ভবন সুরক্ষায়…

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টাচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আগে যেখানে টিনের একচালা ছিল, সেখানে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। কিন্তু ভবন নির্মাণে আমরা যতটা সচেতন, এর স্থায়িত্ব ও পরিবেশগত সুরক্ষার ব্যাপারে হয়তো ততটা নই। ফলে বছর কয়েক যেতে না-যেতেই চকচকে ভবনের দেয়াল ঢেকে যায় শৈবালের গালিচায়, দেখা দেয় ফাটল, ঝুলবারান্দায় কলামের গা থেকে খসে পড়ে পলেস্তারা। শীতে প্রচÐ ঠান্ডা, গরমে দম বন্ধ হওয়া ঘরগুলোতে নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। তাই আস্থার স্থাপনা নির্মাণে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের ভাবা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে প্রকৃতির বিরূপ মূর্তি। যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে স্থাপনাগুলোতেও। তাই এসব স্থাপনা ও বসবাসকারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদ্ভাবিত হচ্ছে কার্যকর নানা ধরনের উপকরণ। এ ধরনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সম্পর্কে জানাচ্ছেন সারোয়ার আলম

শিলা প্রতিরোধী উপকরণ 

উন্নত দেশে বাড়ির ছাদের সৌন্দর্য বাড়াতে অ্যাসফল্টযুক্ত গøাস ফাইবারের মাদুর ব্যবহার করা হয়। এই মাদুরকে বলা হয় শিঙ্গলের মাদুর। উত্তর আমেরিকায় এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে কলোরাডোর মতো এলাকায় বাড়ির ছাদে শিঙ্গলের মাদুর বেশি ব্যবহার করা হয়। এই এলাকায় প্রচুর শিলাবৃষ্টি হওয়ায় ছাদে শিলা প্রতিরোধী উপকরণ স্থাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাদে ব্যবহৃত  শিঙ্গলগুলো সাধারণত ঝড়, ঝোড়ো বাতাস ও পানি প্রতিরোধ করতে পারলেও শিলা প্রতিরোধে খুব বেশি কার্যকর নয়। প্রচÐ শিলাবৃষ্টিতে কখনো কখনো শিঙ্গলগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সে কারণে বিকল্প উপকরণ হিসেবে শিলা প্রতিরোধী ধাতব টাইলস ব্যবহার করছেন নির্মাণকারীরা। এ টাইলসের ওপর পাথরের পাতলা স্তর থাকায় যেকোনো আবহাওয়া কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও টিকে থাকে বছরের পর বছর। বাংলাদেশে শিলাবৃষ্টি প্রকট আকার ধারণ না করলেও প্রতিবছরই কয়েকবার হানা দেয়। তাই ভবিষ্যতে সমূহ বিপদ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে ছাদে ধাতব টাইলস ব্যবহারের কথা বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। 

আর্দ্রতা প্রতিরোধী উপকরণ 

সাধারণত শীত ও গরমপ্রধান এলাকায় বাড়িঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশেও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গরমে অত্যন্ত গরম এবং ঠান্ডায় অতি ঠান্ডা। তবে বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু যেসব দেশে বা অঞ্চলে প্রচÐ ঠান্ডা বা গরম, সেখানকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ওই সব স্থানে বাসা, অফিস, কারখানাসহ অন্যান্য স্থাপনার অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগে থেকেই নির্মাণের সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে জরুরি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হয় গøাস ফাইবার ও জিপসাম বোর্ডের মতো উপকরণগুলো। বাংলাদেশে ফাইবার গøাসের ব্যবহার খুব বেশি না থাকলেও জিপসাম বোর্ডের ব্যবহার দেখা যায়। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা সহিষ্ণু হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঘরের চালা কিংবা ছাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উপকরণে সিলিং ব্যবহার করা হয়। 

উন্নত দেশে যেখানে খুব বেশি ঠান্ডা বা গরম, সেখানে দেয়াল ও ছাদ উভয় অংশেই গøাস ফাইবারের বোর্ড ব্যবহার করা হয়, যা দেখতে সাধারণ গোলাপি কিংবা কমলা রঙের বোর্ডের মতো। বর্তমানে এ ধারণার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গøাস ফাইবারের চেয়ে বেশি কার্যকরী আর্দ্রতা নিরোধক উপকরণ বাজারে সহজলভ্য। পলিমারের তৈরি এ উপকরণটি সাধারণ বোর্ডের মতোই। তবে এর দুটি ধরন আছে। সেগুলো হচ্ছে-

