দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যু!! নির্মাণশ্রমিকদের জীবনমান  উন্নয়নে করণীয়

শ্রমিক ছাড়া যেকোনো নির্মাণ বা উন্নয়নমূলক কাজ চিন্তাও করা যায় না। শ্রমিকদের হাত দিয়েই শুরু বিশে^র উন্নয়নযাত্রা। নানা ধরনের শ্রম বা শ্রমিক থাকলেও নির্মাণশ্রমিকেরাই বরাবর আলোচনায়। কারণ তাঁদের হাত দিয়েই বিশ্বে বড় বড় অবকাঠামো বা দৃষ্টিনন্দন সব নির্মাণ হয়ে চলেছে। আগেকার যুগেও নির্মাণশ্রমিকেরাই নিজেদের নিজস্ব উদ্ভাবিত বুদ্ধি, কৌশল ও মেধা দিয়েই কাজ করেছেন, এমনকি অনেক জটিল প্রকল্পও বাস্তবায়ন করেছেন। অথচ সেই সময়ে শ্রমিকদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণেরও ব‍্যবস্থা ছিল না। শ্রমিকের হাত দিয়েই বিশ্বের প্রাক্্-ঐতিহাসিক সব ভবন, স্থাপনা (যেমন, তার্কিতে ‘গোবেকলি তেপে’, ফিলিস্তিনে ‘টাওয়ার অব জেরিকো’, ভারতে ‘তাজমহল’, চীনে ‘গ্রেট ওয়াল’ ইত‍্যাদি) নির্মিত হয়েছে। আকাশছোঁয়া অট্টালকিার পেছনে নির্মাণশ্রমিকদের শ্রম ও ঘামের কথা আমরা জানি। আর এই কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই জীবন বিপন্ন হয়ে থাকে তাঁদের। দুর্ঘটনায় পড়ে অনেক শ্রমিক মারা যান প্রতিবছর। যারা দুর্ঘটনায় বেঁচে যান, তাঁদের জীবন কাটে পঙ্গু দশায়। 

এখনো বিশ্বে শ্রমিক বা নির্মাণশ্রমিকদের গ্রহণযোগ‍্য কোনো সংজ্ঞা নেই। অর্থাৎ একেক দেশে শ্রমিকদের সংজ্ঞা, বি‍বরণী ও মর্যাদা একেক রকম। তবে সব নির্মাণকাজের সাইটে যেকোনো জাত-বর্ণের শ্রমিকদের শারীরিক পরিশ্রম করে কাজ করতে হয়। এ জন‍্য সচরাচর বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সমাজের অতি গরিব, প্রান্তিক ও অবহেলিত লোকজনই শ্রমজীবী বা নির্মাণশ্রমিক হয়ে থাকেন। প্রথম দিকে সব নির্মাণশ্রমিকই একে অপরের থেকে দেখে কাজ শিখতেন এবং এভাবে উন্নত দেশে পর্যায়ক্রমে এই পেশাটিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ছোঁয়া লাগে। এভাবে একসময় নির্মাণজগতে শিশুশ্রমিকদেরও আবির্ভাব ঘটে যায়। একপর্যায়ে অনেক দুস্থ পরিবারের মেয়েরা তথা সমাজের অবহেলিত মহিলারাও নির্মাণশ্রমিকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় (যা অবশ‍্য এখন আর ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ‍্যপ্রাচে‍্য নেই বললেই চলে)। 

