মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে পোড়ামাটির ভাস্কর্যের ব্যবহার চলে আসছে। ইতিহাস বলে, মেসোপটেমিয়ান কি সুমেরীয় সভ্যতার মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে এই শিল্পের প্রচলন ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপ ও কলম্বিয়ান জনগোষ্ঠীর কাছে টেরাকোটা শুধু মাত্র সিরামিক হিসেবেই পরিচিত ছিল। প্রাচীনকালে এই পদ্ধতিতে নানা ধরনের পাত্র, ইট ইত্যাদি তৈরি করা হতো। ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫ হাজার বৎসর বা তারও আগে সিন্ধু সভ্যতায় প্রচুর টেরাকোটার নিদর্শন পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে ছিল নানা ধরনের তৈজসপত্র, দেব-দেবীর মূর্তি, ফলক ইত্যাদি। মহেঞ্জোদাড়ো (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-১৫০০) নগর-বসতি আবিষ্কৃত হলে সেখানে কিছু পোড়ামাটির নারীদেহ ফলক খুঁজে পাওয়া যায়। একইভাবে পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মৌর্য সা¤্রাজ্য, গুপ্ত সা¤্রাজ্যেও।
টেরাকোটা শব্দের আভিধানিক উৎপত্তি হচ্ছে ১৮ শতাব্দীর প্রথমভাগে। শাব্দিক অর্থে একে পোড়ামাটি বলা যায়। মানুষের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পোড়ামাটির তৈরি সব দ্রব্যই এককথায় টেরাকোটা নামে পরিচিত। আঠালো মাটির সঙ্গে খড়কুটো, তুষ প্রভৃতি মিশিয়ে উপযোগী কাদামাটির মÐ তৈরি করা হয়। সেই মাটি থেকে মূর্তি, দৃশ্যাবলি ইত্যাদি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে টেরাকোটায় রূপ দেওয়া হয়।
টেরাকোটাশিল্প প্রাচীন যুগের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক দিকগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। যে নামেই পরিচিত হোক, বাংলায় পোড়ামাটির ব্যবহার হাজার বছরের পুরোনো শিল্প। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর ও সোমপুর বৌদ্ধবিহার, কুমিল্লার ময়নামতি, দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির এবং বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো প্রতœতাত্তি¡ক স্থানগুলোতে প্রাচীনকালের বিভিন্ন আকারের টেরাকোটার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। পাল পরবর্তী যুগে স্থাপত্যে টেরাকোটার ব্যবহার আরও ব্যাপকতা ও পূর্ণতা লাভ করে। ১৬ শতাব্দীতে মন্দির স্থাপত্যে টেরাকোটা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে টেরাকোটার বিস্তৃত ব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে বেশি তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় সুলতানি আমলে মসজিদ স্থাপত্যে। ১২ শতাব্দীর শেষভাগে তুর্কি নেতা বখতিয়ার খিলজির বাংলাদেশ বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম স্থাপত্যের যাত্রা শুরু হয়। তখন প্রচুর মসজিদের নির্মাণ হয়। ওই সময়ে পাথর ও শক্ত কাঠের বেশ দুষ্প্রাপ্যতা ছিল। ফলে কাঠামো উপকরণ হিসেবে মাটি পোড়ানো ইটের বহুল ব্যবহার ছিল। শুধু কাঠামোতেই নয়, বরং পরবর্তী সময়ে মসজিদের মিহরাব, অভ্যন্তরীণ দেয়াল, বাহ্যিক দেয়ালে টেরাকোটা অলংকরণ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ধারা অব্যাহত ছিল ইংরেজদের হাতে পশ্চিমা সংস্কৃতির আমদানি হওয়া পর্যন্ত।
মাটির সহজলভ্যতার কারণে টেরাকোটা শিল্পের চর্চা প্রাচীনকাল থেকে করে আসছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের দিকে বাংলাদেশের উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে বিকশিত সভ্যতায় এই জাতীয় নমুনা পাওয়া গেছে। বলা যায়, বহু আগে থেকেই বাংলাদেশের শিল্পীরা টেরাকোটা তৈরির কৌশল শিখেছিল।
টেরাকোটার দুইটা ধরন বেশি পরিচিত। একটি টেরাকোটা ফলক, অপরটি মৃৎশিল্প। ফলক বলতে সাধারণত পোড়ানো ইটের ব্যবহারই বেশি পাওয়া যায়। বাংলার শিল্পীরা এই টেরাকোটার কাজগুলো স্থাপত্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন। বাংলায় পাথর সহজলভ্য ছিল না। তাই শিল্পীরা এই সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শিল্পীরা বাংলার অববাহিকার জলোচ্ছ¡াস মাটিকে স্থাপত্যসজ্জার জন্য শিল্পের বস্তুতে পরিণত করেছিলেন। টেরাকোটা একসময় গুরুত্বপূর্ণ ভবন সুন্দরভাবে উপস্থাপনের অন্যতম মাধ্যম ছিল।
