ছাদে লিকেজ হলে…

আপনি হয়তো নান্দনিক একটি বাসায় থাকেন! কিন্তু বর্ষা এলেই অস্বস্তিতে ভোগেন। কারণ ভবনের কংক্রিট ছাদ থেকে চুইয়ে অবাঞ্ছিত পানি ভেতরে প্রবেশ করে। আর এই পানি ক্ষতিগ্রস্ত করছে পুরো ভবনকে। অথচ ভবনটি খুব যে পুরোনো তাও নয়; উন্নত মানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে মোটেও কার্পণ্য করেননি। তাহলে সমস্যা কোথায়? যদিও বিষয়টি উদ্বেগজনক। তবে জেনে রাখুন, এই ধরনের সমস্যায় আপনি একা নন। বিশেষ করে যাঁরা পুরোনো ভবনে বাস করেন। ভবনের কংক্রিটের ছাদ নির্মাণত্রæটি, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তাতে ফাটল বা ছিদ্র (লিকেজ) দেখা দিতে পারে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণে করণীয় সম্পর্কে জানাচ্ছেন- মঈন আহমেদ

লিকেজ ছাদ স্থাপনার জন্য হুমকি

একটি লিকেজ বা ফাটলযুক্ত ছাদ বিভিন্ন উপায়ে একটি স্থাপনার ক্ষতিসাধন করতে পারে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 

লিকেজ ছাদ প্রথমে সিলিংকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বৃষ্টির জমা পানি ছাদ থেকে সিলিং পর্যন্ত তার পথ তৈরি করে এবং সিলিং প্লাস্টার এবং পেইন্টকে প্রভাবিত করে। পানির সংস্পর্শে প্লাস্টার ফুলে যায় এবং পেইন্ট সিলিং থেকে খোসা ছাড়তে শুরু করে।

এই পানি সিলিংয়ে লাগানো সব বৈদ্যুতিক ফিক্সচারের ক্ষতি করতে পারে, যা হতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক। বৈদ্যুতিক তার পানির সংস্পর্শ পেলে ঘটতে পারে শর্টসার্কিটের মতো ঘটনা। আর এই শর্টসার্কিট অধিকাংশ অগ্নিকাÐের জন্য দায়ী।

ছাদ দিয়ে পানি চুইয়ে সহজে দেয়ালে প্রবেশ করতে পারে, যা ঘরকে করে তোলে স্যাঁতসেঁতে ও আর্দ্র। ক্রমাগত পানি প্রবেশের ফলে দেয়াল স্যাঁতসেঁতে হয়ে প্লাস্টারে ফাটল দেখা দিতে পারে;  এতে উঠে যায় রঙের আবরণ।

লিকেজ ছাদের কারণে স্থাপনা আর্দ্র হয়ে যাওয়ায় স্যাঁতসেঁতে হওয়ার পাশাপাশি দেয়ালে দেখা দেয় ফাঙ্গাস ও ছত্রাকের আক্রমণ। পুরো ভবনজুড়ে এটা দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে বাসিন্দাদের অ্যালার্জি, হাঁপানি এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

ছাদে যদি পানি দীর্ঘ মেয়াদে জমে থাকে, তাহলে তা সহজেই ছাদ থেকে দেয়ালের ভেতর দিয়ে বাড়ির ভিত্তিতে প্রবেশ করতে পারে। এতে ভবনের ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা মেরামত করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। 

