নদী ও খালবেষ্টিত ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকার জলাশয়কে দূষণমুক্ত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিছুদিন আগেও ঢাকার জলাধারগুলো স্বচ্ছ ও পরিষ্কার থাকবে এমন চিন্তা ছিল অকল্পনীয়। আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে, সম্প্রতি রাজধানীর আফতাবনগরের দাশেরকান্দিতে নির্মিত হয়েছে পয়োশোধনাগার প্ল্যান্ট, যার মাধ্যমে দূষিত পানিকে শোধন করে পাশর্^বর্তী বালু নদে দূষণমুক্ত পানি দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া মিরপুরসংলগ্ন তুরাগ নদ, রায়েরবাজারসংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদী, পাগলাসংলগ্ন ধলেশ্বরী নদী এবং পূর্বাচলসংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীর নর্দমা নিষ্কাশন পয়েন্টে আরও চারটি পয়োশোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্প ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে করে নগরবাসীর শতভাগ উন্নত ও টেকসই পয়োসেবা নিশ্চিত করবে।
দাশেরকান্দিতে বালু নদের তীরে প্রায় ৬২ একর জায়গাজুড়ে অত্যাধুনিক সমন্বিত পয়োশোধনাগার নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। দাশেরকান্দিতে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট, প্ল্যান্ট ট্রিটমেন্ট এবং ইনসেনেরেশন একসঙ্গে তিনটি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে।
ওয়াসার এই সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি মোট ৮ ধাপে শোধনের কাজ করে থাকে। মূলত মলমূত্র ও রান্নাঘর থেকে আসা মিশ্রিত দূষিত পানিকে পয়োবর্জ্য বলা হয়, যা দাশেরকান্দি প্ল্যান্টে যথাযথভাবে ট্রিটমেন্ট করে শোধিত পানিকে জলাধারে ছেড়ে দেওয়া হয়। পানি থেকে কঠিন বর্জ্যকে প্রথমে আলাদা করে ৬টি ধাপে দূষিত পানিকে শোধন করা হয়। এ ছাড়া আরও দুই ধাপে কঠিন বর্জ্যকে ফ্লাই অ্যাশে রূপান্তর করা হয় এই প্ল্যান্টে।
বাড্ডা, নিকেতন, গুলশান, বনানী, বারিধারা, বারিধারা ডিওএইচএস, বসুন্ধরা, আফতাবনগর, মগবাজার ও কলাবাগান থেকে আসা পয়োবর্জ্য মোট ৮টি পাম্পের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। প্রায় ৫ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পয়োবর্জ্যকে এই ইনলেট পাম্পস্টেশনে নিয়ে আসা হয়।
পানি শোধনের পরবর্তী প্রক্রিয়াটি হচ্ছে প্রাইমারি সেডিমেনটেশন এবং এনারোবিক এনোক্সিক অকসিক ধাপ। পানিতে থাকা দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ, গ্যাস, ফসফিটের মতো উপাদান এই ধাপগুলোর মাধ্যমে ছেঁকে আলাদা করা হয়। পঞ্চম ধাপে আলট্রাভায়োলেট রশ্মির সাহায্যে আবারও জীবাণুমুক্ত করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার মতো বিশুদ্ধতা অর্জন করে এই পানি। শেষ ধাপটিতে পানি কতটা শোধন হচ্ছে তা ইফসি বায়োফ্লুয়েন্ট স্যাম্পলিং চেম্বার বা নমুনা পরীক্ষার ট্যাঙ্কের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগারের শেষ দুটি ধাপে ফ্লাই অ্যাশ রূপান্তরের প্রক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। রোটারি ক্লিন টেকনোলজির মাধ্যমে পানি থেকে আলাদাকৃত কঠিন পয়োবর্জ্যকে পোড়ানো এবং শুকানো হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হলে ০ শতাংশ আর্দ্রতাবিশিষ্ট ফ্লাই অ্যাশে পরিণত হয়। প্ল্যান্টটির প্রতিটি স্থাপনার জোড়া থাকায় একটিতে যান্ত্রিক ত্রæটি ধরা পড়লে অপরটি চালু রেখে পুরো শোধনাগার প্রক্রিয়া চালু রাখা সম্ভব। এ ছাড়া অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে প্ল্যান্টটি তৈরি হওয়ায় পরিবেশের ক্ষতি প্রায় শূন্যের কোঠায়।
এই প্ল্যান্টটি নির্মাণের ফলে রাজধানীতে দৈনিক প্রায় ২০০ কোটি লিটার পয়োবর্জ্যরে ২০-২৫ শতাংশ শোধন হচ্ছে। অর্থাৎ রাজধানীর এক-চতুর্থাংশের বর্জ্য এই পয়োশোধনাগারের মাধ্যমে পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে।
পয়োশোধনের পর সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিশোধিত পরিষ্কার পানি বালু নদে ফেলা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, পানির মানের উন্নতির ফলে বালু নদ ও আশপাশের জলধারায় মাছের উৎপাদন বাড়ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব প্ল্যান্ট নির্মাণ হয়ে গেলে ঢাকার জলাশয়গুলো দূষণমুক্ত হবে বলে আশা করা যায়, যা পরিবেশের ভারসাম্য আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
তবে বেশ কয়েকজন স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবাদীরা এই প্ল্যান্টের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, এই প্ল্যান্ট এখন শুধু হাতিরঝিলের ময়লা পানি প্ল্যান্টে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করবে। এতে খুবই আংশিক কাজ হবে। অথচ, এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটা যে এলাকাকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছে, অর্থাৎ মহাখালী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, নিকেতন এই পুরো অঞ্চলের দূষিত পানি প্ল্যান্টে যাওয়ার জন্য নেটওয়ার্ক এখনো করা হয়নি। যতক্ষণ না করা হবে, ততক্ষণ কাজটা পুরোপুরিভাবে হবে না। যার ফলে এর পুরো সুফল পাওয়ার জন্য ঢাকাবাসীকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।
ফয়সল মোয়ারেফুর রসূল
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৮ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২৩