পেইন্টিংয়ের সাতসতেরো (পর্ব-০২)

রং নির্বাচন 

সঠিক রং নির্বাচন ভবনের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন ভবনে কোন রং মানাবে তা অভিজ্ঞ স্থপতি বা ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ছাড়া বাছাই করা কঠিন। একেকজনের একেক রং পছন্দ। অনেকে অন্যের বাড়ির রং দেখে নিজের বাড়িটিও সেই রঙে রাঙাতে চান। কিন্তু ওই রং ভবনটির পারিপার্শি^কতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা ভেবে দেখি না। পেইন্টিং করার পর হয়তো রংটি তখন আর ভালো লাগে না। এ জন্য সঠিক রং নির্বাচন, স্থাপনার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ধরন এবং পৃষ্ঠতলের অবস্থানের কারণে রঙে ভেরিয়েশন থাকা অত্যন্ত জরুরি। পেইন্ট করার আগে বুঝে নিতে হবে কোথায় কোন রঙে পেইন্ট করছেন। যেখানেই পেইন্ট করুন না কেন নিচের ভুলগুলো যেন না হয়, সেসব বিষয় মাথায় রাখলে অন্তত পেইন্টিং দেখতে খারাপ লাগবে না।

গাঢ় রং এড়িয়ে যাওয়া

আমরা সাধারণত গাঢ় রং এড়িয়ে যাই। অনেকের মতে, গাঢ় রং ব্যবহার করলে অবজেক্টের ওপর আলোর পরিমাণ কম থাকে, তাই সেগুলো অন্ধকার মনে হয়। এ ছাড়া রুমের ভেতরে গাঢ় রং ব্যবহার করলে রুমে আলোকস্বল্পতা দেখা দেয়। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি সে রকম নয়। রুমের ভেতরের আসবাব এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের রঙের ওপর নির্ভর করে দেয়ালের রং কেমন হবে। যদি আসবাব ও অন্যান্য জিনিসপত্রের রং খুব বেশি গাঢ় হয়, তবে দেয়ালে গাঢ় রং ব্যবহার করা একদম ঠিক হবে না। যদি আসবাব, পর্দা ও অন্যান্য জিনিসপত্রের রং হালকা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে দেয়ালে হালকা রং ব্যবহার করাও ঠিক হবে না। সে কারণেই কোথায় গাঢ় রং ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়টি বোঝার জন্য আগেই ভাবতে হবে এবং সে অনুযায়ী আসবাব ও অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা উচিত। শুধু গাঢ় রং ও হালকা রঙের সঠিক কম্বিনেশনেই ফুটে উঠতে পারে আপনার অনিন্দ্য অন্দর। আবার আপনার ঘরটির পারিপার্শ্বিক অবস্থাও বুঝতে হবে। যদি জানালা দিয়ে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসে, তবে ভেতরে গাঢ় রং ব্যবহার করা যেতে পারে। আর যদি পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা না থাকে, সে ক্ষেত্রে গাঢ় রং অবশ্যই পরিহার করতে হবে। 

নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই রং বাছাই

আমরা ভবনের নির্মাণ উপকরণ কিনি নিজের পছন্দের রং অনুযায়ী। এটি যৌক্তিক নয়। ভবনের কাজ পুরোপুরি না হওয়া পর্যন্ত ডেকোরেশন সম্পর্কে অনুমান করা কঠিন। তাই নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই রং পছন্দ করলে পরে তা হোম ডেকোরেশনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণও হতে পারে। তাই রং ব্যবহারের বেশি আগেই তা পছন্দ করা বা কেনা উচিত নয়। ভবন যতক্ষণ না সম্পন্ন হবে, ততক্ষণ ভেতরের প্রাকৃতিক আলো সম্পর্কে বুঝতে পারবেন না। ঘরের ডেকোর অনুযায়ী রং মেলানো, থিম, টেক্সার, শিনÑএসব যাচাই করে তবেই রং বাছাই করতে হয়। এ ব্যাপারে একজন অভিজ্ঞ ডিজাইনারের পরামর্শ নেওয়াই উত্তম।