লিকেজ ছাদ ভবনের কাঠামোগত স্থায়ী ক্ষতিসাধন করতে পারে।

ছাদে লিকেজ সৃষ্টি বা ফাটলের কারণ

ছাদে কেন লিকেজ হয় তা বোঝার আগে জানা প্রয়োজন কংক্রিটের ছাদগুলো কী কী নির্মাণ উপকরণে তৈরি। কংক্রিটের ছাদ পাথর/খোয়া, বালু, সিমেন্ট এবং পানি দিয়ে নির্মিত হয়। এই উপকরণগুলো একত্রে মিলিত হয়ে একটি যৌগ (কংক্রিট) তৈরি করে। আর কংক্রিট ভারী উপাদান হওয়ায় তা ধরে রাখতে ব্যবহৃত হয় রড। ছাদ নির্মাণে প্রস্তুতকৃত কংক্রিটের জন্য প্রতিটি উপকরণের মিশ্রণের অনুপাত সঠিক হওয়া জরুরি। তা ছাড়া ছাদ নির্মাণের আগে উপযুক্ত শাটারিং ও নির্মাণের পর ২১-২৮ দিন পর্যন্ত কিউরিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর কোনোটার ব্যত্যয় ঘটলে ছাদে লিকেজ ও ফাটল দেখা দিতে পারে। 

এ ছাড়া যেসব কারণে ছাদ লিকেজ হতে পারে সেগুলো হচ্ছেÑ 

ছাদে পানি নিষ্কাশনের জন্য সঠিক ঢাল না থাকলে

ছাদে দীর্ঘদিন পানি জমে থাকা

পানির ট্যাংক লিক থাকলে

পানির পাইপ লিক থাকলে 

ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের আক্রমণে ছাদে সব সময় স্যাঁতসেঁতে ভাব বিরাজ করলে

দীর্ঘদিন ময়লা জমে থাকলে

রক্ষণাবেক্ষণ না করলে

মেয়াদোত্তীর্ণ হলে

ছাদের সুরক্ষায় করণীয়

কংক্রিটের ছাদ অত্যন্ত টেকসই, সাশ্রয়ী, পানি ও আগুন প্রতিরোধী এবং সহজে পরিষ্কার করা যায়। তাই ছাদের দীর্ঘ স্থায়িত্বে প্রয়োজন শুধু সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত। ভবনের ছাদে যেন লিকেজ সংঘটিত না হয়, সে ব্যাপারে নি¤œলিখিত বিষয়গুলোকে আপনি অনুসরণ করতে পারেন- 

ছাদে যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন থাকা 

নিয়মিত ছাদ পরিষ্কার করা 

নিয়মিত ছাদ পরিদর্শন এবং কোনো ক্ষতিকর দিক চোখে পড়লে তা দ্রæত মেরামত করা

ছাদে ওয়াটারপ্রুফিং কেমিক্যাল প্রয়োগ

চুন, সুরকি ও ইটের খোয়ার মিশ্রণ ব্যবহার করে প্রথাগত রুফ সারফেস ট্রিটমেন্ট করা

রুফ সারফেস ট্রিটমেন্ট 

রুফ বা ছাদের ওপরে পড়া বৃষ্টির পানি দ্রæত নিষ্কাশন এবং রোদের তাপ নিরোধক হিসেবে বিভিন্নভাবে সারফেস ট্রিটমেন্ট করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি স্থাপনার স্থায়িত্ব ও ব্যবহার উপযোগিতা বাড়ায়। সাধারণত স্ট্রাকচারাল ডিজাইন অনুযায়ী নির্মিত আরসিসি ছাদের ওপর ৩ ইঞ্চি (গড় মাপ) পুরু লাইম কংক্রিট (চুন, সুরকি ও ইটের খোয়ার মিশ্রণ) সংক্ষেপে এলসি ব্যবহার করা হতো। তবে বর্তমানে এলসির পরিবর্তে নতুন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন- সর্বশেষ ছাদটি করার সময় তাপ নিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য হলো বøক বসিয়ে আরসিসি ঢালাই করা এবং বৃষ্টির পানি দ্রæত নিষ্কাশনের জন্য তার ওপর ১ দশমিক ৫ ইঞ্চি পুরু স্ক্রিডিং ঢালাই দিয়ে নিট-সিমেন্ট ফিনিশিং করা। এ ছাড়া এসব ফিনিশিংয়ের ওপরের পৃষ্ঠে রুফিং কম্পাউন্ড নামে তাপ নিরোধক এক প্রকার রং ব্যবহার করা হয়। ছাদের ওপর এ ধরনের ট্রিটমেন্ট সঠিকভাবে করা না হলে রোদের উত্তাপের কারণে টপ ফ্লোরের বাসিন্দারা গরমের কষ্টে ভোগে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানিতে ছাদ তথা ভবনের স্থায়িত্ব কমে যায়।

