প্লাস্টার ও প্লাস্টারে ফাটল

একটি ইমারতের ইটের গাঁথুনি কিংবা অমসৃণ কংক্রিটকে মসৃণ করতে সিমেন্ট-বালুর মিশ্রণে যে বহিরাবরণ দেওয়া হয়, তার নামই প্লাস্টার বা আস্তর। অন্যদিকে খারাপ আবহাওয়া ও বৃষ্টির পানি ইটের গাঁথুনির ভেতরে যেন না ঢোকে সে জন্যও প্লাস্টার অতি জরুরি। ফলে প্লাস্টার বা আস্তরের কাজের গুণগত মানের ওপর একটা ইমারতের স্থায়িত্বতা অনেকটা নির্ভরশীল। 

প্লাস্টারের গুণগত মান যদি ভালো না হয়, বিশেষ করে পানি শোষণক্ষমতা রোধ করা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে বৃষ্টির পানি কিংবা বাতাস থেকে আর্দ্রতা শোষণ করার ফলে দেয়ালে ড্যাম্প দেখা দিতে পারে। যাতে রং নষ্ট হওয়া, প্লাস্টারে ফাটল দেখা দেওয়া, সারফেসে ফোসকা ফোসকা হয়ে প্লাস্টার ঝরে পড়াসহ পুরো কাঠামোটাকেই দুর্বল করে দিতে পারে। প্লাস্টারের এই পানি শোষণক্ষমতা বিভিন্ন কারণে বাড়তে পারে। যেমন:

বালুর এফএম (ফাইননেস মডুলাস) কম হওয়া

বালু-সিমেন্টের অনুপাত সঠিক না হওয়া

বালু-সিমেন্ট ভালোমতো মিশ্রিত না হওয়া

প্লাস্টার সঠিকভাবে কিউরিং না করা

বালুতে পলি মাটি মিশ্রিত থাকা

বালুতে লবণ মিশ্রিত থাকা

প্লাস্টার করার আগে দেয়াল ঠিকমতো ভিজিয়ে না নেওয়া ইত্যাদি

অতএব, প্লাস্টার ও ওয়েদারপ্রæফ কোটের গুণাগুণ ও ফিনিশিং ঠিক রাখতে ব্যবহৃত সব মালামাল এবং কর্মপদ্ধতির গুণগত মান নিশ্চিত করা জরুরি। এখানে উল্লেখ্য, প্লাস্টারের বালু তুলনামূলকভাবে একটু দানাদার (এফএম ১.৫) হওয়া এবং কাদা-মাটি, খড়-কুটা, কাঠ-কয়লা, লবণ ইত্যাদি মুক্ত হওয়া জরুরি। বালু ব্যবহারের আগে চালনি দিয়ে চেলে নেওয়া এবং প্রয়োজনে পানি দিয়ে ধুয়ে নেওয়া দরকার। 

এ ছাড়া, প্লাস্টারের গুণগত মান রক্ষার্থে সিমেন্ট মর্টার তৈরি করতে সিমেন্ট ও বালু নির্দিষ্ট অনুপাতে প্লেইন শিট অথবা শক্ত মেঝের ওপর বিছিয়ে শুকনো অবস্থায় ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। শুকনো মিশ্রণের রং যতক্ষণ পর্যন্ত সর্বত্র এক রকম দেখা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মেশাতে হবে। তারপর অল্প অল্প করে পানি মিশিয়ে প্লাস্টারের উপযোগী করে কাজে লাগাতে হবে। প্লাস্টারের মর্টার বেশি নরম কিংবা শক্ত হওয়া ঠিক নয়।

প্লাস্টারের ক্ষেত্র ব্রিক কিংবা আরসিসি ওয়ার্ক যা-ই হোক না কেন, মর্টার লাগানোর আগে অবশ্যই ভালোমতো পরিষ্কার করে (আলগা কাদা-মাটি, শেওলা ইত্যাদি) পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনবোধে দেয়ালপৃষ্ঠে সিমেন্ট গ্রাউটিং করে (সিমেন্ট ও পানির পাতলা মিশ্রণের প্রলেপ দেওয়া) তার ওপর মর্টার লাগিয়ে প্লাস্টারের ফিনিশিং দিতে হবে। ফিনিশিং দেওয়ার সময় শুকনো মর্টার বা পানি ব্যবহার করা যাবে না। 