এই প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই একটি ভবন বা অপরাপর যেকোনো নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন‍্য মালিক বা ঠিকাদার সরাসরি বাজার থেকে বা নানা সূত্রের মাধ‍্যমে (যেমন স্থানীয় সরদার, লেবার কন্ট্রাক্টর ইত‍্যাদি) দক্ষ/অদক্ষ নির্মাণশ্রমিক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। দ্বিতীয়-তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বিশ্বব‍্যাপী স্ব-স্ব আঙ্গিকে এই ব‍্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যখন প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ‍্যমে ঠিকাদার নিয়োগ এবং অন‍্যান‍্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নির্মাণ ও উন্নয়নকাজ হতে শুরু করে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে নির্মাণজগতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। এভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নির্মাণ এখন শিল্প। অনেক দেশের শ্রমিকেরা এখন কমবেশি শিক্ষিত এবং দক্ষও বটে। অনেক দেশে শ্রমিকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজস্ব ডেটাবেইসও আছে এবং সে অনুসারেই এখন কর্ম নেচার-বেইজডভিত্তিক নির্মাণশ্রমিক নিয়োজিত করা হয়। এতে সেসব দেশে শ্রমিকদের মান, সম্মান ও বেতন-ভাতাদি অন‍্যান‍্য পেশার মতো। তাঁদের দেশে নির্মাণশ্রমিক আর নির্মাণ ব‍্যবস্থাপকেরা একসঙ্গে মিলেমিশে একক সত্তা হিসেবে কাজ করেন। এমনকি শ্রমিক আর ব‍্যবস্থাপকের আবাস্থলও পাশাপাশি। সার্বিকভাবে বলতে গেলে উন্নত দেশে একজন নির্মাণশ্রমিক ও ব‍্যবস্থাপকের মধে‍্য তেমন কোনো দৃশ‍্যমান পার্থক‍্য নেই! 

বাংলাদেশে এখনো শ্রমিকদের জীবন-মানের উন্নয়ন হয়নি। এখনো খোলা বাজার থেকে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। নির্মাণশ্রমিকদের সঙ্গে মালিক বা ডেভেলপারের সঙ্গে কোনো চুক্তিও হয় না। ফলে যখনই কোনো কাজের সাইটে দুর্ঘটনা ঘটে; শ্রমিকেরা হতাহত হন, তখন শ্রমিকদের তথ‍্যাবলি বা সঠিক নাম-ঠিকানার অভাবে সমস‍্যা হয়ে দাঁড়ায় ও অবহেলায় অনেককে চিরতরে অকালে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। এমনকি মৃত নির্মাণশ্রমিকের লাশ মাসের পর মাস হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকতে এবং শেষ পর্যন্ত বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন হতে হয়! দেশে শ্রম আইন এবং আদালত থাকলেও তা তেমনভাবে সক্রিয় নয়! ফলে এই সমসাময়িক বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের পেশা এখনো ‘নি¤œমানের’ বলেই স্বীকৃত। তবে ইদানীং অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বব‍্যাপী নির্মাণকাজের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন)-এর তদারকি বা চাপ এবং নির্মাণশ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ফলে এই পরিবর্তন এসেছে। বিদেশে এখন প্রায় শ্রমিকেরাই মোটামুটি শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমাদের দেশেও এখন কিছু নির্মাণশ্রমিক মোটামুটি শিক্ষিত এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কমবেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর এভাবে অভিজ্ঞ শ্রমিকদের অনেকেই বিদেশি কোম্পানিতে ভালো বেতন-ভাতায় বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এবং তাঁদের কেউ কেউ মেগা প্রকল্পে কাজ করে ভালো বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। কিন্তু এতেও অভিবাসী শ্রমিকদের মান, বেতন ইত‍্যাদিতে বিরাট বৈষম‍্য লক্ষণীয়। মাঝেমধে‍্য দেখা যায়, কিছু অভিবাসী শ্রমিক তাঁদের পাওনা না পেয়েই দেশে চলে আসতে বাধ‍্য হন। 

আসলে দেশেও অনেক নির্মাণশ্রমিক এভাবে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত! যেমন অনেক সময় মালিক বা ঠিকাদারের কাছ থেকে মজুরি না পাওয়া, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালী লোকজন ইচ্ছে করেও শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি না দিয়ে নিজেরাই মেরে দেন। তবে হালে শ্রমিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার চাপে তাঁরা বেতন-ভাতা পরিশোধে বাধ‍্য হচ্ছেন। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা বা আপদ-বিপদে শ্রমিকেরা এখনো তেমন কোনো সাহায‍্য পান না। তবে বিদেশে কর্মরত (অভিবাসী) শ্রমিকেরা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে আইএলও তথা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের শর্ত মোতাবেক ক্ষতিপূরণ পান। মোট কথা, এখন বিশ্বব‍্যাপী অভিজ্ঞ নির্মাণশ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে এবং দুর্ঘটনাও অনেকাংশে কমে এসেছে।

