দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের অদূরেই আটলান্টিক মহাসাগর। এই সাগরের গভীরে রয়েছে রোবেন আইল্যান্ড নামে এক ঐতিহাসিক দ্বীপ। এই নির্জন দ্বীপেই আফ্রিকার অবিসংবাদী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৮ বছর কারাবন্দী ছিলেন। এখানে ছোট্ট একটি কক্ষে রেখে নানা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়েছিল ম্যান্ডেলাকে। নেলসন ম্যান্ডেলা ছাড়াও এই আইল্যান্ডে বর্ণবাদবিরোধী ও মুক্তিসংগ্রামের অনেক নেতাই ছিলেন বন্দী। এর মধ্যে রবার্ট সোবুকে ও জ্যাকব জুমা অন্যতম। পরবর্তীকালে তাঁরা দুজনই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। বিশে^ নির্বাসনের জন্য যে কয়েকটি দ্বীপ বিখ্যাত, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এই রোবেন দ্বীপ। ঐতিহাসিক এই দ্বীপের কথা তুলে ধরছেন মোহাম্মদ রবিউল্লাহ
দক্ষিণ আফ্রিকার বিধানিক রাজধানী কেপটাউন শহরের সমুদ্র উপক‚ল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে রোবেন দ্বীপের অবস্থান, যার আয়তন মাত্র ৬ বর্গ কিলোমিটার। আফ্রিকানদের কাছে এটি ‘রোবেনিল্যান্ড’ নামে অধিক পরিচিত। শুরুর দিকে সামুদ্রিক পাখি, আফ্রিকান পেঙ্গুইন, সিল, কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রাণীর বসবাস ছিল এই দ্বীপে। প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তী সময়ে ক্রীতদাসদের জন্য নির্ধারিত হয়। রোবেন ওলন্দাজ শব্দ, যার অর্থ ‘সিল’। তা থেকেই দৃষ্টিনন্দন দ্বীপটির নাম হয়েছে ‘সিল দ্বীপ’। দ্বীপটি সমতল ও সমুদ্রতল থেকে মাত্র কয়েক মিটার ওপরে বিদ্যমান। বরফ যুগের প্রায় ১২ হাজার বছর আগে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রস্তর উপক‚ল থেকে এই দ্বীপকে পৃথক করেছে। ১৫০০ শতকের প্রথমার্ধেও বিশ্ববাসীর কাছে রোবেন ছিল অজানা দ্বীপ। ১৪৮৮ সালে জাহাজ নোঙরের সময় দ্বীপটির অস্তিত্ব খুঁজে পান পর্তুগিজ পর্যটক বাতোলোমিও ডায়াস।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ওলন্দাজরা বসতি স্থাপন করে অল্প সময়ে এই দ্বীপকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। সেই থেকে প্রায় ৪০০ বছর ধরে কারাবাস, নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার স্থান হিসেবে বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের নির্বাসন ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের নির্বাসনের জন্য ব্যবহৃত এ দ্বীপটি এখন নিষ্ক্রিয় কারাগার। উনিশ শতকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষ করে আফ্রিকান ও ভারতীয় নেতাদেরও সেখানে নির্বাসন দেওয়া হয়। অনেককে মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত করে আবার সম্পূর্ণ বিনা অপরাধেও কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এ দ্বীপে। ১৯৬২ সালের শুরুতে কৃষ্ণাঙ্গ, ভারতীয় ও মিশ্রজাতির বেশির ভাগ বন্দীকে সেখানে পাঠানো হয়। ১৯৬৪ সালের জুনে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ এনে ম্যান্ডেলাকে পাঠানো হয় এ দ্বীপে। সেখানে ৮ বাই ৭ ফুটের একটি কক্ষে তাঁকে রাখা হয়। একটি মাত্র খড়ের মাদুর ও বাথরুম করার জন্য একটি বালতিই ছিল ওই কক্ষের আসবাব। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দ্বীপে পাঠানো বন্দীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণই ছিল ম্যান্ডেলার ভাবশিষ্য। ফলে দ্বীপটির আরেক আদর্শিক নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়’।
১৯৯৭ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার রোবেন দ্বীপের বন্দিশালাকে দেশের অন্যতম জাতীয় জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো দ্বীপটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এই দ্বীপের মূল আকর্ষণ নেলসন ম্যান্ডেলার বন্দিশালা। সেখানে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন বন্দীর দলিল-দস্তাবেজ ও ব্যবহার্য সামগ্রী। বিশেষ এই স্থানটিতে ভ্রমণ করেছেন কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তি।
