কংক্রিটিং

কিউরিং

স্থান-কাল-পাত্রভেদে কংক্রিট ও কংক্রিটিংয়ের প্রকারভেদ আছে, বিষয়টি বহুবার আলোচিত হয়েছে। অতএব, নির্মিতব্য প্রতিটি কাঠামোর গঠন ও প্রস্তাবিত ভারবহনক্ষমতা- সবকিছু বিশদভাবে বিশ্লেষণপূর্বক কংক্রিটের ডিজাইন ও ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এরপর ঢালাইকৃত কংক্রিট যথাযথভাবে কিউরিং করার ওপর নির্ভর করে নির্মিত কাঠামোর কাক্স্ক্ষিত শক্তি সঞ্চারের বিষয়টি। তাই ঢালাইয়ের কাজ সুসম্পন্ন্ করার পর নিয়মানুযায়ী কিউরিং করা অপরিহার্য। ফলে, একটি কংক্রিট স্ট্রাকচার নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন মেম্বার ঢালাই করার কত দিন পর শাটার খোলা যাবে, কত দিন পর্যন্ত কীভাবে কিউরিং করতে হবে, যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে নিয়ে তদ্নুযায়ী সব কাজ সুসম্পন্ন করা জরুরি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্মাণাধীন স্ট্রাকচারের যেকোনো মেম্বার ঢালাই করার পর তা সুষ্ঠুভাবে কিউরিং করা না হলে কংক্রিটের কাক্স্ক্ষিত শক্তি সঞ্চারে বিঘœ ঘটে ইমারতের স্থায়িত্বতা কমে যায়। ফলে, যতই দামি কাঁচা মালামাল ব্যবহার করা কিংবা ভালো মানের কর্মপদ্ধতিসহকারে কাজ সম্পন্ন করা হোক না কেন, পর্যাপ্ত কিউরিংয়ের অভাবে এই অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর তা কিছুতেই কাম্য নয়। তাই সব ক্ষেত্রে ঢালাই শেষ করার ১০ ঘণ্টা পর থেকে পরবর্তী ২৮ দিন পর্যন্ত পর্যাপ্ত কিউরিং নিশ্চিত করার বিষয়ে তীক্ষè নজরদারি রাখা দরকার। একটি স্ট্রাকচারের বিভিন্ন মেম্বার বিভিন্নভাবে কিউরিং করা যেতে পারে। কিউরিং প্রধানত তিনভাবে করা হয়ে থাকে। যেমন:

ওয়াটার কিউরিং

মেমব্রেন কিউরিং

স্টিম কিউরিং

ওয়াটার কিউরিং

ওয়াটার কিউরিং বিভিন্নভাবে করা হয়ে থাকে। যেমন- বড় ও সমতল জায়গার ক্ষেত্রে চারদিকে সিমেন্ট-বালু মিশ্রিত মর্টারের সাহায্যে বাঁধ দিয়ে ২৮ দিন পর্যন্ত পানি আটকে রাখা হয়। এটাই অধিকতর ফলপ্রসূ কিউরিং হিসেবে পরিগণিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢালাইকৃত কংক্রিটের ওপর সরাসরি পানি স্প্রে করেও কিউরিং করা হয়। এ ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান বেশি হলে কিউরিংয়ের যথার্থ ফল পাওয়া যায় না। এ ছাড়া, চট বা জিওটেক পেঁচিয়ে রেখে তার ওপর মাঝে মাঝে পানি স্প্রে করেও কিউরিং করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর হলেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় যে ঢালাইকৃত মেম্বারের গায়ে চট বা জিওটেক পেঁচানো আছে ঠিকই কিন্তু তা পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে, এমনটি মোটেই কাক্স্ক্ষিত নয়। গায়ে পেঁচানো চট বা জিওটেক যাতে সারাক্ষণ ভেজা থাকে, সে ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। 

