ডেনমার্কের অন্যতম আকর্ষণ রাজধানী কোপেনহেগেনে অবস্থিত ডিম্বাকৃতির এক বাগান-শহর যা মূলত গ্রামীণ ভাবধারা থেকে অনুপ্রাণিত। শহরের মাঝখানে যেখানে জায়গা ও সবুজের অভাব তার মাঝে একটা গ্রামীণ পরিবেশবান্ধব আবাসন ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে সকলের দৃষ্টি কাড়বে। একে ঠিক আবাসন বললেও ভুল হবে। কারণ একটি বাগানকে সমভাবে বিভাজিত করে আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। এই কমিউনিটি গার্ডেনটি মূলত কোপেনহেগেনের নারিউম- এ অবস্থিত। সোরিন কার্ল থিওডর মারিউস সোরেনসেনকে বলা হয় সর্বকালের সেরা ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট। সেই ১৯৪৮ সালে তিনি ৪০টি ডিম্বাকৃতির বাগানকে সুসজ্জজিতভাবে বণ্টন করেন যার প্রতিটির আকার প্রায় ২৫/১৫ মিটার। সামনের দিকটা ছড়িয়ে আছে লম্বাটে সবুজ উঠান এবং অন্যপ্রান্তে আছে ডেনমার্কের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ ভাবধারার ঘরবাড়ি। বাড়ির মালিকদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে জমির কোন প্রান্তে তারা নির্মাণ করবেন এবং কোন প্রান্তে সবুজ রাখবেন। যদিও সোরেনসেন কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন যেটা বাড়িওয়ালারা গাইড হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন, তবে তা চাপিয়ে দেওয়া কোনো আইন নয়। আধুনিকতার এ যুগে এসেও এই ডিম্বাকৃতির বাগানবাড়ি প্রকৃতিপ্রেমি বসবাসকারীদের নিকট অপার বিষ্ময়! বিশ^বাসীর আর্কষণে এখনো দৃষ্টিনন্দন আছে এবং ড্যানিশের রাজধানীর অন্যতম এক দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। ইউনিক ওভাল কমিউনিটি গার্ডেন- এর কথকতা জানাচ্ছেন স্থপতি সুপ্রভা জুঁই
প্রথমে সোরেনসেন ঠিক করেছিলেন ডিম্বাকৃতি এই বাগানকে সাধারণ গ্রিড করে করে প্লট ভাগ করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটাকে আরেকটু খোলামেলা রাখেন এবং সজ্জাপদ্ধতির মাঝে দম নেওয়ার মতন পরিবেশ দান করেন। যদিও প্লটের মালিকেরা তাদের ইচ্ছেমতন ডিজাইন এখানে করার স্বাধীনতা পেয়েছেন তাও কোনো না কোনোভাবে এই আকৃতি সকল প্লটের মাঝে কিছু সিদ্ধান্ত এক রাখতে সার্থক হয়েছে। যেমন বুনো গাছপালা দিয়ে এক প্লট থেকে অন্য প্লটের মাঝে তারা বিভাজন পরিকল্পনা করেছেন। যেটা বাগানবাড়ি আবাসনের ধারণাকে দিয়েছে তার প্রাণ।
এই বাগান শহরটি ওপর থেকে দেখতে একরকম এবং রাস্তা থেকে দেখতে সম্পূর্ণ আরেকরকমের অভিজ্ঞতা হয়। বিশেষ করে এইখানে বেড়াতে গেলে মনেই হবেনা খুব ব্যস্ত শহরে এই আবাসনের আবির্ভাব। যেদিকেই দৃষ্টি যাবে সবুজের মাঝে চোখ আঁটকাবেই। যদিও প্রথম দেখায় মনে হবে, এখানে কোনো রাস্তাঘাট নেই। কেবল সবুজ মাঠ আর গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজের ঝোপ। এর পিছনেও সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। ড্যানিশ এই স্থপতি চেয়েছিলেন, এই প্রকল্পে যারা থাকবেন তারা যেন হেঁটে চলাচলকে জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাবতে সক্ষম হন। এর ফলে গাড়িতে ওঠা বা বাড়িতে ঢোকার আগে তারা যতটা সম্ভব মুক্ত বাতাসের সংস্পর্শ পাবেন। আবার প্রতিবেশীদের সাথে গল্প আড্ডার সময় সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলো এই বাইরের জায়গাগুলোকে তৈরি করে দেয়। মুক্ত বাতাস, প্রকৃতির সংস্পর্শ এবং শীত প্রধান দেশের আবহাওয়া বা গ্রীষ্মে সূর্যের তাপ সামাজিক সম্পর্ক রক্ষায় যে বিরাট ভূমিকা পালন করতে সক্ষম আজকালকার মনোবিদেরা সেকথা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। একটা ডিম্বাকৃতির বাগানে বেশি হাঁটার মধ্য দিয়ে এরকম দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এখানে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ডেনমার্ক শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে জমি-বণ্টন এবং নির্মাণের কাজ চলেছে। পুরো বিশ্বেই এখন কমিউনিটি বিশেষে ফুলের বাগান এবং শাক-সবজি ও ফলের বাগানের মাঝে আবাসনকে নিয়ে এসে পরিকল্পনা করছে কিন্তু সেই ১৬০০ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে এই ধারণাকে ডেনমার্ক নিজেদের করে নেওয়ার মাঝে একধরনের গর্ব অনুভব করে। কারণ সেসময় ডেনমার্কের ফ্রেডেরিসিয়ায় দুর্গের চারপাশের দেয়াল ঘেঁষে গাছ রোপণ করার চল ছিলো। প্লটগুলোকে বাগানে সাজানোর পর সোরেনসেন একটি সাত পাতার বুকলেট রচনা করেন যেখানে কিছু দিক-নির্দেশনা এবং পরামর্শ দেওয়া আছে কীভাবে মালিরা এখানে কাজ করবেন। অর্থাৎ এক ধরণের মেইটেন্যান্স ম্যানুয়াল তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। সেই আগেকালে এটি অত্যন্ত আধুনিক চিন্তা কারণ এখনো বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক প্রকল্প হলেও সেটি কীভাবে দিনের পর দিন চলবে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বাস্তবসম্মত রূপরেখা করা হয় না। এমনকি মূল প্রকল্পে গবেষণার কোনো স্থানও রাখা হয় না। যদিও প্রতিটা বাগানকে জ্যামিতিক আকারে ভাগ করে সজ্জিত করা হয়েছে যেন লম্বাটে কেকের ¯øাইস বা টুকরা যা প্রস্থে প্রায় ৫০ ফিটের সমান এবং দৈর্ঘ্যে ৮০ফিট যা, রেনেসাঁতে আবিষ্কৃত সবচেয়ে নান্দনিক সমীকরণ গোল্ডেন সেকশনকে এই সংখ্যা সজ্জায় শোভা পেতে দেখা যায়। প্রতিটি প্লটের মালিক কোথায় বাড়ি স্থাপন করতে চান এবং কোথায় ঝোপঝাড় লাগাবেন ও বাড়ির ভিতরের অন্দরসজ্জাও তাদের ইচ্ছাধীন।
শুরুর দিকে স্থপতি পরিকল্পনা করেছিলেন, প্লটগুলোকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত লম্বালম্বি সাধারণ কতগুলো টুকরায় বিভাজিত করবেন। এটি নিঃসন্দেহে তার তুলনায় আরো উন্মুক্ত একটা সজ্জাপদ্ধতি। ডিম্বাকৃতির মাঝে যে এঁকেবেঁকে যাওয়ার প্রবণতা তার প্রতিফলন অভ্যন্তরীণ সজ্জাপদ্ধতিতেও লক্ষ্য করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোলাকার বাগান থেকে সবজি উৎপাদন করার মধ্য দিয়ে খাবার সরবরাহ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছিলো। দৃষ্টিনন্দন বাগান বিভাজন করে এমন বাগানবাড়ির সংখ্যা ২০০১ সাল পর্যন্ত ডেনমার্কে প্রায় ষাট হাজার ছাড়িয়েছে। বেশিরভার ডিম্বাকৃতির এই বাগানগুলো মিউনিসিপালিটির আওতাধীন আছে। তাদের পক্ষ থেকেও জনসাধারণের জন্য প্লট বরাদ্দ করা হয়। যাদের জন্য প্লট বরাদ্দ করা হয় সেই ফি সাধারণ বাজারদরের চেয়ে অত্যন্ত কম যাতে করে সর্বশ্রেণির মানুষ এখানে থাকার সুযোগ পেতে পারেন। এই কারণে মোহনীয় এই পার্কে নিজেদের স্বপ্নের ঠিকানা গড়ে নিতে সকলকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষাটুকু করার সৌন্দর্যের মাঝেই জায়গাটার সুবিন্যস্ত জীবন প্রণালীর আভাস পাওয়া যায়।
স্থপতি সোরেনসেন জন্মগ্রহণ করেন জার্মানির হামবুর্গ শহরে ১৮৯৩ সালে। বাচ্চাদের জন্য কিছু রোমাঞ্চকর বাগান তৈরি করা ছিলো তাঁর শুরুর দিকের কাজগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য। আরহাউস বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক, কোগেনহাউস মেমরিয়াল পার্কসহ গোটা ডেনমার্কে তাঁর কাজ ছড়িয়ে আছে। জ্যামিতিক আকারের প্রতি তাঁর যে প্রেম যেটা আমরা নাউরাম ডেনমার্ক এলটমেন্ট প্রকল্পে দেখতে পাই তা তাঁর অন্যসব কাজগুলোর মাঝেও দেখতে পাওয়া যায়। এটা নিঃসন্দেহে দারুন যে একজন ল্যান্ডস্পেক আর্কিটেক্ট ও প্ল্যানার হিসেবে ঈশ্বরের সৃষ্ট জ্যামিতির মাঝে নিজের জ্যামিতিক আকৃতিকে পাশাপাশি সুসজ্জিত সংলাপে রাখতে পারার যোগ্যতাটা তিনি অর্জন করেছেন।
