বিস্ময়কর যন্ত্র ক্রেন

আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে যেমন রয়েছে মানুষের দূরদর্শিতা, তেমনি রয়েছে বিস্ময়কর নানা যন্ত্রের ব্যবহার। স্থাপনা নির্মাণে ভারী ভারী পাইল স্থাপন, নির্মাণ সহায়কসামগ্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো কিংবা জাহাজ থেকে বিশাল বিশাল কনটেইনারে খালাসের কাজ যেভাবে করা হয়, তা সত্যিই বিস্ময়কর। যে কাজটি করতে অন্তত কয়েক শ মানুষ প্রয়োজন, সেখানে একটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই কাজগুলো করা সম্ভব। শক্তিশালী এই যন্ত্রটি ক্রেন। আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই ক্রেন মানব সভ্যতা বিকাশে কাজ করে চলেছে। ক্রেনের আদ্যোপান্ত তুলে ধরছেন গোলাম মোর্শেদ

ক্রেন পরিচিতি 

ক্রেন এমন এক মেশিন, যা বিভিন্ন ভারী বস্তু, যন্ত্র, উপকরণ ও পণ্য উত্তোলন এবং উল্লম্ব ও অনুভূমিকভাবে স্থানান্তর করতে ব্যবহৃত হয়। অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প, জাহাজ নির্মাণ; জাহাজে মালামাল উত্তোলন ও খালাস, গুদামজাত করাসহ শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রেন বহুল ব্যবহৃত একটি যান্ত্রিক মেশিন। এই ক্রেন এতটাই দরকারি যে যন্ত্রটি ছাড়া আকাশচুম্বী বহুতল ভবন তথা স্কাইক্রেপার্স নির্মাণ প্রায় অসম্ভব। আর তাই আজকাল আকাশচুম্বী ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে হরহামেশাই দেখা মেলে ক্রেনের। একটি ক্রেন ১ টন থেকে ২০ হাজার টন পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে।

ক্রেনের কার্যপ্রণালি

ক্রেন অন্য সব যন্ত্র থেকে আলাদা। এই যন্ত্রটির কাজ করার জন্য অন্য যন্ত্রপাতি বা শক্তির প্রয়োজন হয় না। যেমন, বুলডোজার, এক্সকাভেটর বা ট্র্যাক্টরের জন্য বাষ্প, গ্যাস বা তেল শক্তির প্রয়োজন। ক্রেন তৈরির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হয়। সেগুলো হচ্ছে-

ভারী বস্তু তোলার ক্ষমতা

ওজন তোলার সময় যাতে ক্রেন নিচে গড়িয়ে না পড়ে

ওজন তোলার সময় ক্রেন যেন ভেঙে না যায়।

বিশালাকার ক্রেন দেখতে জটিল মনে হলেও আসলে এটি বেশ কয়েকটি সরল যন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন,  লিভার, পুলি, হাইড্রোলিক সিলিন্ডার ইত্যাদি। সরল যন্ত্রের মূলনীতি হচ্ছে যান্ত্রিক সুবিধা ব্যবহার করে বল বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা।

ব্যালেন্স ক্রেনে আনুভূমিক একটি বিম থাকে, যাকে বলা হয় লিভার। লিভার এমন একটি যন্ত্র, যেখানে অল্প শক্তি ব্যয় করে অধিক কাজ করা যায়। ক্রেনের লিভারও একই নিয়ম মেনে চলে। ক্রেনের লিভারে তুলনামূলক ছোট মাথায় ভারী বস্তু তুলে দেওয়া হয় এবং লম্বা মাথায় অল্প বল প্রয়োগ করে ভারী বস্তু নড়াচড়া করা হয়।

