‘টারমিনেটর টু’ সিনেমার কথা মনে আছে নিশ্চয়! নব্বইয়ের দশকের এই সিনেমা দেখেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দৃশ্যপট জুড়ে ছিল একটি রোবট আরেকটা রোবটকে হত্যা করতে চেষ্টা করছে। ভালো রোবটটি একটি কিশোরকে বাঁচাতে চাইছে। জাজমেন্ট ডে নামে একটা দিন হবে, যেখানে রোবটদের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে মানুষের পক্ষ হয়ে যে মানুষটি যুদ্ধে জিতে যাবে, তাকে অতীতে এসে একটা রোবট হত্যা করতে চেষ্টা করে। আর আরেকটা রোবট সেই মানুষটিকেই রক্ষা করতে চেষ্টা করে। এই পুরো যুদ্ধটি ঘটেছিল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে কেন্দ্র করে। সেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে আমরা কীভাবে দেখি আর সে নিজেকে কীভাবে দেখে, এই নিয়ে এই নির্মিত হয়েছিল টারমিনেটর টু সিনেমাটি। সম্প্রতি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। প্রযুক্তির জগতে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আদ্যোপান্ত তুলে ধরছেন স্থপতি রাজীব চৌধুরী
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দের অর্থ ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’। আমরা বুদ্ধি দিয়ে অনেক কিছু উদ্ভাবন করতে পারি। ভাব আদান-প্রদানও করি। আর এই কাজটিই যদি প্রোগ্রামের মাধ্যমে একটা মেশিনকে দেওয়া হয়, তাহলেই তাকে বলা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন দুটো রোবট একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এটাই ছিল টারমিনেটর সিনেমার বক্তব্য। রোবট নিয়ে নাটক-সিনেমা কম হয়নি। আই রোবট নামে নির্মিত সিনেমাও ছিল এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েই। কিন্তু সেই সময়েও মানুষ কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমত্তা মেশিনে ট্রান্সফার করতে তেমন সফল হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের তো চেষ্টার অন্ত নেই। ১৯৫০ সাল থেকে এ নিয়ে কাজ চলছে। যদিও ১৩০০ শতকের দিকে বিজ্ঞানী ফিলোসফার পলিম্যাথ রামন লাউল প্রথম এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ধারণা দিয়েছিলেন। এআই বিষয়টি তৈরি হয় ১৯৫৯ সালে। তখন সিলিকন ভ্যালির একটি কনফারেন্সে এআই শব্দটি জন্ম নেয়। সেই কনফারেন্সে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী মানুষ বিভিন্ন এআই প্রজেক্ট সম্পর্কে আলোচনা করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই তথ্যপ্রযুক্তির একটি বিভাগ, যা কম্পিউটার বা মেশিনে মানব বুদ্ধিমত্তা নকল করে বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম হয়।
এআই বিশ্বের অনেক উন্নয়নের ইতিহাস আছে। এটি বহু পুরোনো নয়, এ সম্পর্কে ধারণা এখনো তৈরি হয় এবং এটি দ্রæত উন্নত হচ্ছে। প্রথম এআই ডিজাইন করেন জনপ্রিয় আমেরিকান বিজ্ঞানী জন ম্যাককার্থি। ১৯৫৬ সালে নিউ হ্যামশায়ারের ডার্টমাউথ কলেজে একটি সভার মাধ্যমে তিনি সিলিকন ভ্যালি কনফারেন্সে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল একটি সিস্টেম তৈরি করা, যা নিজের স্বয়ংক্রিয়তা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সমস্যা সমাধান করতে পারে। জন ম্যাককার্থি তাঁর প্রস্তাবের আলোচনার মধ্যে একজন সাইকোলজিস্ট জন শকলে ও গণিতবিদ এডসন ওয়ান নিস তাঁদের উপস্থিতিতে একটি ভোটের মাধ্যমে তাঁর প্রস্তাবটি মেজরিটি হিসেবে গ্রহণ করেন। আর এভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ শুরু হয়।