বর্তমানে অনেকে এই দ্বীপের গাইড হিসেবে কাজ করছেন, যাঁরা একসময় এই দ্বীপেই রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। তাঁরা রোবেন দ্বীপের ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন দর্শণার্থীদের কাছে। প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটারের এই দ্বীপে সহজেই হেঁটেও বেড়ানো যায়। তবে ভ্রমণের অংশ হিসেবে ট্যুর বাসও আছে।
একসময় এখানে কুষ্ঠরোগ নিরাময়কেন্দ্র ও মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। সে সময় কুষ্ঠরোগের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালও স্থাপন করা হয়। এই দ্বীপের কবরস্থানও রয়েছে, যেখানে মৃত বন্দীদের সমাধিস্থ করা হয়েছে। ছিল পোস্ট অফিসও। চুন ও নীল পাথরের খনি ও একটি বাতিঘরও রয়েছে। ১৮৬৫ সালে নির্মিত বাতিঘরে ১৯৩৮ সাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। বাতিঘরে ঘূর্ণন বাতির পরিবর্তে একটি ঝলকানি বাতি ব্যবহার করা হয়, যা প্রতি ৭ সেকেন্ড অন্তর ৫ সেকেন্ড সময়ের জন্য জ্বলে ওঠে। এর আলো ২৮ মাইল দূর থেকেও দেখা যায়, যা জাহাজগুলোর নেভিগেশন সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বাতিঘরটি দ্বীপের সর্বোচ্চ উঁচু স্থান মিন্টু পাহাড়ে অবস্থিত। সামরিক ঘাঁটি হিসেবেও এর ষোলো আনা ব্যবহার হয়েছে।
কেপটাউনের প্রথম ইমাম মাদুরার যুবরাজ সাঈদ আব্দুর রহমান মতুরো স্মরণে নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ। এটি মূলত আব্দুর রহমান মতুরোর সমাধি। এটিও একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে স্থান করে নিয়েছে রোবেন দ্বীপে। দ্বীপের রয়েছে গ্যারিসন গির্জা নামের আরেকটি দর্শনীয় স্থান। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এই গির্জায় প্রতিবছর ভালোবাসা দিবসে গণবিয়ের আয়োজন করে থাকে। দেশ-বিদেশের অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা বা পছন্দের মানুষকে নিয়ে চলে যান ইতিহাসের শামিল হতে দেখা যায়। পুরুষ কুষ্ঠরোগীদের জন্য নির্মিত আরও একটি গির্জাও রয়েছে রোবেন দ্বীপে। এর নাম ‘গুড শেফার্ড’ গির্জা। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাঙ্গলীয় গির্জার মালিকানাধীন ও রোবেন দ্বীপের একমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভবন। খ্রিষ্টীয় ধর্মের অনুসারীদের কেউ কেউ এখানে এসে প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন। তবে খুবই সময়ের জন্য। কারণ এখানে আসা সবাই দলগতভাবে ঘুরে থাকে।
ঐতিহাসিক স্থানের স্বীকৃতি পাওয়ায় দৈনিক ১ হাজার ৮০০ মানুষ দৈনিক ভ্রমণের সুযোগ পান রোবেন দ্বীপের। বহু দূর-দূরান্তের মানুষ এখানে আসেন এর সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে। পর্যটকদের জন্য দ্বীপটি সারা বছর খোলা রাখা হয়। কেপটাউনের ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের ম্যান্ডেলা গেটওয়ে থেকে সকাল থেকে একাধিক ফেরি দ্বীপের দিকে যাত্রা করে। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় দ্বীপে পৌঁছাতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। তবে বৈরী আবহাওয়ায় এই সময় বেশি, কখনো কখনো দিগুণও লাগে। তবে শীতকালে আবহাওয়ার কারণে ফেরি কম চলাচল করে ও সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে শীতপ্রিয়দের বিমুখ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিকল্প জাহাজেও যাওয়া যায় রোবেনে। অনেকে হেলিকপ্টারে চড়েও এই দ্বীপে ঘুরতে যান।
ংঃধৎৎধনরঁষ@মসধরষ.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০২৩