কোপেশ্বর মন্দির ইতিহাস আর স্থাপত্যকথন

ভারতীয় উপমহাদেশ প্রাচীনকাল থেকেই স্থাপত্য, শিল্পকলা, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এই উপমহাদেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতা আর সংস্কৃতির চিহ্ন, যার পরতে পরতে রয়েছে রোমাঞ্চকর পৌরাণিক গল্পগাঁথা; স্থাপত্য আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের মেলবন্ধন! আজ আমরা জানব ভারতের মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর জেলার খিদ্রাপুর গ্রামের কোপেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস আর তার স্থাপত্যকথন। কৃষ্ণা নদীর তীরে অবস্থিত এই স্থাপনাটি স্বর্গমন্দির নামেও পরিচিত। মন্দির স্থাপনাটির আদ্যোপান্ত তুলে ধরছেন স্থপতি তাহিয়া তাবাসসুম

কোপেশ্বর মূলত একটি শিবমন্দির আর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জনপ্রিয় তীর্থস্থান। প্রতিবছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এ স্থানে ভ্রমণ করে থাকেন। প্রতিবছরের কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে গর্ভগৃহের ঠিক মাঝ বরাবর চাঁদ অবস্থান করে, যা মন্দিরটির বিশেষ আকর্ষণ। স্থাপত্যের সঙ্গে  জ্যোতির্বিদ্যার এই অনন্য মেলবন্ধন যে কাউকে অবাক করবে। এটি কেবল সে সময়কার গ্রহ-নক্ষত্রের গণনাই নয়, তখনকার সভ্যতা, ইতিহাস আর ঐতিহাসিক স্থাপত্যেরও এক বিস্ময়কর উদাহরণ! ভারতে গেলে এ মন্দিরটি ঘুরে আসতে পারেন।

প্রাচীন কিংবদন্তি

পুরাণ অনুযায়ী, দক্ষ নামের এক রাজার ছোট কন্যা সতী ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। সতীর অনুরাগ আর একনিষ্ঠতায় শিব মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু এ বিয়েতে রাজা দক্ষের মত ছিল না। পরবর্তী সময়ে তাঁদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন আর এতে শিব আর সতী ছাড়া সবাইকে নিমন্ত্রণ করেন। যজ্ঞের দিন সতী শিবের নন্দীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাবার মুখোমুখি হলে উপস্থিত অতিথিদের সামনে দক্ষ তাকে তিরস্কার করেন। শিবকে নিয়ে এমন অপমান স্ত্রী হিসেবে তিনি সহ্য করতে না পেরে অভিমানে যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহূতি দেন। এ ঘটনা শিবের কানে পৌঁছালে তিনি সেখানে উপস্থিত হন। প্রিয়তমার বিচ্ছেদে ব্যথিত ও রাগান্বিত শিব শাস্তিস্বরূপ দক্ষের মাথা শরীর থেকে আলাদা করেন। এরপর দেবতা বিষ্ণু শিবকে শান্ত করার জন্য এই স্থানে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে সেই স্থানে মন্দিরটি স্থাপিত হয় আর নাম দেওয়া হয় কোপেশ্বর মন্দির। বাংলায় যার অর্থ ‘ক্রোধিত দেবতার মন্দির’।

