ক্লিয়ার কভার অব কংক্রিট ও কংক্রিটিং

কংক্রিট, স্থায়ী ও মজবুত কাঠামো বা অবকাঠামো নির্মাণে বহুল প্রচলিত একটি নির্মাণসামগ্রী। কাজের ধরন ও গুরুত্ব¡ অনুসারে কংক্রিট ও কংক্রিটিংয়ের নানা প্রকারভেদ রয়েছে। আগে ছোট-বড় সব ধরনের কাজেই ম্যানুয়াল মিক্সার মেশিন কিংবা পুরোপুরি ম্যানুয়াল পদ্ধতি অর্থাৎ হাতে মিশিয়ে কংক্রিট তৈরি করা হতো। এই কংক্রিট মেশানো, ঢালা ও ফিনিশিং দেওয়া কাজের ব্যাপারে ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে। এ সংখ্যায় কংক্রিট ও কংক্রিটিংয়ের কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘ক্লিয়ার কভার’ সম্পর্কে থাকছে বিস্তারিত। 

বর্তমানে আমাদের দেশে কংক্রিট মেশানো এবং ঢালাইকাজের পদ্ধতি অনেক উন্নতি হয়েছে। নিতান্তই ছোটখাটো কাজ ছাড়া কোনো কংক্রিটই এখন আর ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে মেশানো হয় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেকোনো কাঠামো নির্মাণের কাজে মজবুত ও স্থায়িত্বতা বিবেচনায় স্টিল বা রডের পরই কংক্রিটের স্থান। তাই সাধারণ কংক্রিটের সঙ্গে রড যোগ করে শক্ত ও মজবুত কংক্রিট তৈরি করা হয়ে থাকে, যাকে রিইফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট সংক্ষেপে ‘আরসিসি’ বলা হয়। এই ‘আরসিসি’র বিস্তারিত ব্যাখ্যাও আগে দেওয়া হয়েছে। তবুও এ সম্পর্কে নতুন করে কিছু ধারণা দেওয়া হলো।

ইট, বালু ও খোয়ার সংমিশ্রণে বিভিন্নভাবে কংক্রিট তৈরি করা হয়ে থাকে। এই কংক্রিট সাধারণত দুই ধরনের হয়- 

প্লেইন সিমেন্ট কংক্রিট বা ‘পিসিসি’ এবং

রিইফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট বা ‘আরসিসি’

‘পিসিসি’ সাধারণত শুধু ইট, বালি ও খোয়ার সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়, যা কম গুরুত্বপূর্ণ এবং উলম্বিক চাপ (ঈড়সঢ়ৎবংংরড়হ) বহন করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘পিসিসি’র সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্টিল অর্থাৎ রড যোগ করে উলম্বিক চাপ ও পার্শ্ব টান (ঞবহংরড়হ) দুটোই বহন করার উপযোগী করে আরসিসি তৈরি করা হয়। কাঠামোর ধরন এবং বিভিন্ন মেম্বারের সাইজ ও গুরুত্ব অনুসারে বিশদ বিশ্লেষণ করে আরসিসি ডিজাইন করা হয়।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, একটি শক্ত, মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো নির্মাণে ‘আরসিসি’ ঢালাইকাজের গুণগত মান রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। তাই, যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ করার ক্ষেত্রে কাঠামোগতভাবে বিভিন্ন মেম্বারের জন্য বিভিন্ন ধরনের চাপ ও টান বহন ক্ষমতাসম্পন্ন কংক্রিট ডিজাইন করে তদনুসারে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়। ফলে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃতব্য স্টিল বা রডের পরিমাণের তারতম্য হয়ে থাকে; তারতম্য হয় ব্যবহারেও। একটি স্থাপনা বা কাঠামোর প্রতিটি ‘আরসিসি’ মেম্বার ঢালাই করার জন্য এর ডিজাইন ও সাইজ অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে বক্স বা ফর্মা তৈরি করা হয় এবং সেই বক্সের ভেতর প্রয়োজনীয় রড বসানোর পর কংক্রিট ঢালাই করা হয়। 

এই বক্স বা ফর্মার ভেতর রড বসানোর সময় কংক্রিট ডিজাইন বিশ্লেষণে বিবেচনায় নেওয়া নিয়মানুযায়ী রডের চারদিকে কংক্রিটের পুরুত্বের ন্যূনতম একটি মাপ নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে, যাকে ‘ক্লিয়ার কভার’ বলা হয়। এই ক্লিয়ার কভার নির্মিতব্য একটি কাঠামোর বিভিন্ন মেম্বারের জন্য বিভিন্ন পরিমাপের হয়ে থাকে। যেমন-

