জাহা হাদিদ দ্য কুইন অব কার্ভ

তাঁর প্রতিটি স্থাপনাই যেন একেকটি আর্ট, যা ক্রমাগত আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন নির্মাণ উপকরণ (স্টিল, কংক্রিট ও গøাস) ব্যবহারে। তাঁর অগ্রগামী দৃষ্টিভঙ্গি একুশ শতকের স্থাপত্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং বিশ্বজুড়ে সেসব কল্পনাকে ধারণ করেছে। গতানুগতিক আকারে নয় বরং তাঁর ডিজাইন করা নানা আকারের বা ডায়নামিক শেপের বিল্ডিং দেখে নিছক খেলা বলে ভুল হতেই পারে। তাই তো তাঁকে বলা হয় ‘কুইন অব কার্ভস’! জাহা হাদিদ। তিনি স্থাপত্যের এক বিস্ময়কর জাদুকর। তাঁর স্বতন্ত্র নকশা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। একজন ইরাকি-ব্রিটিশ স্থপতি, শিল্পী ও ডিজাইনার। বিশ শতকের শেষ থেকে একুশ শতকের অনেকখানি সময়জুড়ে স্থাপত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে পেয়েছেন অনন্য স্বীকৃতি। টুইস্ট, কার্ভ, লেয়ার হোক বা ডায়নামিক ডিজাইন- সবকিছুই যেন তাঁর চিন্তা আর বিচক্ষণতায় হয়ে উঠেছে আরও প্রাণবন্ত! কাজের ক্ষেত্রে যেমন হার মানিয়েছেন লিঙ্গবৈষম্যকে, তেমন চমক দেখিয়েছেন অভিকর্ষ নিয়েও। সৃষ্টিশীল এ স্থপতির আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন স্থপতি তাহিয়া তাবাসসুম

ইরাকের বাগদাদে একটি ধনী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে ১৯৫০ সালের ৩১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন হাদিদ। তাঁর বাবা মুহাম্মদ হুসেন হাদিদ ছিলেন মসুলের একজন শিল্পপতি। তিনি ছিলেন একাধারে ইরাকের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তী সময়ে দেশটির অর্থমন্ত্রী। মা ওয়াজিহা আল-সাবুঞ্জি ছিলেন একজন শিল্পী। তিনি বেড়ে ওঠেন এমন এক বাগদাদে, যা সাম্প্রতিক সময়ে কল্পনাতীত। সেখানে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই ছিল স্বাধীন-মুক্ত। পেয়েছেন এমন এক বাগদাদ, যেটি একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল লে কোরবুজিয়ের মতো আধুনিক স্থপতিদের হাত ধরে। হাদিদ তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন, শৈশবে দক্ষিণ ইরাকের প্রাচীন সুমেরীয় শহরগুলোর ভ্রমণ কীভাবে স্থাপত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মেছিল। ১৯৬০-এর দশকে হাদিদ ইংল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডের নানা বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেন। 

লেবাননের বৈরুতে অবস্থিত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে গণিতে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় এবং সেখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর স্থাপত্যের প্রতি আগ্রহ থেকে ১৯৭২ সালে আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার (অঅ)-এ পড়াশোনার জন্য লন্ডনে যান, যেটি ছিল সত্তরের দশকের প্রগতিশীল স্থাপত্য চিন্তার একটি অন্যতম কেন্দ্র। সেখানে ডাচ স্থপতি রেম কুলহাস এবং গ্রিক স্থপতি এলিয়া জেংহেলিসের অধীনে তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯৭৭ সালে স্থাপত্যে স্নাতক সম্পন্ন করার পর, হাদিদ তাঁর সাবেক অধ্যাপকদের  সঙ্গে রটারডামে একটি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক স্টুডিও অফিস অব মেট্রোপলিটন আর্কিটেকচার (ঙগঅ)-এ যোগদান করেন এবং খুব দ্রæতই কাজের পাশাপাশি সেই প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিও লাভ করেন। 

জাহা হাদিদ স্নাতক শেষ করার পর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার (অঅ)-এ শিক্ষকতা করেন। তাঁর পাশাপাশি হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, হামবুর্গের হোচশুলে ফার বিল্ডেনডে কুনস্টে, শিকাগোর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল, ভিয়েনার ইউনিভার্সিটির্সি অব অ্যাপ্লাইড আর্টসসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব পাওয়ার পরপরই ১৯৭৯ সালে হাদিদ লন্ডনে জাহা হাদিদ আর্কিটেক্টস প্রতিষ্ঠা করেন।