তবে সব ক্রেনই লিভারের নীতিতে কাজ করে না। যেমন, জিব ক্রেন কাজ করে পুলির মাধ্যমে। জিব ক্রেনে একটি হেলানো ভাররক্ষা থাকে, যাকে বলা হয় জিব, যা পুলিকে সাপোর্ট দেয়। পুলির চারপাশে একাধিক দড়ি বা তার পেঁচানো হয় আর যে ভারী বস্তুকে তোলা হবে তার চারপাশেও সেই দড়ি পেঁচানো থাকে। যখন দড়ির অপর পাশে হাত দিয়ে বা অন্য কোনো যন্ত্র দিয়ে টান দেওয়া হয়, তখন সেই টানের ফলে ভারী বস্তুটি ওপরে উঠে যায়। এ ছাড়া, হাইড্রোলিক সিলিন্ডারের মাধ্যমেও ভারী বস্তু তোলা যায়। মনে রাখতে হবে, এই সরল যন্ত্রগুলো আমাদের প্রয়োগকৃত বলের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি করে ভারী বস্তু ওঠাতে বা সরাতে সহায়তা করে।

ক্রেনের ইতিহাস ও বিবর্তন

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে প্রাচীন গ্রিকে ক্রেন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতœতাত্তি¡ক অনুসন্ধান অনুসারে, গ্রিক মন্দির ও স্থাপনা নির্মাণে প্রথম ক্রেন ব্যবহার শুরু হয়। কিছু গবেষক এই সময়কে খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০-৬৫০ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সময়কাল যা-ই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে স্থাপনা নির্মাণসামগ্রী উত্তোলন, সরানো এবং স্থাপন করার জন্য মেশিন ব্যবহারের ইতিহাস আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক আগে এসেছিল। আমেরিকার ইন্ডিয়ানার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ইতিহাসবিদ আলেসান্দ্রো পিরাত্তিনির মতে, ‘পূর্ববর্তী কোনো সভ্যতা এটি ব্যবহার করেছে বলে জানা যায় না এবং এটি প্রায় ২৫ শতাব্দী ধরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছাড়াই নির্মাণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কারণ এটি ছিল নিখুঁত।’

অন্যান্য অনেক প্রাচীন সভ্যতায়ও ভারী বস্তু সরাতে হস্তচালিত শ্রমনির্ভর র‌্যাম্প ব্যবহার করা হতো। তখন ক্রেন ছিল সাধারণ পুলি বা কপিকলযুক্ত, যা ছিল হস্তচালিত। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত ওজন বহন করতে পশু ব্যবহৃত হতো। মধ্যযুগের মধ্যে, ক্রেন অভিযোজিত হয়েছিল ডকগুলোতে জাহাজ লোড এবং আনলোড করার পাশাপাশি নির্মাণে সহায়তা করার জন্য। যেহেতু ডক ইয়ার্ডের ক্রেনগুলো স্থায়ী হতে হয়, তাই পাথরের টাওয়ার বা বড় কাঠের কাঠামোতে তৈরি করা হয়েছিল। ইতিহাসের বেশির ভাগ মেশিনের মতো, শিল্পবিপ্লবের সময় সবকিছু পরিবর্তন হয়েছিল। বাষ্প ইঞ্জিনের মাধ্যমে যান্ত্রিক শক্তি ক্রেনটিকে একটি শক্তিশালী উত্তোলন মেশিনে রূপান্তরিত করেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে হাইড্রোলিক আর্মস, বৈদ্যুতিক মোটর এবং অভ্যন্তরীণ স্বাধীন ইঞ্জিনের ব্যবহার ক্রেনগুলোকে উত্তোলন ক্ষমতা অর্জন করে। উঁচু কাঠামোর নির্মাণকাজে কংক্রিট উত্তোলন করতে হোয়িস্ট বা স্কিপ ব্যবহার করা হয়। 

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের জন্য এই জাতীয় একটি ক্রেনের প্রোটোটাইপটি শেষ পর্যন্ত ১৫ এবং ১৬ শতকে রেকর্ড করা হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্রেনগুলোর কর্মক্ষমতা এবং স্কেলকে আরও উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন ক্রেনে বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে এর কর্মক্ষমতা বাড়ানো হয় বহুগুণে। প্রথম বৈদ্যুতিন ক্রেন ১৮৯০ সালের দিকে জার্মানিতে বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছিল। ক্রেনের সমধর্মী যেসব যন্ত্র বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম- 

