বর্ণিল শহর বো-কাপ

বো-কাপ। দক্ষিণ আফ্রিকার ঐতিহাসিক বর্ণিল শহর। রাজধানী কেপটাউনের অদূরে সিগন্যাল পাহাড়ের কোল ঘেষে মনোরম এ প্রাচীন শহরটি। শহরটির প্রতিটিই স্থাপনাই হরেক রঙে রাঙানো। যেন পটে আঁকা ছবি। পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান আছে, যেখানে গেলেই চোখে ধরা দেয় বর্ণিল সংস্কৃতি, নান্দনিক স্থাপনার সঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্য। বো-কাপ তেমনি একটি শহর। আর এই নান্দনিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর বিশ্বের হাজারো পর্যটক ভিড় করেন এ শহরে। এই বাহারি রঙের শহরটির সলুকসন্ধান তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ রবিউল্লাহ।

২৬০ বছরের নিদর্শন ও ইতিহাসসমৃদ্ধ বো-কাপ। সারি সারি হরেক রঙের ভবন আর খোয়া-পাথরের দৃষ্টিনন্দন রাস্তার জন্যও বিখ্যাত। বো-কাপের অতীত নাম মালয় কোয়ার্টার। মালয় কোয়ার্টার নামে পরিচিত হওয়ার মূল কারণ এখানে মালয়েশিয়ান, আফ্রিকান, ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কার সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক আমলে ১৭৬০ সালের শেষের দিকে বো-কাপে জমি কিনেছিলেন ইয়ান দে ভাল নামে একজন ওলন্দাজ। এক বছর পর দে ভালের ভূসম্পত্তি প্রসারিত হতে থাকে। এরপর এটি একসময় মালয় কোয়ার্টার নামে পরিচিতি পায়। এর আগে এলাকাটি ভালের নামানুসারে ভালেন ড্রপ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৬৩ সালে ইয়ান ভাল এখানে ঘর নির্মাণ করে নিজের ক্রীতদাসদের কাছে বরাদ্দ দিতে শুরু করেন। ‘কেপ মালয়েশ’ নামে পরিচিত এই ক্রীতদাসদের বেশির ভাগই মালয়েশিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কার ছিল। বাকিদের আফ্রিকার অন্যান্য অংশ থেকে কাজের উদ্দেশে কেপটাউনে আনা হয়েছিল। মূলত এ জন্যই ‘মালয়’ নামের উৎপত্তি।

কেপটাউন সিটি সেন্টার ও ডি ওয়াটারকান্ট থেকে ১০ মিনিট ও ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট থেকে ২০ মিনিটে হেঁটে যাওয়া যায় বো-কাপ শহরে। বর্তমানে গোলাপি, কমলা, চুন-সবুজ, বেগুনি, ফিরোজা, হলুদ, বাদামি, নীলসহ সারিবদ্ধ রঙিন ভবনগুলো বো-কাপের মূল আকর্ষণ। এ ছাড়া এখানকার বাহারি খোয়া-পাথরের রাস্তাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। ওলন্দাজ উপনিবেশকালে তৎকালীন হল্যান্ড (নেদারল্যান্ড) থেকে এসব পাথর আফ্রিকায় আমদানি করা হয়। খোয়া-পাথরগুলো ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা থেকে বো-কাপবাসীদের সুরক্ষা দেয়।

তবে ভবনগুলো বর্তমানে বাহারি রঙে সজ্জিত করা হলেও অতীতে এমন ছিল না। আগে জমি লিজ গ্রহণের সময় সব বাড়ির রং সাদা হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। ১৮ দশকের দিকে বাড়িগুলোর রঙে পরিবর্তন আসে। ১৮৩৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসরা এখানকার জমি কেনার অনুমতি পায়। এরপর বাড়ির রং সাদা হওয়ার নিয়মটি বাতিল হয়। স্বাধীনতার প্রকাশের অংশ হিসেবে রঙের এই প্রতীকী চর্চা শুরু হয়েছিল, যা ১৮০ বছর ধরে চলমান। বো-কাপে বেশির ভাগ বাড়িই একতলা, যা ১৭৯০ থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যে কেপ ওলন্দাজ এবং কেপ জর্জিয়া স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে নির্মিত। তবে আঠারো শতকের প্রথম দশকে কিছু বাড়িতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কারণে ব্রিটিশ শৈলী নজরে পড়ে।

বো-কাপের প্রায় সব রাস্তায় ম্যুরাল দেখা যায়, যেগুলোতে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সংমিশ্রণ ফুটে আছে। বো-কাপের প্রাচীনতম বা সবচেয়ে পুরোনো বাড়িটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ঊনিশ শতকের গৃহসজ্জাসামগ্রী। বাড়িটির পেছনে গাছ ও দ্রাক্ষালতাবেষ্টিত খোয়া-পাথরের ছোট আঙিনা সরু গলির মাধ্যমে রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। সপ্তাহের সোম থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকে।