বর্তমান ও আধুনিক স্থাপত্যকর্মে টেরাকোটার ব্যবহার এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও একটা সময় মনে করা হয়েছিল, এ শিল্প আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই হ্রাস পাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নান্দনিকতা ও প্রযুক্তিগতভাবে টেরাকোটা হচ্ছে আরও উন্নত ও বহুমুখী। কারিগরেরা কাদামাটি চেনার ক্ষেত্রে আরও দক্ষ হচ্ছেন এবং নতুন নতুন প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করছেন।
স্থাপত্যচর্চায় টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ম্যুরাল আবহমান সাংস্কৃতিক প্রভাব ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নান্দনিকতার সংবেদন প্রকাশের জন্য একটি নিখুঁত ও নিরবধি সংযোজন হতে পারে। কাদামাটি রং ও আবহেরও প্রতীক। মূলত, প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক রঙের উপস্থিতি ইন্টেরিয়র ডিজাইন টেরাকোটাকে একটি পৃথক মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। টেরাকোটা ম্যুরাল তুলনামূলকভাবে সস্তা ও টেকসই। ব্যয়বহুল শিল্পকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি সময়ের সঙ্গে বিবর্ণ হতে পারে। কিন্তু বাহ্যিক ক্ষতি এড়ানো গেলে পোড়ামাটির ম্যুরালগুলো আজীবন স্থায়ী হতে পারে। বর্তমানে সমসাময়িক স্থাপত্য অনুশীলনে পোড়ামাটির ব্যবহার স্থাপত্যের অভ্যন্তরীণ ও বহির্ভাগে দেখা যায়। টেরাকোটা ম্যুরাল বা ফলকটি এতই বহুমুখী যে এটি আমাদের আধুনিকতাবাদী স্থাপত্যের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে যেতে পারে, অভ্যন্তরীণ ও বহিরাঙ্গন উভয় ক্ষেত্রেই। তবে দুটি অংশে এর ব্যবহারের উপযোগিতা ও পদ্ধতি ভিন্ন।
টেরাকোটা শত শত বছর ধরে বাংলা সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মৃৎপাত্র বা তৈজসপত্র সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একসময় এটিকে হাতে তৈরি গ্রামীণ পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। আধুনিক তৈজসপত্রের ভিড়ে এর ব্যবহার কমে গেলেও গৃহ ও অন্দরসজ্জায় এর আভিজাত্যের মূল্য আছে। একদিকে মৃৎপাত্রের সামগ্রীগুলো যেমন এখন শো-পিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তেমনি আধুনিক উৎসব আয়োজনে, পরিবেশনায় ভিন্নতা আনে। আধুনিক শহরগুলোতে, অবকাশবাড়ির ভেতর ও বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির ম্যুরাল আমাদের শিকড়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। ঢাকায় এবং বড় শহরগুলোতে পোড়ামাটির পণ্য বিক্রি দেখলে বোঝা যায়, মৃৎপাত্র একটি নতুন ডিজাইন ও ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে নতুন করে জনপ্রিয় হচ্ছে। ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে বিদেশি ক্রেতাদেরও মনোযোগ কাড়ছে।
পোড়ামাটির ব্যবহার দেয়ালের একঘেয়েমি ভেঙে দেয়। কখনো কখনো এটি আভিজাত্যের পাশাপাশি সংস্কৃতি সচেতনতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। দেয়াল সাজানোর জন্য পোড়ামাটির পাত্র, টেরাকোটা ফলক, ম্যুরাল ইত্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাড়ির সাজসজ্জায় আঞ্চলিক আবহ বজায় রাখতে পোড়ামাটির ম্যুরালের ব্যবহার চোখে পড়ে। পোড়ামাটির ম্যুরাল লবি বা বাগানে একটি শৈল্পিক পরিবেশ তৈরি করে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ও গণপরিসরগুলোতে যেমন ক্যাফে, বুটিক শপ, কনভেনশন হল বা ছোট অফিসের বিন্যাসে অনেকেই টেরাকোটা অলংকরণ ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট থিম বা আবহকে ফুটিয়ে তুলতে চান।