বাস্তবে যেকোনো নির্মাণকাজের সাইটে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। অনেক সময় আবার নিয়োজিত কিছু শ্রমিক চরম ঝুঁকি নিয়েও কাজ করে থাকেন। এ জন‍্য অবশ‍্যই সংশ্লিষ্ট ভবনের মালিক বা ডেভেলপারের কিছু না কিছু প্রাক্্-প্রস্তুতি থাকা উচিত হলেও এই আধুনিক যুগে এসেও তা দেশের প্রায় ডেভেলপারদের মধে‍্য নেই! নির্মাণ বা অপরাপর ক্ষেত্রে কোনো শ্রমিকদের জন‍্য বিমা পলিসি সুবিধা নেই। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আহত শ্রমিককে নিকটবর্তী কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে তাদের দায় শেষ হয়ে যায়। এ জন‍্য এখনো দেশের প্রায় সব নির্মাণক্ষেত্রে তথৈবচ অবস্থা, যাকে ভবনের মালিক বা ডেভেলপারদের একধরনের উদাসীনতাও বলা যায়! 

এখনো দেশের খুব কম সাইটেই প্রাথমিক চিকিৎসা বা যথাযথ নিরাপত্তাব‍্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই নির্মাণকাজ চলে। প্রতিদিন আমরা এখানে-ওখানে এ রকম অসংখ‍্য শ্রমিকের আহত-নিহত হওয়ার সংবাদ দেখি। সচরাচর গভীর ফাউন্ডেশনে মাটি কাটা ও পাইলিংয়ের সময় চাপা পড়ে, নির্মাণাধীন ভবনের ওপর থেকে ধাক্কা খেয়ে বা পড়ে গিয়ে, নতুবা দুর্বল শাটারিং ও সেন্টারিংয়ের কারণে ঢালাইয়ের সময় ছাদ ভেঙে পড়ে অথবা মাথায় করে ওপরে মালামাল তোলার সময় বা যন্ত্রপাতি (কপিকল ইত‍্যাদি) বিকল/নষ্ট হয়ে অথবা দড়ি ছিঁড়ে গিয়ে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা এবং শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ডেভেলপার হলে এসব ক্ষেত্রে সামান‍্য কিছু ব‍্যবস্থা বা সাহায‍্য-সহযোগিতা করে থাকলেও অন‍্যান‍্য ক্ষেত্রে খুবই যাচ্ছেতাই অবস্থা! এভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে অনেক পরিবার অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়! 

দুঃখজনক হলেও এখনো দেশে যেকোনো নি¤œমানের কাজের জন‍্য নির্মাণশ্রমিকদেরই দায়ী করা হয়। অথচ তা সম্পূর্ণ মালিকপক্ষ বা ডেভেলপারদের ভুল বা অতিলোভের কারণে ঘটে থাকে! মালিক বা ডেভেলপারের লোকজন নির্মাণসাইটে কম রড, সিমেন্ট, বিটুমিন ইত‍্যাদি দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে বলেন। আর এভাবে নি¤œমানের কাজ করতে গিয়ে তাতে ধস বা কেউ আহত-নিহত হলে তখন মালিকপক্ষ এর পুরো দায়ভার নির্মাণশ্রমিকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের আড়ালে রাখতে চেষ্টা করেন। এর প্রধান কারণ, দেশে এখনো ডেভেলপাররাই কাজের নির্মাণশৈলী বা টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনস এবং নির্মাণ কোড মানতে চান না। এ জন‍্য এখনো দেশে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্মাণশ্রমিকদের নিয়োগ ও বেতন, মহার্ঘ‍্য ভাতা ইত‍্যাদি প্রদান পদ্ধতি; শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের অভাব, অবসরকালীন সুবিধা প্রদান ইত‍্যাদি বিষয়ে কোনো আইন বা বিধিবিধান না থাকায় দায়ী!