প্লাস্টার ফিনিশিং দেওয়ার ক্ষেত্রে যত দূর সম্ভব লেভেল ঠিক রাখার চেষ্টা করতে হবে, নইলে রঙের কাজ করার সময় লাইম পুটি করার জন্য অধিক পরিমাণে মালামাল খরচ হওয়াসহ রঙের ফিনিশিং ভালো করা যাবে না। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, প্লাস্টার করার জন্য দেয়াল অতিরিক্ত ভেজানো ঠিক নয়। দেয়াল বেশি ভেজানো হলে প্লাস্টার সারফেস ফিনিশিং দিতে সমস্যা হয় এবং শুকানোর পর সারফেসে ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দিয়ে থাকে।

প্রসঙ্গত, প্লাস্টার শুকানোর পর নানা কারণে সারফেস ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দিতে পারে। যেমন:

প্লাস্টারের আগে দেয়াল অতিরিক্ত ভেজানো

সিমেন্ট-বালুর মিশ্রণে মর্টার তৈরির সময় বেশি পানি দেওয়া

প্লাস্টার ফিনিশিং দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর থেকে পরবর্তী ৭ দিন (ন্যূনতম) ঠিকমতো কিউরিং না করা

মর্টার তৈরির সময় বালু-সিমেন্ট সঠিকভাবে মিশ্রিত না হওয়া

আবহাওয়ার তারতম্য ঘটা ইত্যাদি

ফলে, প্লাস্টারের গুণগত মান রক্ষার্থে কাজ করার সময় উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, প্লাস্টারের কাজে পানির ব্যবহার সঠিক হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, পানি সিমেন্টের সঙ্গে মিশে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়। যার ফলে সিমেন্ট মর্টার জমাটবদ্ধ হয়ে কঠিন বস্তুতে পরিণত হয় এবং পানি ও সিমেন্টের অনুপাতের ওপর এর শক্তি সঞ্চার ত্বরান্বিত এবং বিঘিœত হয়ে থাকে। 

অপর দিকে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি সিমেন্ট মর্টারের গুণগত মান কমিয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে প্লাস্টার ফিনিশিং দিতে বেশি সময় লাগে এবং তাড়াতাড়ি ফিনিশিং দেওয়ার জন্য শুকনো মসলা ব্যবহার করা হয়, যা প্লাস্টারের গুণগত মান রক্ষার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া, প্লাস্টারের সার্বিক মান বজায় রাখতে ফিনিশিং দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর থেকে পরবর্তী ৭ দিন (সর্বনি¤œ) পর্যন্ত নিয়মিত কিউরিং করা অত্যাবশ্যক। নইলে প্লাস্টারের গুণগত মান সম্পর্কিত আলোচনার কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। যাই হোক, এত কিছুর পরও প্লাস্টারে ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দেওয়ার একটি বিষয় থাকে, সে ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। প্লাস্টারে ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দেওয়ার কারণসমূহের মধ্যে আবহাওয়া মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তা ছাড়া, মানুষের সব কাজও শতভাগ সঠিক হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন। 

ফলে, প্লাস্টার করার সময় গুণগত মানসম্পন্ন মালামাল ও কর্মপদ্ধতি ব্যবহার করে সব নিয়মনীতি মেনে চলার পরও মাঝেমধ্যে প্লাস্টার সারফেসে ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দিয়ে থাকে। প্লাস্টার সারফেসে সচরাচর যেসব ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দেয় তার অধিকাংশই সারফেস ক্র্যাক এবং এটাকে সিরিংকেজ ক্র্যাক বলা হয়, যা ইমারতের ক্ষতির জন্য সুদূরপ্রসারী কিছু কারণ হিসেবে দেখা দিলেও তাৎক্ষণিক কোনো ক্ষতির কারণ সৃষ্টি করে না। 

কিন্তু, সাধারণ জনমনে এসব ক্র্যাক বা ফাটল নিয়ে মাঝেমধ্যে আতংকের সৃষ্টি করে এবং অনেকেই বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, যা সমীচীন নয়। এসব ক্র্যাক বা ফাটল সাধারণত বছরান্তে রং করার পর এমনিতেই মিশে যায়। ফলে, প্লাস্টারের মান খারাপ হলে নিয়মিত রং করার ওপর প্লাস্টারের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে এবং ইমারতের জন্য বিশেষ কোনো ক্ষতির কারণ হতে পারে না। সুতরাং একটি ইমারতকে দীর্ঘস্থায়ী করণার্থে নিয়মিত রং করা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ

লেখক

চিফ ইঞ্জিনিয়ার (অপারেশন)

এনা প্রপার্টিজ, এনা গ্রæপ    

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৮ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top