ঐতিহাসিক এই বো-কাপ শহরে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসতি রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে এলাকাটি বহু সংস্কৃতির অংশ হলেও এর জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলিম। ১৮২০ সালের দিকে জাভা ও সিলন (বর্তমান নাম ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা) থেকে রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত মুসলিমরা এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম মসজিদটিও বো-কাপেই অবস্থিত, যা আউয়াল মসজিদ নামে পরিচিত। আরবি ভাষায় আওয়াল অর্থ প্রথম বা শুরু। ইন্দোনেশীয় যুবরাজ ও তুয়ান গুরু আবদুল্লাহ ইবনে কাদি আল-সালাম ১২ বছর আফ্রিকার রোবেন দ্বীপে বন্দী থাকার পর মুক্ত হয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীবালে মাদ্রাসা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।

মুসলিমদের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেও আওয়াল মসজিদটি বিবেচিত। এ ছাড়া বো-কাপ শহরের লং স্ট্রিটে রয়েছে আঠারো শতকে নির্মিত পাম ট্রি মসজিদ। এর সামনে শতবর্ষী দৃষ্টিনন্দন পামগাছের জন্যই এমন নামকরণ করা হয়েছে মসজিদটির। বুয়েটেনগ্র্যাচ স্ট্রিটে রয়েছে প্রাচীনতম নুরুল ইসলাম মসজিদ। তুয়ান গুরুর ছেলে আবদুল রউফ ১৮৪৪ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। এ ছাড়া খিয়াপিনি, হেলিগার, লং স্ট্রিটসহ বিভিন্ন স্ট্রিটে রয়েছে প্রায় ডজনখানেক মসজিদ। বো-কাপের একটি গুরুত্ববহ স্থান তানা বারু। এটি কেপ মুসলমানদের নির্মিত প্রথম কবরস্থান। তুয়ান গুরুসহ দক্ষিণ আফ্রিকার বিশিষ্ট মুসলমানদের কবর রয়েছে এতে। বো-কাপ শহর দেখতে আসা প্রায় সব পর্যটকই তানা বারু দেখে যান। 

ছোট শহর হওয়ায় বো-কাপের সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকেরা হেঁটেই ঘুরে দেখেন। এখানকার রেস্তোরাঁগুলোতে হালাল ও অ্যালকোহলমুক্ত খাবার পরিবেশন করা হয়। এর মধ্যে ফলমূল, সবজি ও মাংস মিশ্রিত কেপ মালয় খাবারের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। কেপ মালয় খাবার মূলত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার রন্ধনশৈলীর মিশ্রণ। কেক, সমুচা, কুইস্টার, জ্যাম কফি, ব্রিডিজ, কারি ও বোবোটি ছাড়াও প্রাচ্য থেকে আমদানি করা হলুদ, জাফরান, মরিচ ও মসলার সমাহার দেখা যায় বো-কাপের রেস্তোরাঁগুলোতে। বাহারি ও মন জুড়ানো নকশার পোশাক, হাতে তৈরি গয়না, উট পাখির চামড়ার হাতব্যাগ, জুতা, ব্রোঞ্জের মূর্তিসহ হস্তশিল্পের সরবরাহ মেলে এখানে। বিশে^র সবচেয়ে বড় ডায়ামন্ডের পাইকারি বাজার রয়েছে বো-কাপ শহরে। 

কেপটাউনের অদূরে অবস্থিত হওয়ায় মিশ্র সংস্কৃতির ইতিহাসসমৃদ্ধ বো-কাপ দেখতে মোটামুটি সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে। ১৬ ও ১৭ শতকে ডাচ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা আনা ক্রীতদাসদের বংশধরদের মাধ্যমে বিকশিত হয় বো-কাপ। এলাকাটি এখনো তার প্রাণবন্ত ইতিহাস ও ধর্মের মিশ্রণের জন্য পরিচিত, যার কারণে দর্শনার্থীদের কাছে বো-কাপ আকর্ষণীয়। কেপটাউন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় সাড়ে ২১ কিলোমিটার দূরে আধা ঘণ্টায় বো-কাপে বাস, ট্যাক্সি বা রাইড শেয়ারিংয়ে যাওয়া যায়। এখানে আছে তিন, চার ও পাঁচতারকা মানের আবাসনব্যবস্থা। তাই যাঁরা রঙিন শহর বো-কাপ দেখতে চান, তাঁরা সহজেই যেতে পারবেন। 

মোহাম্মদ রবিউল্লাহ 

তথ্যসূত্র:

ট্রিপ অ্যাডভাইজার, কেপটাউন ডট ট্রাভেল,

দ্য কালচার ট্রিপ ডটকম, ট্রিপ সেভি ডটকম

ংঃধৎৎধনরঁষ@মসধরষ.পড়স

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৪৯ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top