আমরা প্রতিদিনই পারিপাশির্^ক জীবন থেকে নানা অসংগতির অভিজ্ঞতা অর্জন করি। কখনো দেখছি পারিবারিক কলহ, পাশের বাসায় তুমুল ঝগড়া বা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণ! এসবের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক অথবা অর্থনৈতিক অস্থিরতাসহ অনেক কিছুই দায়ী। রয়েছে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার সম্পর্কও। তবে যা-ই বলি না কেন, মানুষের জীবনে এসব অসংগতির সঙ্গে বাসস্থানের পরিবেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। গোছানো ও পরিপাটি পরিবেশ মন ভালো রাখে। ছোটবেলা থেকে সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে বড় হলে শিশুদেরও মানসিক বিকাশ হয় যথাযথ। তাহলে আমরা ঘর-গৃহস্থালির পরিবেশ নিয়ে কেন ভাবব না! ঘর সাজানোর দরকারি নানা তথ্য ও মনস্তাত্তি¡¡ক বিষয়াদি তুলে ধরছেন কামরুন নাহার
দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই অন্দরসজ্জা আমাদের জীবন বদলে দিতে পারে যেকোনো পরিস্থিতিতে। হয়তো ভাবছেন কীভাবে সাজাবেন আপনার ঘর, কোথায় কী রাখবেন, কেমন রং করবেন, দামি আসবাব লাগবে কি না। আসলে বিষয়টি একদমই এ রকম নয়। ভালোভাবে চিন্তা করলে কম খরচেও টেকসই হোম ডেকোর সম্ভব। দুর্লভ উপকরণে হয় এক্সক্লুসিভ নান্দনিকতা আবার সুলভ উপকরণে হয় ক্লাসিক্যাল সৃজনশীলতা। সাধ, সাধ্য এবং সম্ভাব্য সহজলভ্য উপকরণের ভিত্তিতেই বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ঘরের অভ্যন্তরীণ ডিজাইন ডেকোরেশন বিভিন্ন হয়ে থাকে। তবে রুচির ব্যাপার প্রত্যেকের ব্যক্তিগত। যে যেভাবেই ঘর সাজান না কেন, নিচে উপস্থাপিত প্রাথমিক করণীয়সমূহ সবার আগে ভাবতে হবে।
ঘরের বাস্তু
অনেকেই বাস্তুতন্ত্রে বিশ^াস করেন তাই ঘরের দরজা-জানালা এবং আসবাব কোথায় কোথায় বসাবেন সে বিষয়ে আগেই ভাবতে হবে। আপনি যেখানে বিছানা করবেন তার সঙ্গে দরজা, জানালা এবং দিকের সম্পর্ক রয়েছে। খুব সাধারণভাবেই দক্ষিণমুখী ঘর সবার পছন্দ। তবে আপনার ঘর যদি দক্ষিণমুখী না হয় কিংবা আপনার জমির আকৃতি অনুযায়ী যদি দক্ষিণমুখী ঘর বানানো সম্ভব না হয়, তবে ঘরের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা পরিকল্পার আগে অবশ্যই বাস্তু নিয়ে ভাবতে হবে।
আসবাবপত্র
একটি ঘরের আকার-আকৃতি অনুযায়ী কী ধরনের আসবাব মানাবে তা বুঝে নিতে হবে। ছোট ঘরে বেশি আসবাব থাকলে মনে হবে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। আবার বড় ঘরে কম আসবাব থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। দুই ক্ষেত্রে মানসিক পরিস্থিতির ওপর ভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তা ছাড়া ফাঁকা ঘরে শব্দের প্রতিধ্বনিও হবে অনেক বেশি। তাই নিজেরা না বুঝলেও অন্তত একজন ইন্টেরিয়র এক্সপার্ট দিয়ে সে ব্যাপারে ধারণা নিতে পারেন। ঘরে অনেক আসবাবই থাকে, যা সব সময় কাজে লাগে না। এ ধরনের আসবাব ফোল্ডিং হলে পাওয়া যায় বাড়তি সুবিধা। কাজের শেষে গুটিয়ে রাখলে ছোট বা মাঝারি ঘরে মুভমেন্টের জন্য যথেষ্টই জায়গা পাওয়া যাবে।
গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই নিজের বাড়িতে বাস করলেও শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দাই ভাড়া বাসায় থাকেন। নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকেন এমন পরিবার সংখ্যায় খুব বেশি নয়। যাঁরা নিজস্ব বাসায় থাকেন, তাঁদের জন্য কাস্টমাইজেবল ফার্নিচার অনেক বেশি সুবিধা দেবে। কাস্টমাইজেবল ফার্নিচার হলো যেখানে যে ফার্নিচার রাখা হবে তা স্থায়ীভাবে সেট করা বোঝায়। আমরা সাধারণত আলমারি, খাট, সোফা এগুলো প্রায় সবাই ব্যবহার করি। যদি নিজের বাসা হয় তবে ফাঁকা স্থানে কেবিনেট বানিয়ে আলমারি হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। এতে জায়গাও বেঁচে যাবে, আসবাবপত্রের স্থায়িত্বও বাড়বে, খরচও হবে তুলনামূলক অনেক কম।
ড্রয়িংরুমের আসবাব কেমন হওয়া উচিত? ড্রয়িংরুম হলো ঘরের প্রবেশের পরই যে বৈঠকখানার মতো ঘর থাকে, সেটি। দিন দিন মানুষ বাড়ার ফলে শহরে বা গ্রামে ড্রয়িংরুম খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আগে গ্রামের বাড়িতে ড্রয়িংরুমের পরিবর্তে ব্যবহার করা হতো বাংলো ঘর আর শহরে ড্রয়িংরুম। বর্তমানে এই ঘরগুলোও শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরিস্থিতি যখন এমনই, তখন অবশ্যই ড্রয়িংরুম সাজাতে আমাদের ফার্নিচারের কথা ভাবতে হবে আগে। বহুমুখী আসবাব ব্যবহার করলে এই সংকট থেকে বের হতে পারব।
রান্নাঘর একটি বাড়ির খাবারের মূল উৎস। প্রতিদিনের খাবার তৈরিতেও প্রয়োজন হয় নানা উপকরণ। রান্নাঘরের দেয়াল হতে পারে এসব উপকরণ সাজিয়ে রাখার উপযুক্ত জায়গা। রান্নাঘর বড় হলে হয়তো কেবিনেট বানিয়ে রাখতে পারেন সবকিছু।
রং
ঘর সাজাতে রং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। ঘরের রং কেমন হবে ঘর সাজানোর আগে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সাধারণত রান্নাঘর বা খাবারের ঘরের রং একটু উজ্জ্বল হয় কিন্তু তা যদি ব্যবহার করেন শোবার ঘরে, তবে সেটি হতে পারে বিরক্তির কারণ। হতে পারে মেজাজ খিটখিটে। তাই ঘরে রং নির্বাচনে হতে হবে খুবই সচেতন। যে ঘরেই রং করবেন, অবশ্যই তা আপনার রুচিমতো হতে হবে। শিশুদের ঘরের রং হওয়া উচিত তাদের বয়স, তাদের রুচি এবং পছন্দের সঙ্গে মানানসই। ছেলেশিশুদের ঘরের রং নীল এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে গোলাপি হলে ভালো হয়। তবে অবশ্যই ইল্যুশন বা বিভিন্ন চিত্র ঘরের দেয়ালে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, যা তাদের মানসিক বিকাশে অনেক সহায়ক হবে। কৃত্রিম রং তৈরিতে ব্যবহার করা হয় প্রচুর রাসায়নিক এবং সীসা। তাই যে রং ব্যবহার করবেন, সে ব্যাপারে ভালোভাবে জেনে নিন।
ড্রয়িংরুমে আসবাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হালকা রং ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যদি ঘরে প্রাকৃতিক আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে তবে সে ক্ষেত্রে পাতলা কাপড়ের পর্দা ব্যবহার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে রুমে সাদা, অফহোয়াইট কিংবা যেকোনো হালকা রং ব্যবহার করলে ড্রয়িংরুম হয়ে উঠবে এক স্বপ্নময় জগৎ।
ভেন্টিলেশন
