ্য, ধাতব পণ্য, শস্য এবং কাপড় থেকে তৈরি অগণিত ও বৈচিত্র্যময় পণ্য।
২০ শতকের গোড়ার দিকে শহরটি ভল্ট ও সেফ, মেশিন টুলস, সবজির ক্যান, কাগজ, কাগজ তৈরির যন্ত্রপাতি, লোকোমোটিভ এবং রেলপথের সুইচ, বাষ্প ইঞ্জিন, ডিজেল ইঞ্জিন, ফাউন্ড্রি পণ্য, মুদ্রণের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎপাদনকেন্দ্র ছিল হ্যামিলটন। শুধু উৎপাদনেই এগিয়ে ছিল না হ্যামিলটন, পারস্পরিক সহযোগিতা, সাম্য এবং একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ারও প্রত্যয় ছিল নগর নির্মাতাদের। তারই নির্দশনগুলো তুলে আনা হয়েছে নগরীর বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ভাস্কর্যের মাধ্যমে। এমনই কিছু তাৎপর্যপূর্ণ, অর্থপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যের তথ্য তুলে ধরা হলো-
যৌবনের দেবী হেবের ভাস্কর্য
এই ভাস্কর্যটি ওহাইওর ফার্স্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি উপহারমূলক রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। হ্যামিলটন শহরের হাইস্ট্রিটে অবস্থিত ব্যাংকের কার্যালয়ের প্রধান ফটকে একটি ঝরনায় ১৮৯০ সালে এটি প্রথম স্থাপন করা হয়। হেবে হলেন প্রাচীন গ্রিক ধর্ম ও পুরাণ অনুযায়ী যৌবনের দেবী। ডেনিশ ভাস্কর বার্টোল্ড থারভোল্ডসেন একটি নকশার প্রতিরূপ এবং গ্রিক পুরাণ থেকে নিম্ফ হেবেকে চিত্রিত করেছে। পুরাণের বর্ণানুযায়ী তার ডান হাতে একটি কলস রয়েছে। তার প্রসারিত বাম হাতে রয়েছে পান করার একটি কাপ। শত শত বছর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পৌঁছেছে হেবে। ব্রোঞ্জ ও পাথরই হলো এই ভাস্কর্যের মূল উপকরণ। মূল ভাস্কর্যটির উচ্চতা ৫ ফুট। বর্তমানে নগরীর হাই স্ট্রিটের পকেট পার্কে এটি স্থাপন করা আছে। ভাস্কর্যটি চিরযৌবনের একটি নিদর্শন হিসেবে নাগরিকদের উজ্জীবিত করে।
সিভিল ওয়ার মনুমেন্ট
এটি যুদ্ধের স্মারক হিসেবে নির্মিত ভাস্কর্য। মূর্তিটিতে ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা একজন গৃহযুদ্ধের সৈনিককে চিত্রিত করা হয়েছে। একটি রাইফেলের নল তার পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি ১৮৯৫ সালে ইতালির একজন ভাস্কর নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণই মার্বেলপাথরে খোদাই করে তৈরি করা। এই স্মারক ভাস্কর্যটি মূলত মিলজেভিল-প্লাইমাউথ কবরস্থানের মাঝখানে একটি উঁচু ঘাসের ঢিবিতে স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে এটি একবার সংস্কার করা হয়েছিল। সংস্কারের পর ভাস্কর্যটি আবারও একই স্থানে স্থাপন করা হয়। তবে এবার একটি বেদিতে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়। বেদিতে যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের নাম খোদাই করা আছে। বিভিন্ন সময়ে আমেরিকার সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি উৎসর্গ করা হয়।
ইউক্লিড ক্রস
ভাস্কর্যটি খুবই সাধারণ। তবু এর অনেক তাৎপর্য ও গুরুত্ব রয়েছে আমেরিকানদের জীবনধারায়। মাইকেল ডানবার ২০০৪ সালে জ্যামিতির জনক ইউক্লিডের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের নিদর্শন হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন ইউক্লিড ক্রস। সে সময় গাণিতিক পদ্ধতি আমেরিকান শিল্পবিপ্লবে ব্যাপক ভ‚মিকা রেখেছিল। ১৮ ফুট প্রস্থ ও ২১ ফুট উচ্চতার এই আকর্ষণীয় ভাস্কর্যটি ১৭৬৩ ক্লেভস রোডে স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জের তৈরি।
ড্রাগনফ্লাই ডোম
এই গম্বুজ আকৃতির ভাস্কর্যটিতে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ড্রাগনফ্লাইয়ের জ্যামিতিক প্যাটার্ন রয়েছে। গম্বুজটিতে ভেতর থেকে ভাস্কর্যটি দেখার জন্য রয়েছে একটি প্রবেশদ্বার। এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন ভাস্কর ভোস ফিন। তাঁর বেশির ভাগ ভাস্কর্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ফর্মকে মডিউলার ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ড্রাগনফ্লাইয়ের ইউনিটগুলো বিভিন্ন আর্কিমিডিয়ান আকারে কনফিগার করা যেতে পারে। স্পেস, আকৃতি, প্রতিসাম্য এবং অনুধাবনমূলক ঘটনার ধারণার সঙ্গে পুনরাবৃত্ত এই প্যাটার্নগুলো সাদৃশ্যমান।