ইতিহাস

দ্বাদশ শতকে কোপেশ্বর মন্দিরের এক সমৃদ্ধ এবং আকর্ষণীয় ইতিহাস রয়েছে। মন্দিরটি শিলাহার রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত বলে মনে করা হয়, যাঁরা সেই সময়ে এই অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। শিলাহাররা শিল্প ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং এই মন্দির ছাড়াও আরও বেশ কিছু মন্দির এবং অন্যান্য স্থাপত্য নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, শহরের প্রাচীন নাম ‘কোপ্পাম’ থেকে মন্দিরের এমন নামের উৎপত্তি হতে পারে। কোপ্পাম শহর দুটি বড় যুদ্ধের সাক্ষী ছিল। এর মধ্যে প্রথমটি ১০৫৮ খ্রিষ্টাব্দে চালুক্য রাজা অহবমল্লা এবং চোল রাজা রাজেন্দ্রের মধ্যে সংঘটিত হয়। চোল রাজা রাজাধিরাজা যুদ্ধের সময় নিহত হন এবং দ্বিতীয় রাজা রাজেন্দ্র চোলের রাজ্যাভিষেক এই যুদ্ধক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় যুদ্ধটি শিলাহার রাজা ভোজ-২ এবং দেবগিরির যাদব রাজা সিংহান-২-এর মধ্যে সংঘটিত হয়, যে সময়ে রাজা ভোজ-২ যাদবদের দ্বারা বন্দী হন এবং পানহালার দুর্গে তাঁকে বন্দী রাখা হয়। ঘটনাটি ১২১৩ সালে মন্দিরের দক্ষিণ প্রবেশদ্বারের কাছে শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ করা আছে। এই যুদ্ধের ফলে শিলাহার শাসকদের কোলহাপুর অঞ্চলের শাসনের অবসান ঘটে।

মন্দিরের ভেতর ও বাইরের দিকে প্রায় এক ডজন শিলালিপি রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র কয়েকটি অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। এই শিলালিপিগুলোতে সে সময়কার রাজা ও তাঁদের সভাসদবর্গের নাম খোদাই করা রয়েছে। একটি ছাড়া সব শিলালিপি কন্নড় ভাষা ও তাঁদের নিজস্ব লিপিতে খোদাইকৃত। সংস্কৃত ভাষায় একমাত্র দেবনাগরী শিলালিপিটি সিংহান-২-এর সময়কার এবং এটি মন্দিরের দক্ষিণ প্রবেশদ্বারের বাইরের দেয়ালে স্থাপিত। অন্য এক ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, মন্দিরটি কাপার্দিন নামে এক ধনী বণিক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, যিনি শিবের ভক্ত ছিলেন। মন্দিরটির নামকরণ করা হয়েছিল তাঁর নামে এবং এর থেকেই কোপেশ্বর নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়।

স্থাপত্য

স্থাপত্যের হোক বা শিল্পশাস্ত্র অনুসারে, এটি সম্ভবত মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী মন্দির। মন্দিরটির ইতিহাস, পুরাণের ঘটনাপ্রবাহ আর স্থাপত্য সব মিলে এটি এতটাই সমৃদ্ধ, যাতে রয়েছে বহু শতাব্দী প্রাচীন খোদাই করা পাথর, পাথরের তৈরি স্থাপত্য- সব মিলে যেন ব্যাখ্যাতীত এক ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক। পুরো মন্দিরের ভেতরে মোট ১০৮টি স্তম্ভ রয়েছে। এটি হেমাদপন্থী স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত, যা ছিল এই অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ শৈলীতে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন কালো বেসাল্ট পাথর ব্যবহৃত হয় এবং এরূপ জটিল খোদাই করা শিল্পকর্মই হেমাদপন্থী শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

কোপেশ্বর মন্দিরের স্থাপত্য কেবল একটি জটিল কাঠামোই নয় বরং এর গায়ে খোদাই করা রয়েছে প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনির গল্পগাঁথা। মন্দিরটি এমন একটি বিশাল বইয়ের মতো, যার যেদিকেই তাকানো হয় সেদিকেই খুঁজে পাওয়া যায় একেকটি গল্প। এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন এটি চাঁদ ও সূর্যের পাশাপাশি পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ছাড়াও ঈশান, অগ্নি, নৈঋত ও বায়ু, ঊর্ধ্ব আর অধোঃ নামক আটটি দিকের মিলিত সমন্বয়!