এখনো দেশের সব নির্মাণকাজের সাইটে শ্রমিকের ডাকনাম অথবা তার মুখে বলা নাম তালিকাভুক্ত করে কাজ করানো হয়। আর তারা গরিব বা সমাজের অবহেলিত বিধায় এবং স্থায়ী ঠিকানার অভাবে এদের প্রায় জনের জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয় পত্রও থাকে না। আবার অনেক শ্রমিকদের থাকলেও তার অধিকাংশই ভুয়া! এই কারণে এখনো দেশের উল্লেখযোগ‍্য একটি জনসংখ‍্যা ভোটারবিহীন অবস্থায় বা স্বাধিকার লাভ থেকেও বঞ্চিত! দেশজুড়ে কত মানুষ যে এই পেশায় নিয়োজিত, তার কোনো সঠিক বিবরণীও কোথাও লিপিবদ্ধ নেই!! অথচ দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী যেকোনো শ্রমিকের নিয়োগ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগকারীর। শ্রমিকের ব‍্যক্তিগত সুরক্ষা এবং সাইটে সংশ্লিষ্ট কাজের যন্ত্রপাতির ব‍্যবহার নিশ্চিত হওয়া ছাড়া নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কাউকে কোনো কাজে নিয়োগ করতে পারবেন না। 

কিন্তু দেশে এখনো নির্মাণশ্রমিকদের এসব বিষয় তদারকি, মনিটরিং বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দেখার জন‍্য সরকারি কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ নেই। শ্রম আইন ও আদালত নামমাত্রই বিদ‍্যমান! অথচ বিশ্বব‍্যাপী ‘নির্মাণ’ এখন একটি স্বীকৃত শিল্প এবং ‘চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব’ও চলছে। প্রতিবছর পয়লা মে বিশ্ব শ্রম দিবস হিসেবেও পালিত হয়। ক্ষেত্রমতো স্ব-স্ব দেশের বিল্ডিং কোড বা অপরাপর বিধিবিধান অনুসরণে সব নির্মাণশ্রমিকের উপযুক্ত ড্রেস, হেলমেট, গামবুট, গøাবস, নিরাপত্তা চশমা, বেল্ট ইত‍্যাদি উপকরণ পরেই কাজ করার বাধ‍্যবাধকতাও রয়েছে। অথচ দেশে এখনো বেশির ভাগ শ্রমিকই এমনকি উঁচু ভবন বা ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণেও তেমন কোনো নিরাপত্তা ড্রেস বা ব‍্যবস্থা ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছেন! এতদবিষয়ে দেশের শ্রম আইন, জাতীয় বিল্ডিং কোড (ইঘইঈ) এবং ঈচঞট (ঈবহঃৎধষ চৎড়পঁৎবসবহঃ টহরঃ)-সহ অন‍্যান‍্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেক নির্দেশনা বা গাইড লাইনস থাকলেও প্রায় ক্ষেত্রে তা এখনো উপেক্ষিতই হয় বলা যায়!

দেশে নির্মাণশ্রমিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ‘ইনসাব’ এবং ‘বিলস’-এর মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থাকলেও প্রায় ক্ষেত্রে তারাও তেমন কার্যকর নয়! নির্মাণকাজে শ্রমিকদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়াদি দেখা ও পরামর্শ প্রদানের জন‍্য সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে ‘জাতীয় সেফটি কাউন্সিল’ নামে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটিও আছে, কিন্তু এটিরও কার্যত তেমন কোনো ভূমিকা নেই! কারণ, দেশে এ বিষয়ে এখনো কোনো কার্যকর মনিটরিং সংস্থার অনুপস্থিতি। একইভাবে দেশের শ্রম আইনে নির্দেশনা থাকলেও ওপরের দিকে কয়েকটি কমিটি ব‍্যতীত তৃণমূল পর্যায়ে কোনো কমিটি নেই। এখনো রাজধানী ঢাকায় তথা কোনো জেলা বা উপজেলায় বা উন্নয়ন এলাকায় (যেমন, কোনো শিল্পনগরী, ইপিজেড বা মেগা প্রকল্প এলাকায়) এমনকি অন‍্য কোনো তৃণমূল পর্যায়েও এ ধরনের কোনো কমিটি বা এসব সংগঠনের কোনো শাখা স্থাপিত হয়নি। ফলে নির্মাণশ্রমিকেরা বরাবরই দেশের সর্বত্র এখনো বঞ্চিত।