ঘরের ভেন্টিলেশন খুব সাধারণ একটি বিষয়। যেকোনো ঘরে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা থাকে, তবে কারোর ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা পরিকল্পিত আর কারোরটা অপরিকল্পিত। অপরিকল্পিত ভেন্টিলেশনে দামি ঘরেও জীবন হতে পারে দুর্বিষহ। অপর দিকে পরিকল্পিত ভেন্টিলেশন সব ঋতুতেই জীবনকে করে তুলবে আরও সুন্দর। আপনি নিশ্চয় স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন চাইবেন, তবে ঘর সাজানোর আগে, আসবাব কেনার আগে অবশ্যই যথাযথ ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করুন। কেবিনেট কিংবা আলমারি ব্যবহার করতে ভুল করেও জানালা বন্ধ করা যাবে না। অনেক সময় আমরা ছোট ঘরে বড় খাট ফিটিং করতে অর্ধেক দরজা বন্ধ করে রাখি, যা একেবারেই উচিত নয়। সব সময় ঘরে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসকে আগে প্রাধান্য দিতে হবে। ঘরের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশ সব ঋতুতেই আপনাকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের জোগান দেবে। তাই এই দুই পাশের দরজা, জানালা এবং বারান্দা মুক্ত রাখতে হবে।
বাজেট
গৃহসজ্জায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাজেট। আপনি আসবাব সাজাবেন, রং করবেন কিংবা আরও যা-ই করুন না কেন, অবশ্যই তা আপনার সাধ্যের মধ্যে হতে হবে। ঊর্ধ্বগতির দ্রব্যমূল্যের বাজারে আমরা কোনোরকম জীবনযাপন করতেই হিমশিম খাই, তাই ঘর সাজাতে বাড়তি খরচ সহজেই কেউ করতে চায় না। কম খরচেও উন্নত, নান্দনিক ও ক্ল্যাসিক হোম ডেকোর সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আমাদের ক্রিয়েটিভলি ভাবতে হবে কোন ধরনের রিসোর্স বা উপকরণ হোম ডেকোরের ব্যয় কমাতে পারে। কাঠের আসবাবের পরিবর্তে বাঁশ ও বেতের আসবাব ব্যবহার করলে খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। বহুমুখী আসবাব ব্যবহার করলেও খরচ বাঁচবে বহুগুণ। এ ছাড়া ঘর সাজাতে দরকার হয় বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন গ্যাজেট বা শোপিস। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে সেসব শোপিস সহজেই তৈরি করে নেওয়া যায়। বাজারে কিনতেও পাওয়া যায় এসব জিনিসপত্র। বাজেট কম থাকলে শখের গৃহসজ্জা মনের মতো করতে না পারলে ঋণ না করে ধাপে ধাপেও সাজাতে পারেন ঘর।
এ ছাড়া ঘরের টাইলস, ফিটিংস এবং অন্যান্য সবকিছু বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঘরের ডেকোরেশন কেমন হবে। রঙের ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখবেন ভেন্টিলেশনের সঙ্গে রঙের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। কম আলোর ঘরে অবশ্যই হালকা রং ব্যবহার করতে হবে এবং বেশি আলোর ঘরে গাঢ় রং ব্যবহার করতে পারেন। কারণ হালকা রঙের ঘর আকারে ছোট হলেও একটু যেন বড়ই মনে হবে। গাঢ় রঙের ক্ষেত্রে বিষয়টি পুরোপুরি উল্টো। পরিকল্পিত রঙে ছন্দে সাজান আপনার ঘর। নান্দনিক ও আকর্ষণীয় গৃহসজ্জায় আপনার জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।
হড়নড়.ড়ৎঁহ@মসধরষ.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৯ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