নির্মাণে চারকোল ব্রিকস

আবাসনের চাহিদা মেটাতে শহর-নগরে প্রতিনিয়তই গড়ে উঠছে অসংখ্য স্থাপনা। পুরাতন ভবন ভেঙে নির্মিত হচ্ছে নতুন ভবন। স্থাপনা ভাঙার ফলে ধুলোবালিতে ভারী হচ্ছে বাতাস, নির্মাণ বর্জ্য ল্যান্ডফিল করায় বাড়ছে ভূমিকম্পের ঝুঁকি। পরিসংখ্যান মতে, প্রতিবছর নির্মাণশিল্পের অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর অব্যবস্থাপনায় প্রকৃতিতে ৪-১৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশি^ক উষ্ণতা বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। নির্মাণে ব্যবহৃত সাধারণ ইট উৎপাদনে নির্গত হচ্ছে কার্বন। বিজ্ঞানীদের পরামর্শ, গতানুগতিক ধারার শিল্প থেকে বের হয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হতে হবে পরিবেশবান্ধব। মুম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান স্কুল অব ডিজাইন অ্যান্ড ইনোভেশনের (ওঝউও) গবেষকেরা সাধারণ ইটের বিকল্প হিসেবে জৈব উপাদান ব্যবহার করে একধরনের ইটের উদ্ভাবন করেছেন, যাকে নামকরণ করা হয়েছে চারকোল জৈব ইট বা গ্রিন চারকোল ব্রিকস। এই ইটগুলোর বিশেষত্ব হলো এতে গাছাপালা ও পোকমাকড় বংশ বিস্তার করতে পারে। এই ইটের বিস্তারিত জানাচ্ছেন রিগ্যান ভূঁইয়া

আমাদের দেশে পাকা বাড়ি করতে পারাটা সাধারণ মানুষ গর্বের বিষয় বলে মনে করে। এমন প্রতিযোগিতায় গ্রামের উঠানও ঢেকে যাচ্ছে বালি, কংক্রিট আর সিমেন্টের চাদরে। এ অবস্থায় ইটের বিকল্প ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। আর ইটের বিকল্প বললেই বলতে হবে সবুজ ইট, জৈব ইট কিংবা চারকোল ব্রিকস (ঈযধৎপড়ধষ ইৎরপশং)। পরিবেশবান্ধব এই ইট শুধু নির্মাণের স্থায়িত্বই বাড়াবে না, জীববৈচিত্রও ফিরিয়ে আনবে প্রকৃতিতে। সবুজ চারকোল ব্রিকস হলো উপাদান উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি একটি অনুশীলনভিত্তিক গবেষণার ফল। এ গবেষণায় ভবন নির্মাণের জন্য স্বাস্থ্যকর উপকরণ উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং তাপমাত্রা মোকাবিলায় বিভিন্ন নতুন নতুন জৈব নির্মাণ উপকরণ তৈরি করা হয়। এটি কাঠকয়লা, জৈব লুফা ফাইবার, মাটি এবং বাতাসের সংমিশ্রণে তৈরি করা সিস্টেম, যার মাধ্যমে উৎপাদিত ইট বা বøক জীবাণু প্রতিরোধী এবং ওজনে হালকা। শুধু তা-ই নয়, এর পৃষ্ঠে উদ্ভিদ এবং পোকামাকড়ের বাস্তুতন্ত্র বৃদ্ধিরও পরিবেশ বিরাজ করে। শহরগুলোতে সবুজের মাত্রা খুবই কম। তাই শহুরে জীবনযাত্রা স্বাস্থ্যকর করে তুলতে এবং শহরে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে এ ধরনের নির্মাণ উপকরণের জুড়ি মেলা ভার। যেকোনো স্থাপনায় চারকোল ইট ব্যবহারে পরিবেশ হয়ে উঠবে অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর ও আরামদায়ক।

চারকোল ব্রিকসকে জৈব ইট বলার কারণ, এতে প্রচুর জৈব উপাদান ব্যবহার করা হয়। এই ইট মাটি, সিমেন্ট, কাঠকয়লা এবং লুফাহ ফাইবার দিয়ে তৈরি। লুফাহ (ধুন্দল) অত্যন্ত পরিচিত একটি সবজি। তার চেয়েও বেশি পরিচিত লুফাহ ফাইবার। বাসন মাজার স্ক্র্যাবার কিংবা বাথরুমের শাওয়ার ফ্লাওয়ার হিসেবে লুফাহ ফাইবার বিশ^জুড়ে সমাদৃত।

চারকোল ব্রিকসের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বায়ু। সাধারণ কংক্রিট বøকের চেয়ে গ্রিন চারকোলে ২০ গুণ বেশি বায়ুপকেট রয়েছে, যা অণুজীবদের আশ্রয় ও বংশবিস্তারে সহায়তা করে এবং ঘরের পরিবেশকেও শীতল রাখে। কারণ বায়ুর এই বুদবুদগুলো লুফাহর তন্তুগুলোতে ফাঁকা তৈরি করে। নির্মাণের এই উপকরণটি উদ্ভাবন করেন গবেষক শ্রেয়াস মোর এবং মিনাল সুতারিয়া।

