দ্য হাউস অব কর্নার্স

প্যাসিভ বায়োক্লাইমেটিকের অনন্য এক বাড়ি

দ্য হাউস অব কর্নার্স স্থাপনাটি প্যাসিভ বায়োক্লায়মেটিক বাড়ির অনন্য এক উদাহরণ। স্থাপনাটি স্পেনের স্যান জেভিয়ারে। স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ইকোপ্রোয়েক্টা বা ইকোপ্রজেক্ট আকর্ষণীয় এই আবাসন প্রকল্প ডিজাইন ও নির্মাণ করেছে। মাত্র ১৭০ বর্গমিটার জায়গায় নির্মিত প্রকল্পটি ২০২২ সালের অন্যতম একটি স্থাপত্য। এই প্রকল্পের প্রধান দুই স্থপতি হলেন পাবলো কারবোনেল এবং জুয়ান মিগুয়েল গেলেরা। প্রকল্পটির খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরছেন স্থপতি সুপ্রভা জুঁই

কর্নার পদবিভুক্ত পরিবারের জন্য এই বাড়িটি নির্মিত বলে এর নাম দ্য হাউস অব কর্নার্স। প্যাসিভ বায়োক্লায়মেটিক একটি বাড়ি বলতে আসলে কী বোঝায়, সেটা জানা জরুরি। প্যাসিভের বাংলা নিস্ক্রিয়। তাই বলে নিস্ক্রিয় বাড়িটি সক্রিয় নয় এমন কিন্তু না! বাড়ির ভেতরের যে কাজগুলো তাকে করতে হবে, সেই শর্তগুলো নিশ্চয় সে সম্পূর্ণরূপে পূরণ করছে। কিন্তু প্রাণ প্রকৃতির সঙ্গে যখন সে সংস্পর্শে আসছে, সেখানে সে নিস্ক্রিয়। অর্থাৎ, প্রাণ প্রতিবেশের যে ভারসাম্য সেটাকে একটুও এদিক-ওদিক করছে না। আর বায়োক্লায়মেটিক স্থাপত্য এমনভাবে স্থাপনার নির্মাণ নিশ্চিত করতে চায়, যা সৌর বিকিরণ এবং প্রাকৃতিক বাতাসের গতি, তাপমাত্রা ও তাপ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলোর সর্বোচ্চ উপপ্রয়োগ করার প্রতি বেশি মনোযোগী থাকে।  

সেদিক থেকে এই প্রকল্পটি টেকসই গুণাবলি এবং শক্তির যথাযথ ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেছে। বহুমুখী এবং অনেক রকমের স্পেসের সমন্বয়ে নানা ধরনের কাজ সম্পন্ন করার জন্য বাড়িটি হয়ে উঠেছে জীবন্ত। স্বামী, স্ত্রী এবং একজন শিশুসন্তান- এই হলো বাড়িটির প্রধান তিন সদস্য। এই আবহাওয়ায় বাড়িটি ডিজাইনের সময় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছিল এর ভৌগোলিক অবস্থান। উত্তরের দিক দিয়ে জমিতে প্রবেশের রাস্তা এবং এটিই জমির দীর্ঘ দিক। বাড়িটির আরেক প্রান্ত উন্মুক্ত হয়েছে পশ্চিমাংশে। মূল লক্ষ্য ছিল একটা আরামদায়ক, স্বাস্থ্যকর এবং কম এনার্জি খরচ হয় এমন লিভিং স্পেস, কম নির্মাণ খরচে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক স্পেসগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায় এমন একটি স্থাপনা ডিজাইন ও নির্মাণ করা। 

মুরসিয়ান অঞ্চলের উত্তরমুখী জমি হওয়ার বড় চ্যালেঞ্জ হলো, প্রাকৃতিক অবস্থা অনুযায়ী এখানে আদর্শ হতো যদি দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বমুখী জমি হতো। কিন্তু যেহেতু এই প্লটের বেলায় উত্তরমুখী ভবনই নির্মাণ করতে হবে তাই বায়োক্লায়মেটিক ভবন নির্মাণের চ্যালেঞ্জগুলো এখানে আরও একটু জটিল হয়ে উঠেছিল। তাই ডিজাইনে কৌশলগতভাবে লিভিং স্পেস ও রান্নাঘরকে পূর্বে রেখে বাকি লে-আউট সাজানো হয়। তাতে প্রাকৃতিক আলোপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ও সময় দুই-ই বৃদ্ধি পায়। এখানে মনে রাখতে হবে, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এই স্থান নির্বাচন আমাদের পরিবেশে খাটবে না। কিন্তু এনার্জির যথাযথ প্রয়োগের জন্য আমাদের যে সূত্রগুলো স্থপতি ও নির্মাতাদের প্রয়োগ করা উচিত, সেটার নিদর্শন বা কৌশল আমরা এখান থেকে জেনে রাখতে পারি।