নির্মাণশ্রমিকদের সংগঠন ‘ইনসাব’ (ইমারত নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ) দেশের ভবন বা ইমারত নির্মাণের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের একটি সংগঠন। এর অন‍্যতম লক্ষ‍্য ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, শ্রমিকদের পেশাগত বিষয়, স্বাস্থ‍্য ও নিরাপত্তাব‍্যবস্থা নিশ্চিত করা, পেনশন স্কিম চালু এবং দুর্ঘটনায় আহত-নিহত ও পঙ্গুত্ববরণকারী শ্রমিকদের সর্বনি¤œœ ১৫ লাক টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান রেখে এ জন‍্য প্রজ্ঞাপন জারিসহ শ্রমিকদের ১২ দফা পূরণ ও বাস্তবায়ন করা। আর ‘বিলস’ (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস) হলো- দেশের বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক সংগঠন বা ফেডারেশনের সমন্বয়কারী একটি আঞ্চলিক প্রেসার গ্রুপ, যারা প্রায়ই শ্রমিকদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ ও জরিপ করে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের দুর্ঘটনা, নির্যাতন, শ্রম অসন্তোষ ইত‍্যাদির চিত্র তুলে ধুলে ধরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে  যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন করে।

বাস্তবে যেকোনো নির্মাণকাজের সাইটে দুর্ঘটনার বিভিন্ন প্রেক্ষাপটও রয়েছে। তবে অন্যতম কারণ, নির্মাণশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে উদাসীনতা অর্থাৎ নিরাপত্তাসামগ্রী না পরেই কাজ করা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকে‍ৗশল বিশ্ববিদ‍্যালয় (বুয়েট)-এর পরিচালিত এক সমীক্ষায় প্রকাশ পায়, নির্মাণশ্রমিকদের হতাহতের বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটে ওপর থেকে অসাবধানতায় পড়ে গিয়ে অথবা মাথায় ইট পড়ে। আর বিলস-এর গবেষণায় দেখা গেছে, নির্মাণসাইটে কাজ করার জন‍্য অস্থায়ী (ভালো) সিঁড়ি না থাকা, সাইটে পর্যাপ্ত আলোর অভাব বা এলোমেলোভাবে রড, বালু ও ইটের স্তূপ করে রাখা, স্ব-স্ব কাজের সাইটে নিরাপত্তা জাল না থাকা, হেলমেট-গø‍াবস ইত‍্যাদি না পরা, ত্রæটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব‍্যবহার বা বৈদ্যুতিক সংযোগ ইত‍্যাদির কারণেই মূলত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ‘বিলস’-এর জরিপ মতে, গত দুই বছরে এভাবে প্রায় দুই হাজারের মতো নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন। তবে আমার মতে, এই সংখ‍্যা আরও অনেক বেশি হবে। কারণ নিত‍্যদিন দেশের প্রত‍্যন্ত অঞ্চলেও এ ধরনের বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বহু শ্রমিক মারা যান। আর ‘ইনসাব’-এর মতে, বর্তমানে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় প্রায় ৩৭ লাখ শ্রমিক জড়িত আছেন! তবে বাস্তবে এই সংখ‍্যা আরও বেশি।