পোড়ামাটির ম্যুরাল বা পোড়ামাটির আবহগুলো স্থাপত্যের অঙ্গসজ্জায় ক্ল্যাসিক উপাদান হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এটি একটি ল্যান্ডস্কেপ, বাগান, প্লাজা বা যেকোনো বহিরাঙ্গন সাজানোর জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পোড়ামাটির ফলকগুলো হয় প্রতিলিপিযোগ্য উপাদান অথবা দেয়ালে বুনট বিন্যাসে নতুন নকশা ও কৌশলগুলোর সঙ্গে পুরোনো জনপ্রিয়তায় ফিরে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। পোড়ামাটির দেয়াল তৈরি করা ঐতিহ্যবাহী বাঙালি লোকসংস্কৃতির অংশ হিসেবে বরাবরই জনপ্রিয় ছিল। পাঁচ তারা হোটেল সোনারগাঁওয়ের লবিতে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী ও পর্যটকদের সামনে দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে টেরাকোটার মাধ্যমে। শাপলা ফুল, গরুর গাড়ি, ধান কাটাসহ কৃষকের বিভিন্ন কর্মকাÐ ইত্যাদি আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি কিংবা পছন্দের অব্যক্ত প্রকাশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ভবনে এবং বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি টেরাকোটা ম্যুরালে দেশমাতৃকার জন্য গৌরবময় আত্মত্যাগ এবং দুঃসাহসী কর্মকাÐকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বিষয়বস্তু হিসেবে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেরাকোটার মাধ্যমে ইতিহাসের গল্প বলার বা গল্প সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাদামাটির নকশায় তাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের নানা গৌরবময় অধ্যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মি গলফ ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু মিলিটারি মিউজিয়াম, বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটার, রাজশাহী কলেজ, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ, রংপুরে টেরাকোটা ম্যুরাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একইভাবে ভাষা আন্দোলনের সারমর্ম উঠে আসছে বাংলা একাডেমি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দেয়ালে। বাংলা একাডেমির টেরাকোটা চিত্রে মায়ের ভালোবাসাকে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। অপর দিকে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বাইরের দেয়ালে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বর্ণগুলো একত্র করা হয়েছে টেরাকোটার মাধ্যমে।
আমাদের আধুনিক স্থাপত্যচর্চায় টেরাকোটার ব্যবহার মেধা ও সৃষ্টিশীলতার একটি বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিফলন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উন্মুক্ত চত্বরের একটি বিশেষায়িত দেয়ালকে অলংকৃত করা হয়েছে টেরাকোটার মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিজয়ের মুহূর্ত পর্যন্ত পুরো ইতিহাস গ্রন্থিত হয়েছে একই ক্যানভাসে। সবুজ উদ্যানের শান্ত জলরাশিকে সঙ্গে নিয়ে পোড়ামাটির এ দেয়াল নীরবে ইতিহাসের পাঠ দিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ততম নগরের অধিবাসীদের। বৃটিশ কাউন্সিলসংলগ্ন সড়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মরণে যে স¥রণিকা তৈরি করা হয়েছে, তা পুরো শিক্ষায়তনের শিকড় সন্ধানী চরিত্র ধারণ করতে পেরেছে।
সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অনুভ‚তি প্রকাশ করতেও টেরাকোটার ব্যবহার করা যায়। টেরাকোটার নবীনতম ব্যবহার হচ্ছে টাইলস হিসেবে। শিল্পপণ্য হিসেবে টেরাকোটার উৎপাদন একে আরও সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করেছে। আধুনিক টেরাকোটা টাইলস অট্টালিকার দেয়ালের জ্যামিতিক রেখায় বসানো হায়। টাইলসকে আদতে টেরাকোটা বলা যায় কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে টেরাকোটার মূল চেতনাকে ধারণ করার জন্য টাইলস মডিউল ব্যবহার টেরাকোটার প্রতি আগ্রহের নামান্তর। একই আবহ তৈরি করে বলে উচ্চবিত্তে কিংবা অভিজাত আবাসন ইউনিটে স্থপতিদের নানা শৈল্পিক প্রকাশ এখন পাওয়া যায় ইট, সিমেন্ট কিংবা এমনকি কাঠের ব্যবহারে, যা টেরাকোটারই আরেকটি অধ্যায়। মাটির তৈরি টেরাকোটা তার চারপাশের পুরোনো ইটের ভবনগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। অপর দিকে নিজের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করে কংক্রিটের সঙ্গে বিপরীত অবস্থানের মধ্য দিয়ে। রিলিফওয়ার্ক, মূর্তি, ফলক, ম্যুরাল ও অন্যান্য ছোট স্থাপত্যসজ্জায় তাই এর স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার হয়ে আসছে।
স্থপতি সৈয়দ আবু সালেক
লেখক:
সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, এমআইএসটি
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৪৯ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৩