মেমব্রেন কিউরিং

মনে রাখা দরকার, যেকোনো কংক্রিট তার নির্দিষ্ট শক্তি সঞ্চার করার ক্ষেত্রে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কংক্রিট মিক্সিং করা কিংবা কিউরিং করা উভয় ক্ষেত্রেই পানির ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কংক্রিট মেশানোর সময় ওয়াটার-সিমেন্ট রেশিও অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি ব্যবহার করা হলেও সময়ের ব্যবধান এবং আবহাওয়াজনিত কারণে তা দ্রæত বাষ্পীভূত হওয়ার ফলে কংক্রিটের কাক্স্ক্ষিত শক্তি সঞ্চারে বিঘœ ঘটে। যে কারণে কংক্রিট ঢালাইয়ের পর তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সঠিকভাবে কিউরিং করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ঢালাইকৃত কংক্রিটের ভেতরের পানি দ্রæত বাষ্পীভূত হওয়া বন্ধ করার জন্য কংক্রিটের ওপর এক প্রকার রাসায়নিক ব্যবহারে পাতলা প্রলেপ দেওয়া হয়, যাকে মেমব্রেন কিউরিং বলা হয়। মেমব্রেন কিউরিং পদ্ধতিতে রাসায়নিক প্রলেপ দেওয়া ছাড়াও পলিথিন বা পলিস্টারশিট দিয়েও কংক্রিট ঢেকে দেওয়া যেতে পারে। কংক্রিট ঢালাই করার পর যেসব ক্ষেত্রে পানি আটকে কিউরিং করা সম্ভব হয় না, সেসব ক্ষেত্রে মেমব্রেন কিউরিং বেশি উপযোগী। এই পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, তাই উন্নত দেশে যেখানে পানির স্বল্পতা আছে এবং খরচের ব্যাপারে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, সেসব দেশে এটি বহুল প্রচলিত। 

স্টিম কিউরিং

ঢালাইকৃত কংক্রিট দ্রæত জমাট বাঁধা এবং শক্তি সঞ্চার করার ক্ষেত্রে সাধারণত স্টিম কিউরিং করা হয়ে থাকে। উচ্চ চাপ ও তাপের মাধ্যমে পানিকে বষ্পে পরিণত করে এই কিউরিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই ক্ষেত্রে কংক্রিটিংয়ের কাজটি সচরাচর উন্মুক্ত স্থানে না করে আবদ্ধ জায়গায় করা হয়ে থাকে এবং প্রি-কাস্ট ইউনিটের বেলায় সেটি সম্ভব হয়। উন্নত দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রি-কাস্ট কংক্রিট ঢালাই করা হয়ে থাকে। ফলে, সেসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কিউরিং করা হলেও স্টিম কিউরিংই বেশি প্রাধান্য পায়। 

যা-ই হোক, কংক্রিট স্ট্রাকচারের শক্তি ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিকভাবে কিউরিং করার কাজটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কিউরিং করা তথা পদ্ধতিগত বিষয়ে আমাদের মাঝে বেশ শিথিলতা আছে, যা প্রশ্নাতীতভাবে পরিহার করার মতো একটি বিষয়। যেভাবেই করা হোক না কেন, কংক্রিট স্ট্রাকচারের প্রতিটি মেম্বারের ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত কিউরিং করার বিষয়টি সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার কোনো বিকল্প নেই। তাই, অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি নিশ্চিত করণার্থে ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করার আগেই সুষ্ঠুভাবে কিউরিং সম্পন্ন করার সব প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদন করা প্রয়োজন।

পুনশ্চ: আমাদের দেশের জন্য বড় ও সমতল জায়গার ক্ষেত্রে চারদিকে বালু-সিমেন্টের বাঁধ দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সার্বক্ষণিকভাবে পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা করাই উত্তম এবং ভার্টিক্যাল কিংবা যেখানে পানি আটকানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই চট বা জিওটেক পেঁচিয়ে তা সারাক্ষণ ভিজিয়ে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রসঙ্গত, স্ট্রাকচারের ভার্টিক্যাল মেম্বর অর্থাৎ কলাম কিউরিংয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত চট বা জিওটেক ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা সার্বক্ষণিক ভেজা থাকা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। মনে রাখা দরকার, কলাম ইমারতের সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি মেম্বার, যার গুণগত মানের ওপর পুরো ইমারতটির স্থায়িত্ব নির্ভর করে। পাশাপাশি অন্যান্য মেম্বারের ক্ষেত্রেও অত্র কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আদৌ কোনো অবহেলা করার সুযোগ নেই। 

একটি স্থায়ী ও মজবুত স্ট্রাকচার নির্মাণকল্পে অত্র কাজসমূহ সার্বক্ষণিক তদারকি নিশ্চিত করা, মালামাল ও কাজের গুণগত মান রক্ষা করা, দক্ষ লোকবল নিয়োগ দেওয়া, একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর দিকনির্দেশনা নেওয়া এবং তদ্নুযায়ী সব কাজ সুুৃষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। সুতরাং, যেকোনো একটি ইমারত নির্মাণ প্রকল্পে যে যার অবস্থান থেকে সবকিছু সঠিকভাবে বুঝে নিয়ে সব কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং সার্বিকভাবে সচেষ্ট ও সচেতন হওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ

এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (সার্ভিসেস)

অ্যাডভান্সড্ ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিস্ লি.

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top