আসবাবের রঙের সঙ্গে না মিলিয়ে নেওয়া

আমরা ঘরের রং করার ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের রংকেই প্রাধান্য দিই। রং দেখতে আকর্ষণীয় হলেই মনে করি তা ঘরে ভালো মানাবে। কিন্তু গৃহসজ্জার পর দেয়ালের রং অনেক সময় দেখতে ভালো লাগলেও আসবাবগুলো যেন চোখেই পড়ে না। এর কারণ দেয়ালে রং করার আগে আসবাব কেমন রঙের হবে তা ভাবি না অথবা দেয়ালের রং কেমন হবে তা ভেবে আসবাব ক্রয় করি না। একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আসবাব অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো নিজেদের পছন্দের রঙে নাও পেতে পারি কিন্তু দেয়ালের রং ইচ্ছেমতো বাছার সুযোগ রয়েছে। তাই রুমের ভেতরের সাজসজ্জা আকর্ষণীয় করে তুলতে দেয়ালে রং করার আগে অবশ্যই আসবাবের রঙের কথা ভাবতে হবে।

কালার টেস্টার ব্যবহার 

ভবনের রং করার আগে একবার পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার যে রং দিয়ে পেইন্ট করবেন তা কেমন লাগবে। শুনতে কারও কাছে অবাকও লাগতে পারে। ভাবছেন হয়তো আগে থেকেই কীভাবে কালার টেস্ট করা যাবে। কালার টেস্ট করার বিভিন্ন উপায় আছে। প্রথমেই যখন ভবন ডিজাইন করাবেন, তখনই কালার যাচাই-বাছাই করে নিতে পারেন। ডিজাইনের ফাইনাল রেন্ডারিংয়ের আগে সম্ভাব্য লাইট সোর্স এবং অ্যাঙ্গেল সাপেক্ষে যে রং ব্যবহার করতে চান, তা দেখতে কেমন লাগবে পরীক্ষা করতে পারেন। 

যদি তা মনে না থাকে বা সুযোগ না থাকে, তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেলেও কালার স্ট্রিপ বা টেস্টার ব্যবহার করে দেখে নিতে পারেন কাক্স্ক্ষিত রংটি দেখতে কেমন লাগবে। দিনের বেলায় এ পরীক্ষায় আপনার পছন্দ করা রঙের চূড়ান্ত ইফেক্ট বুঝতে পারবেন। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সাদা দেয়ালের বিপরীত কোনো দেয়ালে রং করার ক্ষেত্রে একটু বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ সাদা রং যেহেতু সব সময় আলোর প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে, তাই তার বিপরীতের রং অবশ্যই সে অনুযায়ী হতে হবে।

অন্যের দেয়ালের রং অনুসরণ

এটি খুই সাধারণ একটি ভুল। কারও ভবনের দেয়ালের রং ভালো লাগলে আমরা সেটি নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকি প্রায়ই। অথচ আমরা ভাবি না, যিনি দেয়ালে রং করেছেন, তিনি তাঁর ভবনের পরিবেশ, আলোর উৎস এবং পছন্দের সঙ্গে মিলিয়েই পেইন্ট করেছেন। আপনার সঙ্গে কোনো একটি শর্তের মিল নাও থাকতে পারে। যদি দু-একটির মিল থেকেও থাকে, তবু আপনার রুচি, আসবাব ও ভবনের ডিজাইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যের একটি ব্যাপার থেকেই যায়। তাই কাউকে অনুসরণ করার আগে আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নেবেন।

কোন ধরনের সারফেসে কেমন রং

পৃষ্ঠতল বা সারফেসের ওপর ভিত্তি করে রং এবং পেইন্টিংয়ের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হবে। যেমন হতে পারে একেক পৃষ্ঠতলের রঙের ধরন, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ভেতরের দেয়াল ও সিলিং 

ডিসটেম্পার: ইট, কংক্রিট ও প্লাস্টারের ওপর ডিসটেম্পার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ডিসটেম্পার, যেমন-অ্যাক্রেলিক, সিনথেটিক, ড্রাই ইত্যাদি। অ্যাক্রেলিক ডিসটেম্পার পানি দিয়ে ধোয়া যায়। কিন্তু সিনথেটিক ও ড্রাই ডিসটেম্পার ধোয়া যায় না।

প্লাস্টিক পেইন্ট: প্লাস্টিক ইমালশন নামেই বেশি পরিচিত। এই রং দীর্ঘস্থায়ী ও ধোয়া যায়। প্লাস্টিক পেইন্ট তিন ধরনের। রেগুলার, ইকোনমিক ও প্রিমিয়ার ইমালশন।

বাইরের দেয়াল

সিমেন্ট পেইন্ট: এটি একধরনের পানি প্রধান রং। সাধারণত বাইরের দেয়াল, নিরাপত্তা দেয়াল ইত্যাদি রকমের আবহাওয়ার প্রভাবযুক্ত বা উন্মুক্ত পৃষ্ঠতলে সিমেন্ট পেইন্ট বিশেষভাবে কার্যকরী।  