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে অনেক এগিয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা এই মেশিন লার্নিং কম্পিউটারের প্রোগ্রামকে মোডিফিকেশনের মাধ্যমে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে নানা উপায়ে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই অংশে পরিণত হয়েছে। যেমন, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন রোবটের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, আপনাকে নেভিগেট করছে আপনারই হাতে থাকা মোবাইল যে জায়গায় যাচ্ছেন, অনলাইন চেক করলেই নিজেকে ম্যাপে সেখানেই আবিষ্কার করছেন। আপনি হয়তো কারও সঙ্গে বাড়ি বানানো নিয়ে কথা বললেন, দেখবেন মোবাইল খানিক বাদেই আপনাকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাড়ি বানানো-সংক্রান্ত কয়েকটা অ্যাড দেখিয়ে দিল। আপনি তো খুঁজতেও চাননি কিন্তু হয়তো ‘সিমেন্ট’ শব্দটা নিয়ে ভাবছিলেন গুগলে ‘স’ অক্ষরটা লিখতেই প্রথমেই দেখতে পেলেন সিমেন্ট শব্দটা। অথচ এটা আপনি মনে মনেই ভেবেছিলেন। আর আপনার মোবাইল সেটা দেখিয়ে দিল। শুধু এই নয়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স লুকিয়ে আছে আরও অনেক মেশিনের ভেতর। ঘরে আমরা যে এলেক্সা বা এ ধরনের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করি, যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।
এর মধ্যে গত কয়েক বছর আগে একটা ঘটনা ঘটে। একজন প্রোগ্রামার একটি প্রোগ্রাম লেখার মাধ্যমে একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট প্রোগ্রাম তৈরি করে, যাতে একটি স্কেচে মানুষ আঁকে, যাকে সে কমান্ড দেয় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার জন্য। দেখা যায় সেটি মানুষের মতো করেই চলাচলের মাধ্যমে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে গেছে। এরপর প্রোগ্রামার এই পথের মাঝে বেশ কিছু উঁচু বাধা তৈরি করে। এরপর সেই স্কেচ মানুষটিকে সেই পথে যেতে বলায় সে ঠিক মানুষের মতোই উঁচু বাধাগুলো পার হয়ে যায়, যা একটি সাধারণ কার্টুন বা স্কেচ আর্টের ক্ষেত্রে মোটেও প্রযোজ্য নয়। প্রোগ্রামকে এভাবে আচরণ করতে দেখে সেই প্রোগ্রামার নিজের লেখা এই প্রোগ্রামটিকে অফ করে দিলেও আসলে মেশিন যে নিজে থেকেই অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে পারছে, এটা বুঝতে পারা যায়। আবার দেখা গেছে কোনো একটি ডিপ ড্রিম প্রজেক্টকে যদি নিজের মতো করে একটি ভাষা তৈরি করতে দেওয়া হয়, তখন সেটি সেই মোতাবেক একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাষা তৈরি করতে পারছে, যা আসলে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে আসলেই কঠিন কাজ। যেহেতু মেশিন নিজেই নিজেকে শেখাতে পারছে, তাই এটির কার্যক্ষমতা মানুষের চাইতেও অনেক বেশি। আর এভাবেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মানুষ নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।