কোপেশ্বর মন্দিরটি মূলত চারটি ভাগে বিভক্ত

স্বর্গমÐপ

সভামÐপ

অন্তরাল কক্ষ এবং

গর্ভগৃহ

স্বর্গমÐপ

স্বর্গমÐপ মন্দিরের বাইরের অংশ, যা সবচেয়ে সুন্দর ও অনন্য বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ। মন্দিরের ছাদে একটি বড় গোলাকার জানালা আকাশের দিকে উন্মুত্ত। মাঝখানের বেদি থেকে আকাশের দিকে তাকালে স্বর্গীয় অনুভূতির জন্য একে স্বর্গমÐপ বলা হয়। গোলাকার দেয়ালের চারপাশে দেবতা গণেশ, কার্তিক, কুবের, যমরাজ, ইন্দ্র ইত্যাদি যথাক্রমে তাঁদের বাহন ময়ূর, ইঁদুর, হাতি প্রভৃতি বাহক প্রাণীর সঙ্গে সুন্দরভাবে খোদাইকৃত রূপে দেয়ালে সজ্জিত রয়েছেন। বেদির কেন্দ্রে দাঁড়ালে স্বর্গমÐপের ভেতর থাকা সভামÐপের প্রবেশদ্বারের বাম দিকের দেয়ালে ব্রহ্মার মূর্তি দেখা যায়। কেন্দ্রের গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ স্থাপিত এবং ডান দিকের দেয়ালের দিকে সুন্দরভাবে খোদাই করা বিষ্ণু দেবতার দেখা মিলবে। একনজরে একই জায়গায় পাশাপাশি ত্রিদেবকে দেখা যায় অর্থাৎ ‘ব্রহ্মা-মহেশ-বিষ্ণু’। 

এই স্বর্গীয় ছাদের চারপাশে অর্থাৎ বড় বড় ৮টি মূর্তির ঠিক পেছনে, বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মূর্তি রয়েছে, যা হিন্দু পুরাণ থেকে অন্যান্য অসংখ্য দেবতাকে নির্দেশ করে। পুরো নকশা দেখে মনে হবে যেন দেবতারা আকাশ থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছেন! মÐপে মোট ৪৮টি স্তম্ভ রয়েছে এবং এদের মধ্যে শুধু বৃত্তাকার ছাদটি ১২টি স্তম্ভের ওপর স্থাপিত, যা স্বর্গমÐপের কেন্দ্র হয়ে একটি বৃত্তের আকারে দাঁড়িয়ে আছে। এই স্তম্ভগুলো ১২টি রাশিচক্রের প্রতীক। প্রতিবছর ত্রিপুরারী পূর্ণিমায় (কার্তিক পূর্ণিমা) রাত ১২টা ৩ মিনিটে চাঁদ এই বৃত্তাকার ছাদের কেন্দ্রে অবস্থান করে! এই মন্দিরের স্থাপত্যের পেছনে কী মাপের অসাধারণ পরিকল্পনা ও চিন্তা ছিল তা সহজেই অনুমেয়। ত্রিপুরারী পূর্ণিমাকে দীপাবলিও বলা হয়, যা ভারতে এবং হিন্দু পুরাণে অন্যতম একটি প্রধান উৎসব। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালে মে মাসের ৪ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত সূর্যের আলো সরাসরি মন্দিরের ভেতরে থাকা শিবলিঙ্গের ওপর পড়ে!

মন্দিরের পূর্ব দিকে একটি পাথরের পাদদেশ বসানো সংস্কৃত ভাষার একমাত্র শিলালিপিটি দেবনাগরী লিপিতে লেখা। এটি প্রমাণ বহন করে যে ১১৩৬ সালে মন্দিরটি যাদব রাজবংশের রাজ সিংহদেব দ্বারা সংস্কার করা হয়েছিল।