চেইন হোয়েস্ট বা জিব হোয়েস্ট

চেইন পুলি বøক

জ্যাক

উইন্স হোয়েস্ট

ক্রেনের মৌলিক যত উপাদান

যদিও ব্যবহার ভিন্নতা অনুযায়ী বিশে^ বিভিন্ন ধরনের ক্রেন রয়েছে, তবে বেশ কিছু মৌলিক উপাদান সব ধরনের ক্রেনেই মিল পাওয়া যায়। একটি ক্রেনের প্রধান অংশগুলো হচ্ছে- 

বুম

জিব

রোটেক্স গিয়ার

আউটরিগার্স

কাউন্টারওয়েটস

রিইনফোর্স-স্টিল কেবল

হুক

বুম

বুম একটি ক্রেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি ক্রেনের বেশির ভাগ লোড বহন করে এবং এই বুমের সাহায্যেই নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানো সম্ভব। বুম মূলত একটি লম্বা বাহু, যাকে প্রসারিত ও সংকুচিত করা যায়। ক্রেনের ধরন এবং তৈরি প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে এর কর্মক্ষমতা। জিব ছাড়াও কিছু ক্রেন কাজ করতে সক্ষম হলেও বুম কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রেনের প্রধান উপাদান বলা যায়। বুমের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো বস্তু উত্তোলন, সরানো এবং নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করানো। 

জিব

জিব মূলত বুমের শেষের সঙ্গে সংযুক্ত জালিবিশিষ্ট কাঠামো। এই জালি কাঠামো বুমের সামনের অংশে যোগ করা হয় ওজন কমাতে বা ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে। এর আকার স্থির এবং বুমের মতো প্রসারিত বা সংকুচিত করা যায় না। মোবাইল ক্রেনের কিছু সংস্করণে জিনিসপত্র সরাতে এবং তুলতে সাহায্য করার জন্য বুমের শেষ পর্যন্ত একটি জিব স্থির থাকে। জিব বা জিব আর্মটির একটি প্রধান উদ্দেশ্য উপাদানটিকে মূল অংশ থেকে দূরে রাখা, যাতে বস্তু সরানোর সময় আঘাত না পায়। 

রোটেক্স গিয়ার

রোটেক্স গিয়ার হলো ক্রেনের ক্যাবের নিচের মেকানিজম। এটি ক্যাব এবং বুমকে ডানে-বামে ঘোরাতে সাহায্য করে। এটি সাধারণ মেকানিজম কিন্তু মেশিনের কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কাউন্টারওয়েটস

কোনো বস্তু উত্তোলন করার সময় ক্রেনের সামনের দিকে ওজনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই অংশটি ভ‚মিকা রাখে। এ ছাড়া মেশিনের স্থিতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। অনেক ক্রেনের সামঞ্জস্যযোগ্য কাউন্টারওয়েট থাকে, যাতে লোড বা কাজের নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে খাপ খায়। টাওয়ার ক্রেনগুলোতে জিবের অন্য প্রান্তে কাউন্টারওয়েট দেখা যায়।

আউটরিগার্স

ক্রেনের নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ আউটরিগার্স। একটি আউটরিগারের কাজ হলো অতিরিক্ত সাপোর্ট প্রদান করা। পাশাপাশি লোডকে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে ক্রেনটি দেবে না যায় বা নড়াচড়া না করতে পারে। তবে অসমতল ভ‚মির জন্য বাড়তি কোনো সুবিধা দেয় না।

রিইনফোর্সড- স্টিল কেবল

যেকোনো ভারী বস্তু উত্তোলন ও সরানোর জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের শক্ত-পোক্ত কেব্্ল বা দড়ির। ক্রেনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় শক্তিশালী ইস্পাত কেব্্ল। ১৮৩০ সালের দিকে খনি থেকে খনিজ উত্তোলনের জন্য স্টিলের তার প্রথম দড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বর্তমানে ব্যবহৃত তারগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী, ক্ষয় ও মরিচা প্রতিরোধী।