সাধারণত মাটির নিচের মেম্বারের জন্য ৩ ইঞ্চি

গ্রেড বিম যদি মাটির নিচে হয় সে ক্ষেত্রে ২ ইঞ্চি নচেৎ ১.৫ ইঞ্চি

কলাম ও রুফ বিমের জন্য ১.৫ ইঞ্চি এবং

ছাদের জন্য ০.৭৫ ইঞ্চি ইত্যাদি।

এভাবে প্রতিটি মেম্বারের জন্য আলাদা আলাদাভাবে এই ‘ক্লিয়ার কভার’ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং এটা যথাযথভাবে মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রয়োজন অনুযায়ী কংক্রিট ডিজাইন করার পর ডিজাইনকৃত কংক্রিটের গুণগত মান নিশ্চিতে প্রকৃত কাজ বাস্তবায়নে কালে সব নিয়মনীতি মেনে চলা অত্যাবশ্যক। মনে রাখা দরকার, প্রতিটি কাঠামো নির্মাণে কংক্রিটের ডিজাইন ক্যালকুলেশন এবং তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করার বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রণীত নির্দিষ্ট কিছু ‘কোড’ বা বিধিনিষেধ আছে। তদ্রƒপ, কংক্রিট তৈরি করা, ঢালাই করা, ক্লিয়ার কভার এবং ফিনিশিং দেওয়ার ক্ষেত্রেও একইভাবে কিছু নিয়মনীতি বা বিধিনিষেধ আছে। ফলে, কংক্রিট ডিজাইন ও প্রস্তুত করার প্রতিটি ক্ষেত্রে এসব ‘নিয়মনীতি’ বা বিধিনিষেধ মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। 

কংক্রিটের দীর্ঘস্থায়িত্বতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃতব্য রডের নানা গুণাগুণ বিশ্লেষণের সময় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘করোশন’ বা ক্ষয়জনিত একটি সমস্যা তুলে ধরে এর কারণ সম্পর্কে নানা আলোচনা হয়। তন্মধ্যে রড তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচা মালামালের গুণাগুণ, এসব মালামালের কেমিক্যাল কম্পোজিশন, প্রস্তুত প্রণালি, রডের রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি ইত্যাদি। যা রড কেনা এবং ব্যবহারপূর্ব সতর্কতা হিসেবে কাজ করে থাকে। কিন্তু কংক্রিট তৈরিতে রড ব্যবহার পরবর্তী সময়ে ‘করোশন’ হওয়ার জন্য কংক্রিটের ক্লিয়ার কভারের যে বিশেষ একটা ভূমিকা আছে, সে আলোচনা খুব কমই শোনা যায়। এ বিষয়টি একটু স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতেই আজকের প্রয়াস। 

আমাদের আশপাশে বিদ্যমান কংক্রিট স্ট্রাকচারের বিভিন্ন মেম্বারে ফাটল দেখে থাকি, কিন্তু এর কারণ বিশ্লেষণ করে কী দেখি? প্রসঙ্গত, কংক্রিট সারফেসে নানা কারণে ফাটল দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে কংক্রিটের ক্লিয়ার কভার একটি অন্যতম কারণ। আমি দেখেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কংক্রিটের ক্লিয়ার কভার সমানভাবে মেইনটেইন করা হয় না। যেমন: একটি কলামের চতুর্দিকে ১.৫ ইঞ্চি ক্লিয়ার কভার থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে প্রায়ই একদিকে ১ ইঞ্চি আর একদিকে ২ ইঞ্চি বা তারও অধিক দেখা যায়, যা আদৌ সমীচীন নয়। মনে রাখা দরকার, কংক্রিটের পার্শ্ব চাপ বা টান বহনক্ষমতা বৃদ্ধি করাই রডের প্রধান কাজ। আর এই পার্শ্ব চাপ বহনক্ষমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কংক্রিটের ক্লিয়ার কভার সঠিকভাবে মেনে চলা অত্যাবশকীয় একটি বিষয়। কারণ, রডের ওপর যখন অতিরিক্ত পার্শ্ব চাপ পড়ে তখন রড বাঁকা হয়ে ক্লিয়ার কভারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। 

ফলে, কংক্রিটের ‘ক্লিয়ার কভার’ পর্যাপ্ত পরিমাণের চেয়ে কম হলে পার্শ্ব চাপে রড বাঁকা হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সেই কারণে কংক্রিটে ফাটল দেখা দেয়। আর এই ফাটল দিয়ে বাতাস থেকে কিংবা বৃষ্টি থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে কংক্রিট আর্দ্র হয়ে যায় এবং রডের ‘করোশন’ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। সময়ের ব্যবধানে ক্রমেই এই করোশনের পরিমাণ বাড়ে এবং কংক্রিট আস্তে আস্তে তার গুণগত মান হারিয়ে রড থেকে ডিবন্ডেড হয়ে ঝরে পড়তে থাকে। যা ¯øাব, বিম ও কলাম প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। ফলে কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে, এর স্থায়িত্বতা লোপ পায় এবং একসময় কাঠামোটি ধসে পড়ার উপক্রম হয়। কংক্রিটের গুণগত মান রক্ষায় আমরা নানা ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেও ক্লিয়ার কভার সঠিকভাবে মেইনটেইন করার ব্যাপারে এত সচেতন নই। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেওয়াার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা একান্ত কাম্য।

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ

এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (সার্ভিসেস)

অ্যাডভান্সড ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিস লি.

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top