সভামÐপ

স্বর্গ মন্দিরের পাশের কক্ষটি হলো সভামÐপ আর এখানেই সর্বাধিক সংখ্যক স্তম্ভের দেখা মেলে। মন্দিরের এই অংশে মোট ৬০টি স্তম্ভ রয়েছে। এর মধ্যকার ৪টি স্তম্ভ কীর্তিমুখী, যার অর্থ এই স্তম্ভগুলো কীর্তিসুর নামক অসুরকে উৎসর্গকৃত। এখানকার একটি স্তম্ভের নিচের খোদাই করা গণেশের দেখা পাওয়া যায়। খোদাই কাজ এই সভামÐপ থেকে শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। বিশ্বাস করা হয়, মন্দির দর্শনের জন্য প্রথমেই স্তম্ভের মধ্যকার গণেশের আশীর্বাদ চাইতে হবে। এ ছাড়া বাকি স্তম্ভগুলোতে পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত এবং হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির অন্যান্য গল্প ও ঘটনাবলির অনুপ্রেরণায় খোদাইকৃত দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন দেব-দেবীও রয়েছেন। মন্দিরের এই অংশটি বেশ অন্ধকার, যা ধ্যান করার জন্য আদর্শ! তাই এই স্তম্ভগুলোর মধ্যে খোদাইকৃত প্রতীকগুলো দেখতে বেগ পেতে হতে পারে। মÐপে মাত্র ৬টি ছোট এবং জটিলভাবে খোদাই করা জানালা রয়েছে, আর সেগুলোই সভামÐপের একমাত্র আলোর উৎস!

অন্তরাল কক্ষ

মন্দিরটি তৈরির সময় অন্তরাল কক্ষের শুরুতে জয় ও বিজয়ের দুটি বিশাল মূর্তি ছিল। এখন শুধু বিজয়ের মূর্তিই রয়ে গেছে। আর এই কক্ষটিই সোজা মন্দিরের মূল অংশে নিয়ে যায়, যাকে গারভা বা অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহ বলা হয়।

গারভা বা অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহ

কোপেশ্বর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহের ভেতরের সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এর মধ্যে পাশাপাশি দুটি লিঙ্গ অবস্থান করছে। এর মধ্যে একটি লিঙ্গ শিবের এবং অন্যটি দেবতা বিষ্ণুর প্রতিনিধিত্ব করে! এটি ভারত এবং বিশ্বের একমাত্র মন্দির, যেখানে বিষ্ণুর লিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের পেছনের কারণ বুঝতে এই মন্দিরের তৈরির পেছনের কিংবদন্তি এবং গল্পগাঁথা জানা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত প্রতিটি শিবমন্দিরের বাইরের দিকে নন্দীকে স্থাপন করা হয়। কিন্তু এই একটি মাত্র ব্যতিক্রমী মন্দির, যার বাইরে একে স্থাপন করা হয়নি। উপরিউক্ত পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, সতী তাঁর বাবা প্রজাপতি দক্ষের বাড়িতে যাওয়ার সময় নন্দীকে সঙ্গে নিয়ে যায় বিধায় আর তা মন্দিরে দেখা যায় না। তবে কর্ণাটকের ইয়েদুর গ্রামে কৃষ্ণা নদীর পাড়ে আলাদা করে একটি নন্দী মন্দির রয়েছে। এর অবস্থান কোপেশ্বর মন্দির থেকে ১০ দূরে, যা সড়কপথ ধরে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই নন্দীকে কোপেশ্বর মন্দিরে শিবের অন্তর্গত বলে মনে করা হয়।

কোপেশ্বর মন্দিরের বাইরের অবস্থা

মন্দিরের বাইরের দেয়ালের গল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন, নিচে মাটির কাছাকাছি মন্দিরের চারপাশে হাতি খোদাই করা রয়েছে। একে বলা হয় গজপাট্টা বা এলিফ্যান্টস বেল্ট। মন্দিরের চারপাশে এমন ৯৬টি হাতি দেখা যায়। বাইরের দিকে খোদাইকৃত দেয়ালগুলোর প্রতিটিতে বেশ কিছু দেব-দেবী গভীর ধ্যানরত অবস্থায় রয়েছেন। গজপট্টের ওপরে পাথরে খোদাই করা আরও বেশ কিছু মূর্তি রয়েছে। এই খোদাইগুলো ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ক্ষয়ে যাওয়া ও ভাঙার কারণে ওপরের দিকের চিত্র বোঝা বেশ কঠিন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি কাঠামো হলো শিবের হরিহর রূপ। এখানে থাকা মূর্তিগুলো শিব এবং বিষ্ণু এ দুটি দেবতার সংমিশ্রণ। মূর্তিগুলো মাটির কাছাকাছি তবুও সহজে বোঝা কঠিন আর এর ভাস্কররা এটিকে এত নিখুঁতভাবে খোদাই করেছেন যে এই মূর্তিগুলোর অভিব্যক্তি বুঝতে খুব একটা কষ্ট হবে না। এর মধ্যে একটি শিবের রাগান্বিত চিত্রিত করে এবং অন্য চোখটি প্রেমের অভিব্যক্তি দেখায়, যা বিষ্ণুকে প্রতিনিধিত্ব করে!