হুক 

সবশেষে, ক্রেনের সাহায্যে বস্তু বা উপকরণগুলো সংযুক্ত করার জন্য একটি মাধ্যম প্রয়োজন। আর এই মাধ্যমটিই হচ্ছে হুক। ক্রেনে উত্তোলনের হুকটি সাধারণত একটি সুরক্ষা বন্ধনী বা বার দিয়ে যুক্ত থাকে, যাতে ট্রানজিটের হুক থেকে উপাদানটি পিছলে না যায়। এই হুক ইস্পাত বা লোহা দিয়ে তৈরি হয়। হেভি-ডিউটি ক্রেন এবং অধিক লোডের হুকগুলো সাধারণত তাপরোধী করা হয়।

বহুল ব্যবহৃত যত ক্রেন

ভারবহন ক্ষমতা, আকার, ধরন ও ব্যবহার উপযোগিতা অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ক্রেনের ব্যবহার লক্ষণীয়। যদিও এদের সাধারণ কার্যাবলি সমধর্মী, তা সত্তে¡ও ক্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঠামো, ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য। বিশে^ বহুল ব্যবহৃত ক্রেনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 

মোবাইল ক্রেন

টাওয়ার ক্রেন

রাফ সারফেস বা অসমতল রুক্ষ ভূখÐের ক্রেন

ওভারহেড ক্রেন

জিব ক্রেন

ক্রলার ক্রেন 

ভাসমান ক্রেন 

অল-টেরেইন ক্রেন 

পিক অ্যান্ড ক্যারি

সাইডলিফট ক্রেন

ক্যারি ডেক ক্রেন 

ট্র্যাভেল লিফট ক্রেন

রেল ক্রেন

এরিয়াল বা এয়ার ক্রেন

ক্লাইম্বিং ক্রেন

রিং ক্রেন

হ্যামারহেড ক্রেন

গ্যান্ট্রি ক্রেন

ডেক ক্রেন

বাল্ক-হ্যান্ডলিং ক্রেন

লোডার ক্রেন

স্ট্যাকার ক্রেন

বøক-সেটিং ক্রেন

মোবাইল ক্রেন

সহজে ব্যবহার্য এই ক্রেন নির্মাণ সাইটে বহুল ব্যবহৃত ক্রেনগুলোর মধ্যে একটি। এই ক্রেনে একটি স্টিলের ট্রাস বা টেলিস্কোপিক বুমযুক্ত মাউন্টেড প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থাকে। এই ধরনের ক্রেনকে প্রয়োজন অনুসারে একটি নির্মাণ সাইটের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা যায়। 

টাওয়ার ক্রেন

এটি ব্যালান্সর্ড বা ভারসাম্য বজায় রাখা ক্রেনের একটি ফর্ম। আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণের সময় এই ক্রেনগুলো অত্যন্ত কার্যকর। তবে সঠিক ভারবহন ক্ষমতা অর্জনের জন্য টাওয়ার ক্রেনের কংক্রিট ভিত্তিটি স্থাপনা নির্মাণের অন্তত এক মাস আগে তৈরি করতে হবে। এটি ফাউন্ডেশনকে স্থির হওয়ার এবং ক্রেন ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ার পূর্বশর্ত।

রাফ সারফেস বা অসমতল রুক্ষ ভূখÐের ক্রেন

অসম স্থল বা অফ-রোড ধরনের পৃষ্ঠতলের ওপর চলাচলের প্রয়োজন হয় এমন কোনো প্রকল্পের জন্য এ ধরনের ক্রেন ব্যবহার করা হয়। এটা সিঙ্গেল-ইঞ্জিন মেশিন, যার অর্থ হলো যে একই ইঞ্জিন যা মেশিনটিকে সরায় তা ক্রেনটিকেও পরিচালনা করে। এ ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহারের কারণেই এই মেশিনগুলো অন্যান্য ক্রেনের তুলনায় অনেক বেশি কম্প্যাক্ট। এ ছাড়া এই আন্ডারক্যারেজ চারটি বিশাল রাবারের চাকাযুক্ত দানব ট্রাকের মতো হওয়ায় রুক্ষ ভূখÐে চলতে সমস্যা হয় না। 