এক্সপান্ডেড পলিস্টারিন ইনস্যুলেশ (ঊচঝ) 

এক্সট্রুডেড পলিস্টারিন ইনস্যুলেশ (ঢচঝ)

উভয় বোর্ডের উৎপাদনের মূল উপকরণ পলিস্টারিন-জাতীয় পলিমার। তবে পার্থক্য হলো, ঊচঝ বোর্ডকে আকৃতি দেওয়ার জন্য বাষ্প ব্যবহার করা হয় এবং ঢচঝ বোর্ডকে আকৃতি দেওয়া হয় মেশিনের সাহায্যে। গঠন যেমনই হোক, এ ধরনের বোর্ড গøাস ফাইবার থেকে বহুগুণ উন্নত এবং বন্যা কিংবা বৃষ্টির পানি থেকে আপনার স্থাপনাকে শতভাগ সুরক্ষা দেবে। দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় নির্মাণের খরচও বাঁচবে কয়েকগুণ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধী জানালা 

ঝড়ের সময় কাচের জানালা এবং দরজাগুলো উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। ঝড়ে জানালাগুলো শুধু ছিন্নভিন্নই নয়, আঘাতের কারণও হতে পারে। বর্তমানে অধিকাংশ ভবনের জানালা হয় কাচের। তাই ঝড়ের সময় জানালা ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। আগে দরজা এবং জানালায় কাঠ ব্যবহার করা হতো, যা ছিল টেকসই এবং ঝুঁকিমুক্ত। তাই পরিস্থিতি বুঝে এর প্রতিকারও তৈরি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রচÐ ঝড়-বাতাসেও কাচের জানালাকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো এমন উপকরণও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টি প্রতিরোধক গøাস সাধারণ দুই রকমের হয়ে থাকে।

একটি দুই স্তরযুক্ত গøাস, যার মধ্যে থাকে দুটি কাচের শিট। শিটের মাঝখানে থাকে অভ্যন্তরীণ পর্দা বা ঝিল্লি, যা ফিল্ম পেপার নামে পরিচিত। গøাস ভেঙে গেলেও পর্দাটি তার ফ্রেমে শক্তভাবে ভাঙা কাচের টুকরোগুলো ধরে রাখে। ফলে ভেতরের গøাসটি অক্ষত থাকে। এই ধরনের জানালা বাতাসের উচ্চগতিতে ছুড়ে ফেলা কোনো বস্তুর আঘাত সহনীয় করে তৈরি করা হয়। ফলে ঝড়ের সময় বাতাস কিংবা বৃষ্টির পানি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। দুই কাচের মাঝখানের পর্দাটি ০.০১৫ ইঞ্চি থেকে ০.০৯০ ইঞ্চি পুরুত্বের মধ্যে হয়ে থাকে। ভেতরের ফিল্ম পেপার (পর্দা) বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। প্রয়োজনমতো যেকোনো রঙের পদা পেতে প্রস্তুতকারক/পরিবেশকদের অর্ডার করতে হয়। রঙিন পর্দা ব্যবহারে সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিজনিত (টঠ) ক্ষতি কম হয়।

অন্যটি লেমিনেটেড উইন্ডো গøাস। এটি এমন একধরনের কাচ, যার ওপরের অংশে একটি গøাস ফিল্ম পেপার ব্যবহার করা হয়। ফলে যেকোনো কারণে কাচের জানালা ভেঙে গেলেও তা একই জায়গায় আটকে থাকে। তাই ঝড়-বৃষ্টিতে এ ধরনের জানালা অনেক বেশি নিরাপদ। 

ফ্লুইড অ্যাপ্লাইড ফø্যাশিং

ফ্লুইড অ্যাপ্লাইড ফ্ল্যাশিং একধরনের তরল কোটিং, যা দরজা-জানালায় প্রয়োগ করা হয়। এই কোটিং অনাকাক্স্ক্ষিত সব ধরনের ছিদ্র বন্ধ করে। দুর্যোগ ও অতিবৃষ্টিপ্রবণ এলাকার ভবনে এই কোটিং বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া গাছপালা কম এ রকম উন্মুক্ত এলাকায় বাতাস ও ধুলোবালি প্রতিরোধে ফ্লুইড ফ্ল্যাশিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেখতে সাধারণত রঙের মতো। প্রয়োগও একই পদ্ধতিতে। তবে এর ঘনত্ব বেশি হওয়ায় তা দরজা, জানালার ছিদ্র বা ফাঁকা স্থান বন্ধ করতে অনেক বেশি কার্যকর। শুধু বৃষ্টির পানিই নয়, হঠাৎ জলোচ্ছ¡াস কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসও প্রতিরোধ করে এই কোটিং। 

