তপ্ত নগরীর তাপ কমাবে ইকোসিটি

রাজধানীসহ সারা দেশে মাসখানেক আগে প্রচÐ দাবদাহে জনজীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল! তখন নগরের সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত তাপমাত্রা হয়েছিল প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৬০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তপ্ত সময় পার করেছে ঢাকাবাসী। গ্রীষ্মে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা এক অশনিসংকেত! পাশাপাশি বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় গরমের আঁচ অনুভ‚ত হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। দেশের অন্যান্য জনপদে কাছাকাছি তাপমাত্রা থাকলেও ঢাকার গরম ছিল অসহনীয়। এমনকি ঢাকার পাশর্^বর্তী শহরগুলোতেও তাপের এই পার্থক্য ৩-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার সঙ্গে শহরের বাইরের গরমের অনুভ‚তির এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাপীয় দ্বীপের প্রভাব (হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট)। এই ইফেক্ট সত্তে¡ও ঢাকার গাছপালাসমৃদ্ধ সবুজ এলাকায় গরমের অনুভ‚তি ছিল কম। কেন এই অসহনীয় উত্তাপ; উত্তরণের উপায়ই-বা কী, তার সলুকসন্ধান করেছেন 

মঈন আহমেদ

স্প্রিনজার নেচারের থিওরেটিক্যাল অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ক্লাইমেটোলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাবের নানা তথ্য উঠে এসেছে। ‘নগরায়ণে পরিবর্তন ও ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাব’ শীর্ষক এই গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সঙ্গে শহরের বাইরের শীতলতম স্থানের দিন-রাতের ভ‚পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টি অনেকটা এমন, ঢাকার অদূরে সাভার বা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে যখন তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে, তখন তেজগাঁও-ফার্মগেট এলাকার তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার ঢাকার ভেতরেও ভ‚পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে মিরপুরের চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকার তাপমাত্রা গুলশানের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। ঢাকার সবচেয়ে উত্তপ্ত এলাকার তালিকায় রয়েছে তেজগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, পল্টন, মতিঝিল, গুলশান, বনানী, রামপুরা, বনশ্রী, উত্তরা, মিরপুর ও শেওড়াপাড়া। গবেষণায় উঠে আসে, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের ভ‚পৃষ্ঠ এলাকা ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে আর জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে সবুজ পরিসর কমে যাওয়া ছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেই বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদের নেতৃত্বে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ঢাকার তাপমাত্রা বিষয়ে একটি গবেষণা হয়। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, শহরের বেশির ভাগ এলাকায় এপ্রিলের প্রায় পুরো সময় তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল; অর্থাৎ এপ্রিলজুড়ে ঢাকায় প্রচÐ তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। প্রচÐ তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকার যেসব এলাকা বেশি উত্তপ্ত, সেসব এলাকায় অগ্নিঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। শুধু ঝুঁকিই নয়, চলতি বছরে বঙ্গবাজার, নিউ সুপার মার্কেটসহ বেশ কিছু স্থানে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাÐ। স্বাধীনতার আগে ঢাকার অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে ২৬টি জলাধার ছিল। বর্তমানে এসবের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তা ছাড়া তপ্ত আবহাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও।  

অস্বাভাবিক দাবদাহের নেপথ্য কারণসমূহ

বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয়, নগরে প্রচÐ গরম অনুভ‚ত হওয়ার কারণ আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট। কার্বণ নিঃসরণ বেড়ে পরিবেশ বিপর্যয় আজ চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে। পর্যাপ্ত গাছ না থাকায় ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। দেশে যেভাবে নগরায়ণ হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকায়। উন্নয়নের মডেল মোটেও টেকসই নয় বরং উত্তাপ সৃষ্টির জন্য দায়ী। দিন দিন যে হারে স্থাপনা গড়ে উঠছে, সেই একই হারে কমছে উন্মুক্ত স্থান, সবুজ বনভ‚মি ও জলাশয়। ঢাকার ৮২ শতাংশ কংক্রিটে আচ্ছাদিত। শহরের খেলার মাঠ, পার্ক ও উদ্যান দখল হয়ে কমছে উন্মুক্ত স্থান, হয়ে পড়ছে বৃক্ষহীন। কিছু কিছু সৌন্দর্যবর্ধক ও বিদেশি গাছ লাগালেও তা বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে চরমভাবে। বাংলাদেশের পরিবেশ বিবেচনা না করে তৈরি হচ্ছে এয়ার টাইট উঁচু উঁচু ভবন। ভবনগুলো কাচে আচ্ছাদিত। এগুলো তাপ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট দায়ী। এই তাপের হাত থেকে বাঁচতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসি, ফ্যান, কুলার, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার। এ ছাড়া যেসব কারণে নগর উত্তপ্ত হচ্ছে-