ওভারহেড ক্রেন 

ওভারহেড ক্রেন উঁচুতে স্থাপন করায় এটি ব্রিজ ক্রেন নামেও পরিচিত। একটি গার্ডার ও একটি ক্লাব ট্রলির সমন্বয়ে হুক-অ্যান্ড-লাইন সিস্টেমে অনুভূমিক বরাবর চলাচল করে এই ক্রেন। চলাচলের সুবিধার্থে এতে ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক মোটর। এই ক্রেন সাধারণত বড় কারখানায় উপকরণসমূহ স্থানান্তরে ব্যবহৃত হয়। উপকরণগুলো উত্তোলনের জন্য একটি ক্রেন দ্বারা আচ্ছাদিত এলাকাজুড়ে এবং সেতু বরাবর সরানোর জন্য একটি ট্রলি রাখা থাকে পৃষ্ঠে। ইস্পাতশিল্পে সাধারণ ওভারহেড ক্রেন ব্যবহার করা হয় উত্তপ্ত উপকরণসমূহ নিরাপদে সরানোর জন্য। এ ছাড়া অটোমোবাইলসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কাঁচামাল পরিচালনার জন্য ওভারহেড ক্রেন ব্যবহৃত হয়। এই ক্রেন মেঝেপৃষ্ঠ দখল করে না। 

জিব ক্রেন

এই ক্রেনের একটি বাহু থাকে (একে জিব বা বুম বলা হয়), যার সাহায্যে ভারবহন করে উল্লম্ব অক্ষের চারপাশে ঘোরানো সম্ভব। জিব আর্মের সাহায্যে লোডটি অনুভূমিকভাবে স্থানান্তর করা যায়। এই আর্ম প্রসারিত ও সংকুচিত করা যায় বেশ দূরবর্তী স্থানের মধ্যে। স্টিল স্ট্রাকচার অ্যাসেম্বলি ইয়ার্ড, শিপইয়ার্ড, জাহাজে ভারী বস্তু চালনা করতে ব্যবহৃত হয় এই ক্রেন।

ক্রলার ক্রেন 

ক্রলার ক্রেনের বুম একটি আন্ডারক্যারেজে মাউন্টকৃত ট্র্যাকের সঙ্গে স্থাপন করা থাকে, যা ক্রেনটিকে স্থিতিশীল ও গতিশীল করে। এই ক্রেনগুলোর উত্তোলন ক্ষমতা প্রায় ৪০ থেকে ৪ হাজার টন। তাৎক্ষণিক গতিশীলতার কারণে যেকোনো সাইটে দ্রæত কাজ করা সম্ভব হয়। এর প্রশস্ত ট্র্যাকগুলো বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ওজন ছড়িয়ে দেয় বিধায় নরম মাটিতে কাজ করতে সুবিধা হয়। তা ছাড়া এই ক্রেন লোড নিয়েও চলাচল করতে সক্ষম। তবে বাড়তি ওজনের কারণে এটা পরিবহন করা কিছুটা ব্যয়বহুল। 

ভাসমান ক্রেন 

ভাসমান ক্রেনগুলো প্রধানত সেতু ও বন্দর নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো এগুলো জাহাজের পণ্য খালাসে ব্যবহৃত হয়। ডুবে যাওয়া জাহাজ বা নৌযান উদ্ধার করতেও ভাসমান ক্রেনের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। 

অল-টেরেইন ক্রেন 

অল-টেরেইন ক্রেন একধরনের হাইব্রিড, যা একটি ট্রাক-মাউন্ট ও রাফ সারফেস ক্রেনের মিশেল। সব ধরনের পরিবেশে চলাচল ও কর্মকাÐ পরিচালনা করার সুবিধার্থে এই ক্রেনে উপযোগী শক্তিশালী চাকাজুড়ে দেওয়া হয়।

পিক অ্যান্ড ক্যারি

পিক অ্যান্ড ক্যারি ক্রেন মোবাইল ক্রেনের মতো, যা সর্বজনীন রাস্তায় ভ্রমণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ক্রেনগুলোর কোনো স্টেবিলাইজার লেগ বা আউটরিগার নেই। স্বল্প ব্যাসার্ধের মধ্যে লোড তুলে তা যেন দীর্ঘ গন্তব্যে পাড়ি দিতে পারে, সেভাবেই ক্রেনগুলো প্রস্তুত করা হয়। এই ক্রেন অস্ট্রেলিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। 