গত ২০১৫ সালে গুগল নিয়ে আসে ডিপ ড্রিম প্রজেক্ট। প্রজেক্টটি তৈরি করেন গুগল ইঞ্জিনিয়ার আলেক্সান্ডার মর্দ্ভিন্তসেভ। এটি কনভোলিউশন নিউট্রাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে স্বপ্নের মতো ছবি তৈরি করতে পারে, যার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতেই নেই। সাইকেডালিক এই ছবিকেই বলা হয় ডিপ ড্রিম। আর এটি স্বপ্ন দেখতেই থাকে। মানে এটি ছবি বানাতেই থাকে। ছবির ভেতর থেকে ছবি ফুটে বের হতে থাকে। গভীরে যেতে যেতে ছবির ভেতরটা আরও উজ্জ্বল ও স্বপ্নময় হয়ে ওঠে। একটি ছবি দেওয়া হলে সেটি নিজের মতো করে নিউরনের মতো করে তৈরি করে ডিপ ড্রিম জেনারেটর। যেমন, মোনালিসার ছবি এতে আপলোড করে দিলেই এটি প্রথমেই যা করে তা হলো সবুজ, গোলাপি ও কালো রং ব্যবহার করে ছবিটিতে মোনালিসার মুখের ওপর ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে এমনভাবে বেশ কিছু গোলক তৈরি করে, যেন সেটি দেখতে অনেকটা কুকুরের মুখাবয়বের মতো মনে হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রাণীর আঁকার ধারণ করে ছবিটি, যা দেখতে মনে হয় যেন স্বপ্নের জগতে থাকা আমাদেরই স্বপ্নময় নানা জন্তু ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ডিপ ফেইক
গুগলের ডিপ ড্রিমের আদলেই কয়েক বছর আগেই আসে ডিপ ফেইক। আর এটিই মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জগতে আলোড়ন তোলে। দেখা যায় একটি ছবিকে কথা বলানো সম্ভব হচ্ছে, যে ছবির মানুষটি মারা গেছে অন্তত ৫০ বছর আগে। আর এর মাধ্যমেই তৈরি করা হয় মেরিলিন মনরো বা হালের জনপ্রিয় ঐশ্বরিয়া রায়ের নানা ভিডিও, যেগুলোতে একেবারে হুবহু মেরিলিন মনরো বা ঐশ্বরিয়া রায়কে কথা বলতে বা নানা কাজ করতে দেখা গেলেও এরা তো মেশিন জেনারেটেড। আর এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমনভাবে ছবিকে ভিডিওতে কনভার্ট করতে শুরু করে যে মনে হয় এগুলো আসলেই ঘটেছে।
কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে আমরা যেসব বিষয় জানি, সবই হলো দুর্বল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আলফা গো নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা আমরা বলতে পারি। এই প্রোগ্রামটি আলফা নামের গেমটি খেলতে পারদর্শী। এমন না যে এটিকে মানুষ শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে খেলতে হবে। ব্যাপারটা অন্যখানে। এটি নিজে থেকেই ইন্টারনেটে থাকা হাজার হাজার আলফা খেলার ভিডিও দেখে এই গেমটি খেলার নানা রকম নিয়ম আয়ত্ত করেছে। আর এর মাধ্যমে নিজেই নিজেকে শিখিয়েছে কীভাবে এটি খেলতে হয়। দেখা গেছে, এই প্রোগ্রামটি মানুষকে হারিয়েছে। এই খেলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে তো হারিয়েছেই, এমনকি এর আগে প্রোগ্রাম হওয়া আরেকটি প্রোগ্রামকেও হারিয়েছে। কিন্তু এটি নিজে থেকে আর কিছুই করতে পারে না, শুধু এই খেলাটিই খেলতে পারে। আর এভাবে আমরা বলতে পারি এরকম প্রোগ্রামগুলো একটি বা দুটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েই শুধু কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু এদের আপনি আরও অনেক কিছু শেখাতে পারবেন। শুধুই একবার দেখিয়ে দিলে এরা নিজে থেকেই অনেক সোর্স থেকে শিখবে এরপর আপনাকেই হারিয়ে দেবে।