ছাদকেও এখানে ব্যবহার করা হয়েছে যেন তা টেরাসের বাগানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে এবং ঘরের ভেতরে পর্যাপ্ত আলো আনতে সক্ষম হয়। বাড়িটির বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ সংযোগগুলো দেখার মতো। এটা চিন্তাশীল ডিজাইনের ফল। মেডিটেরিয়ান স্থাপত্যের নির্যাস হলো ঐতিহ্যগতভাবে এখানে ভেতর-বাহিরকে এক করে ফেলার একটা রীতি আছে। মৃদু জলবায়ুর যে সুবিধা, তার সুমিষ্ট ফল এটি, যা সংস্কৃতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। হাউস অব কর্নার্সে এই দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা প্রচেষ্টা করা হয়েছে, যা সফল। এখানে অল্প জায়গায় সুখকর কিছু অভ্যন্তরীণ স্পেস তৈরি করা হয়েছে, যা মনের অজান্তেই ঘরের বাইরে পর্যন্ত বর্ধিত হয়ে গেছে, সেটা জানালার মাধ্যমে হলেও। লিভিং রুম এবং রান্নাঘরটি দুটি উন্মুক্ত টেরাস দ্বারা সংযুক্ত। তাই গ্রামের বাড়ির ঐতিহ্য আধুনিক মোড়কে এখানে বহাল থেকেছে।  

প্রাকৃতিক শক্তির যথাযথ প্রয়োগের জন্য বায়োমেট্রিক ডিজাইনের কৌশল- ভবনটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সামান্য এনার্জি সরবরাহের মাধ্যমে ঘরের ভেতরে আরামদায়ক তাপমাত্রা নিশ্চিত করা। মূলত অন্দরমহলের যে মূল কাজ, সেগুলোকে বাইরের প্রাপ্ত আলো-বাতাস অনুযায়ী সঠিক জায়গায় সাজানোর প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন কৌশলগত অবস্থানও ছিল। যেমন, সবুজ ছাদ বানানো। যে সবুজ এতক্ষণ বাইরে ছিল, তাকে আবার স্থাপত্যে ধরে নেওয়া হলো এবং শুধু তাই-ই নয়, থার্মাল ইনস্যুলেশন বা ভেতর ও বাইরের তাপমাত্রার পরিবর্তনগত একটা প্রাকৃতিক সমাধানও হলো। এ ছাড়া ছাদের ওপরে মাটির পাত্রে বিন্দু বিন্দু করে পানি সেচের মাধ্যমে তাপমাত্রা হ্রাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ঘরের মাঝে কাঠের কাজ বা কার্পেন্ট্রি এবং শক্তিকে সর্বোচ্চ পরিমাণে ব্যবহারে সক্ষম এমন ধরনের কাচ এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। সূর্যের অতিরিক্ত তাপ থেকে ঘরের ভেতরের আবহ সুন্দর রাখতে ম্যালোর্কান পদ্ধতিতে শাটার প্রয়োগ করা হয়েছে, যেটা আমরা বাংলাদেশেও ব্যবহার করে থাকি। খড়খড়ি-জাতীয় দরজা বা জানালা যেখানে তেরছা করে সমান্তরালভাবে অনেক কাঠের টুকরো এমনভাবে স্থাপন করা হয়, যেন আলো-বাতাস ও বৃষ্টির পানির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন খোদ বাড়ির কর্তা। ফলে আবহাওয়ার প্রতি বাড়ির আচরণ একমুখী হয়ে ওঠে না। আবার ছাদ থেকে সূর্যের নিস্ক্রিয় আলো আনা হয়েছে যেন ঘরের ভেতরে আলোর পরিমাণে কিছুমাত্র আপস করা না হয়। 

টেকসই নির্মাণসামগ্রী যা একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে- ইকোপ্রজেক্ট বা পরিবেশবান্ধব প্রকল্পসমূহ সব সময়েই প্রাকৃতিক নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার প্রতি জোর দেয়। দ্য হাউস অব কর্নার্স-এ প্রাকৃতিক থার্মাল ইনস্যুলেশন বা তাপনিরোধক জাতীয় নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, কর্ক বা ওকগাছের ছাল দিয়ে তৈরি পাতলা কিন্তু স্থিতিস্থাপক ও শক্ত বোতলের ঢাকনা, খনিজ উপাদানে তৈরি রং ইত্যাদি। ভবনের প্রতিটি অঙ্গ একটি স্বাস্থ্যকর এবং সাস্টেইনেবল পরিবেশের জানান দেয়। 

ল্যান্ডস্কেপ ও পানি ব্যবস্থাপনা- এই বাড়ির কোনায় কোনায় আছে প্রকৃতির আনাগোনা। এই যেমন সামনের বাগান যেটি পালোমা ফেরার ল্যান্ডস্কেপ স্থপতির দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছে। এই স্থানটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় পোকামাকড়ের প্রজাতিগুলো একটা জ্যান্ত এবং স্বাস্থ্যকর মেডিটেরিয়ান পরিবেশ তৈরি করে। এভাবে তারা স্থাপত্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এবং প্রতিটি জায়গায় ছায়া বা খেলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশটি বের করে আনে। তা ছাড়া সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি আসে জমানো পানির ধারক থেকে। সেই পানি আসে ছাদ থেকে ধরা বৃষ্টির পানি থেকে। একটি কম বৃষ্টিপাতের এলাকায় যেখানে এই সম্পদের বড্ড অভাব, সেখানে এমন একটি চিন্তা ডিজাইনে সম্পৃক্ত করা পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল একটি আচরণ। 

প্রকল্পটিতে আছে একটা গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, রান্নাঘর এবং সেখানে ছোট একটা খাওয়ার জায়গা, বিরাট লিভিং রুম, একটা লম্বাটে সুইমিং পুল এবং বেশ কিছু স্টোর এলাকা। গ্রাউন্ড ফ্লোরের প্ল্যান দেখলেই বোঝা যায় ভেতর-বাহির এখানে একাকার হয়ে গেছে। এমন একটি স্পেসও এখানে নেই, যার সংস্পর্শ বাইরের টেরাসের সঙ্গে নেই। দোতলার বেডরুমের সঙ্গে আছে সুন্দর টেরাস এবং নিচের যাবতীয় কর্মগুলো দেখার মতো একটা সুন্দর ব্যবস্থাও করা আছে। কারণ একতলার যে বিল্ড এরিয়া, সেটা পুরোটা দোতলায় ব্যবহার করা হয়নি। তাই একতলার ছাদের একটা দারুণ ব্যবহার দোতলায় লক্ষ করা যায়। এটা যেমন দম নেওয়ার একটা দারুণ জায়গা হয়েছে, তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু না থাকায় ‘ভারসাম্য’ বিষয়টা সমস্ত প্রকল্পে প্রতিফলিত হচ্ছে। ছাদ থেকে বৃষ্টির জমানো পানি ধরে রাখা হচ্ছে মাটির নিচে রিজার্ভারে, যেটা গাছগুলোকে সেচ দিচ্ছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। এতে তাপমাত্রা শীতল হচ্ছে। আবার ছাদের ফুটোগুলোর কারণে বাইরের ভারী শীতল বাতাস নিচে ঘরে প্রবেশ করে, গরম হয়ে এলে ওপরে চলে গিয়ে ভেতরের পরিবেশটাকে সব সময়ই আরামদায়ক করে রাখতে পারছে। 

একতলার ভেতরের অংশগুলো যেহেতু বাইরের অংশের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতে পারছে, তাই এখানেও ক্রস ভেন্টিলেশন বা বাতাস আসা-যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে সুচারুভাবে। সীমানাপ্রাচীরে কোথাও অস্বচ্ছ দেয়াল আবার কোথাও আধা স্বচ্ছ খড়খড়ি দিয়ে ভেতরে থাকা মানুষদের ব্যক্তিগত জায়গাকে উপভোগ্য করে তোলা হয়েছে। এর ফলে বন্দিভাব ব্যাপারটাকেও স্তিমিত করা হয়েছে। পাথুরে ল্যান্ডস্কেপের কারণে ধুলোবালি উড়ে উন্মুক্ত এই ঘরের ভেতরে চলে আসার আশঙ্কা থাকছে না আবার সবুজ ও পাথুরে এই দুই উপাদানের একটা সংমিশ্রণও ঘটে। ঘরের ভেতরে এমনকি সিঁড়ির ধারেও নানাখানে প্লান্টার বক্সে সবুজ গাছগুলো দেখলে শান্তিবোধ হয়। এই প্যাসিভ বায়োক্লায়মেটিক বাড়িটি নিঃসন্দেহে পরিবেশবান্ধব বাড়ির ছোট ছোট শর্তপূরণের মাধ্যমে একটি অসামান্য জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। সীমিত কিছু নির্মাণসামগ্রীর পুনঃ পুনঃ এবং যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে এর সাধারণ বোধটি মূলত অসাধারণত্ব। এখানে অবস্থানরত লোকজনের আগলে রাখার মমত্ব এই স্নিগ্ধ স্থাপনাটির মধ্য দিয়ে শান্তভাবে প্রকাশ পেতে থাকে দিন ও দিনান্তে।

ংযঁঢ়ৎড়াধলঁর@মসধরষ.পড়স

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৯ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top