বায়োডিগ্রেডেবল ব্রিকস বা চারকোল ইটগুলো জৈব উপাদানে তৈরি হওয়ায় এর রয়েছে বহুমাত্রিক সুবিধা। এ সুবিধাগুলো শুধু আরামদায়ক বাসস্থানই নিশ্চিত করবে না, আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ পরিবেশ উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।

এ ধরনের জৈব উপকরণে নির্মিত বায়োফিলিক স্পেসগুলোতে বাস করলে মানুষের মন ভালো থাকে। স্বাস্থ্য অনুক‚ল পরিবেশে থাকায় রোগ-বালাই দ্রæত উপশম হয়। শিক্ষার্থীরা  মনোযোগী হয়, কারখানা হলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। 

রাস্তাসংলগ্ন বাড়িগুলোতে সবুজ চারকোল ইটের ব্যবহারের ফলে তা দৃষ্টিনন্দনও হয়। তবে রাস্তার ডিভাইডার কিংবা বাড়িগুলোর বাউন্ডারিতে এ ধরনের ইটের ব্যবহার নান্দনিকতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাতাসকেও বিশুদ্ধ রাখে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি হ্রাস করে। সর্বোপরি মানুষের ইতিবাচক আচরণগুলোকেও অনুপ্রাণিত করে।

চারকোল ব্রিকস জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পরিবেশও অনেক বেশি শীতল রাখে। কারণ এ ইট ব্যবহার করলে ঘরে প্রচুর বাতাস চলাচল করে। 

গ্রিন চারকোল ব্রিকসে ৫৪% জৈব উপাদান ব্যবহার করা হয়, ২১% থাকে এয়ার পকেট। এতে ৪% সিমেন্টের ব্যবহার হয় এবং ৪% অন্যান্য সূ² উপাদান যেমন বালু, নুড়ি পাথর ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়।

গ্রিন চারকোল ব্রিকস গবেষণালব্ধ একটি স্বাস্থ্যসম্মত নির্মাণ উপকরণ। কাঠকয়লা (ঈযধৎপড়ধষ) হলো এই নির্মাণ উপকরণের একটি উপাদান মাত্র, যা এর পৃষ্ঠে থাকে। এতে মাটিও ব্যবহার করা হয় পরিমিত মাত্রায়। কাঠকয়লা মাটি থেকে নাইট্রেট শোষণ করে বাতাসকে বিশুদ্ধ করে। একই সঙ্গে নাইট্রোজেন হলো গাছের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাবার। তারা মনে করেন, এ ধরনের জৈব ইটের ব্যবহার মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করবে।

গ্রিন চারকোল ব্রিকসগুলো ওজনে সাধারণ ইটের চেয়ে অনেক বেশি হালকা হয়ে থাকে। তার চেয়েও বড় সুবিধা হলো এর জৈব উপাদানগুলো আপনার স্থাপনার পরিবেশকে বায়োডেগ্রেডেবল বা জীবাণুমুক্ত রাখতেও সহায়তা করবে। যেহেতু এ ধরনের ইটের নির্মাণের ক্ষেত্রে বালির ব্যবহারও কম হয়, তাই প্রাকৃতিক সম্পদেরও সাশ্রয় হবে। অতিরিক্ত বালি উত্তোলন প্রকৃতির বিপর্যয়েরও কারণ। তাই বলতেই হবে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়রোধে গ্রিন চারকোল ব্রিকসের ভূমিকাও কম নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলেও ধ্রæব সত্য, এ ধরনের ইট ব্যবহার করলে বাড়তি ধাতব শক্তির (রড, ইস্পাত ইত্যাদি) ব্যবহারও হবে তুলনামূলক অনেক কম। এ ক্ষেত্রে লুফা ফাইবারগুলোই শক্তিশালী উপাদান হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা আরও নতুন নতুন টেকসই নির্মাণ উপকরণ উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছেন। স্থপতিদের প্রতি তাদের আহŸান আরও অনেক সময়োপযোগী, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব নির্মাণ উপকরণ উদ্ভাবনে তারা যেন গবেষক ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। পরিবেশবান্ধব নির্মাণ উপকরণ গ্রিন চারকোল ব্রিকস নিয়ে মুম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান স্কুল অব ডিজাইন অ্যান্ড ইনোভেশনের গবষেকদের এই অভিনব উদ্ভাবন শুধু ভারতই নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বিশ^জুড়েও সাড়া ফেলতে পারে।

ৎরমধহনযঁরুধহ৪৩২@মসধরষ.পড়স

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৭ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top