মূলত চার প্রকারের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আছে
রিঅ্যাকটিভ মেশিন
লিমিটেড মেমোরি
থিওরি অব মাইন্ড
সেলফ অ্যাওয়ার্নেস
রিঅ্যাকটিভ মেশিন মানে একটি প্রোগ্রাম আগে কী করেছে, সেটা মনে রাখতে পারে না। এটি আপনাকে সামনে কী হতে চলেছে, সেটা বলতে পারবে; কী কী করতে পারেন, সেই বিষয়ে নানা রকম জ্ঞান দিতে পারবে। কিন্তু গতকাল আপনি কী করেছিলেন, সেটা মনে রাখতে পারবে না। যেমন আমরা যেসব দাবা খেলার বট বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দেখতে পাই, সেগুলো হলো আসলে রিঅ্যাকটিভ মেশিন। আইবিএম এর দাবাড়– সুপার কম্পিউটার ‘ডিপ বøু’-কে আমরা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারি। এটি মানুষকে বলতে পারত সামনে সে কী খেলতে পারে এবং এর জন্য সম্ভাব্য সব রকমের চাল সে দিতে পারত। কিন্তু এর আগের চাল কী দিয়েছে, সেটা মনে রাখার ক্ষমতা তার ছিল না। এ ধরনের বুদ্ধিমত্তাগুলো আশপাশে কী ঘটছে, সেটা দেখেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। এর বেশি ক্ষমতা এদের নেই।
লিমিটেড মেমোরিসম্পন্ন বুদ্ধিমত্তাগুলোর কিছু মেমোরি থাকে, যাতে অতীতে করা কাজগুলো থেকে সে শিখতে পারে সামনে কী করতে হবে। সেলফ ড্রাইভ করতে পারা গাড়ি এই পদ্ধতিতে কাজ করে। এদের মেমোরিতে মানুষের চালানো গাড়ির বিভিন্ন প্রক্রিয়া মেমোরি হিসেবে শেখানো থাকে। সে এগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে থাকা প্রতিবন্ধকতা টপকে যেতে পারে। থিওরি অব মাইন্ড হলো একটি ভবিষ্যৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যা নিজেই একটি বিকল্প সত্তা হবে। এটি মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। কিন্তু অদূরভবিষ্যতে আবিষ্কার করবে বলে আশা করা যায়। আবিষ্কার হয়ে গেলেই ধরে নেওয়া যায় যে আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নতুন যুগে প্রবেশ করব।
সেলফ অ্যাওয়ার্নেস হলো এর পরবর্তী ধাপ, যা অদূরভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীতে ঘটতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই নিজেকে কমান্ড দিতে ও সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবে। এটাই মূলত সেলফ অ্যাওয়ার্নেস। বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে এমন কিছু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রাম, যেগুলো নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। সেগুলো তুলে ধরা হলো-
চ্যাটজিপিটি
চ্যাটজিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ওয়েবসাইট, যাতে আপনি এর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। আপনার চাহিদামতো নানা কাজ করে দেবে। যেমন আপনি হয়তো চাইছেন একটা গান লেখা দরকার। প্রোগ্রামটি আপনাকে গান লিখে দেবে। আবার আপনি চাইলে রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লিখিয়ে নিতে পারবেন। এটি আপনাকে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে চাহিদামতো ছবি এঁকে দিতে পারবে। এমনকি কোনো নাটক-সিনেমার স্ক্রিপ্টও লিখিয়ে নিতে পারবেন। কাজ করার ক্ষেত্রে এটি বাস্তবে থাকা নানা সোর্স থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজেই নিজে শিখে নেয়। অ্যাডভান্স লার্নিং আপনাকে নিয়ে যাবে এক অতি বিচিত্র জ্ঞানের জগতে যেখানে আপনি হয়তো ভাবতেই পারবেন না যে মেশিন কীভাবে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে। এই আর্টিক্যালের একটি অংশ এই চ্যাটজিপিটি দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই অংশটি লাল লাইনে দাগাঙ্কিত। আমি শুধু চ্যাটজিপিটি থেকে জানতে চেয়েছি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ইতিহাস কী? সে নিজে থেকেই এই উত্তর লিখে দিয়েছে। এটি ইন্টারনেটে বিচরণ করা অসংখ্য তথ্য থেকে ডেটা নিয়ে নিজে নিজেই লিখতে পারে। এটাই এর বিশেষত্ত¡।
মিডজার্নি.এআই
মিডজার্নির নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আজকের পৃথিবীতে আমরা যা চাই তা এঁকে ফেলার মতো শিল্পীর অভাব নেই। তেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সও একইভাবে ছবি আঁকতে পারে। আর সেটা সম্ভব হয় মিডজার্নি দিয়ে। ডিসকর্ড নামে একটি চ্যাটিং সফটওয়্যার আছে, যেটাতে মিডজার্নিতে রেজিস্টার করে একে কমান্ড দিতে পারি। আর এটি হাজার হাজার ছবি এঁকে দিতে পারে অনায়াসে। একই ছবি নানাভাবেও আঁকানো সম্ভব। এখন এটি কিছু ছবি বিনা মূল্যে এঁকে দিলেও এতে সাবস্ক্রিপশন কিনতে হয়। এর মাধ্যমে ছবি আঁকা থেকে শুরু করে গ্রাফিকসের কাজও করিয়ে পারি সহজেই। এটিতে কদিন আগেই একজন একটি কমান্ড দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল মানুষের ভবিষ্যৎ ইভল্যুয়েশন কী হতে পারে? এটি যে ইমেজ দেখিয়েছিল ভিডিও আকারে সেটা আসলেই চমকজাগানিয়া। দেখিয়েছিল মানুষের কাছাকাছি এনসেস্টর বানর থেকে বিবর্তিত হতে হতে বর্তমানকালে এসে পৌঁছেছে। এরপর মানুষ বিবর্তন হতে হতে বায়োবোঁ এবং এরপর মেশিনে বিবর্তিত হতে হতে একসময় বিদ্যুতে পরিণত হচ্ছে। এই পুরো ভিডিওটি বানিয়েছে মিডজার্নি, যেটা সত্যিই বিস্ময়কর।
অ্যাডব পডকাস্ট.এআই
এতে আপনি কণ্ঠস্বর আপলোড করতে পারবেন। সেখানে থাকা সব রকমের বাজে শব্দ এটি রিমুভ করে সুন্দর একটি অডিও ফাইল আপনাকে করে দিতে পারবে মুহূর্তেই, যা করতে আপনার অনেক দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হতো, সেই কাজটি করতে পারবেন খুব কম সময়েই।
এনভিডিয়া.এআই
পডকাস্টার ও ভিডিওগ্রাফারদের জন্য এআই দারুণ একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার। এটি দিয়ে সহজেই ভøগারদের চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন করা যায়। দেখা যায়, যাঁরা ভিডিও বানান, তাঁদের সামনে থাকা ভিডিও স্ক্রিপ্ট দেখতে হয়। এটা দেখতে গিয়ে চোখ সরে যায় ক্যামেরা থেকে। ওপরের ছবির মতো করে এটা সেই মুহূর্তের চোখের ভিডিও ক্যামেরার ওপর পড়লে কেমন হয়, এটা ডিপ ফেইকের মাধ্যমে তৈরি করে রেকর্ড করবে। এ ছাড়া এটা গ্রিনস্ক্রিন ছাড়াই ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তন করে ফেলা যায়। এমনকি আমরা নড়াচড়া করলে এটি ভিডিওকে একইভাবে সরিয়ে ভিডিওর গুণগত মান ঠিক রাখা যায়। এটা যে করা যায়, এটা কি আপনি আগে ভাবতে পেরেছিলেন? দেখুন ইন্টেলিজেন্স কতটা উন্নত হয়ে গেছে!