চাহিদার তুলনায় বনভ‚মির অভাব

ব্যাপক অপরিকল্পিত নগরায়ণ

জনসংখ্যার বিস্ফোরণ

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বৃক্ষ নিধন

বড় গাছ না থাকায় প্রয়োজনমতো বৃষ্টিহীনতা

জলাভ‚মি ভরাট

নদী, খাল, জলাশয়দূষণ

অবৈধ ইটভাটায় জ¦ালানি হিসেবে গাছ পোড়ানো

ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ যানবাহন

জীবাশ্ব জ¦ালানি-নির্ভর যান্ত্রিক যানবাহন থেকে নির্গত তাপ 

কালো রঙের অ্যাজফল্ট-বিটুমিনাস সড়ক

কংক্রিট ও কাচ আচ্ছাদিত ভবন ও ছাদ

তাপ উৎপাদনকারী নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার 

পরিবেশদূষণ

আবহাওয়ার পরিবর্তন

কলকারখানার আধিক্য

অতিরিক্ত এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ ও অন্যান্য ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর ব্যবহার প্রভৃতি

অতিরিক্ত তাপের প্রভাব

পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যে হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে অচিরেই পৃথিবী নামক গ্রহটি দ্রæতই হুমকির সম্মুখীন হবে। স¤প্রতি এক গবেষণা জানা গেছে, পৃথিবীর কিছু শহর ও স্থান আগামী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এতটাই উত্তপ্ত হবে যে সেখানে আর মানুষ বাস করতে পারবে না। ত্রয়োবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইসরায়েলের তেলআবিব কিংবা চীনের সাংহাইয়ের মতো ব্যস্ত শহরগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আফ্রিকা, চীন, ব্রাজিল, ভারত কিংবা অস্ট্রেলিয়ার অনেক অংশে মানুষের যাতায়াত বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এসব অঞ্চল এতটাই উষ্ণ ও আর্দ্র হবে যে কেউই এসি ছাড়া থাকতে পারবে না। আর আজ থেকে ৩০০ বছর পরে পৃথিবীর জনবহুল অর্ধেক স্থানেই এই অবস্থার সৃষ্টি হবে। 

প্রতিবছর বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ তীব্র গরমে মারা যায়। সারা বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতজন মানুষ হারিকেন, টর্নেডো এবং বন্যায় মারা যায়, তার থেকে বেশি মানুষ তীব্র তাপপ্রবাহে মারা যায়। এই তাপপ্রবাহের তীব্রতা দিন দিন যত বাড়বে, মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও তত বাড়বে। এমকি স্বাস্থ্যবান পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের এই তীব্র উষ্ণতার সঙ্গে খাপ খাওয়ার ক্ষমতাও হ্রাস পাবে যখন উষ্ণতার তীব্রতা বাড়বে। আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য শরীরে উষ্ণতা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা দরকার। শুষ্ক আবহাওয়ায় আমাদের ত্বক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপ সহ্য করতে পারে। কিন্তু যদি জলবায়ুতে আর্দ্রতা থাকে, তাহলে এই সহ্যক্ষমতা কমে যায়। তখন আমাদের ত্বক ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপ সহ্য করতে পারবে না। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইলম্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের ‘জলবায়ু ও পরিবেশ’ প্রকল্পের পরিচালক পেট্রিক কিননেন বলেন, ‘যে চিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছে তা যথেষ্ট ধ্বংসাত্মক। মানুষ উষ্ণতাজনিত মৃত্যু যে পরিমাণে হবে বলে এত দিন হিসাব করেছে, বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ হবে।’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতিরিক্ত এসির ব্যবহারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়বে। অধিক উষ্ণ দেশগুলো থেকে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা দেশগুলোতে মানুষের স্থানান্তরিত হওয়ার হারও বৃদ্ধি পাবে। আর এসব প্রভাব এরই মধ্যে উপলব্ধি করছে বিশে^র প্রতিটি উষ্ণ শহর। ঢাকার ক্ষেত্রেও তাপজনিত কারণে হিটস্ট্রোকসহ নানা ধরনের রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। 

বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে ইকোসিটি কার্যক্রম

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে বিশে^র উন্নত দেশগুলো বেশ কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গ্রহণ করছে ইকোসিটি কার্যক্রম। ‘ওয়ান প্লানেট সিটি চ্যালেঞ্জ’ ¯েøাগানকে সামনে রেখে প্রতিটি শহরকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের পদক্ষেপ। সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে প্রায় ৬০০ হেক্টর সবুজ ভ‚মি রয়েছে, যা শহরের আকারের প্রায় ২০ শতাংশ। শহরকে স্বাস্থ্যবান্ধব, প্রাকৃতিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এই সবুজ ভ‚মির ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবুজ ভ‚মি মেলবোর্ন শহরের হিট আইল্যান্ড ইফেক্টকে প্রশমিত করে শহরের তাপমাত্রাকে একদিকে যেমন বৃদ্ধি করতে রোধ করে, ঠিক তেমনি শহরের অবকাঠামো বিশেষ করে ড্রেনেজ সিস্টেম থেকে শুরু করে বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে রাখে। 

যেখানে সবুজ গাছপালা রয়েছে, এমনকি সবুজ ঘাসযুক্ত স্থান, সেখানে রাখা হয়েছে স্বয়ংক্রিয় পানির ব্যবস্থা। রাস্তার পাশে বাগান বা স্ট্রিট গার্ডেন, যেখানে নগরবাসী তাদের শহরে ব্যস্ততম জীবনের অনেক সুন্দর সময় কাটায়। এমনকি রাস্তার পাশে রয়েছে ছোট ছোট সবুজ চত্বর। সে চত্বরের ওপর নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর কিছু বড় প্লান্টার বক্স (গাছ লাগানোর জায়গা) রাখা হয় এবং দুটি প্লান্টার বক্সের মধ্যবর্তী স্থানে কয়েকটি চেয়ার এবং ছোট টেবিল দিয়ে বসার কিংবা খাওয়ার জায়গা তৈরি করা হয়। সেখানে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন পাখি ও ছোট প্রাণী, ফোটে রংবেরঙের ফুল, ওড়ে প্রজাপতি। আর সেই প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো শহরে বসবাসরত যেকোনো নাগরিকের উপভোগের বিষয় হয়ে ওঠে, যা তার মনমানসিকতা এবং স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এমনকি তার কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সিঙ্গাপুরে গড়ে তোলা হয়েছে আরবান ওয়াসিস। প্রতিটি সড়কদ্বীপ ও ফুটপাতজুড়ে করা হয়ে নান্দনিক সবুজ বাগান। মরুময় দেশ সৌদি আরবও সবুজ উদ্যান ও শহর গড়ার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি দেশটি নিওম নামে এক অত্যাধুনিক পরিবেশবান্ধব শহর গড়ার কাজ হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া বিশে^র বিভিন্ন দেশ পরিবেশবান্ধব ইকোসিটি গড়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। 

ঢাকাকে আনতে হবে পরিবেশবান্ধব ইকোসিটির আওতায় 

ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে নগরকে আনতে হবে ইকোসিটির আওতায়। গাছপালা না কেটে, নদী-পুকুর-খাল ও জলাশয় ভরাট না করে পরিকল্পিতভাবে যদি রাজধানীর বিস্তার ঘটত, তাহলে ঢাকার আদি অকৃত্রিম রূপ বজায় থাকত। নতুন করে ইকোসিটি গড়ার প্রয়োজন হতো না। ৪০০ বছরের অধিককালের ঐতিহ্যবাহী নগর ঢাকা। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ নগর একসময় ছিল চিত্রকরের আঁকা ছবির মতোই সুন্দর। ছিল সবুজ বৃক্ষরাজি, নদী, খাল আর জলাশয়। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শোভা পেত ফুল-ফলের বাগান। অনেক বাড়ির সামনে ছিল পুকুর ও প্রশস্ত উঠোন। ঢাকার এ অপার সৌন্দর্যের টানে বিশ্বের কত পর্যটক যে এ নগরে পা ফেলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এখনকার বৃক্ষহীন রুক্ষ নগরের সঙ্গে আগের সবুজ ঢাকার কোনো মিলই নেই। প্রতিনিয়ত খোলা জায়গা ভরাট করে ঢাকার বুকে গড়ে উঠছে ইট-কংক্রিটের কঙ্কাল। এ কারণে কাটা পড়ছে হাজারো গাছ। নগর ঢাকা দিনে দিনে বৃক্ষহীন, রুক্ষ ও বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাস অনুপযোগী নগরে পরিণত হয়েছে। এখনো চলছে উন্নয়নের নামে সমানে বৃক্ষনিধন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের বৃক্ষ নিধন যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।  এই বিবর্ণ দশা থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে ও সঠিক প্রতিবেশব্যবস্থা ফেরাতে বৃক্ষ সুরক্ষা ও বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। 