ওয়েদার কোট: ওয়েদার কোটের চরিত্র প্রায় সিমেন্ট পেইন্টের মতোই। তবে পার্থক্য হলো, ওয়েদার কোট সিমেন্ট পেইন্টের চেয়ে বেশি মসৃণ এবং এর অনেক কালার ভেরিয়েশন রয়েছে। 

অ্যাক্রেলিক ইমালশন: বেশি ব্যবহৃত রং এবং দীর্ঘস্থায়ী ও ধোয়া যায়। বাইরের ক্ষতিকর আবহাওয়া ও ধুলো-ময়লা থেকে দেয়ালকে সুরক্ষা দিতে এ ধরনের পেইন্ট ব্যব্যহার করা হয়। এই রং বিশেষত বাড়ির বাইরের দেয়ালেই বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

রঙের ভালো-মন্দ

ভালো মানের পেইন্ট এবং নি¤œমানের পেইন্টের মধ্যে পার্থক্য হলো, ওপরের প্রতিটি উপাদানের পরিমাণ। মাত্রা ছাড়া উপাদান মেশালে রঙের গুণগত মানের তারতম্য হয়। একটি ভালো মানের পেইন্টে নি¤œমানের পেইন্টের তুলনায় পিগমেন্ট ও বাইন্ডারের উচ্চতর মিশ্রণ থাকে। রঙ্গক হলো, যা পেইন্টকে এর আল্ট্রাভায়োলেট (টঠ) প্রতিরোধ এবং স্থায়িত্ব দেয়, যা পেইন্টটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া রঙ্গকের কারণেই পেইন্ট সহজেই বিবর্ণ হয় না। 

একটি ভালো মানের পেইন্ট মিশ্রণ যেমন হওয়া উচিত

উপাদান

মিশ্রণ অনুপাত

রঙ্গক

২০%

এক্সটেন্ডার

২০%

বাইন্ডার

৪০%

দ্রাবক

১৫%

সংযোজন

৫%

উচ্চমানের পেইন্ট ছিদ্রযুক্ত নয় অর্থাৎ ভালো পেইন্ট পানি শোষণ করে না। নি¤œমানের পেইন্ট জল শোষণ করে এবং এতে অনেক ব্দুবুদ থাকে। এর ফলে কিছুদিন পরই দেয়াল থেকে সে রং খসে পড়ে। দেখে মনে হয়, ছোট ছোট আকারে খোসা ছড়াচ্ছে।

পেইন্টে পিগমেন্ট ও বাইন্ডার বেশি থাকলে দাম বেড়ে যায়। তবে পেইন্টের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এতটাই বেশি হয়, যা নি¤œমানের পেইন্ট দিয়ে বারবার রং করার খরচের চেয়ে বেশি নয়। সস্তা পেইন্টের জন্য বিশেষ জায়গা থাকে। একটি বাড়ির সব জায়গার পেইন্টিং একই রকম হয় না। সীমানাপ্রাচীরে সস্তা পেইন্ট হলেও কোনো সমস্যা নেই, তবে মূল ভবনের গায়ে অবশ্যই ভালো ওয়েদার কোট ব্যবহার করা উচিত যেন তা বছরের পর বছর দেয়ালকে সুরক্ষা দেয়। আবার ঘরের ভেতরে চাইলে বিভিন্ন রঙে ইল্যুশনও তৈরি করতে পারেন।

স্থান-কাল-পাত্রভেদে জীবনের রং যেমন ভিন্ন হয়, একইভাবে আপনার পারিপার্শ্বিক পরিবেশও ভিন্ন হয়। তবে আপনার বাসস্থান বা কর্মস্থলের রঙেরই-বা অসামঞ্জস্য থাকবে কেন? পরিবেশ অনুযায়ী স্থাপনার রংও সে রকম হওয়া উচিত। তাই বিল্ডিংয়ে পেইন্ট করার আগে সবকিছু ভালোভাবে না ভাবলে পরে শুধু আফসোসই করতে হবে। আশা করি কীভাবে কোথায় কী পেইন্ট করবেন, সে বিষয়ে ধারণা দিতে পেরেছি। তবে পেইন্টিংয়ের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু বাকি থেকেই যায়। আসলে কত ধরনের পেইন্ট আছে, সেগুলো এখনো বলাই হয়নি। বিভিন্ন রকম পেইন্ট সম্পর্কে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাব আগামী পর্বে।

(চলবে)

রিগ্যান ভূঁইয়া

ৎরমধহনযঁরুধহ৪৩২@মসধরষ.পড়স

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top