সাইডলিফট ক্রেন

এই ক্রেন চলতে সক্ষম একধরনের ট্রাক বা আধা ট্রেলার, যা কনটেইনার উত্তোলন ও পরিবহন করতে সক্ষম। বিশেষ ধরনের এই ক্রেনগুলো স্বাভবিক বস্তু উত্তোলনের পাশাপাশি কোনো ট্রেন বা ট্রাকে থাকা কনটেইনার আড়াআড়িভাবেও ওঠাতে-নামাতে পারে।

ক্যারি ডেক ক্রেন 

ক্যারি ডেক ক্রেন ছোট চার চাকাবিশিষ্ট, যার একটি ৩৬০ ডিগ্রি ঘূর্ণমান বুম ঠিক কেন্দ্রে স্থাপন করা থাকে। এই বুমের নিচে এক প্রান্তে থাকে একটি অপারেটর ক্যাব। পেছনের অংশে ইঞ্জিন এবং চাকার ওপরে থাকে একটি সমতল ডেক। যুক্তরাষ্ট্রে আবিষ্কৃত এই ক্রেন সীমিত লোড উত্তোলন ও স্বল্প দূরত্বে তা বহন করতে সক্ষম।

ট্র্যাভেল লিফট ক্রেন

একটি ট্র্যাভেল লিফট (বোট গ্যান্ট্রি ক্রেন বা বোট ক্রেনও বলা হয়) ক্রেন, যার দুটি আয়তক্ষেত্রাকার সাইড প্যানেল এক প্রান্তের শীর্ষে একটি একক স্প্যানিং বিম দ্বারা যুক্ত থাকে। এই ক্রেনগুলোর লম্বা সুপার স্ট্রাকচার নদী-সমুদ্র থেকে নৌকা, ছোট আকারের জাহাজ ও অন্যান্য জলযান তুলতে ও স্থানান্তরে দারুণ উপযোগী।

রেল ক্রেন

রেলপথে ব্যবহারের জন্য এই ক্রেনে রয়েছে ফ্ল্যাঞ্জযুক্ত চাকা, যা একটি ফ্ল্যাটকারের ওপর মাউন্ট করা থাকে। ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণ, দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন উদ্ধার, ইয়ার্ডে মালামাল পরিচালনা করতে এই ক্রেন ব্যবহার করা হয়।

এরিয়াল বা এয়ার ক্রেন

স্কাই ক্রেনও বলা হয় এই ক্রেনকে। বিশেষ এই কেনকে দেখে সাধারণত হেলিকপ্টারই মনে হবে। আসলে হেলিকপ্টার হিসেবেই এই ক্রেনগুলো ডিজাইন করা হয়। সাধারণত যেসব দুর্গম এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থার  সাধারণ ক্রেন যেতে অক্ষম এবং ভারী উপকরণগুলো আনা-নেওয়া কঠিন, সেখানে এই এয়ার ক্রেন ব্যবহার করা হয়। পাহাড়ি এলাকা, উঁচু ভবন, সমুদ্রদ্বীপসহ প্রভৃতি স্থানে পণ্য পৌঁছাতে এই এরিয়াল ক্রেন তুলনাহীন। এ ছাড়া দাবানল ও অগ্নিকাÐের আগুন নেভাতেও ব্যবহৃত হয় এই এয়ার ক্রেন। 

ক্লাইম্বিং ক্রেন

এই ক্রেনগুলো সাধারণত উইন্ড টারবাইন টাওয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। উঁচু টারবাইনের মতো টাওয়ার তৈরিতে একটি বড় ক্রেন স্থাপন করার পরিবর্তে তুলনামূলক ছোট ক্রেন যুক্ত করা হয়। এই ক্রেনগুলো ক্রমেই টাওয়ারের ওপরে উঠতে উঠতে এর বিভিন্ন অংশ যোগ করতে থাকে। শীর্ষে আরোহণ, জেনারেটর উত্তোলন, রোটর বেøড স্থাপনসহ সমধর্মী কাজে এই ক্রেন অত্যন্ত কার্যকর।