একটু পরিষ্কার করে বলতে গেলে প্রতিটি বস্তুর একটি মহাকর্ষকেন্দ্র থাকে এবং সেই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো দর্শনার্থীর দৃষ্টি আটকে থাকে ওই বস্তুর কক্ষপথেই। একজন দর্শনার্থী ড্রাগনফ্লাইয়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে মহাকাশ, মহাকর্ষ আর বিজ্ঞানের সেই অদৃশ্য খেলাটি অনুভব করতে পারবে। আপাতদৃষ্টে এটিকে দেখতে এলোমেলো মনে হলেও এর ভেতরে রয়েছে অনেক কিছুই। এই ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১১ ফুট, বৃত্তের ব্যাস ২২ ফুট। হ্যামিলটন নগরীর ক্লেভস রোডে এটি স্থাপন করা হয়। তবে কবে স্থাপন করা হয়, এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
লেনটিল ও হারমনি
এই ভাস্কর্যটি হ্যামিলটনের স্থানীয় একজন শিশুতোষ লেখককে সম্মান জানাতে স্মারক হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। রবার্ট ম্যাকক্লোস্কি একাধারে একজন লেখক ও চিত্রকর। এই ভাস্কর্যে তাঁর বইয়ের একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চরিত্রে মসুর নামক একজন হারমোনিকা বাজিয়ে যাচ্ছিলেন এবং পেছন পেছন তাঁর কুকুরটাও তাঁকে অনুসরণ করছিল। তবে কুকুরটির কোনো নাম দেওয়া হয়নি।
ভাস্কর্য নির্মাণের আগে কুকুরটির নামকরণের জন্য প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক প্রস্তাবিত ‘হারমনি’ নামটি কুকুরের নাম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ২০০১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ব্রোঞ্জের এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। হাইস্ট্রিটের লেনটিল পার্কে স্থাপিত লেনটিল এবং হারমনির ভাস্কর্যটি নির্মাণ করে ন্যান্সি স্কন। ব্রোঞ্জের পাশাপাশি এতে ব্যবহার করা হয়েছে ইট।
কিটি বেঞ্চ
এই বেঞ্চটি একটি কাটআউট কৌশলের মাধ্যমে ধাতব পাত থেকে তৈরি করা হয়েছে। পরে এটিকে অফহেয়াইট কালারে রাঙানো হয়। বেঞ্চের পেছনে তিনটি বিড়াল ও তিনটি পাখির একটি বিন্যাস চিত্রিত করা হয়েছে এই শিল্পকর্মে। শিল্পীর নামও কাটা হয়েছে ডান দিকে বিড়ালের পেছনে। বেঞ্চের পাগুলো দেখে মনে হবে যেন বিড়ালেরই পা। ২০০৭ সালে ভাস্কর ডন ড্রুম এটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এটি ১ নম্বর হাইস্ট্রিটে স্থাপন করা হয়েছে।
দ্য আমেরিকান কেপ
আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের এই ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে তাঁকে একটি বক্তৃতার সময় চিত্রিত করা হয়েছে। লিখিত বক্তৃতা তাঁর বাম হাতে ধরা এবং ডান হাত আকাশের দিকে নির্দেশ করা। ভাস্কর ক্রিস্টেন ভিসবেল এই ভাস্কর্যটি ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন। শিল্পীর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুুট ৪ ইঞ্চি। এটিই প্রথম আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের সবচেয়ে বড় আকৃতির প্রতিকৃতি। তিনিই সেই বীর, যাঁর নামানুসারে এই নগরীর নামকরণ করা হয়েছিল। শোভাবর্ধন ও সম্মানার্থে ২১৯ হাইস্ট্রিটে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে।
¯œ্যাপশট
শিশুরা কোমলমতি, শিশুরা দুরন্ত, শিশুরা ভিতু, শিশুরা অবুঝ তারা অনুকরণপ্রিয়। ¯œ্যাপশট নামের এই ভাস্কর্যটিতে শিশুদের বিভিন্ন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কোনো পথভ্রষ্ট শিশু নেশা করছে, কেউ আবার বেসবল গøাভস হাতে বসে আছে। কাউকে আড়ষ্ট হয়ে থাকতেও দেখা গেছে। আমাদের সমাজ ও সমাজব্যবস্থা সব শিশুকে নিয়েই। শিশুদের মধ্যে বিভেদ নেই, বিভাজন নেই। তাই তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার আগেই অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরি। এমনই একটি বার্তা বহন করে একই বেঞ্চে বসে থাকা কয়েকটি শিশু। ভাস্কর জেন ডি ডিকার এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিলেন তবে কবে নির্মাণ করেছিলেন সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ ব্রোঞ্জের তৈরি এই ভাস্কর্যটি ১৩০ হাইস্ট্রিটে স্থাপন করা হয়েছে।
এরকম হাজারো ভাস্কর্যে সুসজ্জিত ওহাইও রাজ্যের হ্যামিলটন নগরী। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাম্য, বিজ্ঞানসহ জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে এসব ভাস্কর্যে। এতে শুধু নগরীর সৌন্দর্যকেই বাড়ানো হয়নি, পাশাপাশি নগরীর সমৃদ্ধির ও আভিজাত্যের ছাপ পাওয়া যায় নান্দনিক এসব সৃষ্টিকর্মে। শিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া ভাস্কর্যের নগরীর সব গল্পই যেন ধরে রাখা হয়েছে প্রতিটি ভাস্কর্যের খাঁজে খাঁজে।
হড়নড়.ড়ৎঁহ@মসধরষ.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬০ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০২৩