স্থপতিদের নানা রকম নতুন প্রকল্পের নকশার জন্য ডাকা হয়, আর তাঁদের কাজ সামাজিক অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে থাকে। জাহা হাদিদ নিয়মিত, অপ্রত্যাশিতভাবে ও দর্শনীয়ভাবে এই পরিধিতে নিজেকে মেলে ধরেছেন আর রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর সাফল্য এতই ধারাবাহিক ছিল যে তিনি বিশ্বজুড়ে নাগরিক, একাডেমিক এবং পেশাদার প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পেয়েছেন। অনুশীলনের ধারাবাহিকতায় তাঁর প্রতিষ্ঠান বিশ্বের অন্যতম উদ্ভাবনী স্থাপত্য স্টুডিও হিসেবে নিজেদের সুনাম প্রায় ৪০ বছর ধরে বজায় রেখে চলেছে।

বর্তমান স্থাপত্যশিল্পে আধুনিকতার নতুন এক ধারার সূত্রপাত হয় মূলত জাহা হাদিদের হাত ধরেই। সমকালীন স্থাপত্যকলার সঙ্গে আধুনিক ও উত্তর-আধুনিকতার সংমিশ্রণে তিনি জন্ম দেন নতুন এক শিল্পভাবনার, যাকে বলা হয় প্যারামিট্রিজম। জাহা হাদিদ ও তাঁর সহকর্মী প্যাট্রিক ছিলেন এর অগ্রদূত। হয়তো গণিতে পড়াশোনা করেছেন বলেই তাঁর নকশায় জ্যামিতির ব্যবহার দেখা যায়। স্থিতিমাপ নকশার ব্যবহার ও স্থিতিমাপ সমীকরণের সীমাবদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবন করেন এই প্যারামিট্রিজমের। শুরুতে হাতে-কলমে নকশা প্রণয়ন করলেও পরে বিশেষ ধরনের কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার করে এই শিল্পকে তিনি ও তাঁর টিম আরও সমৃদ্ধ করেন।

স্থাপত্যের শুরুর বছরগুলো তাঁর জন্য খুব একটা সহজ ছিল না। ১৯৮০ এবং নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে হাদিদের আইডিয়াকে অবাস্তব হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। শুরুর দিকের বছরগুলোতে তিনি বিভিন্ন ডিজাইন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং বিজয়ী হন। বিজয়ী হওয়া সত্তে¡ও বাস্তবতার বিবেচনায় তাঁর ডিজাইন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁদের দৃষ্টিতে এসব ডিজাইন ছিল অবাস্তব; অসম্ভব। এরপর থেকে তাঁর টিম প্রায় প্রতিটি ডিজাইন প্রতিযোগিতায় হারতে থাকেন ও নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। জুরিবোর্ড মনে করত হাদিদের করা নকশাগুলো দেখতে মনে হতো ¯্রফে একেকটা স্কেচ, যা সেই সময়ে নির্মাণের অযোগ্য। এই ধারা পুরো নব্বইয়ের দশকজুড়ে চলতে থাকে। তখন কাজের অভাবে অর্থকষ্টে পড়েন। তবে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর সহকর্মী প্যাট্রিক শুমাখারের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় সেই পরিস্থিতিতে নিজেদের মতো এগিয়ে যান।

১৯৮৮ সালে হাদিদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যখন নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট-এ ফিলিপ জনসন এবং মার্ক উইগলি দ্বারা কিউরেট করা লন্ডনে অনুষ্ঠিত তাঁর ‘ডিকনস্ট্রাকটিভিজম ইন আর্কিটেকচার’ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত সাতজন স্থপতির একজন হিসেবে তাঁর আঁকা ও চিত্রকর্ম প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়। স্থাপত্য জগতে এর মাধ্যমে হাদিদের নাম শুধু আন্তর্জাতিকভাবেই প্রকাশই পায়নি বরং স্থাপত্যশৈলীও প্রথমবারের মতো বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পায়। এভাবেই হাদিদের গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে বাড়ছিল। কারণ একজন ইরাকি-ব্রিটিশ নারী হিসেবে পুরুষশাসিত একটি ক্ষেত্রে নিজের জায়গা করে নেওয়া সে সময়ে খুব একটা সহজ ছিল না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর নিজস্বতা অবশেষে তাঁকে এই ক্ষেত্রের সেরাদের একজন হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।