রিং ক্রেন

রিং ক্রেনগুলো এখন পর্যন্ত ডিজাইন করা বৃহত্তম ও ভারবহী ভূমিভিত্তিক ক্রেন। একটি রিং-আকৃতির সুপারস্ট্রাকচার ট্র্যাকের ওপরে এই ক্রেনগুলো পরিচালিত হয়। বিশাল বিশাল প্রি-ফেব্রিকেটেড প্যানেলসহ অত্যন্ত ভারী উপকরণ উত্তোলন ও সংযোগ করতে এই ক্রেনের জুড়ি নেই। অনায়াসেই হাজার হাজার টন বহন করতে সক্ষম এই দানব ক্রেন।

হ্যামারহেড ক্রেন

এটি এক দৈত্যাকার ক্যান্টিলিভার ক্রেন। এই ক্যান্টিলিভার বা জিবের সামনের অংশটি উত্তোলন ট্রলি বহন করে, জিবটিকে পেছনের দিকে প্রসারিত করে, যাতে যন্ত্রপাতির ওজন ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। এই ক্রেন ১৯ শতকের শুরুতে জার্মানিতে বিকশিত হয়েছিল। তখন যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে এই ক্রেন ব্যবহৃত হতো। পৃথিবীতে মাত্র ৬০টি হ্যামারহেড ক্রেন তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে অবশিষ্ট আছে ৭টি। এগুলো এখন পর্যটক আকর্ষক হিসেবে সংরক্ষিত।

গ্যান্ট্রি ক্রেন

গ্যান্ট্রি ক্রেন অনেকটা ওভারহেড ক্রেনের মতোই রেল বরাবর অনুভূমিকভাবে চলে। সাধারণত একটি একক বিম (মনো-গার্ডার) বা দুটি বিম (টুইন-গার্ডার) এর ওপর লাগানো হয়। ক্রেন ফ্রেমটি গ্যান্ট্রি সমর্থিত বিম এবং চাকাযুক্ত, যা গ্যান্ট্রি রেলে চলে। ভারী উপকরণ সরাতে বিশেষ করে বন্দর ও শিল্পকারখানায় এই ক্রেন ব্যবহার করা হয়।

ডেক ক্রেন

এই ক্রেন সাধারণত জাহাজ বা নৌযানে স্থাপন করা হয়। যেখানে তীরে আনলোডিং-সুবিধা নেই, সেসব জায়গায় সরাসরি নৌযান থেকেই এই ক্রেনের মাধ্যমে পণ্য লোড-আনলোড করা হয়। 

বাল্ক-হ্যান্ডলিং ক্রেন

এই ক্রেনগুলো হুক বা ¯িøং ব্যবহারের পরিবর্তে শেল গ্র্যাব বা বালতির আদলে ডিজাইন করা হয়েছে। এগুলো বাল্ক কার্গোর জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন কয়লা, খনিজ, স্ক্র্যাপ মেটাল ইত্যাদি।

লোডার ক্রেন

লোডার ক্রেন (আর্টিকুলেটিং ক্রেনও বলা হয়) হাইড্রোলিকভাবে চালিত আর্টিকুলেটেড আর্ম, যা একটি ট্রাক বা ট্রেলারে লাগানো হয় এবং কার্গো লোড/আনলোড করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ক্রেন ব্যবহার না হলে অসংখ্য জয়েন্টকে ছোট আয়তনে ভাঁজ করা যায় বিধায় এর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। 

স্ট্যাকার ক্রেন

বিশেষ এই ক্রেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে (কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত) পরিচালিত হয় বিভিন্ন ওয়্যার হাউসে মালামাল গুদামজাত করতে ও সেখান থেকে পণ্য সংগ্রহে। এই ক্রেনে যুক্ত থাকে বিশেষ ফর্কলিফট, যা প্রয়োজনানুযায়ী প্ল্যাটফর্ম ও র‌্যাকে পণ্য স্থানান্তর করতে সহায়তা করে। সাধারণত এ ধরনের ক্রেন হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারকদের বড় ফ্রিজার গুদামে ব্যবহৃত হয়। এই অটোমেশন ফর্কলিফট হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় কাজ করার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দেয়।

বøক-সেটিং ক্রেন

এই ক্রেন বাঁধ ও সড়ক নির্মাণে কংক্রিট বা পাথরের বøক স্থাপনে ব্যবহৃত হয়।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top