যেভাবে ছাদের লিকেজ বা ফাটল মেরামত করবেন

নিচে আলোচিত এই সহজ পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে ছাদের লিকেজ বন্ধ করা যায় খুব সহজেই- 

কংক্রিটের ছাদ থেকে পানির লিকেজ বন্ধের প্রথম ধাপ উৎস খুঁজে বের করা। যদি লিকেজ ছোট হয় তবে পানির দাগ, কালো দাগ বা ছত্রাক/ফাঙ্গাস আক্রান্ত স্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করুন। সাধারণত লিকেজ ছাদের ওপরে ও পানি জমা স্থানেই হয়ে থাকে। এ ছাড়া পানির ট্যাংক ও ড্রেনেজ পাইপের চারপাশটা ভালোভাবে অনুসন্ধান করুন।

এরপর নির্ধারিত স্থান থেকে ধুলা, কাদা, ডালপালা, পাতা, ছত্রাক/ফাঙ্গাস প্রভৃতি অপসারণ করুন। কাজটি নিখুঁতভাবে  করতে একটি প্রেসার ওয়াশার ব্যবহার করতে পারেন।

মেরামতের আগে নিশ্চিত করুন লিকেজ পৃষ্ঠটি পরিষ্কার ও শুষ্ক।

এরপর ফাটল, গর্ত, কোণ এবং অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় মর্টার (ইটের খোয়া/নুড়ি পাথর, বালু, সিমেন্ট ও পানির মিশ্রণ) প্রয়োগ করুন।

অথবা সেখানে প্রাইমার প্রয়োগ করুন ও সম্পূর্ণরূপে শুকানোর জন্য অপেক্ষা করুন। এ ছাড়া ইলাস্টোমেরিক সিল্যান্টও প্রয়োগ করতে পারেন। সিল্যান্টকে শক্তিশালী করতে পরের দিন দ্বিতীয়বার কোট প্রয়োগ করুন।

সর্বশেষ ধাপে ওয়াটারপ্রæফিং সলিউশনের প্রথম কোট প্রয়োগ করুন। প্রতিটি কোটের মধ্যে আদর্শ সময়ের ব্যবধানের জন্য পণ্য প্যাকেজিংয়ে দেওয়া নির্দেশনাবলি অনুসরণ করুন। ওয়াটারপ্রুফিং দ্রবণগুলো ছত্রাক, ফাঙ্গাস, সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধী। এই উপকরণ রেডিমেট অবস্থায় বাজারে কিনতে পাওয়া যায় এবং ব্যবহার করা সহজ বিধায় পেশাদার সাহায্য না নিলেও চলে। 

ওপরে আলোচিত পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করলে আপনি নিজেই ছাদ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করতে পারবেন। তবে যদি ঝামেলাপূর্ণ মনে হয় বা নিখুঁতভাবে কাজটি করতে চান, তাহলে একজন অভিজ্ঞ পেশাদার পুরকৌশলীর সাহায্য নিতে পারেন। এ ছাড়া অনেক প্রকৌশল ফার্ম রয়েছে, যারা এ ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠান থেকেও কাজটি করাতে পারেন খুব সহজেই। মনে রাখবেন, সঠিক এবং নিয়মিত ছাদ রক্ষণাবেক্ষণ আপনার সম্পত্তির দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে অত্যন্ত সহায়ক।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top