সিনথেসিয়া.এআই
এটি দিয়ে খুব সহজেই কিছু টেক্সট থেকে ভিডিও বানিয়ে ফেলা যায়। একটা ভিডিও বানাতে যেসব উপাদান প্রয়োজন হয়, সবই এতে আছে। আপনি একটা স্ক্রিপ্ট দিলে এতে থাকা এআই বট একে ভিডিও উপস্থাপনার মতো করে বানিয়ে দেবে, যা আপনার নিজের করতে অনেক লম্বা সময় প্রয়োজন হতো। আপনি চাইলে পুরুষ বা মহিলা কণ্ঠ ব্যবহার করতে পারেন। আপনি চাইলে এদের বয়স বাড়াতে বা কমাতে পারেন। সবই করা যাবে নিমেষেই।
ভেরাস
আর্কিটেকচার নিয়ে এবার আলোচনায় আসা যাক। একটা আর্কিটেকচার কোনো এক ভিন্ন অবস্থায় কেমন হতে পারে, এটা নিয়ে তো অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়। সেটাই বাস্তবে দেখাতে চলে এসেছে ভেরাস। এটি প্লাগিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আপাতত এটি রেভিট এ ব্যবহার করা যাচ্ছে। এটি দিয়ে একটা রেন্ডার ইমেজকে বিভিন্ন আবহাওয়ায় বিভিন্ন অবস্থায় দেখানো যেতে পারে। তাও নিমেষে। একটা রেন্ডার হতে অনেক লম্বা সময়ের প্রয়োজন হয়। এটি সেই সময়টাকেই কমিয়ে এনেছে ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে। এমনকি এটা দিয়ে এআই জেনারেটেড ডিজাইনও করা যাচ্ছে। আপনি চাইলেই আপনার করা বাড়ির ডিজাইনটি নানারকম করে দেখতে পারবেন। চাইলেই এর রং-ম্যাটেরিয়েলÑএসব পরিবর্তন করে দেখতে পারবেন যে কেমন কেমন হতে পারে। এটি পুরোপুরি আর্কিটেকচারের সঙ্গে রিলেটেড একটি মেশিন লার্নিং প্রজেক্ট, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
প্ল্যানফাইন্ডার.এক্সওয়াইজেড
প্ল্যানফাইন্ডার এমন একটা টুল, যেটা দিয়ে খুব সহজেই আর্কিটেক্টরা ডিজাইন করতে পারেন। এমনকি যিনি কখনোই আর্কিটেকচার নিয়ে পড়েননি, তিনিও কাজ করতে পারেন। মুহূর্তেই হয়ে যায় অটোক্যাডের প্ল্যান, বিভিন্ন লেয়ারে ড্রয়িং হয়ে যায়। চাহিদা দিতে হয়, স্থানের পরিমাণ দিতে হয়, এরপর এটা যা করে, সেটা কোনোভাবেই কল্পনাযোগ্য নয়। এটি লাখ লাখ অপশন নিয়ে হাজির হয়। আমাদের সামনে থাকে এক অনন্ত সম্ভাবনার দুয়ার। অবশ্য এটা স্থপতিদের জন্য কতটা ভালো, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ডাল ই ২ (উধষষ ব ২)
ডাল ই ২ অনেকটাই মিডজার্নির মতো ওয়েবসাইট হলেও এতে আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করা যায়। মিডজার্নিতেও বিভিন্ন বাড়ির ডিজাইন ও প্ল্যান করা সম্ভব হলেও ডাল ই ২ অনেক উন্নত। এতে সুন্দর রেন্ডার ইমেজ পাওয়া সম্ভব। কমান্ড দেওয়ার পরে এটি বিভিন্ন অপশনসহ আর্কিটেকচারাল রেন্ডারড ইমেজ দেখাতে পারে।
রুমজিপিটি.আইও
রুমজিপিটি দিয়ে যেকোনো ইন্টেরিয়র ইমেজকে সুন্দর আর্কিটেকচারাল ডিজাইনে রূপান্তরিত করা যায়। ধরুন, ঘরের ছবি দিয়ে একে বললেন একটি আধুনিক ডিজাইনের ইন্টেরিয়র করাতে চান, এটি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে আধুনিক ডিজাইন সেই বাড়ির ছবির ওপর করে দেখিয়ে দেবে। এটি এমনই এক অদ্ভুত এআই, যে আপনি নিজের বাড়ির বিভিন্ন রকম ছবিতে বিভিন্ন প্রকারের ডিজাইন করতে পারবেন। এটা আপনাকে প্রতিবার বিভিন্ন রকম স্বাদের ইন্টেরিয়র দেখাবে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?