আপনি যদি ওপর থেকে এই গোলাকার আবাসনকে দেখার সুযোগ পান তাহলে দেখবেন সবগুলো রাস্তা কিন্তু প্রতিটি বাড়ির দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে না। এটা সোরেনসেনের উদ্দেশ্য প্রণোদিত চিন্তা। সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার্থে মানুষের আচরণগত দিকটি আসলেও ঈশ্বরের মতন নিজের হাতে তুলে নিতে অনেক সাহসের প্রয়োজন। তবে নিজ কর্মের প্রতি সততা ও নিষ্ঠা থাকলে সকলের হিতের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিতেও সাহস নয় বরং দারুন এক আনন্দ হয়তো তিনি অনুভব করেছেন। নিশ্চয় আজ এতদিন বাদে এই শহরের মানুষজনের মাঝে একটা আদর, সোহাগ এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় আছে। প্রতি রবিবার এই আবাসনের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সব বাচ্চারা একত্রিত হয় খেলার জন্য, অবসরপ্রাপ্ত লোকেরা আসেন একে অপরের সাথে কথা বলে একটা সুন্দর সময় কাটান এবং পরিবারের সবাই মিলে আসেন রোদ পোহাতে অথবা পিকনিক করতেও।
এই বাগাববাড়ির মালিক যারা হলেন সেইসব সৌভগ্যবান মানুষদের জায়গাটা দেখভালের জন্যেও সময় দিতে হয়। বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড়গুলোকে নিয়মিত কাটছাট করে রাখতে হয়। এর ফলে কমিউনিটি-গার্ডেন হিসেবে একই সুরে গান গাওয়ার যে ঘটনাটি এখানে তৈরি হয়েছে তা রক্ষা পায়। তারপরেও মালিকদের নিজস্ব ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে, তারা ঝোপগুলোর উচ্চতায় ভিন্নতা আনতে পারেন। গ্রীষ্মকালে এতে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বেশ খাটাখাটি করার দরকার পড়ে। নতুবা কেউ কেউ ঝোপগুলোকে বাড়ার জন্য ছেড়েও দেন।
কোপেনহেগেনে আরো কিছু গোলাকার বাগান আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে এমন অনেক বাগান আবাসন আছে কিন্তু সেগুলো ডেনমার্কের মতো এতটা সফল এবং দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠেনি। কারণ হতে পারে, ডেনমার্কের সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে যেহেতু গোলাকার বাগানের চল ছিলো তাই নগর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এইরূপ চিন্তার প্রতিস্থাপন করতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে এখানে জায়গা পাওয়ার জন্য অপেক্ষামানের তালিকায় থাকাটায় বড় সমস্যা। কিন্তু প্রকৃত সমস্যাটা ভিন্ন। এমন একটা বাগানকে সারাবছর জুড়ে দৃষ্টিনন্দন রাখার জন্য যে শ্রম দিতে হয় তার জন্যেও অনেক শ্রম, সময় ও অর্থ খরচ করতে হয়। যদিও নিজের বাড়ির জন্য কাজ করা সমস্যা না হয়ে একটা দারুণ উপভোগ্য বিষয়ও হতে পারে। চিন্তা করুন, একটা সাস্টেনেইবল বাগান গড়ে তুলছেন আপনি নিজ উঠোনে যেখানে সারাবছরব্যাপী হরেক রকমের ফল এবং সবজি উৎপাদিত হয়। নতুন নতুন যারা এই আবাসনে আসেন তাদেরকে বলা হয় যেন প্রতিবেশী এবং সাইট ম্যানেজারের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে চলেন। পাশাপাশি যে বিভাজন পরিকল্পনা লিখিত আছে সেটিও তাদের পড়ে নিতে হয়। দর্শনার্থীরা ডেনমার্কে ঘুরতে গেলে এই আবাসনগুলো দেখে আসতে পারেন। রাজধানীর কেন্দ্র থেকে এখানে যাতায়াতের পদ্ধতিটি বেশ সহজ এবং সকলের জন্যে সুলভে পাওয়া সম্ভব।
বর্তমান সময়ে এসে এইরকম আবাসন পদ্ধতি সর্বত্র সমাদার পাচ্ছে এবং পাবে। জীবন প্রণালীর উপরে মানসিকতা যেভাবে নির্ভর করছে তা ভবিষ্যতের পৃথিবীর নেতৃত্বদানকারী মানুষজনের মাঝে যদি ভালোবাসা প্রস্তুত করতে অক্ষম হয় তবে আমরা খুব কঠিন একটা সময়ের সামনা করবো। এজন্য খুব দ্রæত এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে একটা মিষ্টি সহাবস্থান ব্যবস্থা আমাদের নিশ্চিত করতেই হবে।
তথ্যসূত্র
অন্তর্জাল
ঝযঁঢ়ৎড়াধলঁর@মসধরষ.পড়স
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০২৩