কোপেশ্বর মন্দিরের বর্তমান পরিস্থিতি

কোপেশ্বর মন্দিরে, গজপট্টর (খোদাইকৃত হাতির সারি, যা শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতিনিধিত্ব করে) ৯৬টি হাতির মধ্যে মাত্র ৪টি অপরিবর্তিত, বাকিগুলো ক্ষয়ে বা ভেঙে গেছে। মন্দিরের অভ্যন্তরে, গর্ভগৃহের বেশ কয়েকটি মূর্তিও আগের অবস্থায় নেই। বেশির ভাগ ভাঙা অংশ অরক্ষিত অবস্থায় মন্দিরের চারপাশে পড়ে রয়েছে আর কিছু চুরি হয়েছে। 

মন্দিরটি কি অসমাপ্ত?

বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন মন্দিরটি অসমাপ্ত! মন্দিরের কাঠামোতে দাঁড়ালে এর শিখর বা সুপারস্ট্রাকচার এবং মন্দিরের বাকি অংশের নকশার মধ্যে একটি অবিচ্ছিন্ন জোড়া লক্ষ করা যায়। এ থেকে মনে করা হয় যে এর অংশবিশেষ সম্ভবত পরে যোগ করা হয়েছিল অসমাপ্ত মন্দিরটি সম্পূর্ণ করার জন্য।

কোপেশ্বর মন্দির সম্পর্কিত আরও কিছু তথ্য

এই মন্দির সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু দেবতাদের সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান রাখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদিও মন্দিরের আশপাশেই এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো গাইড রয়েছেন। তাঁরা এই মন্দিরের ইতিহাস থেকে শুরু করে স্থাপত্য, এর পেছনের মাইথোলজি নিয়ে বেশ ভালো ধারণা রাখেন। এই গাইডরা মূলত খিদ্রাপুর গ্রামের কৃষক, যারা বছরের পর বছর ধরে মন্দিরের আশপাশেই বসবাস করেন। আর এই মন্দিরের সঙ্গে তাঁদের আত্মার সম্পর্ক! মুখে মুখে প্রচলিত মন্দির সম্পর্কিত নানা গল্প, ইতিহাস এবং তথ্য থেকেই এ সম্পর্কে জানা যায়। তাঁরা বিশ্বাস করে মন্দিরটি মূলত পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে পাওয়া একটি অমূল্য উপহার। মন্দিরে এই উপকথাগুলো লোককাহিনির মতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসছে। তাই এখানে ঘুরতে একজন গাইডের সাহায্য নিতে পারেন। এখানকার গাইডরা মূলত মারাঠি, কন্নড় ও হিন্দিতে কথা বলতে পারেন। ইংরেজিতে বলতে পারা গাইড খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও দুষ্প্রাপ্য না।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, মন্দিরটি বেশ কিছু সংস্কার ও সংযোজন করা হয়েছে। মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে অনেক ছোট উপাসনালয় এবং কাঠামো পরবর্তী সময়ে যোগ করা হয়েছিল। এই পরিবর্তন সত্তে¡ও, মন্দিরের মূল স্থাপত্যশৈলী এবং নকশা সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং মন্দিরটি প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের একটি দুর্দান্ত উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে। কোপেশ্বর মন্দির এই উপমহাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি প্রমাণ।

প্রকাশকা:ল বন্ধন ১৫৪ তম সংখ্যা, জুন ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top