স্থপতি হিসেবে বলা যায়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার দ্রæতই পৃথিবীকে পাল্টে দিচ্ছে। অনেকেই এখন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছবি আঁকছেন, ভিডিও কনটেন্ট বানাচ্ছেন, অনলাইনে আয় করছেন, নিজের পোর্টফোলিও বানাচ্ছেন, বাড়ি ডিজাইন করছেন। এগুলো আশীর্বাদই বলা যায় যতক্ষণ এটা দিয়ে খারাপ কিছু না হচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে খারাপ কাজও কম হচ্ছে না। আগেই বলেছি, অদ্ভুত সব ভিডিও আমরা দেখেছি, যেগুলোর কোনো অস্তিত্বই পৃথিবীতে নেই। যেমন, দেখেছি বিভিন্ন নায়িকার অদ্ভুত সব ছবি, যেগুলো তিনি তোলেননি। আবার দেখেছি এসব এআই টুলের অপব্যবহার। অনেকেই ক্রিয়েটিভ কাজের জন্য এআই টুল ব্যবহার করছেন, যেটা সঠিক মেধার মূল্যায়নে একটা বিরাট বাধা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রফেশনের প্রফেশনালরা এখন নিজেদের কাজের প্রতি এআই-কে হুমকি মনে করছেন। অনেকেই এআই ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।
কিন্তু এআই থেকে কি দূরে থাকা সম্ভব? লক্ষ করলেই দেখা যাবে, হাতের মোবাইল আপনাকে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করে চলেছে। আপনি কী করছেন, কতক্ষণ হেঁটেছেন, কতক্ষণ টিভি দেখেছেনÑসবই। হাতের ডিজিটাল ওয়াচ বলে দিচ্ছে কতক্ষণ ড্রাইভ করেছেন বা সাইকেল চালিয়েছেন। পছন্দের সার্চ থেকেই এটি আপনাকে বলে দিচ্ছে সামনে কী দেখতে চলেছেন বা চাইছেন। মানে এটিই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আপনি হয়তো আপনার কোনো বন্ধুকেই ক্রিকেট খেলা বিষয়ে বললেন- সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন ফেসবুক আপনাকে ক্রিকেট সম্পর্কিত বিভিন্ন ভিডিও ও অ্যাড সাজেশন দেখাচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্যই। আপনাকে প্রতিনিয়ত নজরে রেখেছে এআই। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কী খাচ্ছেন, আপনার পছন্দের গান কীÑসবই জেনে আপনাকে আনন্দ দানের চেষ্টা করছে এটি। এটি মোটেও সংঘবদ্ধ কোনো টুল না। ভিন্ন ভিন্ন ওয়েবসাইট বা ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামগুলো একত্রভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেই হবে আসল ডিজাস্টার। যতক্ষণ এটি মানুষের হাতে আছে ততক্ষণ এটি নিয়ে তেমন ভাবনার কিছু নেই। তবে এটি দিয়ে যেসব অপরাধমূলক কাজ হয়ে চলেছে, সেগুলো নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। হয়তো এরও একটা সমাধান হবে। যেমন, চ্যাটজিপিটি বা মিডজার্নিতে অশ্লীল কোনো শব্দ ব্যবহার করা যায় না। ফলে কোনো মানুষের অশ্লীল ছবি তৈরি করা এগুলো দিয়ে সম্ভব না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, অনেক অশ্লীল ছবি ও ভিডিও তৈরি করার এআই টুলও আছে যেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে না চাইলেও এদের এড়িয়ে চলা তো সম্ভব নয়। ওপেন সোর্সের এই পৃথিবীতে ভালো ও মন্দকে পাশাপাশি রেখেই আমাদের চলতে হবে। স্থপতিদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গেও যুদ্ধ চালাতে হবে। চিত্রশিল্পীদের যুদ্ধ যেখানে মিডজার্নির মতো সাইটগুলোর বিরুদ্ধে। হয়তো আমরা এদের শ্রেণিশত্রæ ভাবতে পারি না। কিন্তু এরা একটা প্রভাব তো রেখেই চলেছে। সেই প্রভাব ভালো নাকি মন্দ, এখনো সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবুও প্রযুক্তি তো এগিয়ে যাবেই। সেই পথের দিকে তাকিয়ে আমরা। হয়তো ভবিষ্যতে মানুষের আসন নেবে প্রযুক্তি। সেদিন মানুষের অবস্থান কেমন হয়, সেই ভবিষ্যতের দিকেই তাকিয়ে থাকা কেবল। বাকিটা সময়ই বলে দেবে।
প্রকাশকা:ল বন্ধন ১৫৪ তম সংখ্যা, জুন ২০২৩