এ ধরনের দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যুর কারণে ক্ষতিপূরণ পাওয়াও আরেক দুঃসাধ‍্য বিষয়। শ্রম আইনে বিভিন্ন রকম দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর জন‍্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারিত থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে এই ক্ষতিপূরণ মেলে। শ্রম আইনে নির্মাণশ্রমিকদের অসুস্থ‍ অবস্থায় ও চিকিৎসার জন‍্য মজুরি-ভাতা প্রধানের বিষয়েও সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে, কিন্তু তাও খুব কম ক্ষেত্রেই প্রতিপালিত হয় অর্থাৎ ‘ক্ষতিপূরণ কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’! একইভাবে শ্রম আইনে দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিকের প্রাণহানি হলে, তা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানানোর নিয়ম। কিন্তু প্রায় ভবনের মালিক, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ডেভেলপাররা তা জানান না বরং গোপন করেন! ফলে দেশে এই পর্যন্ত বা বিগত এক যুগে কত নির্মাণশ্রমিক আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে জীবনযাপন করছেন ও মৃত্যুবরণ করেছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ‍্যান কোথাও লিপিবদ্ধ নেই! আবার এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে শ্রম আদালতের এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের অনেক নির্দেশও উপেক্ষিত!

নির্মাণশিল্পে এসব নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির প্রতিকার তথা সুষ্ঠুভাবে যেকোনো নির্মাণ সম্পাদনের জন‍্য বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড প্রণীত ও গৃহীত হয়। পরে এটি সংশোধিতও হয়। কিন্তু বিগত (১৯৯৩ সাল থেকে) ৩০ বছরে এটি এখনো একটি ‘অপশনাল ডকুমেন্ট’ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে দেশব‍্যাপী ত্রæটিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ চলছেই। প্রায় নিত‍্যদিনই ইমারত এবং অন‍্যান‍্য স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। ২০১৩ সালে ‘রানা প্লাজা’ ধসে প্রায় ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক মারা যাওয়া বা নিখোঁজের পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত (সুপ্রিম কোর্ট) অনতিবিলম্বে এই বিল্ডিং কোডের যথাযথ কার্যকরণে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ প্রদান করেন, কিন্তু অদ‍্যাবধি সেই নির্দেশটি প্রতিপালিত হয়নি। ফলে এই ডিজিটাল তথা স্মার্টার যুগে এসেও সার্বিকভাবে দেশের নির্মাণশিল্প চলছে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে।

নিঃসন্দেহে দেশের উন্নয়ন বিকশিত করার জন‍্য দেশের সব ধরনের নির্মাণ ও উন্নয়নকর্মীদের প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। দেশে এখন অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। অথচ এর প্রায়গুলোতে ওই সব সাহায্যদাতা দেশ বা ডোনার সংস্থার অভিপ্রায় অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োজিত করে কাজ চলছে, যা আমরা রূপপুর আণবিক বৈদ্যুতিক প্রকল্প, ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেল প্রকল্পসহ প্রায় উন্নয়ন প্রকল্পেই দেখতে পাই। আবার দেশের যেসব নির্মাণশ্রমিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তাঁদের বেশির ভাগই উচ্চ বেতন ও সুবিধাদি পেয়ে মধ‍্যপ্রাচে‍্যর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এই অবস্থায় আমাদের দেশে টেকসই উন্নয়নের জন‍্য দক্ষ শ্রমিক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এই সমস‍্যা ও অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশের যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজের সব শ্রমিকদের বিশ্বমানের হওয়ার লক্ষে‍্য সবাইকে অবশ‍্যই কমবেশি শিক্ষিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, ডেটাবেইসধারী এবং জাতীয় পরিচয় পত্রধারী হতে হবে। এ জন‍্য সব শ্রমিকদের কমবেশি লেখাপড়া জানা (মোটামুটি ইংলিশ বলতে ও বুঝতে পারা) এবং স্ব-স্ব বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্নও হতে হবে। সে সঙ্গে সব শ্রমিকের কাজ ও জীবনের নিরাপত্তার জন‍্য শ্রম আদালতকে যথাযথভাবে কার্যকর করাসহ শ্রমকে ইনস্যুরেন্সের আওতায়ও আনতে হবে। এ জন‍্য দেশের শ্রম আইনসহ সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানের আমূল সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে মালিকদের অবহেলা এবং সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর যথাযথ পরিদর্শনের ঘাটতি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।

প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৮ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top