সবুজ ঢাকা গড়তে

স্থাপত্য এবং নগরকেন্দ্রিক গবেষণায় প্রমাণিত একটি শহরের প্রাণ একদিকে যেমন শহরের মানুষ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, অফিস, কলকারখানা প্রভৃতি, ঠিক তেমনি শহরের মাঝখানে গাছগাছালিঘেরা সবুজ চত্বর সে শহরের ফুসফুস। সবুজ নগরী মানে পরিবেশবান্ধব নগরী। গাছপালা নগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখে। গাছ বাতাসে জলীয় বাষ্প ছাড়ার মাধ্যমে যা ১-৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমাতে পারে। প্রতিটি বড় গাছ বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, বায়ুদূষণ রোধসহ শত শত টন কার্বন শোষণ করে গাছ পরিবেশকে অক্ষত রাখতে সহায়তা করে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বলছে, এক হেক্টর বনভ‚মি বছরে ১৮ লাখ গ্রাম কার্বন গ্রহণ করে। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউএনইপির তথ্যমতে, টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি শহরের মোট ২৫ শতাংশ উš§ুক্ত ভ‚মি থাকা প্রয়োজন। সাধারণত উš§ুক্ত ভ‚মি বলতে সবুজ এবং জলজ ভ‚মির সহাবস্থানকে বোঝায়। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ‘টৎনধহরুধঃরড়হ ধহফ মৎববহ ংঢ়ধপব ফুহধসরপং রহ এৎবধঃবৎ উযধশধ, ইধহমষধফবংয-২০১২’ শীর্ষক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকায় মাত্র ১৪ শতাংশ উš§ুক্ত ভ‚মি রয়েছে, যার পরিমাণ এখন সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৯ শতাংশ। একটি দেশে সবুজ নগর করা সহজ নয়। অথচ বাংলাদেশে তা খুবই সহজ। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই আমরা পেয়েছি এই সবুজ দেশ। এখানে গাছপালা অযতেœও বাড়তে পারে, না লাগালেও হয়ে যায়। কিন্তু এই প্রয়োজনের অনেকটাই ¤øান করে দেয় শহরের পর্যাপ্ত খোলা জায়গার অভাব। প্রায় সব জায়গাই ভবন আর রাস্তার দখলে। এ জন্য ঢাকাকে ঘিরে নিতে হবে ভিন্ন পরিকল্পনা। যেমন- 

শহরের ভেতরে গাছ লাগানোর সুযোগ কম থাকায় ঢাকার চারপাশে যে বেড়িবাঁধ এবং বাঁধসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক বৃক্ষায়ণ করতে হবে

যেসব স্থানে জলাভ‚মি রয়েছে, সেখানে জলজ উদ্ভিদ অর্থাৎ পানিতে টিকে থাকতে সক্ষম, এমন গাছ লাগানো যেতে পারে, যা বর্ষায় ও গ্রীষ্মে উভয় পরিবেশেই টিকে থাকতে সক্ষম; যেমন রাতারগুল জঙ্গল

জোন-ভিত্তিক বাগানও তৈরি করা যেতে পারে। এসব বন শহরের দূষিত বায়ু শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহে সহায়তা করবে

হাতিরঝিল, গুলশান লেক, ধানমন্ডি লেক, আশুলিয়া প্রভৃতি স্থানেও প্রচুর গাছ লাগানোর সুযোগ রয়েছে

রাজধানীর প্রতিটি পাবলিক পার্ক, সড়কের দুই ধার, সড়কদ্বীপ, অফিস আঙিনা, স্কুল-কলেজের মাঠ, বাড়ির আশপাশ এমনকি দেয়ালের ভেতর ও বাইরে একটু উদ্যোগ নিলেই লাখ লাখ গাছ লাগানো সম্ভব

প্রতিটি আবাসিক এলাকার বøকভিত্তিক পার্ক গড়ে তোলা ও বৃক্ষরোপণ করা যায়

তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের পরিত্যক্ত জায়গায় আরবান ওয়াসিস তথা সবুজায়ন করা সম্ভব