রল্ফ ফেহলবাউম তাঁর প্রথম দিকের ক্লায়েন্টদের মধ্যে একজন, যিনি ছিলেন সুইস ফার্নিচার ফার্ম ভিট্রার প্রেসিডেন্ট-ডিরেক্টর জেনারেল এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ প্রিটজকার আর্কিটেকচার পুরস্কারের একজন জুরি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮১ সালে তাঁর কারখানায় বড় একটি অগ্নিকাÐের পর, সেখানে একটি নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৩ সালে তিনি হাদিদকে তাঁর এই কারখানার জন্য ছোট একটি ফায়ার স্টেশন ডিজাইন করার আমন্ত্রণ জানান। এটিই ছিল হাদিদের স্থাপত্য কর্মজীবনের সূচনা প্রকল্প।

এর পর থেকেই তিনি একের পর এক সব প্রজেক্টে কাজ করতে শুরু করেন। বিশ্বের প্রায় ৪৪টি দেশে প্রায় সাড়ে ৯ শতাধিক কাজ করেছে তাঁর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ভবন নির্মাণের পাশাপাশি তাঁর শৈল্পিক ভিন্নধর্মী জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার ভবনের অভ্যন্তরীণ সজ্জায়ও নান্দনিক পরিবর্তন এনেছে। তিনি এসব নকশার ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ধরনের আসবাব, গৃহসজ্জাসামগ্রী, পেইন্টিংস, নানা প্রকার গয়না ও জুতার নকশায়। সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের এই সামগ্রী তাঁকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তাঁর মৌলিক কাজসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হলো-

  • ভিত্রা ফায়ার স্টেশন (১৯৯১-১৯৯৩) 
  • স্পিটেলাউ ভায়াডাক্টস হাউজিং প্রজেক্ট (১৯৯৪-২০০৫)
  • কন্টেম্পরারি আর্ট সেন্টার, সিনসিন্নাটি (১৯৯৭-২০০৩)
  • ফেনো সায়েন্স সেন্টার (২০০০-২০০৫)
  • অরড্রুপগার্ড মিউজিয়াম (বর্ধন) (২০০১-২০০৫)
  • বিএমডবিøও প্রশাসনিক ভবন (২০০১-২০০৫)
  • জারাগোজা ব্রিজ প্যাভিলিয়ন (২০০৫-২০০৮)
  • শেখ জায়েদ ব্রিজ (১৯৯৭-২০১০)
  • ২১ শতকের জাতীয় শিল্প জাদুঘর (গঅঢঢও), রোম, ইতালি (১৯৯৮-২০১০)
  • গুয়াংজু অপেরা হাউস (২০০৩-২০১০)
  • রিভারসাইড মিউজিয়াম, গøাসকো, স্কটল্যান্ড (২০০৪-২০১১)
  • লন্ডন অলিম্পিকস অ্যাকুয়াটিকস সেন্টার (২০০৫-২০১১)
  • ব্রড আর্ট মিউজিয়াম, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ল্যান্সিং, মিশিগান, ইউএস (২০০৭-২০১২)
  • গ্যালাক্সি সোহো, বেইজিং, চায়না (২০০৮-২০১২)
  • হায়দার আলিয়েভ সেন্টার, বাকু আজারবাইজান (২০০৭-২০১৩)
  • ডংডাইমুন ডিজাইন প্লাজা, সিউল, কোরিয়া (২০০৭-২০১৩)
  • লাইব্রেরি অ্যান্ড লার্নিং সেন্টার, ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস, অস্ট্রিয়া (২০০৮-২০১৩)
  • সার্পেন্টাইন স্যাকলার নর্থ গ্যালারি, কেনসিংটন গার্ডেনস, লন্ডন, ইউকে (২০০৯-২০১৩)
  • ইনোভেশন টাওয়ার, হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি (২০০৭-২০১৪)
  • ওয়াংজিং সোহো টাওয়ার, বেইজিং, চায়না (২০০৯-২০১৪)
  • নানিজিং ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ কালচারাল সেন্টার (২০১২-২০১৫)
  • ইজাম ফায়ারস ইনস্টিটিউট, এইউবি, বৈরুত (২০১৪)
  • পোর্ট অথরিটি, এন্টওয়ার্প, বেলজিয়াম (২০১৬)

হাদিদ তাঁর কাজের জন্য সমালোচিতও হয়েছেন একাধিকবার। তিনি কাজের ক্ষেত্রে নিজেকে একজন নারী স্থপতির চেয়ে শুধু স্থপতি হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। তাঁর চমৎকার ফর্মগুলো বাস্তবতার বিবেচনায় অসম্ভব হিসেবে ধরে নেওয়া হতো। তাঁর অনেক প্রকল্পের ব্যয় ও স্কেলকে প্রায়ই উপহাস করা হতো। অনির্মিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে হংকংয়ে পিক (১৯৮৩) এবং ওয়েলসের কার্ডিফে অপেরা হাউসের ডিজাইন (১৯৯৪)। কার্ডিফে তাঁর নকশা প্রতিযোগিতায় সেরা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরও ওয়েলস সরকার এই প্রকল্পের জন্য অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পরবর্তী সময়ে সেই প্রকল্পের জন্য অন্য স্থপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