কংক্রিট ফ্রেম 

সাধারণত বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বাড়ি নির্মাণে বাঁশ, কাঠ আর টিনের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। সম্প্রতি আধা পাকা এবং একতলা বাড়ি অনেক এলাকায় দৃশ্যমান হলেও খুব বেশি নয়। আবার প্রতিবছর কালবৈশাখী ঝড়ে এমন সব আধা পাকা ও টিনের বাড়ি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতেও দেখা যায়। ঝড় ছাড়াও ভূমিকম্প আরেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম, যা সবকিছু তছনছ করে দেয়। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই এ দুর্যোগ তাÐব চালায় বলে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বস্তুত ভূমিকম্প প্রতিরোধে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার বিশেষ কোনো কৌশল নেই। তবে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে কংক্রিট ফ্রেম ব্যবহারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই দিয়ে থাকেন। ভূমিকম্প প্রতিরোধে কাঠ ও টিনের বাড়ির চেয়ে কংক্রিটের ফ্রেমের বাড়ি বেশি নিরাপদ। ভূমিকম্প কিংবা ঝড়ে কাঠের কিংবা বাঁশের খুঁটি খুব সহজেই উপড়ে পড়ে, ফেটে যায় কিংবা ভেঙে যায়। তাই ফ্রেমের স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে এবং নিরাপত্তার জন্য কংক্রিটের ফ্রেমই সবচেয়ে ভালো বিকল্প।

ফাইবার সিমেন্ট সাইডিং

স্থাপনার কাঠামো ইট বা কংক্রিট যা-ই হোক না কেন, সাইডিং বা ক্ল্যাডিং উপাদানগুলোই হলো প্রথম সুরক্ষার বিষয়। সাইডিং বা ওয়াল ক্ল্যাডিং হলো প্রতিরক্ষামূলক উপাদান, যা একটি বাড়ির বা যেকোনো ধরনের ভবনের প্রাচীরের বাইরের দিকে সংযুক্ত থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে রোদ, বৃষ্টি, তুষার, তাপ ও ঠান্ডাকেও প্রতিরোধ করে। একইভাবে ভেতরের দিকে একটি স্থিতিশীল ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করে সাইডিং উপকরণগুলো। তা ছাড়া ভবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও সহায়ক। কাঠ কিংবা বোর্ড, স্টিল শিটসহ প্রভৃতি উপকরণ সাইডিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে সাইডিং উপাদান অবশ্যই পরিবেশবান্ধব হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপকরণ হলো ফাইবার সিমেন্ট সাইডিং। 

কাঠের সাইডিং বাতাসের আর্দ্রতার প্রভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারে এবং বাঁকাও হয়ে যেতে পারে। সূর্যের আলো, শিলাবৃষ্টি এবং প্রবল বাতাসে এর রং বিবর্ণ হতে পারে। ফাইবার সিমেন্ট বাতাসে মিশে থাকা যেকোনো রাসায়ানিক উপদানের প্রভাব, সূর্যের তাপ এবং দাগ পড়াসহ বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে ভবনের বাইরের দেয়ালকে সুরক্ষা দেয়। এই আবরণটি আপনার বাড়ি বা বিল্ডিংয়ের জন্য প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন, যা একই সঙ্গে ভেতরের পরিবেশ যেমন আরামদায়ক রাখে তেমনি বহির্দেয়ালও সুরক্ষিত রাখে। 

কষ্টের টাকায় স্বপ্নের স্থাপনা দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে, অভ্যন্তরীণ আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভবন নির্মাণের আগে হাজারবার ভেবে নেওয়া উচিত। একবার নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেলে তা সংশোধন করা অনেক বেশি জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ। তাই পরিকল্পনায় উল্লেখিত বিষয়গুলো আপনার নির্মিত ভবনকে যেমন সুরক্ষিত রাখবে, তেমনি দেবে স্বস্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য। 

ংনহংধৎধিৎ@মসধরষ.পড়স

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৪৯ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top