এ ছাড়া প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি ভবনের ছাদে ও অন্যান্য পরিসরে বাগান সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা

দেশের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো যেন ‘গ্রিন প্লট রেশিও’ বা ‘সবুজায়ন আইন’ মেনে প্রকল্প নির্মাণ করে, তা বাধ্যতামূলক করতে হবে 

প্রায়ই রাজধানীর সৌন্দর্যবৃদ্ধির নামে  সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম সড়কদ্বীপ ও সড়কের পাশে গাছ লাগানো। সৌন্দর্যবর্ধনে সাধারণত বিদেশি গাছ প্রাধান্য পায়। এ দেশের আবহাওয়ায় যা খাপ খেয়ে টিকে থাকতে সক্ষম কি না, তা যথাযথভাবে যাচাই করা হয় না। ফলে অনেক গাছই কিছুদিনের মধ্যে মারা যায়। উদাহরণসরূপ বলা যায়, এয়ারপোর্ট রোডের দুপাশে অনেক বিদেশি গাছ লাগানো হয়েছে। হাতিরঝিলে বিদেশি পামগাছ লাগানো হয়েছে। অথচ আমাদেরই রয়েছে অসংখ্য দেশীয় ফুল ও ফলের গাছ। কিন্তু ঢাকায় এসব গাছ লাগানোর ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা যায়। 

জলাধার সুরক্ষা ও সৃজন

সবুজায়নের পাশাপাশি জলাধার সুরক্ষা ও সৃজন তাপমাত্রারোধে অত্যন্ত সহায়ক। বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে নগর ঢাকার গোড়াপত্তন হয়। বেগুনবাড়ী, সেগুনবাগিচা, আরামবাগ, জিরানী, দোলাই, দেব ধোলাই, কল্যাণপুর, মহাখালী খালসহ অসংখ্য খাল শহরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ব্যবহৃত হতো নৌপথ হিসেবে। উত্তর-পশ্চিমে তুরাগ নদী দিয়ে মালবাহী নৌকা নগরীতে প্রবেশ করত। বেগুনবাড়ী ধোলাই খাল হয়ে তা বুড়িগঙ্গা দিয়ে বেরিয়ে যেত। নগরীর পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম ছিল খাল ও পার্শ্ববর্তী নদীগুলো। কালের আবর্তে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়। এর ফলে অপরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাল ও জলাশয়গুলো ভরাট হতে শুরু করে। ফলে অতিরিক্ত তাপ মোকাবিলায় জলাধার সুরক্ষা ও সৃজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

সবুজ আবাসন প্রকল্প

বৈষ্ণিক উষ্ণতায় উত্তাপ যখন চরমে, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশসমূহ স্থাপনার ক্ষেত্রে যে বিষয়টিতে একমত সেটি হলো ‘গ্রিন বিল্ডিং কনসেপ্ট’, তথা ‘সবুজ আবাসন প্রকল্প’। তবে গ্রিন বিল্ডিং কনসেপ্ট মানে নতুন স্থাপনা কিংবা যেকোনো স্থাপনায় গাছ লাগানো তা নয়। বরং স্থাপত্য ডিজাইন ও নির্মাণ উপকরণের মাধ্যমে যা তাপ সৃষ্টিতে বাধা  দেবে। স্থাপনার ব্যবহৃত উপকরণ যেন নির্মাণ এলাকা থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে। উপকরণগুলো দেশীয় প্রযুক্তি ও জলবায়ুর কথা বিবেচনা করে প্রস্তুত করা হয়েছে কি না। যেসব ‘ফিকশ্চার’ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো পরিবেশবান্ধব কি না খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া খেয়াল রাখতে হবে-

স্থাপনাকে তাপসহনীয় রাখতে থার্মাল ইনস্যুলেটর, ভ্যাকুয়াম বøক, ডাবল ব্রিক, টেনসাইল মেমব্রেন ইত্যাদি নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার 

চারপাশে খোলা জায়গা ছেড়ে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’ (এফএআর) বজায় রেখে ভবন নির্মাণ। খোলা জায়গা পাকা না করে উপযুক্ত প্রজাতির লাগানো

ভবনের পাশে সম্ভব হলে জলাশয় রাখা

স্থাপনায় তাপ উৎপন্ন করে এমন উপকরণ ব্যবহার না করাই ভালো, যেমন কাচ। কাচ ব্যবহারে খেয়াল রাখতে হবে যেন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি প্রকল্পের অভ্যন্তরে না প্রবেশ করে। সে ক্ষেত্রে সানশেড কিংবা লুভ্যার ব্যবহার করা যেতে পারে 