এ ছাড়া টোকিওতে ২০২০ সালের অলিম্পিকের জন্য ডিজাইন করা লন্ডন অ্যাকোয়াটিকস সেন্টার নকশার পর সেখানকার স্থপতিদের বিক্ষোভের মুখে হাদিদ তাঁর নকশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। ২০১৪ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর বিতর্কের সূত্রপাত হয় ২০২২ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম আল ওয়াকরাহ বা আল জানুব-কে ঘিরে। সেখানকার নির্মাণ সাইটে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় প্রায় ১ হাজার বিদেশি কর্মী মারা যান। দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস-এর একজন স্থাপত্য সমালোচক এ পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলেন। হাদিদ এরপর সেই সমালোচক এবং প্রকাশনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। বিষয়টি পরে নানা আলোচনার পর নিষ্পত্তি হয় এবং এ খবর প্রকাশের জন্য তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। সেখান থেকে পাওয়া অর্থ তিনি শ্রম অধিকার রক্ষাকারী একটি দাতব্য সংস্থায় দান করেন।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তাঁর কর্মজীবন পূর্ণ মাত্রার গতি অর্জন করেছিল। পরবর্তী দুই দশকে হাদিদের কাজের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে এবং একজন স্থপতি অর্জন করতে পারেন এমন সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করেছেন। পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে স্থাপত্যের জন্য জাপান আর্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রিমিয়াম ইম্পেরিয়াল পুরস্কার (২০০৯) এবং জওইঅ-এর সর্বোচ্চ সম্মান। হাদিদ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এডিটোরিয়াল বোর্ড অব অ্যাডভাইজার (২০০৫-০৬)-এর সদস্য ছিলেন। ২০০৪ সালে হাদিদ প্রিটজকার আর্কিটেকচার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, যা ছিল স্থাপত্যে নারী হিসেবে প্রথম অর্জন। এই পুরস্কার কোনো স্থপতির জন্য সর্বোচ্চ সম্মান হিসেবে বিবেচিত হয় আর যাকে তুলনা করা হয় স্থাপত্যের নোবেল হিসেবে। ২০০৮ সালে তিনি ফোর্বস-এ প্রকাশিত ‘সবচেয়ে শক্তিশালী ১০০ নারী’ ও ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ‘বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি’, ২০১১ সালে নিউজউইক ম্যাগাজিনের ‘১৫০ নারী, যাঁরা বিশ্ব জয় করেছেন’-এর প্রকাশিত তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ২০১০ সালে রোমের ম্যাক্সি (গঅঢঢও) মিউজিয়ামের জন্য এবং ২০১১ সালে লন্ডনের ইভলিন গ্রেস একাডেমির জন্য ব্রিটেনের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্থাপত্য পুরস্কার স্টার্লিং পুরস্কারে পরপর দুইবার সম্মানিত হন। ২০১২ সালে স্থাপত্যে বিশেষ অবদানের জন্য জন্য ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের উচ্চপদস্থ মহলের আদেশে হাদিদকে ‘ডেম কমান্ডার’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ‘দ্য ডেম’ই প্রথম মহিলা যিনি স্বতন্ত্রভাবে সম্মানিত রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস থেকে ২০১৬ সালে মর্যাদাপূর্ণ রয়্যাল গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। মরণোত্তর পুরস্কারের মধ্যে ২০১৭ সালের পাওয়া ব্রিট অ্যাওয়ার্ডও রয়েছে। ২০১৭ সালে তাঁর প্রিটজার পুরস্কার জয়ের ১৩তম বার্ষিকীতে গুগল তাঁকে ডুডল দিয়ে সম্মান জানায়।

২০১৬ সালের ৩১ মার্চ হার্ট অ্যাটাকে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে গোটা স্থাপত্য পরিসরে নেমে আসে শোকের ছায়া। ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা এই শিল্পীর নকশা করা স্থাপনাগুলো ছিল ভবিষ্যতের এমন এক-একটি দলিল, যা প্রমাণ করে তাঁর যাপিত জীবনের সংগ্রামকে ছাপিয়ে প্রতি মুহূর্তে মুক্তচিন্তার গভীরতা আর পরিসরের বিশালতার একেকটি উদ্্যাপন। পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়া তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের মাঝে এই স্বপ্নদ্রষ্টা টিকে থাকবেন বহুকাল। যাঁকে বলাই যায় সময়ের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে থাকা আপসহীন এক কিংবদন্তি!

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top