ভবনে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা রাখা

স্থাপনায় তাপরোধী হালকা রং ব্যবহার করা

ছাদে সবুজায়ন

অতিরিক্ত তাপমাত্রা রোধে গ্রিনরুফ বা সবুজ ছাদ কৌশলটিও বেশ কার্যকর। এই পদ্ধতিটি যেমন তাপের হাত থেকে বাঁচায়, তেমনি ফুল, ফল ও সবজিও পাওয়া যায়। ঢাকা শহরের প্রতিটা বাড়ি বা ভবনের ছাদের দুই-তিন ভাগ স্থানে যদি গাছ লাগানো যায়, তাহলে ঢাকার সবুজায়নের এ উদ্যোগ অনেকটাই এগিয়ে যাবে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের একদল গবেষকের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভবনের ছাদে সবুজায়নের মাধ্যমে কংক্রিট আচ্ছাদনের তাপমাত্রা প্রায় ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পরিবেশের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো যায়। ছাদে কিছুটা বড় আয়তনের সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমেও সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, তেমনি ভবনকে ঠান্ডা রাখা সম্ভব। 

কংক্রিট দেয়ালে সবুজের সমারোহ

ভবনের দেয়ালে যেন সবুজ উদ্ভিদ জš§াতে পারে, এ জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সবুজ কংক্রিট বা জৈব কংক্রিট ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় খুব সহজেই কংক্রিটে বিভিন্ন ফার্ন-জাতীয় উদ্ভিদ জš§াবে। এ ছাড়া ভবনের গাছে লতাবট, ফার্ন, মানিপ্লান্ট, হাসনাহেনা ইত্যাদি লতানো উদ্ভিদ রোপণ করে ভবনকে সবুজের আবরণে ঢেকে দেওয়া যায়। শুধু ভবনেই নয়, নগরের ফ্লাইওভার ও ওভারব্রিজের কলাম-বিমে এসব উদ্ভিদ লাগালে তা তাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি উৎপন্ন ক্ষতিকারক নানা গ্যাস শোষণ করে নেবে। এতে বৃদ্ধি পাবে শহরের সৌন্দর্যও। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের যত উদ্যোগ 

ইতিমধ্যে ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাব কমাতে আগামী দুই বছরে দুই লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সম্প্রতি ডিএনসিসি ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেসিলেন্ট ফাউন্ডেশনের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। এর আওতায় ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে ডিএনসিসি এবং ফাউন্ডেশনটি যৌথভাবে কাজ করবে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ডিএনসিসিতে ‘চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস, মিয়ামি, সিয়েরা লিওনের সান্টিয়াগো, গ্রিসের এথেন্স, চিলির সান্টিয়াগো ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে চিফ হিট অফিসার রয়েছে। 

এ ছাড়া তাপমাত্রা কমাতে ডিএনসিসি বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে মেটলাইফ ফাউন্ডেশনের অর্থায়ন ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শক্তি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সড়কে ও পেভমেন্টে তাপ-সহনশীল রঙের পেইন্টিং ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ইতিমধ্যে মিরপুরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা জল্লাদখানার সংস্কার করে সেখানকার ৭ হাজার বর্গফুট জায়গায় পেইন্টিং করা হয়েছে। পাশাপাশি সেখানকার উন্মুক্ত জায়গার পুরো অংশে সবুজায়ন করা হয়েছে। আর নতুন করে বসিলার লাউতলা খালের ৯৫ হাজার বর্গফুট জায়গার সবুজায়নের কাজ শুরু করেছে। 

নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ 

ঢাকাকে সবুজ করে তুলতে, বসবাসযোগ্য করতে ও হারানো প্রাকৃতিক গৌরব ফিরিয়ে আনতে নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ। এ জন্য সিটি করপোরেশন, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। স্থপতি ও প্রকৌশলীদের স্থাপনা নির্মাণে হতে হবে আরও দায়িত্ববান ও পরিবেশসচেতন। এ ছাড়া সড়কে সাইকেলের মতো অযান্ত্রিক যানের ব্যবহার ও রিনিউঅ্যাবল এনার্জির ব্যবহার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে হবে অত্যন্ত সহায়ক। 

তথ্যসূত্র:

স্থপতি সজল চৌধুরী

প্রকৌশলী এমদাদুল হক

দ্যকনভার্সন.কম

প্রকাশকা:ল বন্ধন ১৫৪ তম সংখ্যা, জুন ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top